আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ হলো ইয়েমেন। ইয়েমেনের ছোট্ট একটি শহরের নাম শিবাম। শহরটিতে জনসংখ্যার আধিক্য তেমন নেই। বড়জোড় ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষের বাস এই শহরে। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে এই শহরের রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব। এই শহরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা। তবে মজার ব্যাপার হলো বাড়িগুলো মোটেও এখনকার মতো ইট, সিমেন্ট, লোহা বা কংক্রিটের তৈরি নয়। রোদে শুকনো মাটির ইট দিয়ে তৈরি করা হয় এসব বিশাল বিশাল অট্টালিকা।
ষোড়শ শতাব্দীর দিকে ইয়েমেনের এই অঞ্চলটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে বেশ প্রসিদ্ধ লাভ করে। ফলে এই অঞ্চলকে ঘিরে ইয়েমেনের আশেপাশের অঞ্চলের অধিবাসীদের আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। পাশাপাশি এখানকার অধিবাসীরাও ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে থাকে।
তবে সেই সময় শিবাম অঞ্চলের ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল একদল বেদুইন সন্ত্রাসী। আঞ্চলিক লোকজন এই বেদুইন দস্যুদের খুব ভয় করতো। কেননা তারা যেমন ছিল নৃশংস, তেমনি চুরি-ডাকাতিতেও ছিল বেশ দক্ষ। তখন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা শহরবাসীদের রক্ষা করার জন্যে অভিনব এক উপায় বের করলেন। বিশাল বিশাল দেয়ালের প্রাচীর তৈরি করে পুরো শহরটিকে একটি দুর্গের মতো করে ঢেকে ফেলার চিন্তা করা হল। পাশাপাশি শহরের প্রত্যেকটি বাড়ি উঁচু করে তৈরি করার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময় শিবাম অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে বেশ সমৃদ্ধশালী ছিল বলে এমন পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়েছিল।
এই শহরটিতে প্রায় ৫০০ এর বেশি বাড়ি রয়েছে। একেকটি বাড়ি উচ্চতায় ৫ তলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তুলনা করতে গেলে অনেকটা বর্তমানের ফ্ল্যাট বাড়ির আদলেই তৈরি করা হতো বাড়িগুলো। তবে পার্থক্য একটাই, বিশাল বিশাল বাড়িগুলো কেবলমাত্র একটি পরিবারের জন্যেই নির্মাণ করা হয়েছিল।
বাড়িগুলোর কয়েকটি তলা আবার পৃথক পৃথক কাজে ব্যবহারের জন্যে সংরক্ষিত থাকতো। যেমন নিচের তলা বাসস্থানের জন্যে ব্যবহার করা হতো না। যেহেতু পশুপাখি পালন করা তাদের জীবিকার একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল তাই নিচের তলা ব্যবহার করা হতো গৃহপালিত পশুপাখি রাখার জন্যে। ২য় তলাটি অনেক সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বা দোকান বা অফিসের কাজে ব্যবহার করা হতো। আর এই কারণেই ১ম ও ২য় তলায় কোনো জানালা রাখা হতো না। মূলত ৩য় তলা থেকেই বাড়ির বাসিন্দাদের বসবাসের শুরু।
বাড়ির প্রতি তলায় পৃথক পৃথক থাকার ব্যবস্থা থাকতো। বাচ্চাদের জন্যে আলাদা, স্বামী-স্ত্রীর জন্যে আলাদা অথবা পরিবারের একত্রে সময় কাটানোর জন্যে আলাদা, এমনকি অতিথির জন্যে আলাদা তলার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তে পরিবারগুলো ভাগ হতে হতে পুরো বাড়িও বিভিন্ন অংশে ভাগ হতে থাকে। তাই বর্তমানে একেক তলা একেকটি পরিবারের দখলে রয়েছে। আর এসব অঞ্চলে আগের মতো ব্যবসা বাণিজ্য বা অর্থের সেই জৌলুসও আর নেই। তাই একটি পরিবারের পক্ষে পুরো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করাও বর্তমানে প্রায় অসম্ভব বলা চলে।
ধারণা করা হয়, শিবামের মাটির তৈরি ঘরগুলোই অন্য যেকোনো জায়গার মাটির ঘরের তুলনায় উচ্চতায় অধিক। প্রতিটি বাড়ি নির্মাণ করতে ব্যবহার করা হয় কাদামাটি এবং ভূষি। পাতাহীন নাবাক গাছ ব্যবহার করা হয়েছে বাড়িগুলোর কাঠামো তৈরি করার জন্যে। বাড়িগুলো প্রায় ৪৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে।
মাটির ইট তৈরি করার পূর্বে কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন হতো। যেমন মাটির সাথে প্রথমে খড়কুটো ও পরিমাণমত পানি দিয়ে একধরনের সংমিশ্রণ তৈরি করা হতো। তারপর প্রয়োজনমত ইটের আকার দিয়ে কেটে নেয়া হতো এবং সেগুলো মরুভূমির প্রখর রোদে তিনদিন ধরে শুকাতে দেয়া হতো। তিনদিন শুকানোর পর ইটগুলো ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যেত। মরুভূমির উত্তপ্ত রোদের তেজের কারণেই ইটগুলো খুব সহজেই শুকিয়ে যেত।
এরপরে একের পর এক ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি করা হতো বিশাল বিশাল সব দেয়াল। প্রতিটি তলায় কাঠের ছাদ ব্যবহার করা হয়। তবে বাড়ি বানানো হয়ে গেলেও এর রক্ষণাবেক্ষণে কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে বাড়িগুলোর বাইরের দেয়ালে নিয়মিত চুনকাম করতে হয়। দেয়ালে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলে মাটির মিশ্রণ দিয়ে এক ধরনের প্রলেপ দেয়া হয়। ভূমিকম্পের শঙ্কা থেকে অনেকটাই মুক্ত বলে হাজার বছর বেশ স্বচ্ছন্দের সাথেই টিকে রয়েছে বিশাল এই বাড়িগুলো।
অনেক প্রাচীন যুগে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ার কারণে অনেকেই শহরটিকে ‘পৃথিবীর প্রাচীনতম গগনচুম্বী অট্টালিকার শহর’ বা মরুভূমির ম্যানহাটন বা শিকাগো নামেও অবিহিত করে থাকে। এসব শহরে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা রয়েছে বলেই হয়তো শিবামের এই অঞ্চলের এমন নামকরণ।
১৯৮২ সালের দিকে ইউনেস্কোর নজরে আসে শহরটির স্থাপত্যশৈলী। তাদের মতে, ঐতিহাসিকভাবে এত প্রাচীন সৃষ্টিশীলতা আর কোথাও নেই বললেই চলে। সেই বছর শহরটিকে বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে নথিভূক্ত করা হয়। এর ফলে বিশ্বের অনেক পর্যটকের নজর কাড়ে স্থানটি। কিন্তু পরবর্তীতে নিরাপত্তার অভাবে জায়গাটি পর্যটন গুরুত্ব হারাতে থাকে।
শিবামের বাড়িগুলো অতীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের শক্তিশালী অবস্থান ও গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতির উত্থানের প্রতীক। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে প্রায় ২৫০০ বছর আগে এই শহরে এমন স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। ৯০৪ সালের দিকে শিবামে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় যা আল-মিহদার মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদটির উচ্চতা প্রায় প্রায় ১৭৫ ফুট যা এখনো পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে।
তবে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে শিবাম শহরটি রয়েছে বন্যার ঝুঁকিতে। ফলে শহরটির বাড়িগুলোও বেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। বেশ কয়েকটি বন্যার কারণে শিবামের অনেকগুলো বাড়ি বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি বর্তমানে নতুন করে আর আগের মতো বাড়ি বানানো সম্ভব হয় না। ফলে একসময় হয়তো হারিয়ে যেতে পারে হাজার বছরের মধ্যপ্রাচ্যের এই অভাবনীয় প্রাচীন নিদর্শনগুলো।
শিবামের পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে শহরটির চারপাশের অপরূপ স্থাপত্যশৈলী যেকোনো পর্যটককে ভাবতে বাধ্য করে হাজার হাজার বছর পূর্বের সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস। অনেক মানুষের চেষ্টা ও স্থাপত্য কৌশলী এখনো যে কাউকে অবাক করে তোলে পরম বিস্ময়ে। কিন্তু উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হয়তো একদিন হারিয়ে পড়বে অনেক বছর আগের তৈরি এই অসাধারণ কীর্তি।
ফিচার ইমেজ- middleeastrevised.com