পুরনো স্থাপনা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে কথাটা বলতে একটু খারাপ লাগছে! কারণ পুরনো স্থাপনা, রাজপ্রাসাদ বা জমিদার বাড়িতে গেলে শুধু ভালো লাগার অনুভূতিই কাজ করে না! সেখানে কষ্টের অনুভূতিও কাজ করে। তবে সেটা সেরকম রাজপ্রাসাদের মালিক না হতে পারার অতৃপ্তি নয়! কষ্ট লাগে এ কারণে যে যারা এত সুন্দর সুন্দর প্রাসাদের অধিবাসী ছিল, পুরো ভবনকে কর্মচাঞ্চল্যে ভরিয়ে রাখতো আজ তারা কোথায়? তাদের বসবাসস্থল মলিনমুখে বা ঔজ্জল্য নিয়ে দাড়িয়ে থাকলেও নাই সে ভবনগুলোর অধিবাসীগুলো! এটা মানবজাতির একটা বড় ট্রাজেডি। মহাকাল তার সোনার তরীতে তুলে নেয় মানুষের কর্মগুলো কিন্তু সেই কর্মের পেছনের মানুষগুলোকে জায়গা দেয় না! এই ট্রাজেডির কথা ভেবে মনে কষ্ট লাগে।
আবার আনন্দ লাগে এই কথা ভেবে মানবজাতি কতটা পথই না এগিয়েছে! কতকিছুই না করেছে! মানুষের এই সৃষ্টিকর্ম, কর্মচাঞ্চল্য আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।
পুরনো স্থাপনা ভ্রমণে প্রত্যেকের মনেই নস্টালজিয়া এসে ভর করে, পুরনো স্মৃতি এসে উকি দেয়, বর্তমানটা বেশ উপভোগ্য হয়ে দাড়ায় আবার ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে। এজন্য পুরনো স্থাপনা পরিদর্শন করা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে।
বিভিন্ন রাজপ্রাসাদ বা ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শন করলে আমরা একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের অতীত অনুসন্ধান, তাদের বিকশিত হওয়ার পরিভ্রমণটা নিয়ে ধারণা লাভ করি। এটা ইতিহাস ঐতিহ্য চেতনা জাগ্রত করার সাথে সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা বাড়ায়। এজন্য আমাদের দেশে যেইসব রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি, প্যালেস বা যেকোন ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে সেগুলো পরিদর্শন করার সাথে সাথে সেগুলো নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করতে হবে। এটা আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও স্বকীয়তা নির্মাণে সাহায্য করবে।
আবার বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতা বা জাতিসমূহের পুরনো স্থাপনা, রাজপ্রাসাদ পরিদর্শন করতে হবে। তাহলে সে জাতিসমূহের সাথে আমাদের কি কি মিল বা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় সেটা ধরতে পারবো। আবার অনেকেই কোন ধরণের গভীর অনুসন্ধান বা স্টাডি করার জন্য বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেন না। স্রেফ সেটা দেখাতেই সীমাবদ্ধ। এতে দোষের কিছু নেই। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলোতে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের হক আছে। অবশ্য সেটা আদায় করে নিতে হবে। এই যে বিভিন্ন রাজা-বাদশাদের রাজপ্রাসাদে ঘুরাঘুরি হচ্ছে সেখানে তো আমরা সেই অধিকারকেই বাস্তবায়ন করছি! ভূমিকা শেষ করে এবার ভ্রমণবিলাসীদের জন্য কয়েকটা সুন্দরতম রাজপ্রাসাদের কথাগুলো বলে ফেলি। বিশ্বের সুন্দরতম এমন দশটি রাজপ্রাসাদ নিয়ে এই লেখাটি।
অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা ঐসব রাজপ্রাসাদগুলোতে ভ্রমণ করলে আপনি হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের অলিতে গলিতে! প্রতিধ্বনি শুনতে পাবেন অতীতের, অনুভব করবেন অতীতের রাজরাজরাদের উপস্থিতি, হয়তো দেখতে পাবেন তাদের রেখে যাওয়া পায়ের ছাপ! যে পথ দিয়ে হেঁটে চলছে ইতিহাস। আপনি ও তাদের রেখে যাওয়া পথের পথিক হতে পারেন। একেকটি রাজপ্রাসাদ যেন স্বর্গের নকল। স্বর্গ থেকে তো কেউ ঘুরে আসতে পারেনি তবে এ রাজপ্রাসাদগুলো দেখলে মনে হবে স্বর্গ হয়তো এমনটাই! যারা এখনই যেতে পারছেননা তারা শুধু ছবি দেখেই মন জুড়ান। শুধু দেখলেই কিন্তু আপনার হৃদয়-মন জুড়িয়ে যাবে। তাই দেখার সুযোগ মিস করবেন না অবশ্যই!
১. এইলিয়ান ডোনান
স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে একটি দ্বীপের মধ্যে এ রাজপ্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছে। স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি ছবি তোলা দর্শনীয় জায়গাগুলোর মধ্যে প্রথম। ১৭১৯ থেকে শুরু করে ২০০ বছরের মত এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। জেকোবাইট বিদ্রোহের পর রাজপ্রাসাদ অনেকটা ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়। ১৯১১ সালে আবার পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়। পর্যটকরা ৬.৫০ ডলার খরচ করে এ আকর্ষণীয় রাজপ্রাসাদটিতে ঘুরতে পারে।
তাজমহল যেমন দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ নেয় এই রাজপ্রাসাদটিও বিভিন্ন আবহাওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়। সূর্যের আলোতে একরকম দেখা যায়, ঝড়ের সময় আরেক রূপ আর বরফ গলা শীতের সময় অন্য রূপ।
এইলিয়ান ডোনান কি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাজপ্রাসাদ?
চলুন একটু দেখে নেই এর সাথে প্রতিযোগিতা করছে কোন রাজপ্রাসাদগুলো-
২. শ্যাতো দে ভিনসেনস্, ফ্রান্স
ফ্রান্সের প্যারিসের ভিনসেনস্ শহরে এই কেল্লাটি অবস্থিত। এটা ১৩৪০ থেকে ১৪১০ এর মধ্যে নির্মিত হয়। রাজা সপ্তম লুই শিকার করার জন্য বের হলে এ কেল্লাটি ব্যবহার করতেন। আসল স্থাপনাটির বিশাল অংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। চতুর্দশ শতকে নির্মিত অংশগুলোর পুন:স্থাপনা করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। প্রাসাদটির চতুর্দিক একটি পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। প্রাসাদটিতে প্রবেশের জন্য তিনটি বড় বড় প্রবেশদ্বার রয়েছে।
৩. লে মন্ত সেইন্ট মিচেল, ফ্রান্স
ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ক্যুসোনান নদীর নদীর আঁধা মাইল দূরে এটি অবস্থিত। বিশপ আব্রানচেস্-এর অনুরোধে এটি প্রথম দিকে গীর্জা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় ৭০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর। ফরাসী বিপ্লবের সময় এটি জেলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে এর সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেয়া হয়।
৪. রোকা দেলা গুয়েইতা, সান মারিনো, ইতালি
তিনটি টাওয়ার বিশিষ্ট এই রাজপ্রাসাদটি থেকে ইতালির সান মারিনোর পুরোটি দেখা যায়। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে তবে স্থাপনাটি ১১ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার ও বেল টাওয়ার রয়েছে। আরও আছে সেন্ট বারবারা চ্যাপেল ও একটি দুর্গ যেটি বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
৫. নুশোয়ানসেই প্রাসাদ, বেভারিয়া, জার্মানি
এ রাজপ্রাসাদটি জার্মানির বেভারিয়া অঞ্চলের শোয়াংগুতে অবস্থিত। ১৮৮৬ সালে রাজা লুডউইগের মৃত্যুর পর পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। প্রত্যেক বছরে এক মিলিয়নেরও বেশি লোক এখানে ঘুরতে আসে। ডিজনীল্যান্ডের ‘স্লিপিং বিউটি রাজপ্রাসাদ’টি তৈরির ক্ষেত্রে এর অনুকরণ করা হয়েছে।
৬. পার্টারগফ, সেইন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া
এটাকে অনেক সময় রাশিয়ার ভার্সেই বলা হয়। সেন্ট পিটার্সবার্গের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় স্থাপনা হচ্ছে এটি। বলা হয়ে থাকে সম্রাট পিটার দ্যা গ্রেট ভার্সেই থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে এই প্রাসাদটি তৈরি করেন। রাজপ্রাসাদটির ‘পার্টারগফ’-এর অনুবাদ করলে দাড়ায় ‘পিটারের দরবার’। অনেকগুলো বাগান, ঝর্ণা ও পুকুর পরিবেষ্টিত এই অসাধারণ রাজপ্রাসাদটি।
৭. হিমেজি প্রাসাদ, জাপান
জাপানের সবচেয়ে বড় প্রাসাদ এবং পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই প্রাসাদটি। সম্রাট আকামাতসু নরিমুরা ১৩৩৩ সালে এর নির্মাণ শুরু করেন। ৮৩টি অট্টালিকা নিয়ে এই প্রতিরক্ষা কেল্লাটি তৈরি হয়েছিল। এই প্রাসাদটিকে প্রায়ই ‘হাকারু জো’ নামে অভিহিত করা হয় যার অর্থ দাড়ায় ‘সাদা বকের প্রাসাদ’। দূর থেকে এই প্রাসাদটির দিকে তাকালে মনে হবে যেন একটা পাখি আকাশে ডানা মেলে রেখেছে।
৮. ভার্সাই প্রাসাদ, প্যারিস, ফ্রান্স
সম্রাট ত্রয়োদশ লুই এটি নির্মাণ শুরু করেন তার ছেলে চতুর্দশ লুই এটাকে আরও বড় ও সম্প্রসারিত করেন। দুই হাজার কক্ষবিশিষ্ট তার কয়েকগুণ দরজা-জানালাবিশিষ্ট এ প্রাসাদটির সংগ্রহে আছে ৬,১২৩ টি পেইন্টিং ও ২,১০২ টি ভাস্কর্য। ফ্রান্সের অসীম ক্ষমতাধর রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে দাড়িয়ে আছে ভার্সেই।
৯. বজনিক প্রাসাদ, স্লোভাকিয়া
স্লোভাকিয়ার বজনিক শহরে একটি পাহাড়ের উপর এ প্রাসাদটি তৈরি করা হয়। ১৯৭০ সালে এটাকে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করে স্লোভাকিয়া সরকার। প্রথমদিকে এ দুর্গটি কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল পরে আবার পাথর দিয়ে পুন:নির্মাণ হয় ত্রয়োদশ শতকে। অনেকগুলো বিখ্যাত সিনেমার শুটিং হয়েছে এই রাজপ্রাসাদে। ইতালিয়ান ফ্যান্টাসি মুভি ‘ফান্তাগিরো’র শুটিং হয়েছে এখানে।
১০. গ্র্যান্ড প্যালেস, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
এই অনন্য স্থাপনাটি ১৭৮২ সালে নির্মিত হয় এবং প্রায় ১৫০ বছর ধরে ছিল রাজ পরিবারের বাসস্থান। যদিও সদ্য প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদজে চিত্রালদা প্রাসাদে থাকতেন তবে এই প্রাসাদটি বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করতেন। গ্রান্ড প্যালেসটি অনেকগুলো অট্টালিকা, বাগান, লন ও চত্ত্বরের সমণ্বয়ে অসাধারণ সৌন্দর্যের আশ্রয়।