প্রবাদ আছে, “বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।”
সদা বৈচিত্র্যময় এই জীবনে মাঝেমধ্যে মানুষকে এমন সব প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়, যেখানে বিশ্বাসই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এই বিশ্বাস প্রেরণা দেয় সংগ্রামের, শক্তি যোগায় বহু যোজন ক্রোশ পাড়ি দেওয়ার। বিশ্বাস ও সংগ্রামের সম্মিলিত প্রতিচ্ছবিই যেন দৃষ্টিনন্দন চিত্রনাট্যের অনুপম মিশ্রণে আরেকবার পরিবেশন করা হয়েছে ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত লাইফ অভ পাই সিনেমাতে। কোনো প্রকার ফ্র্যাঞ্চাইজি, সাই-সাই কিংবা সুপারহিরো সিনেমা না হওয়া সত্ত্বেও সলো মুভি হিসেবে ভালো সিনেমার কাতারে জায়গা করে নেওয়া লাইফ অভ পাইকে দর্শক স্মরণে রাখবে আজীবন। সারাবিশ্বে সমাদৃত এই সিনেমার অজানা কিছু দিক নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
গল্পের অনুপ্রেরণা
লাইফ অভ পাই মুভির গল্প নির্মাণ করা হয়েছে একই নামের বই ‘লাইফ অভ পাই’ থেকে। ২০০১ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের লেখক কানাডিয়ান-স্প্যানিশ লেখক ইয়ান মার্টেল। জীবনের একটা সময় খুব একলা ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তখন নতুন এক দিশার সন্ধানে ছিলেন মার্টেল। সেসময় তিনি লাইফ অভ পাইয়ের প্লট সাজানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান লেখক মোয়াসির স্কিয়ার লেখা উপন্যাস ‘ম্যাচ অ্যান্ড দ্য ক্যাটস’ (১৯৮১) থেকে। ওই গল্পে সমুদ্রে যাত্রাপথে এক জার্মান ইহুদি শরণার্থী পরিবারের জাহাজ আটলান্টিকে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়, শুধু বেঁচে থাকে ম্যাক্স নামে পরিবারের একজন সদস্য এবং একটি জাগুয়ার। তবে এই গল্প লেখার জন্য তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ, যেমন- আল কোরআন, বাইবেল, গীতা নিয়েও প্রচুর গবেষণা করেছেন। সাথে পড়াশোনা করেছেন প্রাণীর আচরণ এবং বাস্তব জীবনে ঘটা বিভিন্ন জাহাজের দুর্ঘটনা নিয়েও।
পরিচালক বিভ্রাট
বইয়ের কালো ছাপা অক্ষর সেলুলয়েডের ফিতায় উঠে আসতে সময় লেগেছিল পাক্কা এক দশক। ’20th Century Fox’ বইটির স্বত্ব কিনে সিনেমা নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করে ২০০২ সাল থেকেই। শুরুতে পরিচালক হিসেবে প্রোডাকশন হাউজের প্রথম পছন্দ ছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাইট শ্যামালান। কারণ, তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পন্ডিচারির বাসিন্দা। কিন্তু কোনো এক কারণে ব্যাটে-বলে না মিলায় তিনি এই সিনেমার পরিচালনা করতে পারেননি, এবং পরবর্তীতে ‘ল্যাডি ইন দ্য ওয়াটার’ সিনেমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
২০০৫ সালে পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয় প্রখ্যাত ম্যাক্সিকান পরিচালক আলফনসো কুয়েরনকে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ২০০৬ সালে ভারতেও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবারও দেখা দেয় সমস্যা, সরে যান কুয়েরন। অবশেষে ২০০৯ সালে অ্যাং লি-কে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর রূপালি পর্দায় আসার সুযোগ পায় লাইফ অভ পাই।
লটারির টিকেট
সিনেমায় পাই প্যাটেলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুরাজ শর্মা। অথচ এই সিনেমায় পাইয়ের অবতারে অবতীর্ণ হওয়ার কোনো কথাই ছিল না তার। অভিনয়ের পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতাও নেই সুরাজের। কিন্তু কপালের লিখন কে-ই বা খণ্ডাতে পারে? পাই প্যাটেল চরিত্রের জন্য অডিশন দিতে গিয়েছিলেন মূলত সুরাজ শর্মার ভাই। সুরাজ তার ভাইয়ের অনুরোধে কাস্টিং সেটে এসেছিলেন তার ভাইকে সাহায্য করার জন্য। প্রায় ৩০০০ অভিনেতা এই চরিত্রের জন্য অডিশন দিলেও, কাস্টিং ডিরেক্টরের চোখ আটকে যায় সুরাজ শর্মার উপর। এবং বেছে নেওয়া হয় তাকেই। সিনেমার বেশিরভাগ অংশ শুট করা হয়েছিল পানিতে। কিন্তু সুরাজ শর্মা সাঁতারও জানতেন না বিধায় তাকে সাঁতারের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল।
ইরফান খানের চরিত্র
বয়স্ক পাইয়ের ভূমিকায় পর্দায় দেখা দিয়েছিলেন সকলের প্রিয় প্রয়াত বলিউড তারকা ইরফান খান। লাইফ অভ পাই সিনেমায় তার সংযুক্ত হওয়ার গল্প খানিকটা অদ্ভুত। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তিনি এইচবিও-র ‘ইন ট্রিটমেন্ট’ নামক এক টিভি শোর শুটিং করছিলেন। এ সময় লাইভ অভ পাই সিনেমার কাস্টিং ডিরেক্টর এভি কফম্যান ইরফানকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, তিনি যাতে পরিচালক অ্যাং লির সাথে দেখা করেন। ইরফান খান আগে থেকেই অ্যাং লি ও তার সিনেমার ভক্ত ছিলেন। অ্যাংলির সাথে আলাপের পর তিনি ইরফানকে সিনেমায় বয়স্ক পাইয়ের ভূমিকায় রাখবেন বলে কথা দেন। বিচক্ষণ ইরফানও বলেছিলেন, তাকে যতক্ষণ চরিত্রের জন্য নির্বাচন না করা হচ্ছে, ততক্ষণ তিনি বই পড়া শুরু করবেন না। ফিল্মের সকল কাজ শুরু হবার পর তিনি অন্তত কয়েকবার বইয়ের পুরোটা পড়েন।
বাস্তব জীবনের পাই
মুভিতে চরম প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা প্রতিটা মুহূর্তের সংগ্রামকে জীবন্ত রূপে প্রতিফলিত করতে এমন একজনকে পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যিনি বাস্তবেই এই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। মার্কিন নৌ-প্রকৌশলী স্টিভ ক্যালাহানের জাহাজ অ্যাটলান্টিকে তলিয়ে যাবার পর টানা ৭৬ দিন এক রাবার লাইফবোটে সমুদ্রে বুকে একা টিকে ছিলেন। যেখানে তিনি সত্যিকারের সামুদ্রিক প্রাণীকুল, হাঙরদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের ২০শে এপ্রিল, মাছ ধরার এক নৌকা তাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় আটলান্টিক থেকে উদ্ধার করে। ভয়াল এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা তিনি মলাট-বদ্ধ করেছেন ‘Adrift: 76 Days Lost At Sea’ বইয়ে।
রিচার্ড পার্কারের ইতিহাস
পাইয়ের সাথে লাইফবোটে বেঁচে থাকা বাঘটার নাম রিচার্ড পার্কার রাখা হয়েছিল। এই নাম পছন্দ করার পেছনে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত- দুটো কারণই থাকতে পারে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এডগার অ্যালান পো’র “দ্য ন্যারেটিভ অভ আর্থার গর্ডন পিম অভ নান্টুকেট” (১৮৩৮) উপন্যাসে রিচার্ড পার্কার নামের একটি চরিত্র থাকে, যে কিছু নাবিকের সাথে এক শিপরেকে আটকে যায়। পরবর্তীতে বাকি নাবিকদের খাদ্যে পরিণত হয় সে। আবার ১৮৮৪ সালে মিগনোনেট নামে এক জাহাজ সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার পর সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় চারজন মানুষ। যাদের মধ্যে একজন ছিল কেবিন বয় রিচার্ড পার্কার। দুর্ভাগ্যবশত খিদের তাড়নায় তাকেও খাদ্যে পরিণত করে বাকি তিনজন।
গাণিতিক সৌন্দর্য
পাইয়ের সমুদ্রে আটকে পড়া দিনের সাথে গণিতের খুব সুন্দর এক সম্পর্ক রয়েছে। সেটা অবশ্য নির্মাতারা ইচ্ছা করেই রেখেছেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, পাই লাইফবোটে সমুদ্রের বুকে ভেসে ছিল মোট ২২৭ দিন। ওদিকে ২২কে ৭ দিয়ে ভাগ দিলেই মূলত গাণিতিক ধ্রুবক পাইয়ের মান ৩.১৪১৬ পাওয়া যায়।
স্পাইডারম্যানের সম্পৃক্ততা
মুভিতে বয়স্ক পাই প্যাটেল (ইরফান খান) একজন লেখককে তার জীবনকাহিনি বর্ণনা করতে দেখা যায়। ওই লেখক চরিত্রে অভিনয় করেছেন র্যাইফ স্পাল। মজার ব্যাপার হলো, এই চরিত্রের জন্য শুরুতে বাছা হয়েছিল স্পাইডার ম্যান খ্যাত টবি ম্যাগুইয়ারকে। কিন্তু অ্যাং লি পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। যেহেতু এই চরিত্রের স্ক্রিনটাইম ছিল অল্প, তাই তিনি সেখানে জনপ্রিয় কোনো অভিনেতাকে নিতে চাইছিলেন না।
দৃশ্যায়ন
সিনেমার দৃশ্যায়নে ভারতের বেশিরভাগ অংশ দেখালেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশেই এর শুটিং সম্পন্ন করা হয়েছে। পন্ডিচেরির পাশাপাশি কিছু অংশের দৃশ্যায়ন হয়েছিল কেরালার মুন্নারেও। পরবর্তীতে অ্যাং লি দলবল নিয়ে রওয়ানা দেন নিজ দেশ তাইওয়ানে। সিনেমায় দেখানো প্রাণীসমূহের শুটিং তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের চিড়িয়াখানা এবং পিংটাং কাউন্টির কেন্টিং জাতীয় উদ্যানে সম্পন্ন হয়েছিল। সমুদ্রের সিংহভাগ দৃশ্য শুট করা হয়েছে পরিত্যক্ত একটি এয়ারপোর্টের বিশাল এক ওয়েভ ট্যাঙ্কে, যেটাতে পানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১.৭ মিলিয়ন গ্যালন।
ভিএফএক্স
অ্যাং লির ভিজুয়াল মাস্টারপিস ‘লাইফ অভ পাই’ সিনেমার আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে এর চোখধাঁধানো ভিএফএক্স এবং সিজিআই। ভিজুয়াল ইফেক্টের দিকটা দেখভাল করেছিল ‘Rhythm & Hues Studios’ নামে এক কোম্পানি। এছাড়াও এই মুভির থ্রিডি ইফেক্টগুলো লস অ্যাঞ্জেলস, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, কুয়ালালামপুর, ভ্যানকুভার, খাউশুয়িংয়ের বিভিন্ন টিম ডেভেলপ করেছিল। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পুরো সমুদ্র এবং প্রকৃতিকে একটি চরিত্রে ফুটিয়ে তোলা। রিচার্ড পার্কারের সাথে পাইয়ের অনেক দৃশ্য থাকলেও সেগুলো মূলত ভিএফএক্সের কারসাজি। এই চ্যালেঞ্জে ভিএফএক্স দল দারুণভাবে উতরে গেছে।
সমালোচনা
দুনিয়াভরে চারিদিক থেকে তারিফ কুড়ালেও কম সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়নি লাইফ অভ পাই সিনেমাকে। সবার প্রথমেই যে জিনিসটা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সেটা হলো, সিনেমায় দেখানো প্রাণী আচরণ। রিচার্ড পার্কার হিসেবে যে বাঘ ব্যবহার করা হয়েছিল, পানির দৃশ্যের শুটিংয়ে সে মরতে মরতে বেঁচে যায়। যেটাকে অ্যাং লি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন পাওয়া এই সিনেমার একটি গানেও উঠেছিল অনুযোগের সুর, বলা হয়েছিল গানটি নকল। গায়িকা বোম্বে জয়শ্রীকে এজন্য প্ল্যাজারিজমের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। বলা হয়, তিনি জনপ্রিয় তামিল মিউজিসিয়ান ইরাইম্মা থাম্পির মালায়লাম গান ‘ওমানাথিংকাল কিভাড়ু’ থেকে এই মুভির একটি গানের জন্য প্রথম ৮ লাইন নকল করেছেন।
এখানেই শেষ নয়। সেরা ভিজুয়াল ইফেক্টের জন্য অস্কার জিতেছিল এই সিনেমাতে কাজ করা ভিএফএক্স স্টুডিয়ো
“Rhythm & Hues”। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পুরষ্কার জেতার মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই তারা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। এর মূল কারণ হলো প্রোডাকশন টিম অতিরিক্ত কাজ করিয়েও তাদেরকে পারিশ্রমিক না দেওয়া। ফলে দেনায় ডুবে সর্বস্ব খোয়াতে হয় তাদের। এমনকি অ্যাং লি অস্কার অনুষ্ঠানে ওই ভিএফএক্স দলের কথা একটিবারের জন্যও মুখে আনেননি, যেখানে সিনেমার ৯০% ভিএফএক্সের কাজই তারা সামলেছিল।
বক্স অফিস ও পুরষ্কার
বক্স অফিসেও রীতিমতো ঝড় তুলেছিল লাইফ অভ পাই। ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লগ্নিতে নির্মিত এই সিনেমা সারাবিশ্ব থেকে আয় করে নিয়েছিল প্রায় ৬০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফিলোসফিকাল মুভি হিসেবে একে বেশ বড় মার্জিন প্রফিট বলা যায়। সর্বমোট ১০১টি মনোনয়নের মাঝে ৪৬টি পুরষ্কার বাগিয়ে নিয়েছিল এই মুভি।
অ্যাকডেমি অ্যাওয়ার্ডেও বিশেষ চমক দেখিয়ে জিতে নিয়েছিল সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা ভিজুয়াল ইফেক্টস, সেরা অরিজিনাল স্কোরের পুরষ্কার। ‘BAFTA’-তে সিনেমাটোগ্রাফি অ্যান্ড বেস্ট ভিজুয়াল ইফেক্ট পুরষ্কার জেতার পাশাপাশি গোল্ডেন গ্লোব জিতেছিল বেস্ট অরিজিনাল স্কোরের জন্য।