প্রুশিয়ার লিবারেল পার্টি এবং সাধারণ মানুষদের অধিকাংশই অস্ট্রিয়ার সাথে সংঘাতের পক্ষপাতী ছিল না। ১৮৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে লিবারেলদের বিভিন্ন উপদল একত্রিত হয় তাদের দৃষ্টিতে অনর্থক এই সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য। মার্চে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতে যুদ্ধবিরোধি সভা সমাবেশের ঢেউ বয়ে যায়। লড়াইয়ের বিপক্ষে জমা পড়ে অনেক দরখাস্ত।
কিন্তু লিবারেলরা বিসমার্কের দূরদর্শিতার কথা চিন্তা করেনি। তিনি জানতেন জনতার মন পরিবর্তন হতে সময় লাগেনা। দুই-একটি লড়াই জিতলেই সবাই তার দলে ভিড়তে মারমারি লাগিয়ে দেবে। ঠিক তা-ই হলো। প্রুশিয়ান সেনাদের হ্যানোভার, ড্রেসডেন আর হেসে-কেসেল দখলের খবরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। বিসমার্ক জনসম্মুখে আসলেই মানুষ তাকে ছেঁকে ধরত অভিনন্দন জানাতে। জুনের ২৫ তারিখ প্রাদেশিক প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ল। বিসমার্কের সমর্থনপুষ্ট রক্ষণশীল গোষ্ঠী অনেকগুলো আসন লাভ করে। জুলাইয়ের ৩ তারিখ যখন কনিগ্রাটজে প্রুশিয়ানরা অস্ট্রিয়ানদের উপর চূড়ান্ত আঘাত করছে সেদিন রাষ্ট্রীয় ডায়েটের নির্বাচন ছিল। রক্ষণশীলরা আগের ৩৫ আসন থেকে উন্নীত হয় ১৩৬ আসনে। প্রগতিশীল লিবারেল দল প্রায় একশ আসন হারিয়ে ১৪৮ আসনে নেমে আসে। পুরনো লিবারেল দল (ওল্ড লিবারেল) পেল ২৪টি আসন, যা পূর্ববর্তী আসনের দ্বিগুণেরও বেশি। প্রুশিয়ান সংসদের নিম্নকক্ষ চলে গেল রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণে।
বিসমার্ক ঝোপ বুঝে কোপ মারলেন। তিনি লিবারেলদের সাথে সমঝোতা করতে চাইলেন, যদি তারা ডায়েটের অনুমোদন ব্যতিরেকে সরকারের করা পূর্ববর্তী সব খরচের বৈধতা দান করে। অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের পর তাদের ক্ষতিপূরণে তখন কোষাগার পূর্ণ, কাজেই লিবারেলরা জানত তারা বাজেট নিয়ে অচলাবস্থা জারি রাখলেও বিসমার্কের অর্থের অভাব হবে না। তাছাড়া যে সামরিক সংস্কার নিয়ে তাদের এত গাত্রদাহ, অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে এই সংস্কার অসাধারণভাবে সফল।
তবে স্বয়ং রাজাই বিসমার্কের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন। আপাদমস্তক রক্ষণশীল উইলিয়াম লিবারেলদের যেকোনো ছাড় না দিতে অনড়। তবে বিসমার্ক অনেক যুক্তি দেখিয়ে অবশেষে রাজার অনুমতি আদায় করে নেন। ১৮৬৬ সালের অগাস্টের ১৪ তারিখ এই বিল উত্থাপিত হয়। তেসরা সেপ্টেম্বর ২৩০-৭৫ ভোটে তা পাশও হয়ে যায়।
বিসমার্কের অস্ট্রিয়ানদের বিপক্ষে সাফল্য এবং লিবারেলদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা তাদের শিবিরে বিভক্তি তৈরি করে। প্রুশিয়াকে প্রগতিশীল জার্মান রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে মনে করা উপদল বিশ্বাস করতে শুরু করে বিসমার্কই পারবেন সমস্ত জার্মানিকে একই ছাতার তলে নিয়ে আসতে। প্রথিতযশা অনেক লিবারেল সরাসরিই বিসমার্কের পক্ষাবলম্বন করেন। গুস্তাভ মেভিসেন নামে প্রাক্তন এক মন্ত্রী, লিবারেল শিল্পপতি ওয়ার্নার সিমেন্স, কট্টর লিবারেল কার্ল টুইস্টেনসহ অনেককেই বিসমার্ক বুকে টেনে নিয়ে কিভাবে লিবারেল-রক্ষণশীল দ্বন্দ্ব মেটানো যায় তা নিয়ে তাদের মূল্যবান মতামত কামনা করলেন।
বিসমার্কের রাজনৈতিক চালে লিবারেল ঐক্য ভেঙে পড়ল। বিসমার্কের পক্ষাবলম্বনকারীরা ন্যাশনাল লিবারেল হিসেবে একত্রিত হন। এই দলের লোকেরা মূলত প্রুশিয়ার দখলকৃত জার্মান ভূখণ্ডের, যারা বিসমার্কের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নীতি আন্তরিকভাবে সমর্থন করতেন। এদের বলা হতো নিউ প্রুশিয়ান। তাদের নেতৃত্ব অর্জন করেন হ্যানোভার থেকে আসা রুডলফ ভন বেনিংসেন আর ইয়োহান মিকুয়েল। অন্যদিকে প্রগতিশীল লিবারেল পার্টি বিসমার্কের নীতির বিপক্ষে ছিল। তারা নাগরিক স্বাধীনতা এবং সংসদের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী। তাদের চোখে বিসমার্ক স্বৈরাচার, রাজতন্ত্র মান্ধাতা আমলের প্রতিষ্ঠান এবং প্রজাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাই সর্বোত্তম।
বিসমার্কের কার্যক্রমে রক্ষণশীলরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এতদিন তারা বিসমার্ককে নিজেদের একজন বলে জেনে এসেছে। মনে তাদের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল অস্ট্রিয়ানরা জার্মানি থেকে পিঠটান দিলে এসব ডায়েট-ফায়েট বাতিল করে আবার রাজার অধীনে পুরনো সিস্টেমে ফিরে যাবার। বিসমার্ক লিবারেলদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করলে তারা প্রচন্ডভাবে ক্ষিপ্ত হল। সব পুরুষ নাগরিকের ভোটাধিকার, ইটালির বিপ্লবীদের সমর্থন এবং পার্শ্ববর্তী জার্মান রাষ্ট্রগুলোর রাজতন্ত্রের পতনে বিসমার্কের ভূমিকা তাদের প্রচণ্ডভাবে অসন্তুষ্ট করে। তাদের একভাগ তৈরি করল নব রক্ষণশীল (free conservatives) যারা বিসমার্কের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে। এদের মাঝে ছিল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পেশাজীবীরা। তাদের দল দ্রুতই ভারি হতে থাকে। ওদিকে প্রাচীনপন্থি প্রুশিয়ান ভূমি মালিক, জাঙ্কার, কিছু সামরিক অফিসার এবং ধর্মযাজক থেকে যান পুরনো রক্ষণশীল (Old Conservatives) দলে। তাদের কাছে লিবারেলদের সাথে যেকোনো সমঝোতা অস্পৃশ্য একটি ধারণা।
প্রুশিয়ান রাজনীতি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে বিসমার্কপন্থী ন্যাশনাল লিবারেল আর নতুন রক্ষণশীলরা একটি জোট গঠন করে, যারা প্রুশিয়ান তথা জার্মান রাজনীতিতে বহু বছর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই জোট ছিল জার্মান জাতিরাষ্ট্রের ধারণার পক্ষে। অন্যদিকে বিসমার্ক বিরোধীরা নিজেদের রেষারেষি কাটিয়ে এক হতে পারল না। তাদের একদল জার্মান রাষ্ট্র চাইলেও আরেকদলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রুশিয়ান রাজতন্ত্র আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। জার্মানি তাদের কাছে গৌণ।
নর্থ জার্মান কনফেডারেশন
মেইনের উত্তরাঞ্চলের ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলির সাথে ১৮৬৬ সালের অগাস্টের ১৮ তারিখে চুক্তির মাধ্যমে নতুন একটি জার্মান কনফেডারেশন গঠনের দ্বার উম্মোচিত হয়। শর্ত অনুযায়ী কনফেডারেশনের ২৫ বছর বা তদুর্ধ্ব সকল পুরুষ নাগরিক গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এর ডায়েট নির্বাচন করবেন। ডায়েট এরপর সবার জন্য অভিন্ন একটি সংবিধান নিয়ে কাজ করবে। বিসমার্ক নিজে ডিসেম্বরের ১ তারিখ সংবিধানের একটি রূপরেখাও তৈরি করেন। কয়েকবার পর্যালোচনার পরে ১৫ তারিখ কনফেডারেশনের অন্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই খসড়া পৌঁছে দেয়া হয়। কিছু পরিবর্তন পরিবর্ধনের পর এই সংবিধান আলোচনার টেবিলে উত্থাপিত হলো।
বিসমার্কের ছকে নর্থ জার্মান কনফেডারেশনের উচ্চকক্ষ হল ফেডারেল কাউন্সিল/ বুন্ডেস্রাট (Bundesrat)। প্রুশিয়া সর্ববৃহৎ রাজ্য হওয়ায় এখানে তার ছিল সতের ভোট, বাকি ২৬ ভোট অন্যদের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের ভারও প্রশিয়ার হাতে স্থায়িভাবে অর্পিত হয়। ফলে কনফেডারেশনের সামরিক এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক সকল ক্ষমতাই প্রুশিয়ার হাতে কেন্দ্রীভূত হলো। প্রুশিয়ার রাজা হলেন কনফেডারেশন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং আইন প্রয়োগকারী। নিজ ক্ষমতাবলে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারতেন। নিম্নকক্ষের নাম ছিল রাইখস্ট্যাগ (Reichstag)। এখানে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হতেন তিন বছরের জন্য।
বিসমার্কের সংবিধানে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা তিনি ইচ্ছা করেই বাদ রেখেছিলেন। তিনি জানতেন যদি ফেডারেল মন্ত্রীপরিষদ গঠন করতে হয় তাহলে রাইখস্ট্যাগের অনুমোদন লাগবে। ফলে বিসমার্কের পছন্দের লোকেরা না-ও নিয়োগ পেতে পারেন। ফলে প্রশাসনিক কাঠামো ন্যস্ত ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলির নিজেদের উপরে। তারা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ডায়েটে আলোচনার করে সিদ্ধান্ত নিত। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হতো প্রতিটি সদস্যকে আলাদা আলাদাভাবে। ফলে ন্যাশনাল লিবারেলরা দাবি তুলল একটি মন্ত্রীপরিষদের, যারা রাইখস্ট্যাগের জন্য নিয়োজিত থাকবে। ভন বেনিংসেন ১৮৬৭ সালের মার্চে দুইবার এই মর্মে প্রস্তাবও উত্থাপন করেন। বিসমার্ক সরাসরি বিরোধিতা করে দরকার হলে কনফেডারেশন বিলুপ্ত করে দেবেন বলে হুমকি দেন। অবশেষে রফা হলো একদল নয়, একজন মন্ত্রী রাখা হবে রাখস্ট্যাগের জন্য। তবে তার দায়িত্ব কী হবে তা স্পষ্ট করা হলো না।
বিসমার্ক ফেডারেল চ্যান্সেলর নামে একটি পদও সৃষ্টি করেছিলেন, যিনি ফেডারেল কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের কাজ করবেন। এই ব্যক্তি প্রুশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে জার্মান বিষয় সম্পর্কিত বিভাগে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। কিন্তু ফেডারেল চ্যান্সেলরের দায়িত্ব এবং কর্তৃত্ব নিয়ে বিতর্কে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে এই প্রক্রিয়ায় কাজ হবে না। এই পদ কার্যকর করতে হলে একে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রুশিয়ান মিনিস্টার-প্রেসিডেন্টের সাথে একত্রিত করতে হবে। ফলে প্রকৃতপক্ষে এই পদ পরিণত হল চীফ ফেডারেল মিনিস্টারে, যিনি স্বাধীনভাবে কনফেডারেশন ডায়েটের একটি প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে পারবেন। কনফেডারেশনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও তিনি। তবে তার নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে প্রুশিয়ার রাজার হাতে। রাজা চাইলে তাকে বরখাস্ত করতে পারবেন।
বাজেটের ব্যাপারে বিসমার্ক কনফেডারেশনকে সামরিক বাদে অন্যান্য খাতের ব্যয় অনুমোদনের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তবে সামরিক ব্যয় যাতে লাগাম ছাড়িয়ে না যায় সেজন্য তিনি একটি সমঝোতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রতিটি সৈনিকের জন্য মাথাপিছু ব্যয়ের কোটা বেধে দেয়া হলো (দ্য আয়রন বাজেট)। এর সময়সীমা ছিল ১৮৭১ সাল, এরপর রাইখস্ট্যাগ সামরিক ব্যয় বরাদ্দ নিয়ন্ত্রণ করবে।১৮৬৭ সালের এপ্রিলের ১৬ তারিখ ২৩০-৫৩ ভোটে সংবিধান পাশ হয়ে যায়। বিপক্ষে ছিল প্রগতিশীল লিবারেল, পোলিশ প্রতিনিধি, ক্যাথকিল গোষ্ঠী, আর অগাস্ট বেবেল নামে একজন সমাজবাদী।
দক্ষিণ জার্মানি
উত্তর জার্মানিতে কনফেডারেশন গঠন করলেও দক্ষিণ জার্মানির কথা বিসমার্ক ভুলে যাননি। তিনি জানতেন দক্ষিণ জার্মান কনফেডারেশনের রাষ্ট্রগুলো প্রুশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সর্বদাই সন্দেহের চোখে দেখে অভ্যস্ত। তবে প্রুশিয়ার থেকেও বড় এক শত্রু তাদের আছে, ফ্রান্স।
অস্ট্রিয়ানদের পরাজিত করবার পর নেপোলিয়নের দিক থেকে আক্রমণ প্রতিহত করতে বিসমার্ক ফরাসি দূত বেনেডেটের সাথে আলোচনা চালাচ্ছিলেন। দক্ষিণ জার্মান রাষ্ট্রগুলো তখনও নিজেদের আলাদা কোনো কনফেডারেশন গঠন করেনি। বিসমার্ক বেনেডেটের সাথে আলোচনার সূত্র ধরে তাদের বোঝালেন নেপোলিয়নকে বিশ্বাস করা বড় শক্ত। তিনি রাইন অতিক্রম করে পূর্বসূরির মতো ফরাসি আধিপত্য কায়েম করতে চান। দ্রুতই ব্যাডেন, ভুর্তেমবার্গ আর বাভারিয়ার সাথে শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হলো। এখানে একটি শর্ত ছিল যে ফরাসি আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে প্রুশিয়ার রাজা দক্ষিণ জার্মান রাজ্যগুলির সেনাদলের প্রধান মনোনীত হবেন। তার মানে উত্তর ও দক্ষিণ দুই জার্মান অংশেই সামরিক ক্ষমতা চলে যাবে উইলিয়ামের হাতে। তবে এই চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হলো যুদ্ধের প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা আসতে হবে ফ্রান্সের থেকে।
বিসমার্ক এবার ফ্রান্সকে উস্কে দেবার ছক কষতে শুরু করলেন। তার মতে ফরাসিরা বড় দাম্ভিক, আঁতে একটু ঘা দিলেই তারা যুদ্ধের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে। জার্মানিকে এক করতে হাতে আরো কিছু শান্তিপূর্ণ বিকল্প ছিল, তবে ফ্রান্সকে ব্যবহার করাটাই যে শেষ অবধি দরকার হবে তা বোধহয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।