হাসপাতাল কথাটি শুনলে কল্পনায় ভেসে আসে সাধারণ চেহারার সাদা রং করা দেয়ালের বিষণ্ণ একটি কাঠামো। হাসপাতালের অভ্যন্তরে বড় বড় হলরুমে সারি সারি বেড, আর তাতে শুয়ে থাকে যন্ত্রণাকাতর রোগী। রোগীর পাশে বিষাদমাখা মুখে বসে আছে রোগীর কোনো আত্মীয়।
আধুনিককালের হাসপাতালগুলো এই চিরায়ত রূপ থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে এসেছে। স্থাপত্যশৈলীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বদলে দিয়েছে হাসপাতালের চিরচেনা অবয়ব। পরিবর্তন এসেছে হাসপাতালের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায়। সেই সাথে বিবর্তিত হয়েছে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মানও। এখন অত্যাধুনিক কোনো হাসপাতাল আর সুসজ্জিত কোনো বাণিজ্যিক ভবন কিংবা বিলাসবহুল হোটেলের চেহারায় কোনো তফাৎ নেই। কোনো কোনো হাসপাতালের স্থাপত্যকৌশলের সৃষ্টিশীলতা আর নান্দনিকতা আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে।
এই লেখাটিতে থাকছে এমনি কিছু অপূর্ব সুন্দর আর অকল্পনীয় সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত হাসপাতালের কথা।
১. ফ্লোরিডা হসপিটাল ওয়াটারম্যান, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র
তিন তলা সমান উঁচু আলোকচ্ছটা ছড়ানো ছাদের নিচে বিশাল সুসজ্জিত অভ্যর্থনা কক্ষ। একপাশে সাজানো রয়েছে একটা পিয়ানো। কী ভাবছেন? কোনো হোটেল লবির কথা বলছি?
না, ফ্লোরিডা হসপিটাল ওয়াটারম্যানের কথা বলছি। হাসপাতালের সজ্জায় এমন আজব আর বিস্ময় জাগানীয়া সব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিতে আসলে এক ধরনের ভয়ের মধ্যে থাকেন। তাদের ভয়কে কমিয়ে স্বাভাবিক মানসিকতা বজায় রাখতে এমন চমকপ্রদ অনেক ব্যবস্থা রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যেমন- দুর্লভ প্রজাতির অনেক পাখি রাখা হয়েছে হাসপাতালের আঙিনায়। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হাসপাতালে মনেই হবে না আপনি ডাক্তারের কাছে এসেছেন।মনে হবে, বাসায় বসে পাখির গান শুনতে শুনতে কফি খাচ্ছেন। হাসপাতালের রুমে রয়েছে বিশাল বিশাল জানালা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে হাসপাতাল ঘিরে অবস্থিত লেক আর বনের চোখ জুড়ানো দৃশ্য। এই হাসপাতালের প্রত্যেকটি রুমই সিঙ্গেল। সিঙ্গেল মানে যে ছোট, তা কিন্তু নয়। বরং একজন রোগীর থাকার জন্য যা জায়গা লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশি বড় রুমগুলো। যেন পরিবার সহ রোগীরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা।
হাসপাতালটিতে নেই করিডোরের গোলকধাঁধা। প্রত্যেকটি বিভাগে যাওয়ার পথ চলে গেছে এট্রিয়াম থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার তাভারেসে অবস্থিত ১২২ একর এলাকা নিয়ে নির্মিত এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাও অত্যন্ত উন্নত। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউগুলো সমৃদ্ধ। এমনকি প্রতিটি রুমে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রয়েছে। ডাক্তার আর নার্সদের হৃদয়স্পর্শী আচরণে মানসম্মত চিকিৎসার পাশাপাশি সুন্দর পরিবেশ এবং বিনোদনের ব্যবস্থা রোগীকে নিঃসন্দেহে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
২. সেইন্ট রোজ ডোমিনিকান হসপিটাল, লাস ভেগাস, যুক্তরাষ্ট্র
স্প্যানিশ স্থাপত্যকলায় নির্মিত সেইন্ট রোজ ডোমিনিকানের আবেদনময়তা এর বাহিরে যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অভ্যন্তরেও। হাসপাতালের রুমে থেকে রোগীরা দেখতে পারেন চোখ ধাঁধানো লাসভেগাস এবং হাসপাতাল সংলগ্ন মরুভূমির প্রান্তর। অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি এখানে রোগী এবং দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা ব্যবস্থা। হাসপাতালের দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে প্রথম ধাক্কাটা খেতে হয় বিশাল গম্বুজাকৃতির আলো ঝলমলে ছাদ দেখে। আরও আছে ১০০ ফুট উঁচু বেল টাওয়ার। লাসভেগাসের প্রাচুর্য অবলোকনের আদর্শ স্থান এই টাওয়ার। দেয়ালের গায়ে লেখা রয়েছে নানা উৎসাহ আর অণুপ্রেরণার বাণী।
হাসপাতালের অভ্যন্তরে রয়েছে ইনডোর বাগান। দর্শনার্থীরা এখানে উদ্যান ব্যবস্থাপনার পাঠ নিতে পারেন এবং মরুজ উদ্ভিদ জগতের সাথে পরিচিত হতে পারেন।
৩. চিলড্রেনস হসপিটাল অব পিটসবার্গ, পিটসবার্গ, যুক্তরাষ্ট্র
এটি যুক্তরাষ্ট্রের সেরা হাসপাতালগুলোর একটি। বাচ্চাদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত এই হাসপাতালের রয়েছে সৃজনশীল স্থাপত্যশৈলী আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের অভূতপূর্ব সমন্বয়। এই হাসপাতালে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা রিসার্চ সেন্টার। শিশুদের গুণগত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সবরকম চেষ্টাই করেছে পিটসবার্গ চিলড্রেন হসপিটাল। এখানে শুধু বাচ্চাদেরই নয়, বাচ্চাদের বাবা-মা বা দর্শনার্থীদের সময়টা যেন সুন্দর কাটে এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালটির প্রতিটি তলায় রয়েছে বাবা-মায়েদের জন্য আলাদা অপেক্ষা কক্ষ, শিশুদের জন্য বিশাল বারান্দায় ছড়িয়ে আছে নানারকম খেলনা। হাসপাতালটি যেন ছোটখাটো একটি শিশুপার্ক। এখানে লাইব্রেরি, ডাইনিং রুম এবং মিউজিক থেরাপি রুমও আছে।
৪. ক্লিমেনসিউ মেডিকেল সেন্টার, বৈরুত, লেবানন
এটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল। হাসপাতালটি বিশ্ববিখ্যত জন হপকিন্স মেডিসিন ইন্টারন্যাশনালের সাথে সম্পৃক্ত। কাঁচ এবং কনক্রিটের আশ্চর্য সংমিশ্রণে গড়া বহির্ভাগ এবং প্রশস্ত অন্দর সম্বলিত এই হাসপাতালটিতে বিলাসবহুল ফাইভ স্টার হোটেলের আবহ তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালে প্রবেশ করলে এর শৈল্পিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন দেখে সুখানুভূতিতে ছেয়ে যায় মন। হাসপাতালটিতে আছে টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট সুবিধা। অসংখ্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাথে রয়েছে ভিডিও কনফারেন্সিং রুম, যার মাধ্যমে হাসপাতালের বা বাইরের যেকোনো চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা যায়।
৫. ডিক্সি রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টার, সেইন্ট জর্জ, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের উতাহ প্রদেশে মরুভূমির কোল ঘেঁষে অবস্থিত জায়ন ন্যাশনাল পার্ক। আর পার্কের পাশে স্থাপিত ডিক্সি রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টার। এই হাসপাতালের ডিজাইনারদের মরুভূমির প্রচণ্ড তাপমাত্রার মাঝে স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়টি যথেষ্ট বিবেচনা করতে হয়েছে। যেমন- ভবনটি কোনদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবে, আলো কোনদিক থেকে আসবে প্রভৃতি। তারা পার্শ্ববর্তী জায়ন গিরিখাদ থেকে উল্লিখিত ধারণাগুলো পান এবং স্কাইলাইট ব্যবহার করে হাসপাতালের গর্ভে প্রচুর আলো প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। এখানে প্রতিটি রুমেই হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগের সাথে যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে। হাসপাতালের রুম থেকে বাইরের মরুভূমি দেখা যায়। হাসপাতাল ভবনে সার্জারি, কার্ডিওলজি, ইমেজিং প্রভৃতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা প্রবেশপথ আছে।
৬. উইনি পামার হসপিটাল ফর উইমেন্স এন্ড বেবিস, অরলান্ডো, যুক্তরাষ্ট্র
হাসপাতালটি দেখে লাস ভেগাসের কোনো ক্যাসিনো বলে ভুল হতে পারে। এই হাসপাতালটি এতটাই সুন্দর যে, এখানে আসলে রোগী ভুল করে তার রোগকে আশীর্বাদ মনে করতে পারে। তবে এখানে চিকিৎসা নেওয়ার সৌভাগ্য থেকে পুরুষেরা বঞ্চিত হবেন। কারণ হাসপাতালটি শুধু নারী এবং শিশুদের সেবায় নিয়োজিত।
কাঁচের অত্যাধিক ও শৈল্পিক ব্যবহার হাসপাতাল ভবনটিকে অতুলনীয় সৌন্দর্যে সিক্ত করার পাশাপাশি হাসপাতালের অভ্যন্তরকে দিনের বেলায় প্রাকৃতিকভাবে আলোকিত করে রাখে। কাঁচের এই নান্দনিক সাম্রাজ্য মূলত রোগীকে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে মসৃণভাবে সুস্থ করতে অবদান রাখে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে রয়েছে শান্ত রঙের পরশ। হাসপাতালের প্রতিটি রুমে সর্বোচ্চ প্রাইভেসি সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে।
৭. ক্লিনিক হিরসল্যানডেন, জুরিখ, সুইজারল্যান্ড
আধুনিক এবং চমকপ্রদ ডিজাইনের জুরিখের এই হাসপাতালটির ইন্টেরিয়র এবং এক্সটেরিয়র- দু’রকম সাজসজ্জাই অনন্য।
বাসাসুলভ পরিবেশের এই হাসপাতালটিতে ২৫৯টি সিঙ্গেল এবং ডাবল রুম রয়েছে। আছে ক্যাবল টেলিভিশন, ইন্টারনেট, এডজাস্টেবল বিছানা প্রভৃতি সুবিধা। এছাড়াও রয়েছে হাউসকিপিং সার্ভিস, যারা সপ্তাহে তিন দিন প্রতিটি রুমে তাজা ফুল রেখে যায়। ফলে আপনি পেতে পারেন সুবাসিত সুন্দর রুম। হাসপাতালটি সর্বাধুনিক চিকিৎসাপ্রযুক্তিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে। এই হাসপাতাল সুইজারল্যান্ডের প্রথম সাইবারনাইফ রেডিওসার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেছে।
৮. মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনা অ্যাশলে রিভার টাওয়ার, চার্লসটন, যুক্তরাষ্ট্র
সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটন উপদ্বীপ সংলগ্ন এই হাসপাতালটি বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা আর আকর্ষণীয় স্থাপত্য কৌশলের জন্য বিখ্যাত। বিলাসবহুল হোটেলের মতো ইন্টেরিয়র ডিজাইন, হাসপাতালের ভেতরে লাগানো বিচিত্র গাছগাছালির সতেজতা আর নীল পাথরের কাজ করা টাইলসে মোড়ানো প্রবেশপথ দেখে আপনার মনে হতে পারে, আপনি হাসপাতালে নয়, বরং কোনো রিসোর্টে বেড়াতে এসেছেন। স্কাইলাইট আর কাঁচের প্রাচুর্য হাসপাতালটির সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে। এখানে রয়েছে রোগীদের সেবায় ১৫৬টি সিঙ্গেল রুম। রুমগুলোতে কড়া গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা হয়।
৯. সামার রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টার, গ্যালাটিন, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি প্রদেশের গ্যালাটিনে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই হাসপাতালটি তৈরি করা হয়েছে অসাধারণ নান্দনিকতায়। হাসপাতালের প্রবেশপথ পেরুলেই অভ্যর্থনা কক্ষ। আরামদায়ক গদিআঁটা চেয়ার, মার্বেলের কারুকাজ করা দেয়াল আর বিশাল স্ক্রিনের টেলিভিশনে সাজানো অভ্যর্থনা কক্ষ রোগীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। কাঁচের সতর্ক ব্যবহার, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আলোয় আলোকিত এই সুশোভিত হাসপাতালটি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। হাসপাতালের একপাশে কাঁচে ঘেরা টাওয়ারও রয়েছে।
১০. হসপিটাল পান্টা প্যাসিফিকা, পানামা সিটি, পানামা
প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ের উদার প্রকৃতির আশ্রয়ে গড়ে ওঠা পান্টা প্যাসিফিকা হাসপাতাল দক্ষিণ আমেরিকার হাসপাতাল জগতে অগ্রগামী নাম। এটি জন হপকিন্স মেডিসিন ইন্টারন্যাশনালের ছত্রছায়ায় কাজ করে থাকে। সমৃদ্ধ প্রযুক্তিসম্পন্ন এই হাসপাতালে রয়েছে ৫২টি সিঙ্গেল রুম, ১১টি স্যুইট এবং একটি প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটের আরামদায়ক পরিবেশ, যা রোগীদের দ্রুত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। প্রশান্ত মহাসাগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্বাদ নেয়ার পাশাপাশি রোগী এবং রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা হাসপাতালকে ঘিরে অবস্থিত পানামা সিটির দারুণ দারুণ সব রিসোর্ট, শপিং মল, রেস্টুরেস্ট এবং নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার সুযোগ পেতে পারেন।
সেবার আদর্শে আর সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে গড়া এই হাসপাতালগুলো মেডিকেল ট্যুরিজম জগতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুস্থতার জন্য সুষ্ঠু চিকিৎসা এবং সুন্দর পরিবেশ দুটোই প্রয়োজন- এই হাসপাতালগুলো সেটাই মনে করিয়ে দেয়। আশা করি আমাদের দেশেও অচিরেই এমন মোহনীয় সৌন্দর্যের এবং বিশ্বমানের সেবাদানকারী হাসপাতাল নির্মিত হবে।