লন্ডনের পিকাডিলি হোটেলের গ্রিল রুমটার যা আয়তন, তাতে লারউডের রান-আপই ঠিকঠাক হতো কি না, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে যথেষ্ট। সোনা দিয়ে গিল্টি করা করিন্থিয়ান কলাম, অলংকারে সাজানো কোভিং, উঁচু ছাদ থেকে নেমে আসা ঝাড়বাতির কক্ষে তাই হ্যারল্ড লারউড, বিল ভোস, আর্থার কার এবং, অতি অবশ্যই, জার্ডিন যখন জড়ো হয়েছিলেন একত্রে, তাকে কুশলাদি বিনিময়ের চাইতে বেশি কিছু ভাবা হয়নি সেক্ষণে।
চতুর্পক্ষীয় আলাপচারিতার শুরুটা হয়েছিল ভীষণই অপ্রস্তুতভাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাতের খাবারের আগে বিয়ার নিয়েছিলেন চারজনই, তবুও কথা ঘুরে ফিরেছিল এক শাখা থেকে অন্য শাখায়। অনেক বাক্য পেরিয়ে অবশেষে জার্ডিন মুখ ফুটে বলেছিলেন তার চাওয়া, ফুল লেংথের যুগে বল রাখতে হবে গুড লেংথে আর লেগ স্ট্যাম্পে। নিজের চাহিদার স্বপক্ষে যুক্তিও ছিল প্রস্তুত, লেগ স্ট্যাম্পে বল রাখবার অর্থই হলো রান করার সুযোগ বহুলাংশে কমে যাওয়া।
লেগ থিওরির এই পরিমার্জিত সংস্করণের নেতিবাচকতাগুলোও জার্ডিন জানিয়ে দিয়েছিলেন সাথে সাথে। বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে, চাপের মুহূর্তে স্নায়ুর পরীক্ষা হবে চূড়ান্ত, আর একটু এদিক-সেদিক হলেই দর্শকেরা তেড়ে আসবে ভীষণরূপে।
লারউড যেন এমন কিছুর জন্যে পা বাড়িয়ে তৈরিই ছিলেন। তার পক্ষ থেকে যে কোনো আপত্তি নেই, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এর আগেরবারের অস্ট্রেলিয়া সফরের এক গল্প বলে।
সেবারের এক ম্যাচে লারউডের প্রতিটি শর্ট বলই অস্ট্রেলীয় উইকেটরক্ষক অ্যালান কিপ্যাক্স হুক করছিলেন সমানে। তৎকালীন দলনেতা পার্সি চ্যাপম্যানকে বলে লারউড জার্ডিনকে পাঠিয়েছিলেন লং লেগের সীমানায়। খাটো লেংথের বলগুলো অবশ্য পত্রপাঠ মাঠের বাইরে বিদায় হচ্ছিল এরপরও, মাথার উপর দিয়ে বল উড়ে যেতে দেখে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেন জার্ডিনও। ‘রাই ধৈর্যং, রহু ধৈর্যং’ শাস্ত্রবাক্য আপ্ত মেনে লারউড ফল এনে দিলেন তারপরই। কিপ্যাক্স বিদায় নিয়েছিলেন ওই জার্ডিনের হাতে ক্যাচ দিয়েই।
লারউড রাজি হয়ে যাওয়াতে, তাকে গুরু মানা ভোসেরও আপত্তি করবার সুযোগ ছিল না। নিজ দলের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে পুরোপুরি, তবে শৈশবে পাওয়া ‘কাউন্টির আগে দেশ’ শিক্ষা মেনে বাধ সাধেননি নটিংহ্যামের অধিনায়ক কারও। নটিংহ্যামের হয়ে দুজনে মিলে লেগ-থিওরির চর্চা করছিলেন এর আগে থেকেই। আর লেগ-থিওরির পরিমার্জিত সংস্করণের প্রথম দর্শন মিলেছিল জার্ডিনের সারের বিপক্ষে। সে ম্যাচে লারউড-ভোস মিলে বহুল পরিমাণে ‘শর্ট অ্যান্ড লেগ’ ডেলিভারি ছুঁড়েছেন বলে রিপোর্ট করেছিল ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকা, বোলিংয়ের মাথা-মুণ্ড কিছু বুঝতে না পেরে সারের আল্ফ গোভার বিরসবদনে লারউডকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি এত বাজে বল করলে কেন?’
লারউডের জবাবটা এসেছিল পরিষ্কার, তারা নতুন কিছুর চেষ্টা করছেন। নতুনত্বের আরেক প্রস্থ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল দু’দিন বাদে নটিংহ্যাম-এসেক্স ম্যাচে। লেগ সাইডে স্ট্যাম্পের হাতদশেক দূরত্বে দাঁড়িয়েছিলেন ছয়জন ফিল্ডার, তাদের পেছনে আরও দুজন, সাথে ছুটে এসেছিল লারউডের গোলা। জ্যাক ও’কনোর ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে ছেড়ে গিয়েছিলেন মাঠ, ওপেনার ডুডলি পোপ বুকে-পিঠে-কোমরে আঘাত পেয়েছিলেন সর্বত্র।
দু’সপ্তাহ পর কার্ডিফেও চলেছিল পরবর্তীকালে ‘বডিলাইন’ বলে খ্যাতি পাওয়া এই বোলিংয়ের প্রদর্শনী, সেদিন দর্শক সারিতে থাকা আঠারো বছরের জন আর্লটও এই বোলিংয়ের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি। পাবেন কী করে? নটিংহ্যাম ড্রেসিংরুমের বাইরে কেউ তো জানতেই পারেনি, ভেতরে ভেতরে কি এক অগ্নিবাণের ফর্মুলা তৈরি হচ্ছে!
***
টিলবুরি বন্দর থেকে এমসিসি ক্রিকেট দলেকে সাথে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে ‘অরন্টস্’ জাহাজ ছেড়ে গিয়েছিল সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে। প্রিয় দলকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানাতে জেটিতে ভিড় করেছিলেন বেশ কিছুসংখ্যক সমর্থক, সাথে খেলোয়াড়দের পরিবার তো ছিলই। নাবিকের সঙ্গে খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দিয়ে জার্ডিন ঘুরে তাকিয়েছিলেন ফ্যানদের দিকে। ‘অ্যাশেজ ফিরিয়ে আনবোই’ বলে তাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে না হতেই বেজে উঠেছিল জাহাজের হুইসেল। শুরু হয়েছিল ৩১ দিনের সমুদ্রযাত্রা, আর দীর্ঘ আট মাসের ওশেনিয়া সফর।
অস্ট্রেলিয়াগামী এমসিসি স্কোয়াড ঘোষিত হয়েছিল এর বেশ কিছুদিন আগেই। দল নির্বাচনটা হয়েছিল অবশ্য ধাপে ধাপে। অধিনায়ক হিসেবে জার্ডিনের যাওয়া তো নিশ্চিতই ছিল, জুলাইয়ের মধ্যভাগে সে তালিকায় নাম উঠেছিল দিলীপসিংজি, লেসলি অ্যামিস, হার্বার্ট সাটক্লিফ আর জজ ডাকওয়ার্থের।
সদ্যসমাপ্ত মৌসুমে ১৪১ উইকেট নেবার পরও যখন লারউড প্রথম নির্বাচিতদের তালিকায় নিজের নাম খুঁজে পাননি, নিজের ব্যাপারে বরাবরই নৈরাশ্যবাদী এই ক্রিকেটার তখন মানসিকভাবে মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, শীতকালটা তার মুরগির খামারেই কাটাতে হবে ভেবে। এমনকি পেছনে ফেলা আসা কয়লাখনিতে ফেরত যেতে হবে আবারও, এমন সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছিল তার মনের কোণে। জানা যায়, জার্ডিনের কথামতো বল করেও জায়গা পেলেন না দেখে তাকে শাপশাপান্তও করেছিলেন সমানে।
লারউডের হতাশা অবশ্য স্থায়ী হয়নি দিন পনেরোর বেশি, আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই ঘোষিত হয়েছিল আরও আট ক্রিকেটারের নাম। গাবি অ্যালেন, বব ওয়াইট, নবাব ইফতিখার আলী খান পতৌদি, ফ্রেডি ব্রাউন, ওয়াল্টার রবিন্সের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দুই পেশাদার ক্রিকেটার লারউড আর ভোসের নাম। এর বাইরে মরিস টেট, মরিস লেল্যান্ড আর হেডলি ভেরিটিকে জায়গা দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছিল এমসিসির দল ঘোষণা।
কিন্তু জাহাজে আরোহণের সময় এগিয়ে আসতে আসতে খসে পড়তে শুরু করেছিলেন নির্বাচিতরা। শুরুতেই ব্যবসায়িক কারণে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন রবিন্স, তার বদলে জায়গা মিলেছিল ডার্বিশায়ারের স্পিনার টমি মিচেলের। যক্ষ্মাক্রান্ত হয়ে টন্টনের প্যাভিলিয়নে পড়ে গিয়েছিলেন দিলীপসিংজি, অস্ট্রেলিয়ার বদলে শীতকালটা তার কাটাতে হয়েছিল সুইস আল্পসে। এডি পেইন্টারের ঠাঁই হয়েছিল তার বদলে, মাসছয়েক বাদে ব্রিসবেনে যিনি নিশ্চিত করেছিলেন অমরত্ব।
তবে কাটাছেঁড়া নাটকের মহাপর্ব অবশ্য মঞ্চস্থ হয়েছিল মরিস টেটকে ঘিরে। ততদিনে তার বয়সঘড়ি ছাড়িয়েছে ৩৭-এর ঘর, ১৯৩২ ঘরোয়া মৌসুম শেষ করেছিলেন বোলিং গড়ের তালিকায় পঞ্চম স্থানে থেকে। লর্ডসে তার ডাক পড়েছিল অ্যাশেজ দলে জায়গা পাবার পর, সেখানকার কোনো এক কর্তা তাকে বলেছিলেন যে লন্ডনের ওল্ড বেইলির মতোই নাকি তিনি পুরনো হয়ে গিয়েছেন; সেবারের সফরতালিকায় যে তার নাম রয়েছে, তা নাকি নেহায়েতই নির্বাচকদের দয়া-দাক্ষিণ্যের ফল। কথাগুলো তার অহমে লেগেছিল নিশ্চিত, বিশেষত আগের দুই অস্ট্রেলিয়া সফরে দলের সেরা বোলার তো ছিলেন তিনিই। সফরের জন্যে ব্রাইটন থেকে মেডিকেল টেস্ট করিয়ে ফেরত আসবার পথেই তিনি ভেবে নিয়েছিলেন, এসব কথা শুনে এবারের সফরে যাওয়াটা তার উচিৎ হবে না। বাড়ি ফিরে লর্ডসে টেলিফোন করে তাই সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন না।
কিন্তু স্বামী সফরে না গিয়ে গুমরে মরবেন ঘরের এক কোণে, এটা মেনে নিতে পারেননি টেটের সহধর্মিণী ক্যাথ, যিনি নিজেও তখন সন্তানসম্ভবা। উপায়ান্তর না পেয়ে এমসিসির সচিব বিল ফিন্ডলেকে চিঠি লিখলেন তিনি। জানালেন, তার স্বামীর ফোন কলকে যেন উপেক্ষা করা হয়, খেলবার মতো সামর্থ্য তার এখনো রয়েছে। প্রথম চিঠির জবাব না পেয়ে তিনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন আরও একবার। ততদিনে টেটের বদলে বিল বোয়েসকে নিয়ে ইংল্যান্ড দল রওনা হয়ে গিয়েছে ডাউন আন্ডারের উদ্দেশ্যে।
ক্যাথের বারংবার আর্জিতে টেটের স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়েছিল আরেকবার। এমসিসির চিকিৎসকের ‘ফিট’ সার্টিফিকেট পেয়ে তিনি তড়িঘড়ি ব্যাগপত্তর গুছিয়ে রওনা দিয়েছিলেন মার্শেইয়ের উদ্দেশ্যে। ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়াগামী আর কোনো জাহাজ ছিল না কাছেপিঠে, তাই তাকে চড়ে বসতে হয়েছিল ফ্রান্স থেকে ছাড়া ‘স্ট্যাথনেভারে’। জাহাজ স্ত্রম্বোলি পেরোতে না পেরোতেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, তার চতুর্থ সন্তান জন্ম নিয়েছে।
***
সব মিলিয়ে তাই এমসিসির ব্যাটেলিয়ন দাঁড়িয়েছিল ২০ জনে। ১৭ ক্রিকেটারের পাশাপাশি ম্যানেজার রূপে যাচ্ছিলেন প্লাম আর রিচার্ড প্যালারেট, সাথে স্কোরারের ভূমিকায় উইলিয়াম ফার্গুসন। ডেভিস কাপ খেলতে ইংল্যান্ডে আসা অস্ট্রেলিয়ান হ্যারি হপম্যান আর অ্যাশেজ কাভার করতে যাওয়া বিখ্যাত সাংবাদিক আর্থার মেইলিও ছিলেন ২০,০০০ টনের অরন্টোস জাহাজে।
ভেরিটির আবার ছিল ডায়েরি লিখবার অভ্যাস; তার ডায়েরি থেকেই জানা যায়, ‘বে অব বিস্ক’ পেরোতে না পেরোতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন লারউড, পেইন্টার আর মিচেল। জার্ডিন তার অধিনায়কত্ব ফলাতে শুরু করে দিয়েছিলেন সমুদ্রের ভেতরেই, সফর চলাকালীন কোনো অটোগ্রাফ দেয়া যাবে না বলে সমন জারি করেছিলেন। ক্রিকেটারদের প্রতি তার খেয়ালের মাত্রা বোঝা যায় রৌদ্রের নিচে টানা ২০ মিনিটের বেশি না থাকার নির্দেশনায়, সময়ে সময়ে তিনি খেলার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনাও করছিলেন সতীর্থদের সাথে। ফিটনেস সেশন চলেছিল নিয়মিত, জাহাজের ডেকে ক্রিকেটও খেলা হয়েছিল কখনো কখনো। আর যারা একটুু-আধট পান করতেন, তাদের পানাভ্যাস বজায় ছিল সমুদ্রেও। শুরুর দিকের হোমসিকনেস কাটিয়ে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররাও সহজ হতে শুরু করেছিলেন ধীরে ধীরে। সমুদ্রের জল-হাওয়া, মাউন্ট ভিসুভিয়াস, কিংবা পিরামিড – চোখের সামনে আসা প্রতিটি দৃশ্যই তারা গিলেছিলেন মুগ্ধ চোখে; যা দেখে অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক রেগ উইলমোট বলছেন,
“ইংলিশ ক্রিকেটাররা যেন কোনো সুখী ভ্রমণদলের ছবি। সামনে যা-ই পড়ছে, স্কুলপড়ুয়া ছেলেদের মতোই যেন অবাক হয়ে গিলছে। জাহাজের বাদবাকি যাত্রীদের মধ্যেও তারা জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছেন।”
ফ্রান্সের তুলোন, ইতালির নেপলস হয়ে সুয়েজ খাল, তারও পরে পোর্ট সাঈদ হয়ে লোহিত সাগর, আরব সাগর পেরিয়ে অক্টোবরের ৮ তারিখে জাহাজ পৌঁছেছিল সিলনে (বর্তমান শ্রীলংকা)। সেখানে নেমে কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে এমসিসি স্কোয়াড একদিনের ম্যাচ খেলেছিল অল সিলন একাদশের সঙ্গে। খেলার চাইতে পৃথিবীর এ প্রান্তে থাকা ব্রিটিশদের আতিথ্য নেওয়াই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য, বহুদিন বাদে শক্ত জমিতে নেমে ইংলিশ ক্রিকেটাররাও যেন ফেরত পেয়েছিলেন নবজীবন।
গল ফেস হোটেলে গভর্নর স্যার গ্রায়েম থমসনের আতিথ্য নেওয়া শেষে জাহাজ চলতে শুরু করেছিল আবারও। জাহাজ অস্ট্রেলিয়ায় ভিড়েছিল বিলেত ছাড়ার ৩১ দিন বাদে।
এবারে, যুদ্ধ হলো শুরু!
***
হার্বার্ট সাটক্লিফ যখন ওয়াকায় সফরের প্রথম বল খেলতে তৈরি হচ্ছিলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থাটা কেমন ছিল? এক কথায়, শোচনীয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পুরো বিশ্বই পড়েছিল ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর থাবায়। বাদ যায়নি অস্ট্রেলিয়াও, মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৯ শতাংশই তখন বেকারত্বের শিকার। ইংল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চড়া সুদে ঋণ নিতে হচ্ছিল তাদেরই কাছ থেকে। অর্থনীতিতে ধসের প্রভাব পড়ছিল রাজনৈতিক-সামাজিক-পারিবারিক সবখানে। রাজ্য আর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে বিবাদ চলছিল জোরেশোরে, ফুলেফেঁপে উঠছিল দেউলিয়া হবার হার। পুলিশ আর বেকারদের মাঝে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছিল নিত্যকার ঘটনা, আন্দোলন চলছিল সিডনি, অ্যাডিলেড, মেলবোর্ন সর্বত্র।
এত সব অরাজকতার মধ্যেও পুরো দেশ এক মোহনায় মিলেছিল একটি নামে। ৫’৭” ফুটের মানুষটি যেন দায় নিয়েছিলেন সমস্ত অস্ট্রেলিয়ানের না পাওয়ার বেদনা ভোলানোর। এমনকি ক্রিকেট যাদের জীবনে ছিল দূর আকাশের তারা, সেই মানুষগুলোও যেন তৃপ্তি খুঁজে নিয়েছিলেন তার সাফল্যে। জ্যাক ও’হাগানের গান তখন ফিরছিল অস্ট্রেলীয়দের মুখে মুখে। ‘আওয়ার ডন ব্র্যাডম্যান’, অস্ট্রেলিয়ানদের ডন ব্র্যাডম্যান। আর ডন যেহেতু ক্রিকেট খেলেন, ভালোবাসার খানিকটা ভাগ পেয়েছিল ব্যাট-বলের খেলাটিও।
অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিকেট খেলা রেডিওতে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল সেই ১৯২৫ সালে। কাকতালীয়ভাবে, পুরো ম্যাচের ধারাবিবরণী সরাসরি সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের অ্যাশেজ দিয়েই। দিনের খেলা শেষে খেলা নিয়ে রেডিওতে নিজেদের মন্তব্য জানিয়ে যেতেন ক্রিকেটাররা, এমনকি মাঠের বাইরে বসে থাকাকালীন খেলা নিয়ে একটি অনুষ্ঠানও করেছিলেন ব্র্যাডম্যান। অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩২ সালের জুলাইর পহেলা দিনে, রেডিওর জনপ্রিয়তাও অস্ট্রেলিয়ায় বাড়তে শুরু করেছিল সে সময়েই। একটি রেডিও কিনতে যে খরচ পড়ত, তা ছিল বেশিরভাগ অস্ট্রেলিয়ানের তিন সপ্তাহের বেতনের সমান। তবুও রেডিও মানে মাঠে না গিয়েও মাঠে থাকা, এই লোভে পড়ে বহু বেকারও কিনে ফেলেছিল রেডিও। জার্ডিনের দলের কীর্তিকলাপ যে গোটা অস্ট্রেলিয়ায় ক্ষোভের অনল জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তাতে খেলাগুলো রেডিওতে সম্প্রচার হবার ভূমিকাই ছিল সবচাইতে বেশি।
***
ইংলিশ দলের জাহাজ ভিড়েছিল পশ্চিম পাড়ের পার্থে। দেশের বাকি রাজ্যগুলোর সঙ্গে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার দূরত্ব তখনও পাঁচদিনের রেলভ্রমণ, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাই রাজ্যটির নাম তখনো ওঠেনি। তবে ইংল্যান্ড অবশ্য অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে প্রথম দু’টি ম্যাচ খেলেছিল ওয়াকাতেই। জার্ডিন যে যুদ্ধজয়ে এসেছেন, তা বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন এখান থেকেই।
পার্থের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পূর্বপারের রাজ্যগুলোর সময় ব্যবধান ঘন্টাতিনেকের। সফরে প্রথম ম্যাচের আগে ক্লড করবেট তাই অনুশীলনের মাঝেই জানতে চেয়েছিলেন ওয়াকায় হতে যাওয়া ম্যাচ নিয়ে জার্ডিনের ভাবনা। তিনি তো জানানইনি, উল্টো করবেট তাকে সময় পার্থক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বলেছিলেন,
‘তাদের অপেক্ষা করতে বলো।’
প্রথম তিনদিনের ম্যাচের দ্বিতীয় দিন ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে, ফলপ্রাপ্তির আশা তাই ছিল না। পতৌদি খেলেছিলেন ১৬৬ রানের ইনিংস, লারউডও বল করেছিলেন নিয়ন্ত্রিত লাইনে। তবে টেডি মার্টিনের কথা মানলে পুরো সিরিজে কী হতে চলেছে তার আভাস মিলেছিল বোয়েসের হাতে।
রাজ্য দলের অধিনায়ক ডিক ব্রায়ান্ট তার বলের আঘাতে নীল হয়ে গিয়েছিলেন বলেই দাবি করেছিলেন মার্টিন। জার্ডিনের সঙ্গে গ্যালারিতে ভিড় করা অস্ট্রেলিয়ানদের রেষারেষির সূত্রপাতও এই ম্যাচেই, যা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল পরবর্তী পাঁচ মাস জুড়েই। দর্শকদের কথা বললে অবশ্য ওয়াকায় দ্বিতীয় ম্যাচের কথাই বলতে হয়। সেই তিনদিনের ম্যাচের প্রতিদিনই দর্শক উপস্থিতি ছিল দশ হাজারের বেশি, তৃতীয়দিন যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বিশের কোটা। ‘সম্মিলিত অস্ট্রেলিয়ান একাদশ’ নামের আড়ালে সে ম্যাচে যে খেলেছিলেন ব্র্যাডম্যান!
লারউড আর ভোস সে ম্যাচে খেলেননি। টেস্ট হোক কিংবা প্রদর্শনী ম্যাচ, ব্র্যাডম্যানকে সামনে পেলেই তার শরীর বরাবর তারা অগ্নিবাণ ছুঁড়তেন কি না, তা-ও তাই জানা হয়নি। তবে ফিঙ্গলটন দাবি করেছিলেন, সে ম্যাচে নাকি গাবি অ্যালেনের বল খেলতেও ডন ভয় পাচ্ছিলেন। দর্শকদের হতাশায় ফেলে ব্র্যাডম্যান দশ রান পেরোতে পারেননি কোনো ইনিংসেই, অস্ট্রেলিয়ান একাদশও পারেনি ফলোঅন এড়াতে। যদিও জার্ডিন কোন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন কে জানে, তৃতীয় দিনের বেশিরভাগটা জুড়েই বল করিয়েছিলেন লেল্যান্ড-পেইন্টার-অ্যামিসকে দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ান একাদশ তাই বাঁচিয়ে ফেলেছিল ম্যাচ, অবশ্য প্রদর্শনী ম্যাচে জয়-পরাজয়ের হিসেব কে-ই বা করে!
সিরিজের প্রথম টেস্টের আগে ইংল্যান্ড ম্যাচ খেলেছিল আরও তিনটি ম্যাচ, প্রস্তুতি ম্যাচের আবরণে যা পেয়েছিল প্রথম শ্রেণির ম্যাচের মর্যাদা। অস্ট্রেলিয়াতে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও চলছিল পুরোদমে। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচ খেলতে এমসিসির পরবর্তী গন্তব্য ছিল অ্যাডিলেড। সেখানে পৌঁছাতে তাদের ট্রেনে কাটাতে হয়েছিল পাঁচদিন, ভেরিটি যে রেলযাত্রাকে বলছেন ‘অস্বস্তিদায়ক’। নুরালবোরের ঊষর মরুভূমি পেরোনোর সময় নাকি ঘরে ফিরে যেতে মন চাচ্ছিল অনেকেরই। নিজেদের চাঙা রাখতে ‘সর্বকালের সেরা একাদশ’ নির্বাচনের খেলা চালু ছিল তখনও, সাথে টমি মিচেলের স্বভাবসুলভ রসিকতা তো ছিলই (এক স্বর্ণের খনির শ্রমিকের সঙ্গে রসিকতা করতে গিয়ে আরেকটু হলে প্রাণই হারাতে বসেছিলেন তিনি)।
সমস্ত ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে ইংল্যান্ড সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল নভেম্বরের চার তারিখ। বডিলাইন বোলিংয়ের তেমন কোনো প্রয়োগ ছাড়াই এমসিসি জিতেছিল ইনিংস ও ১২৮ রানে। তবে শোনা যায়, এই ম্যাচের মাঝে বিল বোয়েসের সঙ্গে ‘হয় অফ অ্যাটাক, নয় লেগ অ্যাটাক’ নিয়ে একপ্রকার দ্বন্দ্বই হয়ে গিয়েছিল জার্ডিনের। পুরো ট্যুরের মতো জার্ডিন যে সে ঝগড়াতেও জিতেছিলেন, তা তো পরবর্তীতে বোয়েসের জার্ডিনের গুণগ্রাহীতে রূপান্তর হওয়াই প্রমাণ করে।
এমসিসির পরবর্তী গন্তব্য ছিল মেলবোর্ন। সেখানে প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল ভিক্টোরিয়া রাজ্য দল, যাদের সঙ্গে এমসিসি পায় আরেকটি ইনিংস ব্যবধানে জয়ের দেখা। নভেম্বরের ১৮ তারিখ থেকে শুরু হওয়া ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়ান একাদশ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বডিলাইন প্রথমবারের মতো আলোয় আসে এ ম্যাচেই।
জার্ডিন সে ম্যাচে খেলেননি, বিল ও’রাইলি যাকে পরবর্তীতে জার্ডিনের ধূর্ত পরিকল্পনার এক অংশ বলেই আখ্যা দিয়েছেন। যদি ব্র্যাডম্যান সেঞ্চুরি করে ফেলেন, কিংবা বডিলাইন বুমেরাং হয়ে ফেরে, এসব শঙ্কায় ম্যাচ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন জার্ডিন – এমন দাবিই ছিল ও’রিলির। ম্যাচে জার্ডিনের বদলে অধিনায়কত্ব করেছিলেন বব ওয়াইট। তবে বোলারদের যেহেতু নির্দেশনা দেয়া ছিল আগে থেকেই, লারউড-ভোস-বোয়েস শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়ে সে ম্যাচে বল ছুঁড়েছিলেন লেগস্ট্যাম্পে কিংবা তার ওপরে। সে ম্যাচের বোলিং নিয়ে ওয়াইট পরবর্তীকালে বলেছিলেন,
“ম্যাচের কিছু সময় আমরা লেগ-থিওরির প্রয়োগ করেছিলাম, যদিও এর পরের ম্যাচগুলোর মতো অমন রূঢ়ভাবে নয়।”
‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার’ এ ম্যাচে এমসিসির ফিল্ড-সেটিংকে আখ্যা দেয় ‘a fan-shaped back wicket field’ বলে। রান করবার চাইতে নিজেদের মাথা বাঁচাতেই বেশি মনোযোগী হতে হয়েছিল ব্যাটসম্যানদের বলেও জানা যায় তাদের প্রতিবেদন থেকে। আর্থার মেইলির কাছ থেকে জানা যায়, লারউডের বল উডফুলের বুকের কাছে আঘাত করেছিল বেশ কয়েকবার। ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিংই অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিল সবচাইতে বেশি। প্রথম ইনিংসে ৩৬ রান করলেও প্রতি বলেই তার ব্যাঙলাফ দেখে হতচকিত হয়েছিলেন দর্শকেরা। হবস যদিও ইংল্যান্ডের এই আক্রমণের বিরোধী ছিলেন, তবুও তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এই বডিলাইন বোলিংই ব্র্যাডম্যানের খেলাকে বোতলবন্দী করে দিতে পেরেছিল।
দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৬০ রানে অলআউট হলেও, কিংবা চারদিনের ম্যাচ বৃষ্টির বদান্যতায় বেঁচে গেলেও ব্র্যাডম্যানকে বশ করবার মোক্ষম অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে ভেবে জার্ডিন নিশ্চয়ই তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন ম্যাচশেষে। বব ওয়াইট তো পুতুলমাত্র, এই ম্যাচ দিয়েই বডিলাইন বোলিংয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবার কারিগর তো তিনিই ছিলেন!
লারউডের বিধ্বংসী বোলিং নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল এরপরই। ডন ব্র্যাডম্যান বোর্ডের কর্তাদের জানিয়েছিলেন, মেলবোর্নে ইংল্যান্ড দল তাদের গা তাক করে বল ছুঁড়েছে। তাকে অবাক করে দিয়ে এসিবির পদস্থরা জবাব দিয়েছিলেন, তাদের মনে হয় না যে ইংলিশ বোলাররা এমন কিছু করেছেন।
‘আরগাস’ পত্রিকায় এ ম্যাচের পরই রেজ উইলমট লিখেছিলেন লারউডের ভয়ংকর বোলিং নিয়ে। ডেভিড ফ্রিথকে লেখা পার্সি টেলরের চিঠিতে জানা যায়, আর্টিকেল প্রকাশের পরদিন সকালে উইলমটের কাছে এসে ‘অধিনায়কের নির্দেশে এমন বোলিং করছি’ বলে জানিয়ে গিয়েছিলেন লারউড। ৯৫-১০০ মাইল গতিতে শরীর লক্ষ্য ছুটে আসা বল কীভাবে একজন ব্যাটসম্যান খেলবে, তা নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন অনেকে। লারউড অবশ্য বিশ্বাস করতেন, ডন ব্র্যাডম্যান একটি না একটি উপায় ঠিকই বের করে নেবেন।
ব্র্যাডম্যান লারউডের বোলিংয়ের অ্যান্টিডোট বের করতে পেরেছিলেন কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি সিরিজের তৃতীয় টেস্টের আগে। নাটকে ভরা এক সিরিজে বাড়তি মশলা মিশিয়েছিলেন ওই বেঁটে-খাটো মানুষটা।