১৮২০ সালের কথা। ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ চার্লস ম্যাসন দেশ-বিদেশে ঘুরছেন নানা প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের সন্ধানে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তিনি চলে এলেন ভারতবর্ষে। ঘাঁটি করলেন পাঞ্জাবের পশ্চিমে মন্টোগোমারি জেলায়। সেখানে তিনি ইরাবতী নদীর পূর্ব তীরে খুঁজে পেলেন এক বিশাল ঢিবি। পরবর্তীতে ম্যাসন তার বিভিন্ন লেখনীতে সেই ঢিবির প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তার ধারণা সত্যি ছিল; পরবর্তীতে জানা যায়, সেই ইরাবতীর তীরেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার এক অন্যতম নগরী, যার নাম ‘হরপ্পা’।
হরপ্পা নগরী আবিষ্কারের কাহিনী
তখন ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনকাল চলছে। ১৮৫৭ সালে, ব্রিটিশ রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়াররা করাচী ও লাহোরের মধ্যবর্তী ইস্ট ইন্ডিয়ান রেললাইন নির্মাণের জন্য রাস্তা তৈরির কাজ হাতে নেয়। সেসময়ই বিভিন্ন জায়গা খননকালে হরপ্পার কিছু ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় তারা। ১৯১২ সালের দিকে প্রত্নতত্ত্ববিদ জে ফ্লিট হরপ্পা অঞ্চল থেকে কিছু দুষ্প্রাপ্য সীলের নিদর্শন পান। এই ঘটনার পর এসব পুরার্কীতি দেখে উদ্বুদ্ধ হন দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব প্রত্নতত্ত্ববিদ। কিন্তু এই পুরাকীর্তি আবিষ্কার করতে লেগে যায় আরো প্রায় বেশ কিছু বছর। ১৯২১-২২ সালে বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল ও ই. জে. এইচ. ম্যাককি হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগরীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য শুরু করার ঘোষণা দেন। সঙ্গে নেন ভারতীয় পুরাকীর্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞ দুই প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহানিকে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর খননকার্য। স্যার জন মার্শাল ও রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহানি যুক্ত হন হরপ্পার খনন কাজে এবং ই. জে. এইচ. ম্যাককি ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্ত হন হরপ্পা থেকে ৩৫০ মাইল দূরে মহেঞ্জোদারোর খনন কাজে। জন মার্শাল ও দয়ারাম সাহানির নেতৃত্বে আবিষ্কৃত হয় ভারতীয় ইতিহাসের বহু প্রাচীন এক নগরী, ‘হরপ্পা’। তারা শুধু একটি নগরী আবিষ্কার করেননি, আবিষ্কার করেন এই নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক নগর সভ্যতা যা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ বা সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত।
সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার প্রধান রাজধানী ছিল এই হরপ্পা। বর্তমানে পাঞ্জাব প্রদেশের ইরাবতী (রাভি) নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল সে সময়ের সমৃদ্ধ এই নগরী। পাঞ্জাবের সাহিওয়াল থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই নগরী।
কাদের সৃষ্ট এই হরপ্পা?
কাদের তত্ত্বাবধানে হরপ্পা নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা আজও রহস্যাবৃত। হরপ্পাকে কেন্দ্র করে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার কোনো লিখিত দলিল নেই। নগর খননকালে যেসব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল তা সিন্ধু লিপিতে লেখা। এই লিপির অর্থ উদ্ধার করা এখনো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ঐসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে এই নগরী সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের ধারণা, খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দ থেকে ১৯০০ অব্দ পর্যন্ত এই নগরী স্থায়ী ছিল। মূলত দ্রাবিড়দের হাতেই এই নগরী ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে বলে অনেক ঐতিহাসিকের মত। প্রাচীন হরপ্পাবাসীর দেহগত নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়দের বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়।
আবার অনেক ঐতিহাসিক আর্যদেরকে এই নগরী ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার মূল দাবিদার বললেও তার সপক্ষে কোনো জোরালো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ আর্যরা ভারতবর্ষে এসেছিল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে আর হরপ্পা নগর ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে তারও অনেক আগে; তা প্রায় তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, হরপ্পা সভ্যতার সাথে সুমেরীয় সভ্যতার অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্টিমার হুইলারের অভিমত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মতে, উভয় সভ্যতার মধ্যে অনেক অমিল রয়েছে। হরপ্পাবাসীরা তাদের সভ্যতার উৎকর্ষতার জন্য সুমেরীয় সভ্যতা হতে কিছু ধরাণা নিলেও এই সভ্যতা আসলে ভারতীয়দেরই তৈরি।
হরপ্পার সীমানা
১৫০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল হরপ্পা নগরী। হরপ্পা নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতা বর্তমান ভারত ও পাকিস্থানের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। হরপ্পার আশেপাশের অনেক অঞ্চল ঘিরে বিভিন্ন নগরের পত্তন ঘটে। ঐতিহাসিকদের মতে, এ ধরনের ছোট-বড় নগরীর সংখ্যা ছিল প্রায় হাজারের ওপর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নগরগুলো হলো পাকিস্তানের হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, গনেরিওয়ালা এবং ভারতের ধোলাবীরা, কালিবঙ্গান, রাখিগড়ি, রুপার, লোথাল ইত্যাদি। অন্যান্য নগরগুলোর আয়তনও কম-বেশি একই রকম। তবে হরপ্পা সভ্যতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নগরগুলো মিলিয়ে মোট আয়তন হবে প্রায় ১২,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার।
নগর পরিকল্পনায় আধুনিকতার ছোঁয়া
নদীর তীরে গড়ে উঠা হরপ্পা নগরীতে আধুনিক নগর ব্যবস্থার যাবতীয় উপাদান পাওয়া যায়। পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে গৃহ নির্মাণ কৌশলেও উন্নত নগর ব্যবস্থার ছোঁয়া পাওয়া যায় এখানে। সড়ক এবং গলিপথ ছাড়াও নগরীকে ঘিরে পরিকল্পনামাফিক তৈরি হয়েছিল বড় বড় ভবন, বাজার, ছোট-বড় ঘরবাড়ি, কৃষিখামার এবং গো-চারণ ভূমি।
বেশিরভাগ বাড়িই দোতলা কিংবা তিনতলার। নগরের প্রধান সড়কগুলোর প্রশস্ততা ছিল প্রায় ৩০-৩৪ ফুট এবং অপ্রধান সড়কগুলোর প্রশস্ততা ছিল প্রায় ৯ ফুট। বাড়িগুলোর আশপাশের গলির রাস্তাগুলোও ছিল ৫ ফুট পর্যন্ত চওড়া। নগরের ভবন ও বাসা-বাড়ি তৈরিতেও বৈচিত্রময়তা পরিলক্ষিত হয়। নগরের প্রবেশ পথে ছিল বিশাল তোরণ, যাতে থাকতো নানাবিধ জরুরী বিজ্ঞপ্তি। রাস্তার পাশে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়ক বাতির ব্যবস্থা ছিল। শহরের প্রধান প্রধান রাস্তার দুই পাশে মূল নর্দমাগুলো তৈরি হয়েছিল। সবকিছুতেই ছিল এক আধুনিক নগরায়নের ছোঁয়া।
নগরীর গৃহনির্মাণ শৈলী
প্রত্নতাত্ত্বিকগণ এক গবেষণায় দেখেন যে, হরপ্পা নগরী দু’ভাগে বিভক্ত ছিল, শাসক এবং তাদের পরিবারবর্গদের জন্য দুর্গ ও সাধারণ মানুষের বসবাসের জন্য নিচের শহরাঞ্চল। শহরাঞ্চলের বাড়িঘরগুলোকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বণ্টন করা হতো। সমাজের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে কৃষক, শ্রমজীবী ও অন্যান্য স্বল্প আয়ের মানুষেরা এক বা দুই কক্ষের ছোট বাড়িতে বসবাস করতো। সরকারী কর্মকর্তা, ধনী ও ব্যবসায়িক সমাজ অপেক্ষাকৃত বড় পরিসরে বিস্তৃত বাড়িগুলোতে বসবাস করতো। উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের বাড়ি ও প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে নগরীর সবচেয়ে বড় বড় বাড়িগুলো ব্যবহৃত হতো বলে প্রত্নতাত্বিকদের অভিমত।
বড় বড় বাড়িগুলো হতো দোতলা বা তিনতলা এবং বহু কক্ষবিশিষ্ট। প্রাঙ্গনঘেরা সেসব বাড়িগুলোর অধিকাংশই তৈরি হতো পলিমাটির তৈরি ইট দিয়ে, আর তাতে থাকতো কাঠ ও নলখাগড়া জাতীয় উপকরণ। এমনকি কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হতো পাথর। দূর্গের বাড়িগুলো তৈরি হতো ইট ও পাথর দিয়ে। বাড়ির দেয়ালে ব্যবহৃত হতো মাটিমিশ্রিত নলখাগড়া বা কাঠের টুকরো। রাস্তা থেকে বাড়িগুলো দেখতে না পাওয়ার জন্য রাস্তার দিকে দরজা এবং জানালা রাখা হতো না। দরজা-জানালা তৈরি হতো কাঠের ফ্রেম দিয়ে, তাতে থাকতো নানারকম অলঙ্করণ ও রঙের ব্যবহার। শন বা কাঠের উপকরণ দ্বারা তৈরি একধরনের কার্পেট ব্যবহৃত হতো দরজা ও জানালায়। ঘন কাদার আস্তরণ দিয়ে তৈরি হতো মেঝে।
বাড়ির ছাদ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো কাঠের ফ্রেমের তৈরি বিম এবং তার উপর থাকতো কাদা ও নলখাগড়ার মিশ্রণে তৈরি আস্তরণ। বাড়িতে খাট, চেয়ার, টেবিল থাকতো, ছিল আলো আসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। বাড়ির ভেতরের দিকে ছিল রান্নাঘরের ব্যবস্থা। প্রত্যেক বাড়িতে যেমন ছিল স্নানাগার, তেমনি সুপরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম। স্নানঘর এবং ড্রেন তৈরিতে ব্যবহৃত হতো ইট ও পাথর। সর্বসাধারণের পানি ব্যবহারের জন্য যেমন ছিল সার্বজনীন কূপের ব্যবস্থা, তেমনি অনেক বাড়িতে নিজস্ব পানির কূপও ছিল। তাছাড়া অনেক বাড়িতে টেরাকোটার ব্যবহার বিশেষ লক্ষ্যণীয়।
নগর সুরক্ষা
হরপ্পাবাসীদের ভয় ছিল পশ্চিম দিক থেকেই হয়তো বহিঃশত্রুর আক্রমণ হবে। তাই পশ্চিম দিকটা ছিল সবসময় সুরক্ষিত। গড়ে তোলা হয়েছিল নগর প্রাচীর। প্রাচীরের সামনে সৃষ্টি করা হয়েছিল গভীর পরিখা। তারপরই তৈরি হয়েছিল সুরক্ষিত দুর্গ। দুর্গগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ছিল যথাক্রমে ১,২০০ ফুট ও ৬০০ ফুট। দুর্গকে ঘিরে ছিল ৪০ ফুটের মতো উঁচু প্রতিরক্ষা দেয়াল। দুর্গের বাইরের দিকে পোড়ানো ইটের ৪ ফুট পুরু আরেকটি অতিরিক্ত দেয়াল থাকতো। দুর্গ সুরক্ষায় থাকতো প্রয়োজনীয় সৈন্য-সামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র।
কৃষি ব্যস্থাপনা
হরপ্পাকে কেন্দ্র করে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠলেও জনসাধারণের এক বিশাল অংশ কৃষিকে জীবিকা হিসেবে নিয়েছিল। হরপ্পা ইরাবতী নদীর তীরবর্তী হওয়ায় মাটি ছিল বেশ উর্বর এবং কৃষি কাজের উপযুক্ত। পানিসেচের যথাযথ ব্যবস্থাও ছিল। তবে হরপ্পায় জমি তৈরিতে লাঙল ব্যবহৃত হতো কিনা তার কোনো নির্দশন পাওয়া না গেলেও কালিবঙ্গানে পাওয়া কিছু নির্দশন হতে অনুমান করা হয়, হরপ্পাবাসীরা লাঙলের ব্যবহার জানতো।
হরপ্পাবাসীদের মূল উৎপাদিত ফসল ছিল গম ও যব। সেখানে উন্নতমানের তুলাও জন্মাত। উর্বরতার কারণে বিপুল পরিমাণ শস্য উৎপন্ন হতো। উদ্বৃত্ত শস্য সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিশাল শস্য-সংরক্ষণাগার, হরপ্পা খননকালে যার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সংরক্ষণাগারের পাশেই ছিল একটি পাথরের তৈরি উচুঁ স্থান। শস্য মাড়াইকরণের কাজে তা ব্যবহৃত হতো বলে অনেক ঐতিহাসিকের মত।
হরপ্পার অধিবাসীদের দুধ এবং মাংসের যোগান এই কৃষকরাই দিত। কৃষিকাজের পাশাপাশি তারা নানারকম পশুপালন করতো মাংস ও দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য। কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়, গরু, কুকুর, মহিষ, উট, গাধা, ভেড়া ও ছাগল ইত্যাদি নানা গৃহপালিত জন্তুর দেখা পাওয়া যেতো হরপ্পায়। গাধা ও উট জিনিসপত্রের ভার বহনের কাজে ব্যবহৃত হতো। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী নৌপথে নগরীতে নিয়ে আসা হতো। কৃষিপণ্যের উদ্বৃত্তের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে আধুনিক এক নগরী হরপ্পা।
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তার
হরপ্পাবাসীরা শুধু কৃষির উপর নির্ভরশীল না হয়ে নানা ব্যবসা-বাণিজ্যেও নিয়োজিত ছিল। বাণিজ্যের জন্য তারা ব্যবহার করতো স্থল, নৌ ও সমুদ্রপথ। হরপ্পায় মাটির তৈরি খেলনা পাওয়া গেছে, যাতে বিভিন্ন পশুর দ্বারা চাকায় টানা গাড়ির অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। তা থেকে অনুমান করা হয়, স্থলপথে চাকাওয়ালা পশুটানা গাড়ির সাহায্যে একস্থান থেকে অন্যস্থানে মালামাল পরিবহন করা হতো।
নৌ ও সমুদ্রপথে নৌকার সাহায্য নেয়া হতো। সমুদ্রপথে বাণিজ্যের ব্যাপারে কোনো প্রত্যক্ষ তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে তার আশেপাশের নগরগুলোতে। সেসব নগরে নৌ-বন্দর এবং জাহাজ নির্মাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। হরপ্পাবাসীরা শুধু অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল না, বৈদেশিক বাণিজ্যেও তারা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের বাইরে, বিশেষ করে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে হরপ্পা নগরীর ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। মুদ্রা প্রচলনের কোনো নিদর্শন হরপ্পায় পাওয়া না যাওয়ায় অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত, সে সময় সম্ভবত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে মালামাল কেনাবেচা হতো।
হরপ্পাবাসীরা যেসব পণ্য রপ্তানী করতো তার মধ্যে ছিল চিরুনী, বস্ত্র, নানা কুটিরশিল্পজাত পণ্য ইত্যাদি। রূপা এবং বিভিন্ন ধাতুর তৈরি জিনিসপত্র বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমদানী করা হতো। হরপ্পা খননকালে কিছু মিশরীয় জিনিসের সন্ধান পাওয়া গেছে যা থেকে ধারণা করা হয়, হরপ্পার সাথে মিশরের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। আর এভাবে হরপ্পার অধিবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল।
হরপ্পা অধিবাসীদের জীবন ও জীবিকা
হরপ্পা নগরীর অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান ছিল যথেষ্ট উন্নত। নগরীর লোকসংখ্যা কত ছিল তার কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও, অনুমান করা হয় এই সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০। আবার কারো মতে তা লক্ষাধিক। সিন্ধুলিপির যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে ধারণা করা হয়, হরপ্পাবাসীদের একটা অংশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিল। হরাপ্পাবাসীরা কৃষিকাজ ছাড়াও নানা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নিয়েজিত ছিল। তারা কুঠার, বর্শা, ছোরা, তীর-ধনুকের ব্যবহার জানতো। হরপ্পাবাসীর অবসর বিনোদন ছিল পাশা খেলা, শিকার এবং ষাঁড়ের খেলা। নগরে খাদ্যের অভাব ছিল না। অধিকাংশ ফসলই নিজেরা উৎপাদন করতো।
হরপ্পাবাসীর প্রধান খাদ্য ছিল যব এবং গমের তৈরি খাদ্য। এছাড়া দুধ, খেজুর ও মাংস প্রভৃতি হরপ্পাবাসীর খাদ্য তালিকায় প্রাধান্য পেতো। হরপ্পার অধিবাসীরা বহু ঈশ্বরবাদী ছিল বলে নানা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন হতে জানা যায়। দেব-দেবীর আরাধনা ছাড়াও গাছপালা (যেমন- নিম গাছ) ও নানা পশু (যেমন- ষাঁড়) উপাসনারও প্রচলন ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়।
হরপ্পার জনগণের গড় আয়ু ছিল মাত্র ত্রিশ। খননকালে আবিস্কৃত হওয়া কবর থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। সম্ভবত হরপ্পাবাসীরা চিকিৎসা ব্যবস্থা ততটা আধুনিক ছিল না। কোনো কোনো মৃত মানুষের সরাসরি কবর হতো, আবার কারো কারো মৃতদেহ প্রথমে পুড়িয়ে, পরে তার ছাই কবর দেয়া হতো।
অধিবাসীদের পোশাক পরিচ্ছদ
হরপ্পাবাসীরা কী ধরনের পোশাক পরিধান করতো তার কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। তবে খননকালে যেসব মূর্তি ও অলংকার পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সুতিবস্ত্র ছিল অধিবাসীদের প্রধান পোশাক। নারীপুরুষের পোশাকে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না বলে ঐতিহাসিকদের অনুমান। শরীরের উপরের অংশে পরিধানের জন্য ব্যবহৃত হতো শালের মতো বস্ত্র আর নিচের অংশে ধুতি জাতীয় বস্ত্র। বস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হতো তুলা আর পশম। নারী-পুরুষ উভয়েরই ছিল অলঙ্কার প্রীতি। অলঙ্কার নির্মাণে ব্যবহৃত হত সোনা এবং রূপাসহ নানা মূল্যবান ধাতু ।
শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা
হরপ্পা খননকালে একটি রাজমূর্তির ভগ্নাশেষ পাওয়া যায়। তা থেকে অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল হরপ্পায় এবং পুরোহিত ও রাজা উভয়েই সে সময় সমাজকে শাসন করতো।
হরপ্পা নগরে সামাজিক বৈষ্যম্যের একটি প্রকৃত চিত্রের দেখা মেলে। একদিকে এই বৈষম্যের ধারণা পাওয়া যায় নগরকে দুটি অংশে বিভক্ত করা থেকে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে মৃতদেহকে বিভিন্নভাবে কবর দেয়ার পদ্ধতি থেকেও সমাজের দুটি ভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু অধিবাসী মৃতদেহ সরাসরি কবর দিত। আবার কোনো কোনো অধিবাসীর মৃতদেহ দাহ করে তার ছাই নিয়ে কবর দেওয়ার প্রচলন ছিল। খননকালে কিছু কবরের মধ্যে মৃতদেহের ব্যবহার্য জিনিসও পাওয়া গেছে। কবরগুলির এই পার্থক্য হরপ্পা সভ্যতার শ্রেণী বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ বলেই ধারণা করা হয়।
কারিগরি শিল্পের উত্থান
হরপ্পার অধিবাসীরা মাটি ও তামার ব্যবহার জানতো। আর এসব উপকরণে তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে গড়ে উঠেছিল কুটিরশিল্প। হরপ্পার মৃৎশিল্পীরা তৈরি করতো নানা রকমের মাটির পাত্র, চমৎকার সব মাটির পুতুল, বিভিন্ন রকমের বাসনপত্র, যেমন- থালা, জালা, কলসি, বাটি ইত্যাদি।
প্রায়শই এসব মাটির পাত্রে আঁকা হতো নানারকম নকশা। অনেক কারিগর চিনামাটি দিয়ে নানা জিনিসপত্রও তৈরি করতে পারতো বলে ধারণা করা হয়। সোনা ও রূপা দিয়ে তৈরি হতো নানা অলঙ্কার। তামা দিয়ে তৈরি হতো কুঠার, বর্শা, ছোরা, তীর- ধনুক, গুলতি, ঢাল ইত্যাদি নানারকমের অস্ত্রশস্ত্র। হরপ্পা নগরী খননকালে এসব নিদর্শন প্রচুর পাওয়া গেছে। এ থেকে অনুমান করা হয়, নগরীর অনেক অধিবাসীই ছিল জাত শিল্পী ।
কীভাবে পতন ঘটলো হরপ্পা নগরীর
কীভাবে এই সমৃদ্ধ নগরীর পতন ঘটলো তা আজও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ইতিহাস। ঐতিহাসিকগণ আজও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি এই ব্যাপারে। তবে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৭০০ এর মাঝামাঝি কোনো এক সময়েই এই নগরী ধ্বংস হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে এই নগর ধ্বংস হয়নি। ধ্বংসের পিছনে রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হাজারো কারণ। ঐতিহাসিকদের একটি অংশের অনুমান, অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প- এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এই নগরী ধ্বংস হয়।
আবার অনেকে মনে করেন, অনাবৃষ্টিই দায়ী এই নগর ধ্বংসের পিছনে। বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে জমির উর্বরতাশক্তি হ্রাস পায়, ফলে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। তাই কৃষিনির্ভর হরপ্পার পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী।
আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, যুদ্ধে পারদর্শী আর্যদের উপর্যুপরি আক্রমণের কারণে পতন ঘটে হরপ্পা নগরীর। প্রত্নতাত্ত্বিক এক অনুসন্ধানে হরপ্পায় একটি কবর থেকে একসাথে অনেকগুলো মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা থেকে অনুমান করা হচ্ছে বড়ধরনের এক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এই হরপ্পায়, যার কারণে পতন ঘটে নগরটির। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার সপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ আর্যরা ভারতবর্ষে এসেছিল হরপ্পা নগরী ধ্বংস হওয়ার পাঁচশ বছর পর। বরং কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্লেগ জাতীয় কোনো মহামারীর কারণে ধ্বংস হয়েছে এই সমৃদ্ধ নগরী।
কাজেই কোনো সুনিদিষ্ট কারণ জানা না গেলেও কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ অবশ্যই ছিল এই সমৃদ্ধ নগরী ধ্বংসের পিছনে। আর এভাবেই সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যায় মহেঞ্জোদারোর মতোই নগর সভ্যতার আরেক অপরূপ নিদর্শন ‘হরপ্পা নগরী’।
ফিচার ইমেজ- phillipkay.wordpress.com
এ সিরিজের আগের পর্ব: