পুরোদস্তুর ক্রিকেটীয় ফ্যামিলি। বাবা মার্টিন ছিলেন অ্যাডিলেডের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার। দাদা ভিক্টর রিচার্ডসন ছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলের সাবেক অধিনায়ক। তাই চ্যাপেল ব্রাদারদের রক্তেই ছিল ক্রিকেট। কিন্তু এই ক্রিকেটীয় রক্তই একটা সময়ের দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় কলঙ্কের জন্ম দেয়। বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল, মেজো ভাই গ্রেগ চ্যাপেল, ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেল – তিনজনই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সেই চ্যাপেল ব্রাদারদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত সাবেক অজি অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেলকে নিয়ে।
সাবেক অজি অধিনায়ক গ্রেগরি স্টিফেন চ্যাপেল। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছড়ি ঘুরিয়েছেন কিংবদন্তি এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচে খেলেছিলেন ১০৮ রানের এক ইনিংস। অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম ম্যাচেও সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টেও পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন।
তবে মজার ব্যাপার হলো, ৫ জানুয়ারি জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে ১৮২ করেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে সিডনিতে। এর ঠিক ৮ বছর আগে ১৯৭৬ সালে সেই সিডনিতে সেই একই তারিখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও সেই একই স্কোর (১৮২ রান) করেছিলেন।
সাদা পোশাকের ক্রিকেটে যেকোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ছিলেন সাবলীল। ১৯৭২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩১, একই বছর ওভালে ১১৩, সে বছরের শেষ দিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১১৬ রান। সময়ের সাথে সাথে যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথম দফায় ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত অধিনায়কত্ব করেছেন। এরপর বিতর্কিত বিশ্ব ক্রিকেট সিরিজের পর পুনরায় ১৯৭৯ সালে অধিনায়কের দায়িত্ব পান। ১৯৮৪ সালে অবসরের আগপর্যন্ত তিনি অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭১ সালে মেলবোর্নে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একদিকের ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই ছিলেন অপরাজিত, খেলেছিলেন ২৯ বলে ২২ রানের ইনিংস। ক্যারিয়ারের ১৬তম ইনিংসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন। তবে এর মাঝে বেশ কিছু ম্যাচ জেতানো ইনিংস এসেছে চ্যাপেলের ব্যাট থেকে। তবে সাদা পোশাকে সেঞ্চুরি পেতে মোটেও অপেক্ষা করতে হয়নি কিংবদন্তি এই অজি ব্যাটসম্যানকে। ক্রমেই হয়ে উঠেছেন টিম অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং স্তম্ভ। ধারাবাহিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। পুরো ক্যারিয়ার জুরেই খেলেছেন সমান তালে। ১৯৭৪ সালে বেসিন রিজার্ভে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছিলেন প্রথম ইনিংসে অপরাজিত ২৪৭* এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ১৩৩ রান। ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে এসেও ব্যাটিং ধার এতটুকুও কমে যায়নি। ক্যারিয়ারের শেষ চার বছরেই করেছেন সাত সেঞ্চুরি!
গ্রেগ চ্যাপেলের শক্তির জায়গা ব্যাটিং হলেও তিনি মিডিয়াম পেস বল করতেন। ওয়ানডেতে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছেন দু’বার। ১৯৭৭ সালে বার্মিংহামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০ রানে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। যদিও বড় ব্যবধানে ম্যাচ হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপর সিডনিতে চ্যাপেল-তোপে মাত্র ৬৩ রানে অলআউট হয়েছিল ভারত। ভারতের সাথে সে ম্যাচে ১৫ রানে পাঁচ উইকেট ওয়ানডেতে তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং।
৭৪ ওয়ানডেতে চ্যাপেলের শিকার ৭২ উইকেট। সাদা পোশাকে ৮৭ ম্যাচে চ্যাপেলের শিকার ৪৭ উইকেট। ফিল্ডার গ্রেগ চ্যাপেলও কম যাননি, ৮৭ টেস্ট খেলে নামের পাশে আছে ১২২ ক্যাচ। অবসরের আগপর্যন্ত টেস্টে সর্বাধিক ক্যাচের রেকর্ড ছিল চ্যাপেলের।
ওয়ানডেতে ৭২ ম্যাচে ৪০ গড়ে করেছেন ২,৩৩১ রান। টেস্টে ১৫১ ইনিংসে করেছেন ৭,১১০ রান। টেস্টে ২৪ শতকের সাথে আছে ৩১টি অর্ধশতক। ব্রাডম্যানের পরবর্তী সময়ে গ্রেগ চ্যাপেলকেই অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান বিবেচনা করা হতো। আর নিজের সময়ের সেরা ফিল্ডারদের একজন গ্রেগ চ্যাপেল।
১৯৮১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি, মেলবোর্নে বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিরিজ কাপের তৃতীয় ফাইনাল ম্যাচ। আগের দুটি ফাইনালে ১-১ সমতায় অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড। এ ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়া। গ্রায়েম উডের ৭২ এবং অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেলের ৯০ রানের উপর ভর করে ২৩৫ রান তোলে অজিরা। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৪৯.৫ ওভারে নিউ জিল্যান্ডের সংগ্রহ ৮ উইকেটে ২২৯। অর্থাৎ, শেষ বলে ছয় মারলে ম্যাচ টাই হবে।
এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম দিলেন অজি অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে শেষ ওভারটি করছেন গ্রেগ চ্যাপেলের ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেল। অধিনায়ক তার ছোট ভাইকে ডেকে বল মাটিতে গড়িয়ে (আন্ডারআর্ম) করার পরামর্শ দেন।
ভাইয়ের কথামতো কাজ করলেন ট্রেভর চ্যাপেল। স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকা কিউই ব্যাটসম্যান ব্রায়ান ম্যাকক্যাকনি তো কোনোরকমে বল ঠেকিয়ে ক্ষোভে ব্যাট ছুঁড়ে মারেন। ভাবা যায়! ক্রিকেট মাঠের এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিতর্কে জড়িয়েছিলেন।
১৯৮৪ সালে ক্রিকেট থেকে অবসরের পর অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া দলের কোচ হিসেবে। ২০০৫ সালে ভারতীয় দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ পান গ্রেগ চ্যাপেল। জন্ম দেন বিতর্কের, যে বিতর্ক চায়ের কাপের আড্ডা থেকে গড়িয়েছিল ভারতের পার্লামেন্ট পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব থেকে ভারত বিদায় নিলে গ্রেগ চ্যাপেল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। ২০১০ সালের পর থেকে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত নির্বাচকের ভূমিকায় দেখা গেছে সাবেক এই অজি অধিনায়ককে।
ক্রিকেটার, অধিনায়ক, নির্বাচক, কোচ, ধারাভাষ্যকার- সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিকেটের সাথে জড়িত ছিলেন। তবে গ্রেগ চ্যাপেলের কথা উঠলে সবার আগে আলোচনায় আসে সেই আন্ডারআর্ম বোলিং প্রসঙ্গটা। আজ আন্ডারআর্ম বোলিং নেই, কিন্তু ক্রিকেট আছে। ক্রিকেটে অনেক কিছু ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। কিন্ত এই আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের সেই কালিমা মুছে যায়নি। যতদিন ক্রিকেট থাকবে, ততদিন এই কালিমা নিয়ে বেড়াতে হবে অস্ট্রেলিয়ানদের, একইসাথে ক্রিকেটকেও।