‘বিফোর সানসেট’ চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্র জেসে ওয়ালেস প্যারিসে সিন নদীর বুকের উপর ক্রুজে করে ঘোরার সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি গল্প বলেন। জার্মানরা যখন মিত্রবাহিনীর আক্রমণে নিজেদের অধীকৃত প্যারিস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়, তখন সিদ্ধান্ত নেয় নটর ডেম ক্যাথেড্রাল ধ্বংস করে যাবার। ভেতরে বিস্ফোরকগুলো সাজিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় তারা শুধুমাত্র একজন সৈন্যকে রেখে গিয়েছিল বিস্ফোরকগুলোর সুইচ চাপার জন্য। একটিমাত্র সুইচ চাপলেই নটর ডেম সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু নটর ডেমের সৌন্দর্য সেই সৈন্যকে এতটাই বিমোহিত করে রেখেছিল যে সে সুইচটি চাপতে পারেনি। তাই প্যারিসের এতগুলো বিখ্যাত স্থাপত্যশিল্পের মধ্যে নটর ডেম ঠিকই যে তার জায়গা ধরে রেখেছে, এটা মোটেই আশ্চর্যের কিছু নয়।
‘নটর ডেম’ একটি ফরাসি শব্দ। এর ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘আওয়ার লেডি’। বাইবেলে বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ী কুমারী মেরিকে এখানে ‘আওয়ার লেডি’ বলা হয়েছে। ক্যাথেড্রালটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটা জানা যাক।
প্রতিষ্ঠা
একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্যারিস ফ্রান্সের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তৎকালীন প্যারিসের বিশপ মরিস ডি সালি ১১৬০ সালে ‘ইল দ্যু লা সিতে’র পূর্ব প্রান্তে একটি চার্চ স্থাপন করার ইচ্ছাপোষণ করলেন। তখন সেখানে রোমান দেবতা জুপিটারের দুটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছিল। মরিস দ্যু সালির ইচ্ছা ছিল এই দুটি মন্দিরকে একত্রিত করে একটি বিশাল ভবন নির্মাণ করবেন।
তিন বছর পর রাজা সপ্তম লুইস এবং পোপ তৃতীয় আলেকজান্ডারের উপস্থিতিতে নটর ডেমের প্রথম পাথরফলকটি স্থাপন করা হয়। এরপরে ১১৮৯ সালে হাই অল্টারটি (যে বেদিতে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়) এবং কয়্যের, ক্যাথেড্রালের পশ্চিমের ফ্যাসাড ও নেইভটি ১২৫০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ করা হয়। এরপরের একশ বছর ধরে পোর্চ, চ্যাপেল এবং অন্যান্য অলংকরণের কাজ করা হয়। এর নতুন ধরনের গথিক স্টাইলের পেছনে কাজ করেছেন জন দে শেল, পিয়ের দে মন্ত্রেউই, জন র্যাভিসহ আরো অনেক স্থপতি। ১৩৪৫ সালে ক্যাথেড্রালের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
গঠন
নটরডেম ক্যাথেড্রালে একটি কয়্যের (ক্যাথেড্রালের যেখানে প্রার্থনাসংগীত গাওয়া হয়) এবং এপ্স (দেয়ালে অর্ধবৃত্তাকার খাদের মত জায়গা যেটা অর্ধগোলক আকারের গম্বুজ দিয়ে আবৃত), একটি ছোট ট্রান্সেপ্ট (চার্চের ভেতরে ক্রস আকারের তির্যক জায়গা) রয়েছে। এর কেন্দ্রীয় স্পায়ারটি (বিল্ডিংয়ের উপরে কনিক্যাল বা পিরামিড আকারের অবয়ব) উনিশ শতাব্দীর সংস্কারের সময় যোগ করা হয়েছিল। নকশানুযায়ী ক্যাথেড্রালটির ভেতরের অংশ ৪২৭ ফুট লম্বা, ১৫৭ ফুট চওড়া এবং ছাদটি ১১৫ ফুট উঁচু। দুটি সুবিশাল গথিক টাওয়ার পশ্চিমের ফ্যাসাডটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, যেটা তিন তলায় বিভক্ত। এর দরজাগুলো সুন্দর গথিক ধরনের বক্রতা দিয়ে শোভিত এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের রাজাদের মূর্তির সারির উপর বসানো হয়েছে।
দুটি টাওয়ার ২২৩ ফুট উঁচু; এগুলোর ছাদ যে স্পায়ারগুলো দিয়ে অলংকরণ করার কথা ছিল সেগুলো কখনোই বসানো হয়নি। ক্যাথেড্রালের পূর্বদিকের দেয়ালে এপ্সের বিশাল কতগুলো জানালা রয়েছে যেগুলো রেয়োনেন্ট গথিক স্টাইলের অবিভক্ত ফ্লায়িং বিউট্রেসের (বিশেষ ধরনের বাঁকানো কাঠামো, যার নিচে ভার বহন করার জন্য পিলার থাকে) উপর বসানো। ক্যাথেড্রালের তিনটি সুবিশাল রোজ উইন্ডো তাদের তেরো শতকের কাঁচগুলো ধারণ করে আছে।
নটর ডেমের এক বিখ্যাত আর্টিফ্যাক্ট হল তার বেল টাওয়ারের ঘন্টাগুলো। কোনো দর্শনার্থী এই ঐতিহাসিক ঘন্টাগুলো যদি দেখতে চান, তাকে বেল টাওয়ারের সিঁড়ির ১৪০টি ধাপ গুনতে হবে। ফ্রান্সের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ দিনে এই ঘণ্টাগুলো বাজানো হয়।
ইতিহাস এবং সংস্কার
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে। নটর ডেমও তার ব্যতিক্রম নয়। নটর ডেমের ইতিহাসে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে ১৪৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে। ক্যাথেড্রালের মধ্যে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যকার একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরিকে একইসাথে ফ্রান্সেরও রাজা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
ঐ বছরই কয়েক মাস আগে ফ্রান্সের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত নারী জোয়ান অব আর্ককে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। জোয়ান অব আর্ক ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের যুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সকে তার বুদ্ধিদীপ্ত সামরিক কৌশল দিয়ে সাহায্য করেন। তার নেতৃত্বে ফ্রান্স কয়েকটি যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। যা-ই হোক, যুদ্ধশেষে ১৪৫৬ সালের একটি নতুন বিচারে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। পরে ১৯০৯ সালে নটর ডেম ক্যাথেড্রালে তাকে বিটিফাই (ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা কোনো ব্যক্তির স্বর্গবাসী হওয়ার ঘোষণা) করা হয়।
ষোড়শ শতাব্দীর সময়ে ক্যাথেড্রালটির পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাঙন ধরে। আধুনিকায়নের নামে এর অনেকগুলো অলংকরণ সরিয়ে ফেলা হয়। পরে ১৬৯৯ সালে রাজা চতুর্দশ লুই স্থপতি রবার্ট দ্যু কত্তেকে এটি পুনর্নির্মাণ করার দায়িত্ব দেন। এই সময়েই এটি তার বিখ্যাত অরগানটি পেয়েছিল, বর্তমানে যার আট হাজার পাইপ রয়েছে।
ফরাসি বিপ্লবের সময়ে আবারো নটর ডেমের দুর্ভাগ্য শুরু হয়। এই সময়ে চার্চটি খাবার এবং মদের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এভাবে নোংরা এবং অযত্নে এটি ভগ্নদশায় পড়ে। এই সময়েই ক্যাথেড্রালের ভেতরের অনেকগুলো মূর্তি তাদের মাথা হারিয়েছিল। এই বিচ্ছিন্ন মাথাগুলো ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বর্তমানে ক্লুনি মিউজিয়ামে এগুলো সংরক্ষিত আছে।
বিপ্লবের পরে ১৮০১ সালে নেপোলিয়ন সরকার একটি চুক্তি সম্পন্ন করে যে, নটর ডেমের নিয়ন্ত্রণ ক্যাথলিক চার্চের কাছে ফেরত যাবে। পরে ১৮০৪ সালে নেপোলিয়নকে এই ক্যাথেড্রালেই সম্রাট ঘোষণা করা হয়। এর পূর্বেই তার উদ্যোগে ক্যাথেড্রালটি মেরামত করা হয়।
নেপোলিয়নের উদ্যোগের পরেও নটর ডেমের ভেতরের ভগ্নদশা সম্পূর্ণভাবে ঠিক হয়নি। ১৮৩১ সালে ভিক্টর হুগোর ‘নটর ডেম দ্যু পারী’ উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম’ নামে প্রকাশিত হয়। এরপরেই নটর ডেমকে তার পুরাতন ঐতিহ্যরুপে ফিরিয়ে আনার জন্যে একটি ক্যাম্পেইন শুরু হয়ে যায়। ১৮৪৪ সালে বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি ইউজেন ভিওলে ল্যু দুচকে নিযুক্ত করা হয় ক্যাথেড্রালটি মেরামতের জন্যে। এই প্রজেক্টটি প্রায় বিশ বছর সময় ধরে নটর ডেমকে তার পুরাতন রুপে ফেরত আনতে সাহায্য করেছিল। ১৯৯৬ সালে ভিক্টর হুগোর বই থেকে ডিজনি ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে।
সৌভাগ্যক্রমে কোনো বিশ্বযুদ্ধই নটরডেমের বড় কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। যদিও জার্মানদের ভয়ে এর অনেকগুলো শিল্পকর্ম সরিয়ে রাখা হয়েছিল। এরকম সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল রোজ উইন্ডোর (সম্ভবত ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত সবচেয়ে বড় গ্লাস উইন্ডো) মতো কিছু অনন্য পুরাতাত্ত্বিক শিল্পকর্ম এবং অলংকরণকে নিরাপদ রাখার জন্য। ১৯৪৪ সালে জার্মান সৈন্যরা প্যারিস ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে এই নটর ডেমেই প্যারিসবাসীর স্বাধীনতা উদযাপন করা হয়।
১৯০৫ সালে পাস হওয়া একটি আইন অনুযায়ী ক্যাথেড্রালটি সরাসরি ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়। যদিও শুধুমাত্র রোমান ক্যাথলিক আচার অনুষ্ঠানের জন্যই এটা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই প্রতি রবিবার ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা সমাবেশ বসে এবং এটিই প্যারিসের আর্চবিশপের কার্যালয়।
সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড
‘বিফোর সানসেট’ চলচ্চিত্র দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল। সেখানে একটি কথা বলা হয়েছে,
But you have to think that Notre Dame will be gone one day. There used to be another church at the Seine, right there.
ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন সময়েই নটর ডেম এতবার ধ্বংস হওয়ার মুখোমুখি হয়েছিল যে এই কথাটিকে মিথ্যা শঙ্কা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সম্প্রতি ১৫ এপ্রিল, ২০১৯ সালে আগুন লেগে ক্যাথেড্রালটির মধ্যযুগীয় ছাদ এবং স্পায়ার ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। যদিও বেল টাওয়ার এবং রোজ উইন্ডোগুলো এই আকস্মিক আগুন থেকে রক্ষা পায়। ধারণা করা হচ্ছে, এই আগুন ফরাসি বিদ্রোহের তুলনায়ও নটর ডেমের বেশি ক্ষতি করেছে। তাই ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাঁখো নটর ডেম পুনর্নির্মাণের জন্যে অর্থসাহায্য চেয়ে একটি ক্যাম্পেইনের ঘোষণা দেন। এর পরপরেই ফ্রান্সের ধনী পরিবার এবং কোম্পানিগুলো থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ইউরোর মতো অর্থসাহায্য উত্তোলন করা হয়।
যারা পিসিতে গেম খেলেন তাদের নিশ্চয়ই ‘অ্যাসাসিন্স ক্রিড: ইউনিটি’ গেমের কথা মনে আছে। ২০১৪ সালে ফ্রান্সভিত্তিক গেম ডেভেলপার কোম্পানি ইউবিসফট ফরাসি বিদ্রোহের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই গেমটি মুক্তি দিয়েছিল। এই গেমটি যেহেতু প্যারিসের পটভূমিতে তৈরি এবং গেমটিতে প্রতিটি ভবনের দেয়াল বেয়ে ওঠা যায়, তাই পর্যাপ্ত তথ্যসহ নির্মাতাদেরকে গেমের ভেতর নটর ডেমের একটি নিখুঁত ভার্চুয়াল প্রতিরুপ তৈরি করতে হয়েছিল। এজন্য ডেভেলপাররা অনেক সময় নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এবং এসময় অনেক ছবি তুলেছিলেন ও নকশার সাহায্য নিয়েছিলেন। ইউবিসফট কোম্পানি নটর ডেম পুনর্নির্মাণে তাদের আর্কাইভে থাকা এসব তথ্য এবং ছবি দিয়ে সাহায্য করার ইচ্ছা জানিয়েছে। নটর ডেমের সম্মানে তারা এপ্রিলের ২৫ তারিখ পর্যন্ত ‘অ্যাসাসিন্স ক্রিড: ইউনিটি‘ গেমটি বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। এমনকি কোম্পানি থেকে সাড়ে পাঁচ লক্ষ ইউরোও দান করা হয়েছে।
শেষ কথা
নটর ডেম একইসাথে একটি ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন। অগ্নিকাণ্ডের পর প্যারিসের একজন অধিবাসী বলেছিলেন,
It’s not just a Parisian monument. It’s not just Christian. It’s not just French.
এজন্যই প্রতি বছর নটর ডেম দেখতে প্রায় ১২-১৪ মিলিয়ন দর্শনার্থীর সমাগম হয়। এ কারণেই নটর ডেমে আগুন লাগার পর পুরো পৃথিবীর মানুষ ব্যথাভরা বুক নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিল। এভাবেই নটর ডেম পুরো পৃথিবীর মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভুলে একসুতোয় গেঁথে দেয়।