সামনেই ইংল্যান্ড সিরিজ। এর আগে বাংলাদেশ দলের সাজঘর উত্তাল। দলের দুই বড় তারকা, ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল আর বাকি দুই ফরম্যাটের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের মধ্যে বিবাদ আর মনোমালিন্যের গুঞ্জনে জেরবার পুরো ক্রিকেটপাড়া। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান শেষ পর্যন্ত মুখ খুললেন এই ব্যাপারে। ক্রিকবাজে আতিফ আজমের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আরো কথা বলেছেন বিসিবিতে তাঁর পথচলা, বর্তমান কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে, দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের ভবিষ্যৎসহ অনেক ব্যাপারে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে আপনার যাত্রার শুরু হয়েছিল কীভাবে?
আমি যখন এলাম, আমি প্রথমে সাপোর্ট স্টাফদের সাথে ডাকলাম, প্রধান কোচ (তৎকালীন প্রধান কোচ শেন জার্গেনসন), অধিনায়ক (তৎকালীন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম), এবং সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে কথা বললাম। কথা বলার পরে আমার মনে হলো, দলে কোচের ভূমিকাটা ঠিক পরিষ্কার নয়।
আমি কোচকে তার পরিকল্পনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন যে তিনি অধিনায়ক এবং সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে কথা বলে জানাবেন। খেলোয়াড়রাও একই কথা বললো। তখন আমি বুঝলাম যে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। আমি এরপর কোচকে জিজ্ঞেস করলাম তার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ব্যাপারে, তিনি বললেন যে পরবর্তী তিন-চার বছরে দলে কোনো নতুন খেলোয়াড় আসবে না। আমি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এমনকি খেলোয়াড়রাও একই কথা বলল, বিশেষ করে অধিনায়ক। আমি তখন ভেবেছিলাম এটাই হয়তো ঘটে এখানে, এখানকার ক্রিকেট-সংস্কৃতি হয়তো এটাই।
তাদের যুক্তি ছিল, যদি নতুন খেলোয়াড়রা দলে চলে আসে, সেক্ষেত্রে পুরনো খেলোয়াড়রা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই সংস্কৃতির ইতি টানতে হবে, এবং এজন্য আমার নতুন খেলোয়াড় লাগবে। কিন্তু যেহেতু কোচ-অধিনায়ক উভয়েই এই মতের বিরুদ্ধে, আমার জন্য কাজটা কঠিন ছিল। তাই আমি পুরো কোচিং স্টাফই বদলে ফেললাম, এবং ২০১৪ সালে চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে প্রধান কোচ হিসেবে নিযুক্ত করলাম।
আরো একটা ব্যাপার ছিল। আমার কানে এসেছিল যে খেলোয়াড়রা ঠিকমতো অনুশীলনে আসে না, বা আসলেও ঠিকমতো অনুশীলন করে না। কেউ কেউ দেরি করে আসে। তখন আমি আমাদের পেশাদারিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিলাম।
শৃঙ্খলাই ছিল আমার অগ্রাধিকার। একই সাথে আমি ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্টের প্রবর্তন করেছিলাম, যেন আমাদের অর্থনৈতিক খাতের স্টক এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। বিসিবির কাছে অনেকেরই ঋণ ছিল, যা তারা পরিশোধ করছিল না, আর কোনো চুক্তিপত্র না থাকায় তারা টাকা দিতেও অস্বীকৃতি জানায়।
আমি যখন প্রথমবারের মতো আইসিসির বোর্ড মিটিংয়ে গেলাম, আমার অভিজ্ঞতা ছিল এক কথায় যাচ্ছেতাই। ঐ মিটিংয়ে বাংলাদেশের কোনো জায়গাই যেন ছিল না। পরের মিটিংয়ে তো কথাই উঠল যে বাংলাদেশ আর জিম্বাবুয়েকে টেস্ট থেকে ছেঁটে ফেলা যায় কি না। তাই ঐ মিটিংয়ের পরই আমার মূল মনোযোগ গেল পারফরম্যান্সের দিকে; কেননা পারফরম্যান্স যদি ভালো হয়, সবার মনোযোগ তখন এমনিতেই কেড়ে নেওয়া যায়।
আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল র্যাঙ্কিংয়ের সেরা পাঁচে ওঠা, কেননা তাহলে মানুষ আমাদের গুরুত্ব দেবে। আরেকটা বিষয় ছিল দর্শকদের সমর্থন। কোনো দল জনসমর্থন না পেলে আইসিসি তাদের খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না। দুটো বিষয় আবার পিঠেপিঠি; কেননা পারফরম্যান্স ভালো না হলে দর্শকদের সমর্থনও কমতে থাকবে।
এমন এক সন্ধিঃক্ষণে আমরা হাথুরুসিংহেকে নিযুক্ত করলাম, এবং তিনি আমাদের একটা রূপরেখা দিলেন। বড় দলগুলো বাংলাদেশে আসলে তাদের বিরদ্ধে আমরা কীভাবে খেলব, কোন উইকেটে খেলব, এসজি নাকি কোকাবুরা বলে খেলবো — প্রতিটা বিষয়ে তিনি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিলেন। এরপর আমাদের ছেলেরাও তার পরিকল্পনা অনুসারে ভালো খেলতে শুরু করল। ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের পর আইসিসি থেকে প্রশংসা এলো, র্যাঙ্কিংয়েও উন্নতি হলো, দর্শক সমর্থন বাড়ল। এভাবেই বিসিবিতে আমার যাত্রা শুরু।
আপনি ২০২২ সালের অক্টোবরে চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে প্রধান কোচ নিযুক্ত করেছিলেন, কিন্তু রাসেল ডোমিঙ্গো পদত্যাগ করেছিলেন ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। আপনি কি এমন কোনো ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে ডোমিঙ্গো তার মেয়াদ শেষ না করেই চলে যেতে পারেন?
আমি বিষয়টা ব্যাখ্যা করি। হাথুরুসিংহের প্রথম কার্যকালে সবাই তাকে পছন্দ করতো না। রাসেল ডোমিঙ্গোর ক্ষেত্রে, আমি যেটা বলতে পারি, কোচ হিসেবে তার পারফরম্যান্স নিয়ে কিন্তু কোনো কথা ছিল না, দুটো বিষয় ছাড়া। প্রথমত, যেহেতু তিনি ভবিষ্যতের চিন্তা করতেন, তাই জয়-পরাজয় তার জন্য অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সেইটা খারাপ কিছু না। কিন্তু উনি আবার এশিয়া কাপ আর বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
আমার কথা হচ্ছে, আপনার সামনে যখন দ্বিপক্ষীয় সিরিজের সুযোগ আছে, আপনি কেন এমন বড় দুটো টুর্নামেন্টে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন? ২০২১ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দিকে তাকান, উনি প্রতিটা ম্যাচে দলে পরিবর্তন এনেছেন। আমার মনে হয়েছে, উনি যেটা করছেন সেটা ঠিক না। আর দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে ক্রিকেটারদের সাথে আপনাকে অনেক বেশি কথা বলতেই হবে।
ডোমিঙ্গো অভিযোগ করেছিলেন যে, দলে বাইরের হস্তক্ষেপ বেশি। তার আঙুলটা ছিল খালেদ মাহমুদ সুজনের দিকে। একটু বলবেন দলে খালেদ মাহমুদ সুজনের ভূমিকাটা আসলে কীরকম আর তার অপরিহার্যতাটা কোথায়?
রাসেল ডোমিঙ্গো এবং স্টিভ রোডসের একটা ব্যাপার ছিল, তারা কেউই মাঠে বার্তা পাঠাতে পছন্দ করতেন না। তাদের যুক্তি ছিল, আপনি তো ভুল করতে করতেই শিখবেন, তাই মাঠে বার্তা পাঠিয়ে শুধরে দিতে চাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা তো আমাদের সংস্কৃতির সাথে যায় না, আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। সুজনও তাই মেনে নিতে না পেরে মাঠে বিভিন্ন বার্তা পাঠাতো – একে দিয়ে বল করিয়ো না, বা ওটা এখন করো না, এরকম।
আর যখন সুজন এই কথাগুলো বলছে, কোচরা স্বাভাবিকভাবেই এটা নিতে না পেরে আমার কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তখন আমি বলেছি যে এটাই আমাদের ‘সংস্কৃতি’, আর আমরা পাড়ার ক্রিকেট থেকে ক্লাব ক্রিকেট সবখানে এটাই অনুসরণ করে আসছি। আর ডোমিঙ্গোর পারফরম্যান্সের ব্যাপারে আমি খুশি, তবে আমার মনে হয় তিনি শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।
হাথুরুসিংহের বিদায়ের পরে কোচ হয়ে প্রথমে এসেছিলেন স্টিভ রোডস, এরপর রাসেল ডোমিঙ্গো। দু’জনের কেউই আপনার প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। এর পেছনে কি শুধুই সাংস্কৃতিক ব্যবধানটা দায়ী? আর হাথুরুসিংহের কাছেই ফিরতে হলো, কারণ তিনি একজন ‘কড়া হেডমাস্টার’?
আমি জানি না হাথুরুসিংহেকে ‘কড়া হেডমাস্টার’ বলা হয় কেন। হ্যাঁ, তিনি খেলোয়াড়দের মুখের ওপর সোজাসাপ্টা কথা বলেন। তবে তার সেরা দিকটা হচ্ছে, তিনি যদি কোনো খেলোয়াড়কে কিছু বলতে চান, তিনি সেটা ঐ খেলোয়াড়কে আলাদা করে ডেকে বলেন। সেটা যদি নেতিবাচক কিছুও হয়, তিনি সেটা সবার সামনে বলেন না। কিন্তু ডোমিঙ্গো নেতিবাচক কথাগুলোও সবার সামনেই বলতেন, আর এটাই ছিল খেলোয়াড়দের সাথে তার সমস্যা।
স্টিভ রোডসের অ্যাপ্রোচটা আবার আলাদা ছিল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করতেন, কেন আমাদের জিততে হবে। বিশ্বকাপের সময়ে, আমাদের জন্য যত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচই হোক না কেন, তিনি বলতেন যে এটা শুধুই আরেকটা ম্যাচ। ডোমিঙ্গোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা, তিনি বেশ ভালোই করছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে তার সাথে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সংঘাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেটা তিনি ঘটাতে চাননি, বরং সিনিয়রদের যেটা ভালো মনে হয় সেটা করতে দিতে চেয়েছেন। হাথুরুসিংহের ক্ষেত্রে যেটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে, সেটা হলো আমাদের দু-তিনজন সিনিয়র খেলোয়াড় আর খুব বেশিদিন খেলবে না।
আমি কয়েকদিন আগে মাহমুদউল্লাহর সাথে কথা বলেছি, তার অবসরের কোনো পরিকল্পনা থাকলে আমাদের জানাতে বলেছি। কেননা আমাদের সেই পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে, যখন আমরা একটি সিরিজ খেলিয়ে তাকে বিদায় জানাতে পারি। সে বলেছে যে আমাদের জানাবে, কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি যে সে কিছু জানাবে না। এখন পর্যন্ত শুধু তামিমই এই ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলেছে, আর কেউ বলে নাই।
এখনকার সময়ে বিদায়ী সিরিজ আয়োজন করা আসলে কতটুকু সম্ভব?
খুব কঠিন। তিন ফরম্যাটেই ব্যস্ত সূচি থাকে। কীভাবে তিন ফরম্যাটে তিনটা ভিন্ন সময়ে বিদায় দেওয়া সম্ভব? উদাহরণস্বরূপ, যদি মাহমুদউল্লাহ আমাদের আগে থেকে টেস্টে অবসরের সিদ্ধান্তটা জানাতো, আমরা হয়তো ম্যাচের আগে সেটা ঘোষণা করে কিছু আয়োজন করতে পারতাম। যদি মাহমুদউল্লাহর মনে হয় যে সে টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডে থেকে অবসর নিতে চায়, সেক্ষেত্রে আমরা আয়োজন করব, যেভাবে লাসিথ মালিঙ্গা বা শচীন টেন্ডুলকার বিদায় নিয়েছে। যদি খেলোয়াড়রা না চায়, তাহলে সেটা তাদের ব্যাপার, কিন্তু আমাদের বার্তাটা পরিষ্কার। আমি মাশরাফিকে অনেকবার বিদায়ী অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু সে এটা চায় না। আর সে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নেয়নি।
প্রথম কার্যকালে হাথুরুসিংহের সাথে সিনিয়র ক্রিকেটারদের কিছু সমস্যা ছিল। আপনার কি মনে হয় যে হাথুরুসিংহের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সিনিয়রদের সামলানো?
দেখুন, হাথুরুসিংহের ভালোমন্দ দুটো দিকই আছে। কখন কোন খেলোয়াড়কে কী বলতে হবে, সেটা তিনি নিজেই ঠিক করেন, এমনকি আমাকেও তিনি জানান না। যেমন, হঠাৎ করেই তিনি মাশরাফিকে কিছু একটা বলেছিলেন, মাশরাফি তাতে দুঃখও পেয়েছিল। আমি পরে মাশরাফির সাথে কথা বলেছিলাম, সে বলেছিল যে অধিনায়ক হলেও হাথুরুসিংহে তাকে বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচে বসিয়েও রাখতে পারেন, এবং সেজন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আমাদের খেলোয়াড়রা তো এগুলোর সাথে পরিচিত না। তাই আমি তখন হাথুরুসিংহেকে বলেছিলাম এগুলো না বলতে, এবং সিনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যাপারে অন্তত আমার সাথে আগে কথা বলে নিতে।
হাথুরুসিংহে চলে যাওয়ার পরে আমরা শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দলগুলোর কাছে হারছিলাম, তখন একদিন, মাশরাফি আমাকে বলেছিল হাথুরুসিংহেকে ফিরিয়ে আনার কথা। এর বাইরে আমি ভাসা ভাসা শুনেছিলাম হাথুরুসিংহে আর তামিমের মধ্যে কোনো একটা সমস্যার কথা, কিন্তু ওদের নিজেদের মুখে সেটা কোনোদিনও শুনিনি। অথচ হাথুরুসিংহেকে এবার আনার আগে তামিমসহ সব খেলোয়াড়ের সাথে আমি কথা বলেছিলাম, এবং তারা প্রত্যেকেই ইতিবাচক মতামত দিয়েছিল।
হাথুরুসিংহে শততম টেস্টের দল থেকে মাহমুদউল্লাহকে বাদ দিয়েছিলেন, এছাড়া মুশফিকের সাথে তার শীতল সম্পর্কের কথা শোনা গিয়েছিল…
তিনি তো অন্যান্য অনেককেও বাদ দিয়েছিলেন, যেমন মুমিনুল। আর তাছাড়া ঐ সময়ে তার মনে হয়েছিল যে তার কাছে মুশফিকের চেয়ে ভালো কিপার আছে, আর উনি সবসময়ই সেরা কিপারকে দিয়ে কিপিং করাতে চেয়েছেন। এটাই কোচ হিসেবে তার চিন্তার ধরন, যেখানে আমরা হয়তো ভাবছি দ্বিতীয় বা তৃতীয় সেরা উইকেটকিপারের হাতে গ্লাভস তুলে দিয়ে সেরা ব্যাটসম্যানকে খেলানোর কথা।
এই সময়ে, উনি পরিচালক এবং নির্বাচকদের সাথে বসে যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা হলো, ফিল্ডিংই তার অগ্রাধিকার। তিনি বলেছিলেন যে তিনি খেলোয়াড়দের ব্যাটিং-বোলিংয়ে উন্নতি করতে পারেন, কিন্তু ফিল্ডিংয়ে নয়। আর আমাদের ফিল্ডিংয়ের অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না।
হাথুরুসিংহে বলেছিলেন যে তিনি হয়তো মাঠে ফিল্ডিংয়ের সময়ে একজন বা দুইজন খেলোয়াড়কে লুকিয়ে রাখতে পারেন, কিন্তু সংখ্যাটা যদি পাঁচ বা ছয় হয়ে যায়, তখন এটা বড় সমস্যা হয়ে যায়। তিনি আরো বলেছিলেন যে এমন ফিল্ডিং নিয়ে বিশ্বকাপে ভালো করা সম্ভব না। তাই তার মতে একটা কাটঅফ পয়েন্ট থাকা উচিত; হয় ফিল্ডিংয়ের উন্নতি করো, নতুবা বাদ যাও। তাসকিনের প্রত্যাবর্তনের পরে আমরা সবাই যখন তার প্রশংসা করছিলাম, হাথুরুসিংহে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন তার ফিল্ডিংয়ের ব্যাপারে; কেননা তাসকিনের ফিল্ডিং আগে তেমন ভালো ছিল না। হাথুরুসিংহের চাওয়াটা এমনই ছিল।
আপনার কি মনে হয় যে হাথুরুসিংহে সিনিয়রদের সামলাতে পারবেন?
আমার মনে হয় কাজটা কঠিন হবে। ডোমিঙ্গোরও সমস্যা ছিল সিনিয়রদের সাথে, এবং একটা পর্যায়ে তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন কোচ যদি কিছু না বলে এভাবে হাল ছেড়ে দেন, এবং অন্যান্যদের যা ইচ্ছা তাই করতে দেন, তাহলে তো কোচকে রাখার কোনো মানে নেই। তাই তাকে পরিবর্তন করতেই হতো। আর আমি এবার সভাপতির পদে দাঁড়াতেই চাইনি, কেননা আমি জানতাম যে এবার আমাকে কিছু রূঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, প্রথম কার্যকালের মতো।
সিনিয়রদের জন্যও এটা কঠিন। আর আমাদের খেলোয়াড়দের সমস্যা হচ্ছে, তারা তাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আগেভাগে কিছু জানায় না। হাথুরুসিংহের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হবে এটা, কেননা আমি জানি, যদি কোনো সিনিয়র খেলোয়াড় পারফর্ম করতে ব্যর্থ হন, হাথুরুসিংহের দলে তার জায়গা নেই।
বিভিন্ন সময়ে, কোচরা আপনার কাছে কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড়ের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন। কয়েকজন কোচ বলেছেন যে, সিনিয়রদের পর্যাপ্ত সমাদর না করলে ড্রেসিংরুমকে ঠিক রাখা যায় না…
হাথুরুসিংহের আগমনের পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে একটা সমস্যা হবে, যদিও আমি এখনই সেটা প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। আমি যেটা করতে পারি, সেটা হচ্ছে সমস্যাটা বড় না হওয়ার আশা করা। হাথুরুসিংহে এবার সিনিয়রদের প্রশ্রয় দেবেন না, আর এটাই সমস্যা। হয় তার পরিকল্পনামতো সবাইকে কাজ করতে হবে, নয়তো বিদায় নিতে হবে। হাথুরুসিংহে এমনই।
তবে যে বাংলাদেশকে তিনি আগে কোচিং করিয়েছিলেন, আর যে বাংলাদেশকে তিনি এখন কোচিং করাবেন, দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। অধিনায়ক হওয়ায় তামিম এখন মন খুলে কথা বলতে পারবেন, সাকিবও। সাকিবের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, কোনো কোচের সাথে তার কখনো কোনো সমস্যা হয় না।
অন্যদের ব্যাপারে কী বলবেন? তাদেরও কি একই সমস্যা হতে পারে না?
আমি অধিনায়ক আর সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে বসবো, কথা বলবো। হাথুরুসিংহের সাথে আমি কথা বলেছি, তবে যেহেতু তিনি অনেকদিন পরে এলেন, এখনো বিস্তারিত কথা বলিনি। তাকে পরিস্থিতি বোঝার জন্য কিছু সময় দিতে চাচ্ছি। এরপর তার মতামত নিব। তবে আমি এখন তামিমের সাথে বসবো এবং কথা বলবো।
আমার মনে হয় না তামিম এবং হাথুরুসিংহের মধ্যে কোনো সমস্যা হবে। সর্বশেষ যখন তিনি এলেন, তামিমের পারফরম্যান্স খুব ভালো ছিল না। সবাই তামিমকে বাদ দেওয়ার কথা বলছিল। ঐ সময়ে আমি হাথুরুসিংহের সাথে কথা বলেছি, তিনি বলেছিলেন যে তামিম আমাদের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। তিনি নিজেই তামিমের সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য তিন মাস সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। তাই আমার মনে হয় না যে তামিম আর সাকিবের সাথে হাথুরুসিংহের কোনো সমস্যা হবে।
কিছু কিছু কোচের নিজের পছন্দের খেলোয়াড়কে বাছাই করে দলের সাথে রাখার প্রবণতা থাকে। হাথুরুসিংহে এমন নন, তিনি এগুলো বরদাশত করবেন না। তিনি অবশ্যই একজন খেলোয়াড়কে পর্যাপ্ত সুযোগ দেবেন, কিন্তু যদি সে এর মধ্যেও ভালো না করে, তবে তাকে বাদ পড়তে হবে। আর মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর ব্যাপারে বলতে গেলে, মুশফিক বিপিএলের ফাইনালে রান করেছে দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই খুশি।
গত এক-দেড় বছর ধরে মুশফিক তেমন রান পাচ্ছিল না দেখে আমি কিছুটা মর্মাহত ছিলাম। আমি সবসময়ই বলে এসেছি, মুশফিক আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান। আমার এখনো মনে হয় যে সে ব্যাট হাতে ভালো করবে, কিন্তু চিন্তার জায়গা তার উইকেটকিপিং। যদি সে কিপিং না করে, তখন তার ফিল্ডিং নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, আবার যদি সে কিপিং করে, তাকে অবশ্যই উন্নতি করতে হবে।
মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নাই, তবে তার ফিল্ডিংয়ের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। বয়সের সাথে সাথে অনেক কিছু পাল্টায়, রিফ্লেক্স, দৃষ্টিশক্তি, রিঅ্যাকশন টাইম। মাহমুদউল্লাহ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একজন অলরাউন্ডার, কেননা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাকে দিয়ে আমরা বোলিংও করাতে পারি। আমার যেটা মনে হয়, এখন তারা খেলাটা চালিয়ে যাবে। কিন্তু দুই বছর পরে? প্রশ্নই ওঠে না।
কয়েকজন কোচের মতে, এদের মধ্যে কিছু ক্রিকেটারকে কোচিং করানো যায় না। আপনি কী মনে করেন?
কিছু কিছু কোচ অভিযোগ করেন যে খেলোয়াড়রা তাদের কাছে ব্যাটিং পরামর্শের জন্য আসেন না। আমার যেটা মনে হয়, ক্রিকেটাররা যদি ব্যাটিং কোচের কাছে না যান, তাহলে উন্নতি হবে কীভাবে? শুধু অ্যাশওয়েল প্রিন্স না, অন্য কোচরাও একই কথা বলেন। তবে আপনাকে বুঝতে হবে যে, কয়েকজন সিনিয়র নিজে নিজে প্র্যাকটিস করেন। এই জিনিসটা কিছু কোচ মেনে নেন, কিছু কোচ মেনে নেন না।
শ্রীধরণ শ্রীরামের চুক্তি না বাড়ানোর কারণ কী? তার কি আর ফেরার সম্ভাবনা আছে?
আমরা তাকে এনেছিলাম শুধু টি২০ বিশ্বকাপকে মাথায় রেখে। কেননা এশিয়া কাপ আর এর আগের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে আমি হতাশ ছিলাম। আমরা তাকে এনেছিলাম দলের মাইন্ডসেট বদলানোর জন্য। আমরা তাকে সব ফরম্যাটের প্রধান কোচ হিসেবে কখনোই ভাবিনি, এবং এটা নিয়ে তার সাথে আলোচনাও হয়নি।
আরেকটা সমস্যা হচ্ছে আইপিএলের সাথে তার সম্পৃক্ততা। আমরা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোচ আনতে রাজি নই। যদি রাজি থাকতাম, তাহলে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের অনেক কোচকেই আনতে পারতাম। আমরা হাথুরুসিংহেকে এনেছি, এর একটা বড় কারণ হচ্ছে তাকে পুরোটা সময়ে পাওয়া যাবে। আইপিএলে শ্রীরামের চুক্তি ২০২৪ পর্যন্ত, আর যদি চুক্তির মেয়াদ বাড়ে তাহলে তিনি আইপিএলেই থাকবেন, আর তাতে আমাদের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। তাই ২০২৪ সালে তিনি চিন্তা করবেন যে পুরোটা সময় আমাদের দিতে পারবেন কি না। আর যদি আমরা তখন আগ্রহী থাকি, তার সাথে কথা হলেও হতে পারে।
বাংলাদেশ সবসময়ে কেন বিদেশী কোচের পেছনেই ছোটে? দেশী কোচরা কেন সেই সুযোগটা পান না? আমাদের মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের মতো কোচ আছেন, যিনি চারবার বিপিএল জিতেছেন…
সহকারী কোচ চেয়ে আমরা বিজ্ঞাপন দিয়েছি। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে সালাউদ্দিনের সাথে কথা বলেছি, এবং তিনি বলেছেন যে তিনি পারবেন না। আমরা আইসিসির ওনার সঙ্গেও (আমিনুল ইসলাম বুলবুল) কথা বলেছি। দেখেন, তাদের দেখলে হয়তো মনে হবে তারা জাতীয় দলের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। আসলে কিন্তু তা না। এই কাজটা সহজ না; আর আমাদের যেমন এফটিপি, আমাদের ফুলটাইম কোচ দরকার।
দেশী কোচরা আবেদন করুক। আমরা চাই দেশী কোচরা যেন এগিয়ে আসে। আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে দেশী কোচদের যোগ্য করে গড়ে তুলব। কেননা যখন বিদেশী প্রধান কোচ থাকবেন না, তখন এই দেশী কোচদেরই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসতে হবে।
আমি হাথুরুসিংহের সাথেও এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমার আগামী আট বছরের খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা পরিকল্পনা আছে। কোন খেলোয়াড় আসবে, কে কার জায়গা নিবে। অনেকটা হাথুরুসিংহের আগের কার্যকালের মতো, যখন তিনি তিন বছরের পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। আর এই কোচদের সাথে জাতীয় দলে কাজ করার পর, এরপর তারা অনূর্ধ্ব-১৯, হাই পারফরম্যান্স, বাংলাদেশ টাইগার্স, এসব দলের দায়িত্ব নেবেন, আবার কেউ কেউ জাতীয় দলের সাথে থাকবেন। এই পরিকল্পনাটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি এখন।
এটা মোটামুটি সবাই জানেন যে সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবালের সম্পর্কে ফাটল রয়েছে, এবং তারা কথা বলেন না। শুধুমাত্র পেশাদারিত্বের খাতিরে তাদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। এটা কীভাবে ঠিক করা যায় বলে আপনার মনে হয়? আর এটাকে কি সুস্থ ড্রেসিংরুম বলে মনে হয় আপনার?
কোনোভাবেই এইটা সুস্থ ড্রেসিংরুম না। আর সাকিব-তামিমের সম্পর্কে ফাটলের যে ব্যাপারটা, এমন না যে আমি এটা ঠিক করার চেষ্টা করিনি। আমি তাদের দুজনের সাথেই কথা বলেছি, এবং আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটার সুরাহা করা এই মুহূর্তে খুব একটা সহজ না। তবে তাদের দু’জনকেই একটা বার্তা দেওয়া হয়েছে – আমরা জানি না তোমাদের মধ্যে কী চলছে, কিন্তু কোনো ম্যাচ বা সিরিজ চলাকালে এগুলো যেন সামনে না আসে। তারা দু’জনেই নিশ্চিত করেছে যে এরকম কিছু ঘটবে না।
জাতীয় দলে তো কিছু গ্রুপিংও চলছে এই মুহূর্তে…
অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংই এখন বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমার সাথে কারো কোন সমস্যা নেই। আমি শুধু ভয় পাচ্ছি এই গ্রুপিং নিয়ে, আর আমি নিজেও খুব সম্প্রতিই জেনেছি এই ব্যাপারে। এমনকি বিশ্বকাপেও, আমি টিম হোটেলে না থেকেও যা যা দেখেছি এবং শুনেছি… ভাবতেই পারছি না যে কীভাবে সম্ভব। এই ব্যাপারটা যেভাবে সম্ভব থামাতে হবে, যদি আমরা ভবিষ্যতে ভালো করতে চাই। আর সবাইকে এটা বুঝতে হবে যে দলের অভ্যন্তরে গ্রুপিংয়ের কোনো সুযোগ নেই।
যদি আপনি গ্রুপিং থামাতেও পারেন, দলের দু’জন খেলোয়াড় একে অপরের সাথে কথা বলছেন না, ব্যাপারটা একটু খারাপ দেখায় না?
সাকিব-তামিমকে তো মাঠে এবং ড্রেসিংরুমে অবশ্যই কথা বলতে হবে। ড্রেসিংরুমের পরিস্থিতি আরো বাজে ছিল, যদিও সম্প্রতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এই ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে আমি সাকিব-তামিমের সম্পর্কে পরিবর্তন দেখতে চাই, অন্তত ড্রেসিংরুমে তো বটেই। এর বাইরে তারা কী করলো, সেটা আমার দেখার বিষয় না।