অ্যাকশন, ড্রামা, সাসপেন্স… একটু করে কি রোমান্সও?
তামিম ইকবালকে ঘিরে গত কয়েকদিনে যা হলো, রায়হান রাফির হাতে এই চিত্রনাট্য পড়লে এ থেকে আরও একটা বক্স অফিস হিট সিনেমা বেরোত নিশ্চিত। তামিমের সরল মনে বলা ‘শতভাগ ফিট নই, তবুও খেলব’ উক্তি দিয়ে শুরু যেই কাণ্ড, পাল্টা জবাব, অবসর, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ পেরিয়ে তার শেষটা হলো নাজমুল হাসান পাপনের আবেগতাড়িত উচ্চারণে, ‘অধিনায়ককে ছাড়া আমরা বিশ্বকাপে খেলব কী করে!’
তবে সিনেমার রেশ তো কেবল দেখাতেই শেষ হয় না, ভালো-মন্দ, আলোচনা-সমালোচনারও জায়গা থাকে। শুক্রবারের পর থেকে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তামিমের ফেরত আসাটা জরুরি ছিল কি না।
নিখাঁদ ব্যাটার হিসেবে যদি চিন্তা করা যায়, তামিম কি খেলার মতো অবস্থায় আছেন এখন? ফিজিও ও দলের কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে তার যে আলাপ হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটা তিনি খেলতে চেয়েছিলেন নিজের ম্যাচ ফিটনেস বুঝতেই। এবং, একমাত্র ম্যাচে যে ইঙ্গিত পেলেন, তাতে উপলব্ধিটা হতাশাব্যঞ্জকই হওয়ার কথা। ফজল হক ফারুকীর যে বলে সেদিন আউট হয়েছেন তিনি, গুড লেংথের শর্টার সাইডে পড়া বলটা কোনোভাবেই ফ্রন্ট ফুটে খেলার মতো ছিল না। কী করা উচিত ছিল, সেটা এর কয়েক বল আগে তিনি নিজেই দেখিয়েছেন। একই লেংথের বলটা কাট করেছিলেন, চার পেয়েছিলেন।
বয়স বাড়লে হাত-পায়ের পেশিগুলোতে শিথিলতা আসাটা স্বাভাবিক, প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় বেড়ে যাওয়াটাও নরমাল। বয়স ৩৫-এর দাগ পেরিয়েছে, ডেভিড ওয়ার্নার থেকে রোহিত শর্মা, সবাই তো সংগ্রাম করছেন বয়সের ছাপ ব্যাটিংয়ে পড়তে না দেওয়ার মিশনে নেমে। তামিমের সংগ্রামটা আরও বেড়ে যাচ্ছে একই সময়ে ফিটনেস নিয়েও লড়তে হচ্ছে বলে। কোমরের ব্যথা, শরীর ভারী হয়ে যাওয়া – তামিমের এসব সমস্যা তো দৃশ্যমান খালি চোখেই।
এমনিতেই তার ফ্রন্ট ফুট স্ট্রাইডটা খুব লম্বা, সব বলই খেলতে চান ফ্রন্ট ফুটে। শরীর পাতলা না হলে পেছনের পায়ে যাওয়াটা অনেক কঠিন তার জন্যে। যে বলটায় আউট হলেন, তার শরীর ওই মুহূর্তে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি, তাকে ব্যাকফুটে যেতে হবে। তার প্রতিক্রিয়াটা হলো হাত-সর্বস্ব। তিনি খোঁচা মারলেন।
ফিটনেসের এমন অবস্থা নিয়েই বিশ্বকাপে গেলে ওই দুই মাস তার খুব ভালো কাটবে, নিন্দুকেরা জবাব পাবেন তার ব্যাটের তোড়ে, এমন আশাটা একটু বল্গাছাড়াই। অলৌকিকটা তো এত আচমকাও ঘটে না।
তামিমের অবসর ভেঙে ফেরাটা তামিমের জন্য কতটুকু ভালো হলো, এই প্রশ্নটা তাই থাকছেই। কিন্তু, তার ফেরাতে দল যে উপকার পাবে, এটা বেশ নিঃসংশয়। তবুও গণতান্ত্রিক পৃথিবীতে দ্বিমত করার সুযোগ যেহেতু থাকছেই, নিঃসংশয় কথারও ব্যাখ্যা করা উচিত।
তামিম যদি না-ই খেলতেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সবার প্রথমে খুঁজতে হতো ওপেনিংয়ে লিটন দাসের সঙ্গীকে। যে কাজটা আগের চার বছরে করেনি বাংলাদেশ। লিটন আর তামিমের বাইরে পাঁচটা ম্যাচও পাননি তৃতীয় কোনো ওপেনিং ব্যাটার। বিশ্বকাপের আগে আর বড়জোর পাওয়ার কথা ১০টা ম্যাচ, সেটাও বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠবে ধরে নিয়ে, এই সময়ে দলের সেট-আপে নতুন কেউ এসেই মাত করে দেবেন, এমন বাজি ধরতে ইলন মাস্কই হতে হবে।
তামিম না খেললে বাংলাদেশকে তো ভাবতে হতো ক্যাপ্টেনসি নিয়েও। ব্যাটার তামিমকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি যে দারুণ, এর পাল্টা দাঁড় করানো মুশকিল হবে তার কট্টর নিন্দুকেরও।
তামিমের দুর্দান্ত নেতৃত্বের প্রমাণ মিলেছে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতেও। মাত্র ১৬৪ রান টার্গেট দিতে পেরেছিল বাংলাদেশ, এর মধ্যেও যতটা অ্যাটাকিং ক্যাপ্টেনসি করা যায়, তামিম সেটা করেছেন।
কম রান পেয়েছেন বোর্ডে, ম্যাচ জিততে চাইলে উইকেট নেওয়ার জন্য ঝাঁপাতেই হতো। সেজন্য তিনি পেসারদের বল করতে বলেছিলেন ওপরে ওপরে। সেদিন আফগানিস্তানের পেসাররা শর্ট লেংথ টার্গেট করলেও বাংলাদেশের অ্যাভারেজ লেংথ ছিল অনেকটাই ফুল। ৭.২৫ মিটারের আশেপাশে।
অ্যাটাকিং বোলিং করলে একটা ঝুঁকি থাকে রান বের হয়ে যাওয়ার। কিন্তু, সেদিন বাংলাদেশ প্রায় ২২ ওভার বল করে রান দিয়েছে ৮৩। ২১.৪ ওভারের মধ্যেই ৭৭টা ডট বল করেছেন বাংলাদেশি বোলাররা।
এত বেশি ডট বল করার কৃতিত্ব অবশ্যই বোলারদের, তবে সেদিন তামিমের ফিল্ড সেটআপটার প্রশংসাও করতে হবে আপনার। এক কথায় তার ক্যাপ্টেনসিকে বলা চলে, উদ্ভাবনী।
যেমন ধরুন, প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ বোলিং শুরু করেছিল কনভেনশনাল অ্যাটাকিং ফিল্ড সেটআপেই। দুই স্লিপ, কাভার আর শর্ট মিড উইকেটা একটু এগিয়ে দাঁড়ানো ক্যাচিং পজিশনে।
কিন্তু, পরের ওভার থেকেই তামিম ক্যাপ্টেনসিতে ভিন্ন কিছুর চেষ্টা করা শুরু করলেন। পয়েন্টের ফিল্ডারকে টেনে আনলেন খুব সামনে, যেন ড্রাইভ খেলতে গেলে যদি বলটা ওপরে উঠে যায়, তো ফিল্ডার ক্যাচ ধরতে পারেন।
পঞ্চম ওভারে গিয়ে মোস্তাফিজকে লেগ সাইডের সার্কেলে দিলেন তিনজন ফিল্ডারকে। ভেতরে ঢোকা বলগুলো ফ্লিক করতে গিয়েও ক্যাচ ওঠার চান্স থাকে, সেই ক্যাচগুলো ধরার জন্য মানুষও আছে।
সপ্তম ওভারে মোস্তাফিজকে পয়েন্টে দেওয়া হলো দুজন ফিল্ডার। সেই প্ল্যানটা কাজে লেগেও গেছিল প্রায়। ইব্রাহিম জাদরানের ড্রাইভটা বেরিয়ে যায় সামনে দাঁড়ানো ফিল্ডারের হাত ছোঁয়া দূরত্ব দিয়ে।
ভাগ্য পক্ষে কাজ করেনি, এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে সেদিন। পেসাররা ভালো বল করেছেন, হাসান মাহমুদ ব্যাটের কানা নিয়ে খেলেছেন, তবুও উইকেট পড়েনি। আর ক্রিজে দুজন ডানহাতি ব্যাটার থাকলে যে মেহেদী হাসান মিরাজকে এনে কোনো লাভের লাভ হতো না, সেটা দ্বিতীয় ওয়ানডে দেখলেই পরিষ্কার বোঝার কথা।
তামিম তাই স্পিন অ্যাটাক করতে চাইলে খুঁজে নিয়েছেন সাকিবকে। আর সাকিবকে বলে এনেও ফিল্ড সেটআপে বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন তামিম। শর্ট মিড-অফে লিটনকে দাঁড় করালেন, যেন ড্রাইভ করে ইজি সিঙ্গেল না নেওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে লেগ সাইড ফাঁকা করে দিয়ে ব্যাটারকে লোভ দেখালেন, অফ স্টাম্পে সরে এসে বল লেগে ঘোরাতে। সেক্ষেত্রে সাকিবের আর্মারগুলো আরও লিথাল হওয়ার কথা। মিস করলেই তো এলবিডব্লিউ।
তামিম তাই সেদিন উইকেট নেওয়ার চেষ্টা কম করেছেন বলা যায় না। কিন্তু, টার্গেট এতটাই কম ছিল যে আফগানিস্তানের ব্যাটারদের ঝুঁকি নেওয়াই লাগেনি।
ওয়ানডের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকে বোলিং-ফিল্ডিংয়ে এমনই প্রো-অ্যাকটিভ তামিম। তার ব্যাটিংটা ধীরস্থির-শান্ত-সৌম্য সূচনা পছন্দ এক তৌহিদ হৃদয় ছাড়া তার দলের বাদবাকি ব্যাটারদেরও, প্রতিপক্ষ ৩০০ রান করে ফেললেই নিশ্চিন্ত দম ফেলতে শুরু করে – ব্যাটিং মানসিকতা নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগই করা যায় তামিমের বাংলাদেশের বিপক্ষে। কিন্তু, তামিম এর জবাব দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকেও ৩০০ রানের নিচে আটকানোর করার চেষ্টা করে। ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যে ৩৭ ম্যাচে ক্যাপ্টেনসি করেছেন তিনি, সেখানে বাংলাদেশ ৩০০-এর বেশি রান হজম করেছে ৫ বার। সংখ্যাটা আফগানিস্তান ছাড়া বিশ্বকাপের অন্য যেকোনো দলের চেয়ে কম।
তামিমের এই ‘বোলিং দিয়ে আক্রমণ, ব্যাটিং দিয়ে রক্ষণ’ নীতিটা পছন্দ না-ই হতে পারে আপনার। চাইতেই পারেন, বাংলাদেশও ইংল্যান্ড-সাউথ আফ্রিকার মতো আক্রমণ করুক ব্যাট হাতে। এই চাহিদাটাই তো আধুনিক পৃথিবীর নিয়ম।
কিন্তু, সমস্যা যেখানে, তামিম এই বাংলাদেশের ছাঁচটা গড়ে তুলেছেন সর্বশেষ তিন বছরে। এই টেমপ্লেটই ওডিআই সুপার লিগে বাংলাদেশকে তৃতীয় বানিয়েছে। দলকে অন্য কোনো পরিকল্পনাতে খেলাতে চাইলে তাই কিছুটা সময় দিতেই হবে।
কিন্তু, বিশ্বকাপ যে মাত্র তিন মাসই দূরে!