Light in the House- Lighthouse; বাংলায় বাতিঘর- মানব সভ্যতার এক ঐতিহাসিক আবিষ্কার। সমুদ্রগামী নাবিকেরা একদিকে যেমন সেই প্রাচীনকাল থেকে আকাশের তারার উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে পথ চলতো, তেমনি তাদের পথচলা নিরাপদ করতে ভূমিতে থাকতো একঝাঁক বাতিঘর। খ্রিস্টপূর্ব সময়ে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর থেকে শুরু করে আধুনিককালের সাম্প্রতিকতম বাতিঘরের উদ্দেশ্য একই। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আলো ফেলে সমুদ্রের নাবিকদের সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া এবং সমুদ্রের অগভীর অঞ্চল সম্পর্কে যুগপৎ সতর্ক করা।
২৯০ থেকে ২৭০ খ্রিস্টপূর্বের কোনো একসময় তৈরি হয় আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। সম্রাট আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর টলেমীয় সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত এই বাতিঘরটি ছিল প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম সপ্তাশ্চর্য। এরপর শত সহস্র বাতিঘর তৈরি হয়েছে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক Lighthouse Directory-এর তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯,৫০০টিরও বেশি বাতিঘর রয়েছে। তবে এই সংখ্যায় (বর্তমানে) কার্যকর নয় এমন বাতিঘরগুলোও অন্তর্ভুক্ত। সে যা-ই হোক না কেন, প্রতিটি বাতিঘরই ইতিহাসের পাতায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। এত এত বাতিঘরের মাঝে চলুন দেখে আসি শতাব্দী প্রাচীন সাতটি বিখ্যাত বাতিঘর। এই সাত বাতিঘরের ভিতর কেবল একটিই বর্তমানে কাজ করে না। কারণ, অনেক আগেই সে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে।
টুরলিটিস বাতিঘর, গ্রীস
গ্রীসের দৃষ্টিনন্দন এই বাতিঘরটি ১৮৮৭ (কোথাও কোথাও অবশ্য ১৮৯৭ সালের কথা উল্লেখ আছে) সালে তৈরি করা হয়েছিল। এটি তৈরি করা হয়েছে শত সহস্র বছরের প্রাকৃতিক উপায়ে ক্ষয়প্রাপ্ত এক পাথর স্তম্ভের উপরে। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ৭ মিটার উপরে সিলিন্ডার আকৃতির এই স্থাপনাটি উচ্চতায় ৩৬ মিটারের মতো। গ্রীসের বন্দরনগরী অ্যান্ড্রোসের ভেনেশিয়ান দুর্গের বিপরীত দিকে এটি অবস্থিত। দেখলে মনে হবে, পানিবেষ্টিত এক উত্থিত পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে বাতিঘরটি। তবে মূল বাতিঘরটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভেঙে যায়। দীর্ঘ সময় এটি এভাবেই পড়ে ছিল। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এক ধনকুবের তেল ব্যবসায়ী এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পুনর্নির্মাণের পরে এটি হয়ে যায় গ্রীসের প্রথম স্বয়ংক্রিয় বাতিঘর; অর্থাৎ গোধূলিবেলায় এই বাতিঘরের আলো জ্বালানোর জন্য কোনো মানুষের প্রয়োজন হয় না।
কিন্তু এই আধুনিকতার পরও টুরলিটিস বাতিঘরটি এক অমোঘ আকর্ষণে পর্যটক ও ফটোগ্রাফারদের বিমুগ্ধ করে রেখেছে। তাদের কাছে এটি যেন এক জাদুর টাওয়ার!
পোর্টল্যান্ড হেড লাইট, যুক্তরাষ্ট্র
ভূমি থেকে ৮০ ফুট উপরে অবস্থিত এই বাতিঘরটি যুক্তরাষ্ট্রের শত পোতাশ্রয়ের স্টেট¹ হিসেবে পরিচিত মেইনের কেপ এলিজাবেথ শহরে অবস্থিত। প্রায় সোয়া দুইশ’ বছরের পুরাতন এই বাতিঘরটিতে সর্বপ্রথম ১৭৯১ সালের ১০ জানুয়ারি আলো জ্বালানো হয়।
প্রায় ৭২ ফুট উচ্চতার মেইন স্টেটের সবচেয়ে পুরাতন এই বাতিঘরটিতে ১৬টি বাতি ছিল যেগুলো তিমি মাছের তেল দিয়ে জ্বালানো হতো। বর্তমানে অবশ্য স্বয়ংক্রিয় (Automated) প্রক্রিয়ায় আলো জ্বালানো হয়ে থাকে। ১৮৬৫ সালের দিকে এর উচ্চতা আরো ২০ ফুট বাড়ানো হয়। পর্যটক আকর্ষী এই বাতিঘরটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বাতিঘরটির পাশে একটা মিউজিয়ামও রয়েছে; এখানে শতাব্দী প্রাচীন এই স্থাপনাটির বিভিন্ন জিনিসপত্র রেখে দেওয়া হয়েছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।
টাওয়ার অব হারকিউলিস, স্পেন
প্রাচীন রোমান সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন এবং কার্যকর বাতিঘর। প্রথম শতকের শেষভাগে স্পেনের লা করুনিয়া (La Coruña) পোতাশ্রয়ের প্রবেশমুখে অবস্থিত ৩৪ মিটার উচ্চতার এই বাতিঘরটি অবশ্য রোমানদের কাছে Farum Brigantium তথা ব্রিগানশিয়া বাতিঘর নামে পরিচিত ছিল।
আঠারো শতকে স্থপতি ইউস্তাকিও জিয়ান্নিনি (১৭৫০ – ১৮১৪) ৫৭ মিটার উঁচু পাথরের উপর নির্মিত হাজার বছরের পুরাতন এই রোমান স্থাপনার উপরে আরো ২১ মিটার যোগ করেন। ২০০৯ সালের ২৭ জুন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পাওয়া এই বাতিঘরটিকে ঘিরে বহু উপকথা, রূপকথা প্রচলিত আছে। এরকমই এক রূপকথা হল, গ্রীক দেবতা জিউস পুত্র হারকিউলিসকে নিয়ে। তিন দিন, তিন রাতের অবিরাম যুদ্ধের পরে হারকিউলিস অত্যাচারী গেরিয়নকে হত্যা করে। হারকিউলিস গেরিয়নকে তার অস্ত্রসমেত বাতিঘরের স্থানটিতে পুঁতে রাখে এবং সেখানে এই বাতিঘরটি প্রতিষ্ঠা করে।
রূপকথার হারকিউলিসের অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র ক্ল্যাসিকাল রোমান সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন এই বাতিঘরের আশেপাশে আছে একটি ভাষ্কর্য পার্ক ও একটি মুসলিম সিমেট্রি।
পিজিয়ন পয়েন্ট বাতিঘর, যুক্তরাষ্ট্র
সান ফ্র্যান্সিসকোর ৫০ মাইল দক্ষিণে এক অসাধারণ নিসর্গে অবস্থিত পিজিয়ন পয়েন্ট বাতিঘর। ১৮৭২ সালের ১৫ নভেম্বর, এক শীতের সূর্যাস্তে আলো জ্বালিয়ে শুরু হওয়া পিজিয়ন পয়েন্টের যাত্রাপথ আজ অবধি চালু আছে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে। পিজিয়ন পয়েন্ট নামকরণ কিন্তু পায়রা বা কবুতরের ইংরেজি শব্দ Pigeon থেকে আসে নি। এর নামকরণের পেছনে আছে এক দুঃখজনক ইতিহাস। ১৮৫৩ সালের এক জুনের রাতে এই ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে বিধ্বস্ত হয় Carrier Pigeon নামের এক দ্রুতগামী জাহাজ। সবাই বেঁচে ফিরলেও রাতের ঘন কুয়াশায় উপকূল থেকে প্রায় ৫০০ ফুট দূরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১৭৫ ফুট লম্বা Carrier Pigeon। সেই বিধ্বস্ত জাহাজের নামে উপকূলীয় জায়গাটির নামকরণ করা হয়; সেই সাথে পিজিয়ন পয়েন্ট বাতিঘরেরও।
১১৫ ফুট লম্বা এই বাতিঘরটিতে অন্য বাতিঘরগুলোর মতো স্পার্ম তিমির তেল ব্যবহার করা হতো না। তার পরিবর্তে শূকরের তেল দিয়ে বাতি জ্বালানো হতো; সাথে ছিল ফার্স্ট-অর্ডার ফ্রেসনেল লেন্স। পরবর্তীতে ১৮৮৮ সালের দিকে শূকরের তেলের জায়গায় কেরোসিন তেল ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে অবশ্য DCB-24 Aerobeacon ব্যবহার করা হয়। সাদারঙা এই বাতিঘরটির আলোর রেঞ্জ প্রায় ৪৪ কিলোমিটার (২৪ নটিক্যাল মাইল); ১ (ইউএস) নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫ কিলোমিটার। ১৯৮০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার হিস্টোরিক্যাল ল্যান্ডমার্ক হিসেবে এই পিজিয়ন পয়েন্ট বাতিঘরকে উল্লেখ করা হয়।
হুকহেড বাতিঘর, আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ডের ওয়েক্সফোর্ড কাউন্টির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত হুকহেড বাতিঘরটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি বাতিঘর। বলা হয়ে থাকে, পঞ্চম শতকে ডুবহান নামের এক সন্ন্যাসী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই উপদ্বীপে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানকার সন্ন্যাসীরা এই আশ্রমে রাতের বেলা আগুন জ্বালিয়ে সমুদ্রে চলাচলকারী নাবিকদের তীরের কঠিন পাথরের উপস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করে দিতেন। এরপর ১২০৭ সালের দিকে লর্ড অব লেইন্সটার উইলিয়াম মার্শাল বর্তমানের হুকহেড বাতিঘর নির্মাণের নির্দেশ দেন।
মূলত এই বাতিঘরটি রাতের বেলা ব্যারো নদীর তীরে অবস্থিত নিউ রস শহরের নৌ-বন্দরে আসা জাহাজগুলোকে আলো দেখানোর উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৮০০ বছরের পুরাতন এই বাতিঘরটি নির্মাণের পর থেকে সতেরো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সেখানে বসবাসকারী সন্ন্যাসীরাই দেখাশোনা করতো। ২০১১ সালের জুন মাসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্রাভেল গাইড বুক হিসেবে বিখ্যাত Lonely Planet ৩৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই বাতিঘরটিকে The great granddaddy of lighthouses হিসেবে উল্লেখ করেছে।
গিবস হিল বাতিঘর, বারমুডা
ঢালাই লোহার তৈরি পৃথিবীর সর্বপ্রথম এই বাতিঘরের উপর থেকে বারমুডার পুরো দ্বীপটির উপর চোখ বুলিয়ে নেয়া যাবে। ১৮৪৬ সাল থেকে পথনির্দেশক আলো বিচ্ছুরিত করে যাওয়া সাউদাম্পটন প্যারিশের এই বাতিঘরটির উচ্চতা ১১৭ ফুট; আছে ১৮৫টি সর্পিলাকার সিঁড়ি।
গিবস হিলের শক্তিশালী আলোকচ্ছটা সমুদ্রের প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায়। আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখতে পায় এর আলোর রেখা। গিবস হিলের বাতিঘর আগে কেরোসিন নির্ভর ছিল। বর্তমানে ২.৭৫ টন ভরের ১, ০০০ ওয়াটের বাল্ব দিয়ে আলো সরবরাহ করা হয়। ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে আরোহণের পরপরই ১৯৫৩ সালের ২৪ নভেম্বর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই বাতিঘরটি পরিদর্শন করতে যান। রানীর মুগ্ধতাকে একটি স্মারকে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
কুতুবদিয়া বাতিঘর, বাংলাদেশ*
চট্টগ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্র বন্দর হিসেবে বিখ্যাত ছিল। নবম শতকে আরব বণিকেরা সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সময়ের পরিক্রমায় অনেক জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষের পদচিহ্ন পড়ে চট্টগ্রামের মাটিতে। ১৮২২ সালে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর চর সাগর গর্ভ থেকে উত্থিত হয়। এসব পাললিক ভূমি চট্টগ্রাম বন্দরে আসা দেশি-বিদেশি জাহাজগুলোর চলাচলে বেশ সমস্যা তৈরি করতো। ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত কুতুবদিয়ায় (এটি কক্সবাজারের একটি দ্বীপ উপজেলা) প্রায় ১২০ ফুট উচ্চতার একটি বাতিঘর স্থাপন করে। ১৮৪৬ সালে নির্মিত এই বাতিঘরটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন বাতিঘর। কাঠের পাটাতন ও সিঁড়ির এই বাতিঘরটিতে ছিল ছয়টি কামরা। সবচেয়ে উপরের কামরায় ছিল আট ফিতার বাতি যেটি নারিকেল তেল দিয়ে জ্বালানো হতো। আট তলাবিশিষ্ট এই বাতিঘরটি ১৮৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুতুবদিয়া বাতিঘরের আলো প্রায় ৩৫ কিলোমিটার গভীর সমুদ্র থেকেও দেখা যেতো।
ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হেয়ারের তত্ত্বাবধান ও প্রকৌশলী জে এইচ টুগুডের নির্দেশনায় ৪,৪২৮ টাকায় (তৎকালীন হিসেবে) নির্মাণ করা হয় কুতুবদিয়া বাতিঘর। ১৯৬০ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই বাতিঘরটি। ১৯৬৫ সালে ৭ একর জমিতে বেড়িবাঁধের ভেতরে পুনরায় আরেকটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। আর শতাব্দী প্রাচীন সেই পুরাতন বিখ্যাত বাতিঘর? ভাটার সময় বিলীন হয়ে যাওয়া পুরাতন বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষের কিছু কিছু অংশ নাকি এখনো দেখা যায়।
ফিচার ইমেজ- wall.alphacoders.com
ফুটনোটঃ
- Johnson, Clifton, New England, a human interest geographical reader, The Macmillan Company, 1921, p: 345
* একমাত্র কুতুবদিয়া বাতিঘরটিই এখানে ব্যতিক্রম। অন্য ছয়টি বাতিঘর এখনো কার্যকর; কুতুবদিয়া বাতিঘরটি এখন আর কার্যকর নয়। শুধু বাংলাদেশের শতাব্দী প্রাচীন এই বাতিঘরটির সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিতেই এখানে কুতুবদিয়া বাতিঘরের আলোচনা করা হয়েছে।