গ্রিক স্থপতিরা প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এবং বৈচিত্র্যময় ধারায় স্থাপত্যশৈলীর প্রবর্তন করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের শহর-নগর এবং জীবনযাত্রার জন্য নির্মিত সকল স্থাপনাতেই নান্দনিকতার পাশাপাশি শৈলীর ভিন্নতা পাওয়া যায়। গ্রিকদের যেসব স্থাপত্যশৈলী এখন অবধি মানুষের মনকে আকর্ষণ করে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো গ্রিকদের মন্দিরগুলো। পাহাড়ের উপর সুন্দর আর ক্লাসিক স্থাপত্য ধারায় গঠিত। আজকের আয়োজনে থাকছে প্রাচীন গ্রিসের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ভবনগুলোর কিছু বর্ণনা।
অ্যাগোরা
অ্যাগোরা শব্দটি গ্রিক। এর অর্থ দাঁড়ায় ‘সমাবেশের জন্য খোলা জায়গা’। প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসের প্রথম দিকে, শহরের মধ্যে এরকম একটা খোলা স্থান নির্ধারণ করা থাকতো। সেখানে সবাই মিলে নাগরিক সমাচার, সৈন্যবাহিনীর মহড়া কিংবা রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করতে পারতো। পরবর্তীতে অ্যাগোরা পরিণত হয় একটি উন্মুক্ত কিন্তু তাবু দিয়ে ঢাঁকা এক বাজারে (যেটা এখনো গ্রিসে বিদ্যমান আছে)। এখানে ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান নিয়ে বসে এবং কারিগররা আসে তাদের বানানো জিনিসপত্র বিক্রি করতে। আর নাগরিকরা আসে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিতে। প্রাচীন গ্রিক স্থাপত্যের মধ্যে মন্দিরগুলোর পরেই যে স্থাপত্যগুলো সবচাইতে বেশি প্রসিদ্ধ তা হচ্ছে অ্যাগোরা।
প্রাচীন গ্রিসে অ্যাগোরাগুলো মূলত বর্গাকার কিংবা ত্রিভুজাকার হতো; বেশিরভাগ সময়ই সেগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হতো। এগুলো যেন নগরের একদম প্রাণকেন্দ্রে থাকে এবং এর আশেপাশের অঞ্চলটি যেন মঠ, মন্দির এবং বিভিন্ন নাগরিক স্থাপত্যে দিয়ে ঘেরা থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হতো। পরবর্তীতে অ্যাগোরাকে ঘিরে ভবন গড়ে উঠতে শুরু করলে কিংবা জনসংখ্যার আধিক্য দেখা দিলে এটি সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতো তারা।
স্টোয়া
স্টোয়া হচ্ছে প্রাচীন গ্রিসের সহজ আর সাদাসিধে একটা স্থাপত্য। বলা যায় চলাচলের জন্য মুক্ত কোনো স্থান। এটি একধরনের হাঁটার রাস্তা বা প্যাসেজ। এরা লম্বা আর মোটা স্তম্ভের সারি দিয়ে দুদিক থেকে ঘেরা থাকে অথবা কখনো কখনো এক পাশে স্তম্ভ আর অন্যপাশে প্রাচীর দেয়াল থাকে। স্তম্ভগুলো সমান্তরালে দাঁড়িয়ে থাকে আর সেগুলোর উপর আচ্ছাদিত ছাদ থাকে।
স্টোয়াগুলো সাধারণত প্রায় ১০০ মিটার বা ৩৩০ ফুট সমান লম্বা। আর কলামগুলো প্রায় ৪ মিটার বা ১৩ ফুট এবং ছাদের জায়গাটা প্রায় ৮ মিটার বা ২৬ ফুটের সমপরিমাণের হয়ে থাকে। স্টোয়াগুলোর মধ্য দিয়ে লোকেরা অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। যখন কোনো স্টোয়া অ্যাগোরার দিক নির্দেশ করত তখন পেছনের প্রাচীরগুলোতে ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান খুলে পসরা সাজিয়ে বসত এবং বিক্রি করত।
এগুলো মূলত মন্দির অথবা থিয়েটারে নির্মিত হতো। কিছু কিছু অ্যাগোরার চারিদিক থেকেই স্টোয়া থাকত; তবে বেশিরভাগ স্টোয়াই অশ্বখুরাকৃতি কিংবা ইংরেজি এল অক্ষরের মতো কিংবা গ্রিক অক্ষর পাই এর মতো করে বানানো কাঠামো। আবার কিছু কিছু স্টোয়ার পেছন দিকে বিশাল কক্ষ থাকত।
ট্রেজারি (থিসোরাস)
ট্রেজারি বা রাজ কোষাগার (গ্রিক ভাষায় থিসোরাস) হচ্ছে মন্দির সদৃশ ছোট স্থাপত্য ভবন। এখানে দেবতাদের উদ্দেশ্যে অভিজাত শ্রেণির অর্ঘ্য স্বরূপ দেওয়া সম্পদসমূহ নিরাপদে গচ্ছিত রাখা হতো। ট্রেজারি ভবনগুলো মূলত নাগরিক ভবন হিসেবেই পরিচিত ছিল। বিশেষ কোনো গোত্র বা ব্যক্তিবিশেষের বদলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্মিত হতো। অবশ্য বেশ কিছু স্বেচ্ছাচারী শাসক নিজেরাই তা নির্মান করে নিত। প্রাচীন বীরদের সম্মানে অথবা দেবতাদের উদ্দেশ্যে অভিজাতদের দেওয়া সম্পদ এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত মালামাল এখানেই সংরক্ষণ করা হতো। লম্বা এবং ধাপবিহীন কাঠামো দিয়ে থিসৌরির ভিত্তি স্থাপন করা হতো।
সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের থিসৌরিটি নির্মিত হয়েছিল সপ্তম শতকের শেষের দিকে, আর সবচেয়ে প্রাচীনটি নির্মিত হয়েছিল চতুর্থ শতকের শেষের দিকে। বেশিরভাগ থিসৌরি জনসমক্ষে নগরচত্বরের আশেপাশে নির্মিত হতো। তবে কিছু কিছু থিসৌরি শহরের বাইরেও স্থাপন করা হতো।
থিয়েটার (থিয়েটর)
গ্রিক স্থাপত্যের বড় বড় স্থাপনাগুলো হচ্ছে থিয়েটার বা নাট্যমঞ্চ। থিয়েটারে প্রথাগত রীতিনীতি অনুযায়ী অভিনীত নাটক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। থিয়েটারগুলো অর্ধ-গোলাকৃতির হতো। প্রসেসেনিয়াম (মঞ্চের বিশেষ জায়গা) এবং মঞ্চকে ঘিরে চারদিক জুড়ে বসার ব্যবস্থা থাকত এসব থিয়েটারে।
ভালো একটা গ্রিক থিয়েটার প্রধান তিনটি অংশে নির্মিত হতো- স্কিন, থিয়েট্রন এবং অর্কেস্ট্রা। স্কিন (অভিনয়ের জায়গা) এবং থিয়েট্রন (বসার জায়গা) এই দুইয়ের মাঝের গোলাকার অথবা অর্ধ-গোলাকার সমতল জায়গা হচ্ছে অর্কেস্ট্রা। কিছু কিছু থিয়েটারে অভিজাতদের জন্য বিশেষ বসার স্থান থাকত, যেগুলোকে প্রোহেড্রিয়া বা প্রোয়েড্রিয়া বলা হতো।
অভিনয়ের পুরো জায়গাটা জুড়েই স্কিন বিদ্যমান থাকত, এবং বেশিরভাগ সময়ই এগুলো প্রাসাদ বা মন্দিরের সম্মুখভাগের প্রতিনিধিত্ব করত। কিছু কিছু স্কিন আবার কয়েকতলা উচ্চতার ছিল এবং সেগুলোর প্রবেশপথও আলাদা আলাদা ছিল। যথাযোগ্য স্থানে দেবতার ভাষ্কর্য থাকত যেন পুরো মঞ্চটাই দেবতার নজরে থাকে।
প্যালেস্ট্রা (জিমনেসিয়াম/ব্যায়ামাগার)
গ্রিক ব্যায়ামাগারও ছিল নাগরিক ভবন। পৌর কর্তৃপক্ষ এদের নির্মাণ এবং নিয়ন্ত্রণ করত। এগুলো পরিচালিত হতো জিমনিশিয়ার নামে সরকারী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে। মূলত, জিমনেসিয়াম হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে যুবক এবং মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা নগ্ন হয়ে প্রতিদিনকার খেলাধুলা এবং ব্যায়াম করত; সম্ভবত তারা স্নান ঘরে গোসলও সেরে নিত।
তবে সেসব জায়গায় লোকেরা সামাজিক যোগাযোগ, টুকটাক কথাবার্তা, গল্পগুজব, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং শিক্ষা-দীক্ষা বিষয় নিয়েও আলাপ আলোচনা করত। কিছু জিমনেসিয়ামে লেকচার হলও থাকত। সেখানে ভ্রমণরত দার্শনিকেরা এসে বক্তৃতা দিয়ে যেতেন। ছাত্রদের জন্য একটা ছোট্ট পাঠাগারও রাখা হত সেখানে।
এছাড়াও, ব্যায়ামাগারগুলো প্রদর্শনী, বিচারসংক্রান্ত শুনানি, এবং সরকারি অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি যুদ্ধের সময় সামরিক ব্যায়াম এবং সামরিক অনুশীলনের জন্যেও ব্যবহৃত হতো।
ফাউন্টেন হাউস (জল সংরক্ষাণাগার)
এগুলোকে বলা যেতে পারে বড় বড় পুল। নগরীর জল সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হতো এগুলো। প্রথম দিকে বিভিন্ন ধরনের পাইপ দিয়ে জলাধার বানিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি মজুদ করা হতো খোলা জায়গাতেই।পরে ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে এগুলোতে আচ্ছাদন যুক্ত হয়। ছাদের সংযুক্তি দিয়ে বড় ভবনের মধ্যেও এ ধরনের সংরক্ষাণাগার তৈরি হতো। পানির সঠিক প্রবাহ এবং নিষ্কাশনের জন্যে ছিল আলাদা ব্যবস্থা।
ডোমেস্টিক হাউস (গৃহস্থালি ঘরবাড়ি)
গৃহস্থালি ঘরবাড়িতেও স্তম্ভশোভিত লম্বা বারান্দা থাকত প্রবেশের জন্য। বারান্দার শেষ মাথায় ঘরগুলো আলাদা হয়ে যেত। যেমন- শোবার ঘর বা খাবার ঘর। এগুলো এক থেকে দুই তলার বেশি হতো না সাধারণত। প্রত্যেকটার অভ্যন্তরেই আলো-বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ততার জন্য খোলা আঙ্গিনা রাখা হতো। শীতকালে উষ্ণতার জন্যে উনুনের ব্যবস্থা করা হতো এবং কুয়া রাখা হতো যেন সবসময়ই পানির যোগান থাকে।
আর থাকতো অ্যান্ড্রন। এটি হচ্ছে প্রাচীন গ্রিসের পুরুষদের থাকার স্থান বিশেষ। এগুলো সাধারণত বাড়ির উপরের তলার দিকে হতো। বাড়ির সকল পুরুষেরা কিংবা বহিরাগত পুরুষরা মিলে সেখানে মদ্যপান এবং গল্পগুজব করত। আর অ্যান্ড্রনের মতো করে নারীদের জন্য নির্মিত হতো গুনাইকোনিটিস। নারীদের সুবিধার্থে সাধারণত দ্বিতীয় তলার পেছন দিকে অথবা বাড়ির ভেতরের দিকে এরকম কক্ষ নির্মান করা হতো। সেখানে নারীরা গল্পগুজব ছাড়াও সেলাই কর্ম বা হাতের কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন।
বাড়ির ভেতরের প্রাঙ্গন ছিল উন্মুক্ত। এখানে নারী, পুরুষ, পরিবারের লোকজন অথবা অপরিচিতরা অনায়াসে প্রবেশ করতে এবং ঘুরাঘুরি করতে পারত। টুকিটাজি কাজের কথা বলা ছাড়াও এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।