Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বডিলাইনের ব্যবচ্ছেদ: চতুর্থ পর্ব

ক্রিকেট নিয়ে ও’ব্রায়েন কোনো ধরনের মোহাচ্ছন্নতায় ডুবে থাকলে তা খুব সম্ভবত কেটে গিয়েছিল প্রথম ইনিংসেই। অভিষেক ইনিংসেই তার ৪৭ বলে ১০ রানের ইনিংসকে কোথায় বরণ করে নেবে, উল্টো দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি আউট হতেই এমসিজিতে সেদিন উপবিষ্ট রেকর্ড ৬৩,৯৯৩ দর্শক ফেটে পড়েছিল উচ্ছ্বাসে। দর্শকদেরই বা দোষ দিই কি করে, চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামবার কথা ছিল যে তাদের ডনের। ব্র‍্যাডম্যান ক্রিজে এসে পৌঁছুলে, গ্যালারির উল্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে সাটক্লিফ তাই বলেছিলেন, ‘দারুণ অভ্যর্থনা, ডন।’ দার্শনিক বনে গিয়ে ব্র‍্যাডম্যান যার প্রত্যুত্তর করেছিলেন, ‘যাবার বেলায়ও কি একইরকম থাকবে?’

কে জানে, বিধাতা ব্র‍্যাডম্যানকে ভবিতব্য আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কি না! গ্যালারির হর্ষধ্বনি কমেনি মিনিট পাঁচেকের আগে, বিল বোয়েস এর মাঝেই বল করতে এসে ফেরত গিয়েছিলেন দু’বার। স্নায়ুক্ষয়ী সে সময়ে বোয়েস এসেছিলেন আরেকবার, একদম চাওয়ামতো না হলেও সফল হয়েছিলেন বল করতে, শর্ট লেংথে পড়া সে বল অফে সরে গিয়ে ব্র‍্যাডম্যান চেয়েছিলেন হুক করতে। স্নায়ু নিশ্চিত করেই ছুঁয়ে গিয়েছিল তাকেও, ব্যাটের নিচের কানায় লেগে বল ছুটেছিল স্ট্যাম্পের দিকে, রেডিওতে কান পাতা লক্ষ শ্রোতা শুনেছিলেন দুটি মাত্র শব্দ, ‘He’s OUT.’

প্রত্যাশাভঙ্গের সেই মুহূর্ত; Image source: Bodyline Autopsy

মুহূর্তের মাঝে এত পটপরিবর্তন সামলে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সবাই। জার্ডিন তার ক্রিকেটীয় জীবনে যে একবারমাত্র অপারগ হয়েছিলেন নিজের আবেগ সামলে নিতে, সে ক্ষণটি হয়েছিল তখনই। দু’হাত তুলে তিনি যেন নেচে উঠেছিলেন যুদ্ধজয়ী সৈনিকের মতো। হতবিহ্বল হয়ে বোয়েস তাকিয়ে ছিলেন আম্পায়ারের দিকে। সাধের রেডিও ভাঙা গিয়েছিল অনেক পরিবারে। এমসিজির গ্যালারি তখন যেন কেওড়াতলা শ্মশানঘাটের রেজিস্ট্রার ঘরের সামনের চাতাল, চোখের সামনে যেন চলছে প্রিয়জনের শব পোড়ানোর আয়োজন।

***

সিডনির পর মেলবোর্নেও হার মানে সিরিজ খোয়ানোর নিশ্চিন্তি। বিল ও’রাইলি তাই ফিল্ডিং করতে নেমেছিলেন আম্পায়ারকে তার চোখ-কান ঠিক আছে কি না জিজ্ঞাসা করতে করতে। হতচকিত আম্পায়ার উত্তর দেবার আগেই ও’রাইলি দিয়েছিলেন ব্যাখ্যা,

“দুটোরই দরকার হবে। আমি আজ উইকেট নিতে নেমেছি।”

ও’রাইলি যে মিথ্যে আস্ফালন করেননি, তা তো স্কোরকার্ডে চোখ বুলালেই পরিষ্কার হয়। এমসিসির প্রথম ইনিংসে পাঁচ ব্যাটসম্যান উইকেট দিয়েছিলেন ও’রাইলিকে, ৩৫ ওভার বল করেও ওভারপ্রতি রান খরচ করেছিলেন দুইয়ের কম। শুধু পরিসংখ্যান কপচালে অবশ্য সেদিনের ও’রাইলির সামান্যই জানা হয়। টপ স্পিনের সঙ্গে দুর্দান্ত গুগলি, ব্যাটসম্যানের ফুটওয়ার্কের চরমতম পরীক্ষা নেওয়া দ্রুতগতির লেগস্পিন, সাথে ক্ষণে ক্ষণে বিভ্রান্তিতে ফেলা স্লোয়ার বল, কবজি ঘোরানো বলকে শিল্প বলা যে কবির কল্পনা নয়, ও’রাইলি যেন তারই প্রমাণে নেমেছিলেন।

ও’রাইলিকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন ক্ল্যারি গ্রিমেট আর আয়রনমঙ্গার, দু’জনে ওভারপ্রতি রান দিয়েছিলেন যথাক্রমে ১.৩১ আর ২.০০। অফ-ফিল্ড নিয়ে লেগ-থিওরির সফল প্রয়োগ করেছিলেন ওয়ালও, নিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ৪ উইকেট। সেবারের সফরে এলবিডব্লিউর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন ওয়াইট, ও’রাইলির বলে তিনি সংশয়াতীত এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়তেই ইংল্যান্ড ৩০ রানে হারিয়েছিল প্রথম উইকেট। যে হ্যামন্ড ছিলেন ইংল্যান্ডের আশা-ভরসার কেন্দ্রে, সেই হ্যামন্ডও ৮ রানের পরে আর আটকাতে পারেননি ওয়ালের আচমকা ভেতরে ঢোকা নিচু হওয়া বলটিকে। পতৌদি চেষ্টা করেছিলেন স্বভাবজাত রক্ষণাত্মক খেলায় টিকে থাকবার, অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডারদের বদান্যতায় তার সঙ্গে টিকে গিয়েছিলেন সাটক্লিফও। তবে পতৌদির রক্ষণ প্রাচীর ভেদ করতে ও’রাইলির লাগেনি ৭৮ বলের বেশি, ম্যাককেব সহজ ক্যাচ হাতছাড়া করলেও ৩০ রানে দাঁড়ানো অবস্থায় ওল্ডফিল্ড স্ট্যাম্পিং করতে ব্যর্থ হলেও সাটক্লিফও করতে পারেননি ৫২-য়ের বেশি। জন ওয়ারেল যে ইনিংস দেখে বলেছিলেন, ‘আমার দেখা সবচেয়ে বাজে টেস্ট অর্ধশতক।’ জার্ডিনও পারেননি অধিনায়কোচিত কোনো ইনিংস খেলতে। ফলাফল, ইংল্যান্ড পাঁচ উইকেট হারিয়েছিল ১০৪ রানে, ‘নিউ ইয়ারস ইভ’ আসতে আসতে খুইয়ে ফেলেছিল ৯ উইকেট, অস্ট্রেলিয়ার চাইতে তখনো তারা পিছিয়ে ৬৮ রানে। মাঝে রবিবারের বিশ্রান্তি দিনের পর ইংল্যান্ড টিকেছিল সামান্যই, সোমবার সকাল-সকালই ভোস ক্যাচ দিয়েছিলেন গ্রিমেটের বলে, দ্বিতীয় ইনিংস অস্ট্রেলিয়া শুরু করেছিল ৫৯ রান এগিয়ে থেকে।

রবিবারকে ‘রেস্ট ডে’ বলাটা অবশ্য ভুলই হয়েছে, সবার যে সেদিন ছুটি মেলেনি। শোনা যায়, স্বাগতিক হবার সুবিধা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যেন পিচে কোনোরূপ কারচুপি না করতে পারে রবিবারে, এজন্যে জারডিনের হুকুমে নববর্ষের দিনে সর্বক্ষণ একজন চর বসে ছিলেন ইংল্যান্ডের সাজঘরে।

***

এমসিজিতে শনিবারে দর্শক উপস্থিতি পড়ে গিয়েছিল বেশ। আগের দিন তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক হয়েছিল শতাধিক দর্শকের, এই ভয়েই বোধহয়। তবে মূল কারণ, সেদিন ব্র‍্যাডম্যান ব্যাট করেননি।

সোমবারে ব্র‍্যাডম্যানের ব্যাটিং করবেন, এমন সম্ভাবনা জাগতেই দর্শক উপস্থিতি চড়ে গিয়েছিল চকিতে। দিনের খেলা শুরু হবার ঘন্টাতিনেক আগে থেকেই স্টেডিয়াম ফটকে দেখা গিয়েছিল হাজার বিশেক দর্শকের আনাগোনা। শনিবারের দর্শক উপস্থিতির রেকর্ড লেখা হয়েছিল নতুন করে; ৬৮,২৩৮ জন মানুষ সেদিন জায়গা পেয়েছিল স্টেডিয়ামে। আর গ্যালারিতে ঠাঁই না পেয়ে বেশ কিছু অস্ট্রেলীয় চড়ে বসেছিল গাছের ডালে। চাইলে বিনা টিকেটে খেলা দেখা যায় সেখান থেকেও।

মেলবোর্নে রেকর্ড-গড়া দর্শক উপস্থিতি; Image source: Bodyline Autopsy

প্রথম ইনিংসে নিরাশ করেই বোধকরি দ্বিতীয় ইনিংসে বাড়তি কিছু করবার তাগিদ ছিল ব্র‍্যাডম্যানের। অস্ট্রেলিয়া দুই উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল ইনিংসের শুরুতেই, ফিঙ্গলটন আর লিও ও’ব্রায়েন দলকে টেনে নিয়ে যেতে পারেননি ২৭ রানের বেশি। সাড়ে ৮৫ ওভার ফিল্ডিং করে ব্র‍্যাডম্যানকেও তাই মাঠে ফিরতে হয়েছিল অল্প বিরতিতেই। ক্রিজে এসে গার্ড নিতে নিতে তার ঠোঁটে খেলে গিয়েছিল হাসির রেখা, হ্যামন্ড যা স্মরণ করে পরবর্তীতে লিখেছিলেন,

‘আমি তখনই বুঝেছিলাম, তাকে এবারে আর ফেরানো যাচ্ছে না।’

লারউড লেগ-ফিল্ডে চলে গিয়েছিলেন তাকে নামতে দেখেই, পয়েন্টের সামনে তো কোনো ফিল্ডারই ছিল না ব্র‍্যাডম্যানের ইনিংসের শুরুতে। দর্শকমনে স্বস্তি ফিরিয়ে ব্র‍্যাডম্যান প্রথম বল খেলেছিলেন নির্লিপ্তভঙ্গিতে, প্রথম ইনিংসের হন্তারক বোয়েসকে হুক করে মেরেছিলেন প্রথম চার। উডফুলকে সাথে নিয়ে সামাল দিয়েছিলেন প্রাথমিক বিপর্যয়ের, পরবর্তীতে রিচার্ডসনকে সাথে নিয়ে দলের লিডকে টেনে নিয়েছিলেন ২০০-র কাছে। লক্ষ্য হিসেবে একেই ভাবা হচ্ছিল যথেষ্ট, এমসিজির সেবারের ক্ষতবিক্ষত পিচের সুবিধা নিতে অস্ট্রেলিয়ার তিন স্পিনার তো ছিলেনই।

বুড়ো রিচার্ডসন ডনকে সঙ্গ দিয়েছিলেন বেশ আঘাত সয়ে, লারউডের বল উরুতে লাগলে একবার শুশ্রূষা নিতে যেতে হয়েছিল মাঠের বাইরেও। হ্যামন্ডের চতুর স্পিনে তিনি ফিরেছিলেন ৩২ রানে, প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যান খুইয়ে অস্ট্রেলিয়ার ২য় ইনিংসে সংগ্রহ তখন ১৩৫, শেষের পাঁচ ব্যাটসম্যান মিলে তুলেছিলেন মোটে নয় রান।

কিন্তু অপরপ্রান্তে ব্র‍্যাডম্যান তো ছিলেন। তৃতীয় দিনের মধ্যাহ্ন-বিরতির পরের সেশনে তিনি তুলেছিলেন ৫২ রান, চা-বিরতিতে গিয়েছিলেন ৭৭ রানে। গোটা দেশ তখন দু’হাত জড়ো করে ব্র‍্যাডম্যানের শতকের প্রার্থনায় মত্ত। তৃতীয় সেশনে খেলা শুরু হলে চকিতে ব্র‍্যাডম্যান পৌছে গিয়েছিলেন ৯৬-তে, লারউডের ওভারেও একবার নিয়েছিলেন ৯ রান। কিন্তু ওদিকে তো উইকেটের পতনও তো হচ্ছিল সমানে। ওয়ালের পরে ও’রাইলিও যখন ফিরেছিলেন এলবিডব্লিউ হয়ে, ব্র‍্যাডম্যান আর সেঞ্চুরির দূরত্ব তখনও দুই রানের। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আয়রনমঙ্গার এসেছিলেন ক্রিজে, তর্কসাপেক্ষে ইতিহাসের সবচাইতে বাজে ব্যাটসম্যান উপাধি তার নামের পাশেই সাঁটানো চলে।

আয়রনমঙ্গার ব্র‍্যাডম্যানকে নিরাশ করেননি, হ্যামন্ডের দুটো বল পার করে দিয়ে ব্র‍্যাডম্যানকে এনেছিলেন স্ট্রাইকে। ওসব মাইলফলক, দর্শকদের তার সেঞ্চুরিপ্রাপ্তির জন্যে প্রতীক্ষা, হাজারো প্রার্থনা তার ভেতরে যে উত্তেজনার ঢেউ খেলায় না, তা বোঝাতেই যেন শতক পূর্ণ করেছিলেন ভোসের পরের ওভারের শেষ বলে। বডিলাইন-ফিল্ডের ওপর দিয়ে ফাঁকা মিড উইকেটে বল ঠেলে উইকেটের এ মাথা-ও মাথা করেছিলেন তিনবার; ব্র‍্যাডম্যান পৌঁছেছিলেন ১০১ রানে। সে সেঞ্চুরি নিয়ে সর্বশেষ পাঁচ টেস্টেই ব্র‍্যাডম্যান পেয়েছিলেন শতকের দেখা।

ব্র‍্যাডম্যান নিরাশ করেন না, দুই ইনিংসে তিনি ব্যর্থ হতেন না;  Image source: Bodyline Autopsy

ম্যাচ শুরুর আগে বডিলাইন বোলিং মোকাবিলায় যে পরিকল্পনা এঁটেছিলেন, তার প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল যথাযথ। যদিও সেদিনের শতকের মাত্র এক-চতুর্থাংশ রানই এসেছিল অফসাইডে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট এর চাইতে কম রানের দলীয় সংগ্রহে (১৯১) ব্যক্তিগত শতক দেখেনি কোনোকালে। একপ্রান্তে তিনি তুলেছিলেন ১০৩, সে সময়ে বাদবাকি ব্যাটসম্যানরা মিলে তুলেছিলেন মোটে ৬১।

অবশ্য এই খণ্ড খণ্ড পরিসংখ্যান ওই তিন ঘণ্টার সুযোগছাড়া আক্রমণাত্মক শতকের কতটুকুই বা বোঝাতে পারে! তার চাইতে বরং জন ওয়ারেলের উক্তিই তুলে দেয়া ভালো। ভিক্টর ট্রাম্পারের কোনো সতীর্থ যদি কোনো ইনিংস দেখে বলেন, ‘এর চাইতে নিখুঁত শতরান কেউ করেনি’, তখন তো তাকে আলাদা মূল্য দেওয়াই লাগে!

***

২৫১ রানের লক্ষ্য পেয়ে তৃতীয় দিন শেষ বিকেলে এমসিসি ব্যাট করেছিল ৪৫ মিনিট। ইতিবাচক সূচনার আশায় জার্ডিন ক্রিজে পাঠিয়েছিলেন সাটক্লিফ আর লেল্যান্ডকে, দু’জনে মিলে চাওয়ামতো শুরু এনেও দিয়েছিলেন। অবিচ্ছিন্ন ৪৩ রান তুলে তারা দু’জনেই দিনের খেলা শেষ করবার পর ফেভারিট মানতে হচ্ছিল ইংল্যান্ডকেই।

কিন্তু চতুর্থ দিন সকালেই পাশার দান গিয়েছিল বদলে। আগের রাতের সংগ্রহে কিছু যুক্ত হবার আগেই, সাটক্লিফের রক্ষণ চিড়ে ও’রাইলি খুলেছিলেন আলিবাবার দরজা, আম্পায়ার জর্জ হিলি যে বলকে বলেছেন ‘The best I’ve seen’!

ও’রাইলির ভেলকিবাজি; Image source: Bodyline Autopsy

সে আউটের পর স্কোরবোর্ডে ৭০ তুলতে ইংল্যান্ড হারিয়েছিল আরও তিন উইকেট। একশো পেরোতে না পেরোতেই এমসিসির মূল ভরসা হ্যামন্ডকে তুলে নিতেই নিশ্চিত হয়েছিল, এই ম্যাচ আর অস্ট্রেলিয়া হারছে না।

শেষ প্রতিরোধ অবশ্য এসেছিল এরপরেও। অ্যালেন আর ওয়াইট জোট গড়েছিলেন পঞ্চাশ রানের। এলবিডব্লিউর সঙ্গে ওয়াইটের রোমান্সের কথা তো বলা হয়েছে আগেই, সেই আউটেই সমাপ্তি ঘটেছিল এই জুটির। এর পরপরই তিন উইকেট তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছিল চতুর্থ দিন মধ্যদুপুরেই।

ম্যাচ শুরুর আগে যে উডফুলকে অধিনায়ক রাখা হবে কি হবে না তা নিয়ে চলেছিল বিস্তর জল্পনা, এমনকি যেজন্যে টসও অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের বেশ পরে। চারদিন ব্যবধানে সেই উডফুলকে নিয়েই স্লোগান উঠেছিল এমসিজির গ্যালারিতে। ম্যাচ শেষ হবার ঘন্টাখানেক পরেও গ্যালারি ফাঁকা হচ্ছে না দেখে অন্তর্দহনে জ্বলতে থাকা জার্ডিন বলেছিলেন,

‘তোমরা তো জিতেছো। তাহলে চলে যাচ্ছো না কেন?’

ডন ব্র‍্যাডম্যান অবশ্য খেলা শেষে সঙ্গে সঙ্গেই চলে গিয়েছিলেন তার রেডিওর দায়িত্ব সারতে। খেলা নিয়ে সোজাসাপ্টা মন্তব্য করলেও ইংল্যান্ডের বোলিং নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি তিনি। যা করবার, দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। মেলবোর্ন টেস্ট শেষ হবার পরদিন প্রকাশিত ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় হোর‍্যাস হিল লিখেছিলেন,

“ইংল্যান্ডের বোলিংয়ের লক্ষ্য স্ট্যাম্প নয়, বরং তারা বল করছে ব্যাটসম্যানদের শরীর বরাবর; যেন ব্যাটসম্যানরা নিজেদের শরীর বাঁচাতে অথবা রান করতে ক্যাচ তুলে দেয়। লেগ-ট্র‍্যাপ থিওরির এমন বীভৎস প্রয়োগ… ক্রিকেট এরকম কিছু আগে দেখেনি।”

এবং অ্যাডিলেডের অগ্নুৎপাতও পৃথিবী তখনো দেখেনি।

***

পিয়ের হোটেল, এখানেই উঠেছিল ইংলিশ শিবির; Image Credit: Wikimedia Commons

গির্জার শহরে ক্রিকেটের উৎসব বসেছিল জানুয়ারির ১৩ তারিখে। উৎসবে যোগ দিতে গাড়িতে, রেলে আর নৌপথে হাজারে হাজার মানুষ ছুটেছিল অ্যাডিলেডের পানে। মেলবোর্ন থেকে অ্যাডিলেডগামী এক্সপ্রেস ট্রেন তখন যাতায়াত করতো দিনে চারবার, ম্যাচ শুরুর আগের সপ্তাহে প্রতিবারই এর যাত্রা ছিল ‘হাউজফুল’। ওয়েস্ট্রেলিয়া, মানুন্ডা কিংবা কাতুম্বার মতো স্টিমারগুলো পোর্ট অ্যাডিলেডে নোঙর করছিল যাত্রীতে টইটুম্বুর হয়ে। গ্রীষ্মকালের দরুন তাপমাত্রা তখন এমনিতেই বেশি, আশেপাশে লোকে গমগম অবস্থা যেন সে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল আরও।

তাপমাত্রা চড়েছিল পিয়ের হোটেলেও, ম্যাচ খেলতে ইংলিশ শিবির অবস্থান করছিল যেখানে। মেলবোর্নের ম্যাচ হেরে এমনিতেই তখন কোণঠাসা এমসিসি, ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে চিঠিপত্তরও আসতে শুরু করেছিল জার্ডিনের নামে। সিরিজজুড়ে দর্শকদের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে থাকা জার্ডিন অ্যাডিলেডে খেলেছিলেন আরেক দান, এবারে এমসিসির অনুশীলন দেখতে আসা দর্শকদের সামনে ঝুলিয়েছিলেন ‘নো এন্ট্রি’ বিজ্ঞপ্তি। জার্ডিনের এমন উদ্ধত আচরণের সুযোগ নিয়ে ছড়াতে শুরু করেছিল নানা কল্পকাহিনী। এক সাপ্তাহিক পত্রিকা দাবি করেছিল, ‘মরিস টেট জার্ডিনকে বিয়ারের বোতল ছুঁড়ে মেরেছেন।’ টেট যে অভিযোগের অসাড়তা প্রমাণে পরবর্তীতে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে সময় তারা দু’জনে ৬০ মাইল দূরত্বে ছিলেন।

লারউডের সঙ্গে জার্ডিনের কলহের খবরটি অবশ্য সম্পূর্ণ গুঞ্জন নয়। বাঁ-পায়ে জখম নিয়েও মেলবোর্নের কাঠফাটা রোদ্দুরে লারউড করেছিলেন ৩৫ ওভার। এমসিজি টেস্ট শেষে লারউড তাই আশা করেছিলেন খানিক বিশ্রামের। তাকে অবাক করে দিয়ে জার্ডিন তাকে রেখে দিয়েছিলেন এক প্রদর্শনী ম্যাচের দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে, যা নিয়ে জার্ডিনের সঙ্গে একপ্রস্ত বসচাও হয়ে গিয়েছিল লারউডের। ভুল বুঝতে পেরে জার্ডিন তাই ফন্দি এঁটেছিলেন, বেন্ডিগোর প্রদর্শনী ম্যাচে ভিক্টোরিয়ান কান্ট্রি খেলবে তেরোজন নিয়ে, আর এমসিসি জবাব দেবে বারো জনের ব্যাটে। চ্যারিটি ম্যাচে খেলোয়াড় সংখ্যায় কী-ই বা যায় আসে!

গুজবের সে সময়ে সংবাদমাধ্যমে অবশ্য ভিন্ন কিছু এসেছিল। সতীর্থদের জন্য পানি টানতে অহমে বাঁধে লারউডের, অস্ট্রেলিয়ার পত্রপত্রিকা ছেয়ে গিয়েছিল এমন সব প্রতিবেদনে। ভাগ্যিস, সিরিজ চলাকালীন ক্যাঙারুর দেশে থাকা ইংলিশ সাংবাদিকেরা বিরত থেকেছিলেন এমন খবর পাঠানো থেকে; নয়তো লর্ডসে লারউডের সমন জারি হয়ে যেত সিরিজের নিষ্পত্তি হবার আগেই।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া প্রতিবেদনগুলো প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল জনমনে, আর রেডিওর কল্যাণে বডিলাইনের হল্কা তো টের পেয়েছিলেন তারাও। অ্যাডিলেডের চলতি পথে এমসিসির খেলোয়াড়দের দর্শকেরা হানছিলেন অগ্নিদৃষ্টি; লারউড শুনেছিলেন এমন কিছুও,

‘Mom, he (Larwood) doesn’t look like a murderer.’ 

‘ক্রিকেট ইজ ওয়ার মাইনাস শ্যুটিং’ — মাইক মার্কিসির এ কথাকে এমসিসির অধিনায়ক বেদবাক্য বানিয়ে নিয়েছিলেন সিরিজের শুরু থেকেই, ধীরে ধীরে যা সংক্রমিত হয়েছিল অজি-সমর্থকদের মাঝেও। ঘটনার ঘনঘটা আর নানা গুজবে সিরিজের দ্বিতীয় আর তৃতীয় টেস্টের মাঝের এগারো দিনকে নিশ্চয়ই এক মহাকাল মনে হয়েছিল এমসিসির ক্রিকেটারদের।

লারউডের জন্যে যে মহাকাল কখনো শেষ হয়নি।

***

অ্যাডিলেডের বিখ্যাত সেই টস; Image source: Getty Images 

কিউরেটর আলবি রাইটের গড়া পিচে আগুন ঝরবে, এমন কিছু ভাবতে কষ্টকল্পনাই করতে হতো এর আগে। ঐতিহ্যগতভাবে তো অ্যাডিলেইড ওভালের উইকেট ব্যাটসম্যানদের স্বর্গরাজ্যই ছিল। সিরিজে জার্ডিন টস জিতেছিলেন প্রথম এবং শেষবারের মতো, পিচ দর্শনের পরে বোলিং নেবার কোনো কারণ খুঁজে পাননি তিনি। তবে ঘণ্টাখানেক পরে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকলে, সে সুযোগ নিশ্চয়ই দু’হাতে লুফে নিতেন জার্ডিন।  

পরে নেমে রান পাচ্ছেন না, সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাই বহু আলোচনা-পর্যালোচনার পরে সাটক্লিফকে নিয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমেছিলেন জার্ডিনই। ওয়ালের হাত থেকে বেরোনো ম্যাচের চতুর্থ বলই আচমকা লাফিয়ে উঠে আঘাত করেছিল সাটক্লিফের কাঁধে, এরপরে ম্যাচজুড়ে অমন আঘাতের স্মৃতি জমা হয়েছে অসংখ্য।

প্রথম বিশ মিনিটে রান এসেছিল মাত্র চার, প্রথম সেশনে চার উইকেট হারিয়ে ৩৭। উপর উঠেও রান পাননি জার্ডিন, তার পিছু নিয়েছিলেন হ্যামন্ড, সাটক্লিফ আর অ্যামিসও। স্বল্পস্থায়ী ইনিংসেই ক্রমাগত শর্ট বলের মুখে পড়ে হ্যামন্ড নাকি রাগে গজরাতে গজরাতে বলেছিলেন,

‘এমন কিছুই যদি ভবিষ্যতের ক্রিকেট হয়, তবে আমি এর শেষ দেখে ফেলেছি।’

চিরকালীন শান্তমূর্তি ওয়াইট ছয় মারছেন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে; Image source: Bodyline Autopsy

মধ্যাহ্ন-বিরতির পরে কেউ রেডিও শুনতে শুরু করলে ভুলবার্তাই পৌঁছাত তার কাছে। সচরাচর সাবধানী ওয়াইট পর্যন্ত মেরেছিলেন তিন ছয়, লেল্যান্ডের সঙ্গে মিলে প্রতি আক্রমণে গড়েছিলেন ১৫৬ রানের জুটি, শুরুর ১০০ তুলতে সময় লাগিয়েছিলেন মাত্র দেড় ঘণ্টা।

মাঝে ধ্বস নেমেছিল আরেকবার, সিরিজে প্রথমবারের মতো সুযোগ পাওয়া পেইন্টার আর ভেরিটি মিলে আরেকটি জুড়ি গড়েছিলেন ৯৬ রানের। রানআউট-স্ট্যাম্পিং-ক্যাচ মিসের মহড়া, লেজের ব্যাটসম্যানদের প্রতিরোধ, সাথে অ্যাডিলেডের তীব্র রোদ, ততক্ষণে ইংল্যান্ডের ইনিংসকে বিভীষিকা মনে না হয়ে পারেই না অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের। পীড়নের মাত্রা বেশি গিয়েছিল ও’রাইলির ওপর দিয়েই, স্কোরকার্ডে পঞ্চাশ ওভার লেখা থাকলেও অসংখ্য নো-বলের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বল করেছিলেন এর চাইতেও ঢের বেশি।

ম্যাচের নিয়মিত দৃশ্য, বল করছেন ও’রাইলি; Image source: Bodyline Autopsy

আড়াই ঘণ্টার অকল্পনীয় এক ইনিংস খেলে ভেরিটি আউট হয়েছিলেন শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে। ভেরিটি করেছিলেন ৪৫, ৩০ রানে ৪ উইকেট থেকে এমসিসি ৩৪১।

সুপ্রিয় পাঠক, আমরা ‘বডিলাইন’ নাটকের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেছি।

This article is in Bangla language. This article is on the cricket's most sensational test series, 1932-33 ashes. Necessary images are attached inside.

Featured image © Getty Images

Background Image ©  Getty Images

Reference:

  1. David Frith; (2002); Bodyline autopsy: The full story of the most sensational test cricket series Australia vs England 1932-33 (1st ed.); Aurum Press Ltd, 74-77 White Lion Street, London N1 9PF; ABC Books for the Australian Broadcasting Corporation.
  1. Harold Larwood (Duncan Hamilton).Duncan Hamilton (2009); Harold Larwood (Paperback ed.); 21 Bloomsbury Square, London WC1A 2NS; Quercus.

Related Articles