প্রাক্তন বিটলস, স্যার পল ম্যাককার্টনিকে একবার নারী কণ্ঠশিল্পীদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, কণ্ঠের বিচারে তার শোনা নারী শিল্পীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দ্য কার্পেন্টার্সদের সদস্য ক্যারেন কার্পেন্টার। নামকরা পত্রিক রোলিং স্টোনের তালিকাতেও ক্যারেন কার্পেন্টার ইতিহাসের সেরা একশো গায়িকার মধ্যে চুরানব্বইতম স্থানে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে তাদের গান করার কিছু আলাদা ব্যান্ডই আছে, যারা মাঝে মাঝে ট্যুর করে থাকে।
তারপরও কিন্তু ‘দ্য কার্পেন্টার্স’ নিয়ে সঙ্গীতভক্তরা এখনও দ্বিধাবিভক্ত। প্রতি একজন কার্পেন্টারভক্তের বিপরীতে আরেকজন কিন্তু তাদের গান নিয়ে তাচ্ছিল্য করতে ছাড়ে না। এমনকি, একই পরিবার বা বন্ধুদের মাঝেও কার্পেন্টারদের নিয়ে মতভেদ বিদ্যমান।
রিচার্ড আর ক্যারেন
দ্য কার্পেন্টার্স ভাই-বোন রিচার্ড আর ক্যারেনের গানের জুটি। তাদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের নিউ হ্যাভেন শহরে হ্যারল্ড আর অ্যাগনেস দম্পতির ঘরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই ১৯৪৬ সালের ১৫ অক্টোবর রিচার্ডের জন্ম। ক্যারেন পৃথিবীতে এসেছিলেন আরো চার বছর পর, ১৯৫০ সালের ২রা মার্চে।
রিচার্ডের মাঝে ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হয়। মেরি ফোর্ড, গাই মিচেল, প্যাটি পেজ, পেরি কোমো, ন্যাট কিং আর লেস পলের মতো শিল্পীরা তাকে আকর্ষণ করতেন। ক্যারেন কিন্তু শুরুতে গানবাজনা অত পছন্দ করতেন না। তার আগ্রহের জায়গা ছিল খেলাধুলা। তবে হাই স্কুলে থাকাকালীন ‘গ্লকেনস্পিয়েল’ নামে একধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে গিয়ে ক্যারেনের মনোভাব পরিবর্তন হয়। যন্ত্রশিল্পী হিসেবেই অবশ্য স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি।
সঙ্গীতজগতে প্রবেশ
১৯৬৩ সালে নিউ হ্যাভেন ছেড়ে হ্যারল্ড আর অ্যাগনেস চলে এলেন লস অ্যাঞ্জেলসের কাছে, ডাউনিতে। এখানে স্কুল শেষ করে রিচার্ড ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মিউজিক নিয়ে পড়াশোনার জন্য আবেদন করেন। একই সময় গানের একটি দল করার চিন্তাও মাথায় ঢোকে তার।
রিচার্ড বোন ক্যারেন আর বন্ধু ওয়েস জ্যাকবসকে রাজি করিয়ে ফেলেন। আত্মপ্রকাশ করল ‘দ্য রিচার্ড কার্পেন্টার ট্রিয়ো’। দলের প্রধান রিচার্ড বাজাতেন পিয়ানো, ক্যারেন হাতে নেন ড্রামস আর ওয়েস ব্যাস। ১৯৬৬ সালে এই ত্রয়ী ‘হলিউড বাউল’ প্রতিযোগিতায় সঙ্গীতে প্রথম স্থান অধিকার করে। আরসিএ রেকর্ড নামে একটি কোম্পানির সাথে অল্প সময়ের জন্য এরপর চুক্তিবদ্ধ হয় দলটি।
আরসিএ-র সাথে খুব দ্রুতই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। ওয়েস জ্যাকবসও নানা কারণে ছিটকে পড়েন দল থেকে। বোনকে নিয়ে রিচার্ড এবার ‘স্পেক্ট্রাম’ নামে আরেকটি ব্যান্ড গঠন করেন। এতে তার ইউনিভার্সিটির চার ছাত্রও ছিলো। তবে কিছুদিন পর এই দলও ভেঙে যায়।
রিচার্ড আর ক্যারেন এবার বাইরের কাউকে না নিয়ে নিজেরাই তৈরি করলেন ‘দ্য কার্পেন্টার্স‘। সময় তখন ১৯৬৮। ক্যারেনের সুরেলা কণ্ঠের কারণে ড্রামারের পাশাপাশি তিনিই হলেন ব্যান্ডের কণ্ঠ। রিচার্ড পিয়ানো বাজানো আর সুর তৈরির কাজ করতেন। প্রয়োজনে বোনের সাথে কণ্ঠও দিতেন তিনি।
প্রথম ব্যান্ড ভেঙে যাবার পর থেকেই রিচার্ড তাদের গান রেকর্ড করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে পাঠাচ্ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি একটি কোম্পানির সাথে চুক্তিও করেন। তবে আরসিএ-র মতো এটাও বেশিদিন টেকেনি, কারণ, ছোট্ট সেই কোম্পানির কাছে ক্যারেনের কণ্ঠ বাজারজাতকরণের মতো যথেষ্ট অর্থ ছিল না।
রিচার্ড হাল না ছেড়ে তাদের গান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে থাকেন। ১৯৬৯ সালে এর একটি পড়ল ‘এ অ্যান্ড এম’ রেকর্ডসের অন্যতম ব্যক্তি হার্ব অ্যালপার্টের হাতে। তিনি সাথে সাথেই তাদের সাথে চুক্তি করে নেন। ক্যারেনের বয়স তখন ১৯, রিচার্ডের ২৩।
‘এ অ্যান্ড এম’ থেকে ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘অফারিংস’ (Offerings)। প্রত্যাশামতো ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয় এটি। তবে এরপর তাদের দুটি গান ‘Close to You’ আর ‘We’ve Only Just Begun’ প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম গানটি চার্টের শীর্ষস্থানে উঠে আসে। পূর্বে আরেকজন এই গান গাইলেও রিচার্ডের সুরে ক্যারেন নতুন আঙ্গিকে গানটি পরিবেশন করেন। সেই বছরের গ্র্যামি পুরষ্কার আসরে দুটি গ্র্যামি জিতে নেয় দ্য কার্পেন্টার্স।
‘Close to You’ নামে অ্যালবাম বের করে প্রচুর সফলতা পায় দ্য কার্পেন্টার্স। খুব দ্রুতই তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ডাক আসতে থাকে নানা জায়গায় গান পরিবেশনের। কার্পেন্টারদের কোনো ব্যক্তিগত ম্যানেজার না থাকায় সঙ্গীত তৈরির পাশাপাশি মিডিয়া, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর দর্শকদের সাথে তাদেরই সরাসরি কথা বলতে হতো। তরুণ রিচার্ড আর ক্যারেনের উপর এজন্য প্রচন্ড চাপ তৈরি হয়। ক্যারেন মূলত ড্রামস বাজাতে পছন্দ করতেন, গাইতে গিয়ে বহু মানুষের মনোযোগের লক্ষ্যবস্তু হওয়া তার মানসিক জগতে বড় এক ধাক্কা দেয়।
খ্যাতির শীর্ষে
সত্তরের দশক ছিল কার্পেন্টারদের সুবর্ণ সময়। একের পর এক সফল গান উপহার দিয়ে যায় তারা। সব গানের সঙ্গীতায়োজন করতেন রিচার্ড। তবে স্টুডিওতে তার একরোখা আচরণ নিয়ে বেশ সমালোচনা ছিল, কারণ নিজের কাজে ভিন্নমত সহ্য করতেন না তিনি। বিপরীতে, ক্যারেন ছিলেন অনেকটা মৃদুভাষী এবং সরল প্রকৃতির। তার কণ্ঠের উপযুক্ত করে রিচার্ড সুর দিতেন, আর ক্যারেন একবসাতেই তুলে ফেলতেন সেই গান। ক্যারেনের প্রায় সব গানই স্টুডিওতে একবারে রেকর্ড করা।
১৯৭৩ সালের ১লা মে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সামনে হোয়াইট হাউজে কনসার্ট করে দ্য কার্পেন্টার্স। সময়টা ছিল তাদেরই। টেলিভিশন শো, বিশ্বজুড়ে ট্যুর, একের পর এক হিট অ্যালবাম তাদের ঘরে ঘরে পরিচিত করে তুলেছিল। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত কার্পেন্টারদের পঞ্চম অ্যালবামের গান ‘Yesterday Once More’ তাদের সফলতম গানে পরিণত হয়।
ইমেজ
পাঠক নিশ্চয় ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন- সবই তো বুঝলাম, কিন্তু কার্পেন্টারদের নিয়ে বিতর্কটা পরিষ্কার হলো না! এজন্য তাকাতে হবে সময়টার দিকে। তখন ‘রক অ্যান্ড রোল’ জোয়ার চলছে। রকস্টারদের পুজো করছে তাদের ভক্তরা। অগোছালো, অনিয়ন্ত্রিত জীবনে অভ্যস্ত রক তারকাই তরুণসমাজের ক্রেজ। তাদের কাছে এই তারকাদেরই বেশি জীবনঘনিষ্ঠ মনে হয়। ধুমধাড়াক্কা রক মিউজিকের সামনে অন্য সবই তাদের কাছে খেলো।
সঙ্গীতের দিক থেকে কার্পেন্টারদের গান ছিলো পপ ঘরানার। ক্যারেনের মোলায়েম ও সুরেলা কণ্ঠ, এবং রিচার্ডের সুর রক গানের থেকে একেবারেই ভিন্ন। তাদের এজেন্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্য কার্পেন্টারদের পরিচ্ছন্ন ইমেজ তৈরি করে তাদের রকশিল্পীদের থেকে বিপরীত মেরুতে দাঁড় করানো। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের জীবন প্রচার করা হতো গোছানো, ধূমপান, মদ্যপানমুক্ত বলে। কোনো স্ক্যান্ডালের সাথে কার্পেন্টারদের জড়ানো হয়নি। যদিও রোলিং স্টোনের সাথে সাক্ষাৎকারে রিচার্ড জানিয়েছিলেন, পুরো বিষয়টি তাদের উপর রেকর্ড কোম্পানি থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের যে পরিচ্ছন্ন ইমেজ উপস্থাপন করা হচ্ছিল, কার্পেন্টারদের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে তার খুব বেশি মিল ছিল না।
ঠিক এই কারণেই সঙ্গীতভক্তদের অনেকের মধ্যেই কার্পেন্টারদের নিয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। একে তো তাদের হালকা ধরনের গানকে রক সঙ্গীতে আসক্ত ভক্তরা মিউজিকই মনে করত না। তার উপরে যে ক্লিন ইমেজ কার্পেন্টারদের নামে ব্যবহার করা হয়, তা অনেকেরই বিরক্তি তৈরি করে। অনেক সমালোচকের কাছেও কার্পেন্টারদের গান উপাদেয় মনে হয়নি।
মজার ব্যাপার হলো- তারপরও একের পর এক হিট উপহার দিয়ে যাচ্ছিলেন রিচার্ড আর ক্যারেন। ফলে মাথা চুলকাতে থাকেন সমালোচকেরা। অবশেষে তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কার্পেন্টারদের প্রকাশ্যে বাতিল করে দিলেও বহু মানুষ ঠিকই তাদের গান শোনে। কিন্তু সতীর্থদের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনতে হবে বলে সেকথা প্রকাশ করে না। ফলে যারা প্রকাশ্যে কার্পেন্টারদের মুণ্ডুপাত করছে, তাদের অনেকের ঘরেই তাদের অ্যালবাম সাজানো আছে।
ক্যারেনের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি
কার্পেন্টারদের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে ক্যারেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। তখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ ছিল না। কারো বিষয়ে কথা বলার সময়ও বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হতো না। ফলে সমালোচকদের অনেকেই যখন ক্যারেনের কণ্ঠের ব্যাপারে কিছু না বলে তাকে মোটা বলে উপহাস করতে শুরু করেন, তখন তিনি তীব্রভাবে আঘাত পান।
নিজের ওজন নিয়ে ক্যারেনের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। তিনি পড়ে যান ওজন কমানোর অবসেশনে। কেবল গ্রিন সালাদ আর আইস টি ছাড়া অন্য কোনো খাবার মুখেই তুলতেন না। তিনি ওজন কমাতে ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ঔষধও ব্যবহার শুরু করেন। আজকের দিনে হলে এগুলো ‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ নামে একটি রোগের বহিঃপ্রকাশ বলে চিহ্নিত হতে পারত।
১৯৭৫ সালে ক্যারেনের ওজন নেমে আসে ৩৫ কেজিতে। কেউ যাতে বুঝতে না পারে এজন্য সবসময় ঢোলা কাপড় পরতেন তিনি। এমনকি রিচার্ড বা তার পরিবারও বুঝতে পারেনি। সেই বছর লাস ভেগাসে ট্যুর করার সময় তার ভয়ঙ্কররকম শীর্ণ শরীর ধরা পড়ে যায়। ট্যুর শেষে লস অ্যাঞ্জেলসে ফিরেই তাকে ভর্তি করা হয় সিডার-সিনাই হাসপাতালে। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানান, ক্যারেন শারীরিক ও মানসিক অবসাদে ভুগছেন। আসন্ন সব ট্যুর অবিলম্বে স্থগিত করা হয়। যারা টিকেট কিনেছিলেন, তাদের ফিরিয়ে দেয় হয় অর্থ। বলা হয়- এ সময় প্রায় ২,৫০,০০০ ডলার হারায় দ্য কার্পেন্টার্স।
হাসপাতাল আর বাসা মিলিয়ে অনেকদিন লোকচক্ষু থেকে দূর থাকেন ক্যারেন। এরপর ভাই-বোন আবার কাজ আরম্ভ করলেন। তবে তার আসল রোগ তখন শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, ফলে সাময়িক চিকিৎসা হলেও মূল সমস্যা থেকেই গিয়েছিল।
১৯৭৬ সাল থেকে কার্পেন্টাররা ব্যস্ত হয়ে পড়ে টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে। তাদের অ্যালবামগুলো ফ্লপ না হলেও আগের মতো কাটতি ছিল না। তবে টিভির বদৌলতে জনপ্রিয়তা উল্টো বাড়তে থাকে।
১৯৭৭ সাল নাগাদ অব্যাহত ট্যুরের চাপ ক্যারেন আর রিচার্ডকে কাবু করে ফেলে। ক্যারেনের স্বাস্থ্য আরো ভেঙে পড়ছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শকরাও তার অত্যধিক শীর্ণদেহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। রিচার্ড নিজের মানসিক চাপ কমাতে আশ্রয় নেন ঘুমের ওষুধের। ক্রমেই এই নেশায় জড়িয়ে যান তিনি।
১৯৭৯ সালে রিচার্ড ঘুমের ওষুধের উপর নির্ভরতা কমাতে চিকিৎসা নিতে থাকেন। এ সময় দ্য কার্পেন্টার্সদের সমস্ত প্রোগ্রাম স্থগিত ছিল। এই অবসরে ক্যারেন নিজের একটি অ্যালবাম করার সিদ্ধান্ত নেন। এতদিন তিনি কেবল রিচার্ডের সুরেই গেয়ে আসছিলেন, এবার চাইলেন নতুন কারো সাথে গান করবার। প্রথমে দোনোমনা করলেও পরে রিচার্ড বোনকে সমর্থন করেন। ক্যারেন নিউ ইয়র্কে গিয়ে খ্যাতনামা সুরকার ফিল র্যামোনের সাথে দেখা করলেন।
র্যামোন আর ক্যারেন একটি অ্যালবাম তৈরি করেন। ততদিনে রিচার্ড সেরে উঠেছেন। ‘এ অ্যান্ড এম’ স্টুডিওর লোকজন আর রিচার্ডে সামনে অ্যালবাম বাজানো হয়। ক্যারেন নিজে তার কাজ নিয়ে উৎসাহী থাকলেও রিচার্ড আর স্টুডিওর কর্তারা একেবারেই এই অ্যালবাম পছন্দ করেননি।ফলে আপাতত হিমাগারে রাখা হয় এটি।
ক্যারেনের মানসিক স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছিল। অ্যালবাম প্রকাশ না হবার হতাশা কাটতে না কাটতেই তিনি বিয়ে করেন থমাস বারিস নামে এক রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারকে। এরপর রিচার্ডের সাথে দ্য কার্পেন্টার্সদের সর্বশেষ অ্যালবামের (Made In America) কাজ করেন তিনি।
এর কিছুদিন পর নানা সমস্যায় ক্যারেন আর থমাস আলাদা হয়ে যান। কেউ না বুঝলেও এসময় নিজের সহ্যসীমার প্রায় শেষে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। ওজন নিয়ে অবসেশন তার আরো বেড়ে যায়। তিনি কদাচিৎ কিছু মুখে তুলতেন। রিচার্ড বোনকে চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্কে নিয়ে আসেন। এখানে একজন মানসিক চিকিৎসক তাকে দেখেন, তবে খুব উপকার হয়নি। এরপর লেনক্স হিল হাসপাতালের রেখে নল দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা হয় ক্যারেনের জন্য। এ কাজ করতে গিয়ে তার ফুসফুসে আঘাত লাগে।
জুটির পরিসমাপ্তি
১৯৮৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার।
ক্যারেনের মা, অ্যাগনেস সকালবেলা মেয়েকে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে আসতে দেখলেন। ক্যারেন এরপর কফি বানাতে দিয়ে উপরতলায় চলে যান। অনেকক্ষণ পরও তিনি নেমে না আসলে অ্যাগনেস প্রথমে ক্যারেনের ঘরে থাকা ফোনে কল দেন। কেউ না ধরলে তিনি নিজেই যান সেখানে। আবিষ্কার করেন মেঝেতে পড়ে থাকা ক্যারেনের মৃতদেহ।
অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হিসেবে ময়নাতদন্ত করে পুলিশ। রিপোর্টে বলা হয়- ইপেকাক নামে একরকমের ওষুধ অত্যধিক ব্যবহারেই তার মৃত্যু হয়েছে। ওজন কমানোর জন্য ক্যারেন এটি ব্যবহার করছিলেন। এই ওষুধ ব্যবহার করলে বমি হতো। ক্যারেন মনে করতেন, বমি করে শরীর হালকা করতে পারবেন তিনি। কিন্তু বেশি পরিমাণে নিলে যে মৃত্যু হতে পারে এটা তার জানা ছিল না।
মাত্র ৩২ বছর বয়সে ক্যারেনের চলে যাওয়া ছিল সঙ্গীতজগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তার মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মনোযোগী না হওয়ায় অনেকের সাথে সাথে অভিযোগের আঙুল উঠেছিলো ভাই রিচার্ডের দিকে।
১৯৯৬ সালে নামকরা সাংবাদিক রব হারবার্গার দাবি করেন- ক্যারেনের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল দুটি জিনিস, তার কণ্ঠ এবং শরীর। কণ্ঠের উপর রিচার্ডের নিয়ন্ত্রণ ক্যারেনকে নিজের মতো করে গান গাইতে দেয়নি। তাই শরীরের নিয়ন্ত্রণটাই কেবল ছিল তার হাতে, যে কারণে তৈরি হয় অবসেশন। এই শরীর নিয়ে খোঁটার ফলেই তার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি শুরু।
সাফল্যের খতিয়ান
১৯৭০ থেকে ১৯৮৪, এই চৌদ্দ বছরে কার্পেন্টারদের সতেরটি গান চার্টের প্রথম বিশে স্থান করে নিয়েছিল। নয়টি অ্যালবাম অর্ধ মিলিয়ন কপির বেশি বিক্রি হওয়ায় গোল্ড সার্টিফিকেট পায়। একটি অ্যালবাম হয় মাল্টি প্লাটিনাম (দুই মিলিয়নের বেশি বিক্রি)। তিনবার গ্র্যামিও জয় করে তারা।
পুরো সময়টাই ছিল রক অ্যান্ড রোলের। এর মধ্যেই দ্য কার্পেন্টার্স আলাদা করে নিজেদের চেনাতে সক্ষম হয়। সব মিলিয়ে তাদের ১০০ মিলিয়নের বেশি রেকর্ড বিক্রি হয়,যা আজও অব্যাহত আছে। দ্য কার্পেন্টার্সদের দুটি গান স্থান করে নিয়েছে গ্র্যামির হল অব ফেমে। হলিউড ওয়াক অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাদের নামে একটি স্টার।
বর্তমানের কথা
ক্যারেনের মৃত্যুর পর রিচার্ড দ্য কার্পেন্টার্স নামে এককভাবে মিউজিক করে যান। বোনের পুরনো রেকর্ডিং নিয়ে একটি অ্যালবাম মুক্তি দেন। ধারাবাহিকভাবে আরো কয়েকটি অ্যালবামও প্রকাশ করেন তিনি। ক্যারেনের নিজের করা অ্যালবামের অনেক গান ব্যবহার করা হয় এই পরের অ্যালবামগুলোতে। এসবের মাঝেও ১৯৮৭ সালে রিচার্ড নিজের একক অ্যালবাম প্রকাশ করেন। একই বছর বোনের জীবন নিয়ে তৈরি একটি তথ্যচিত্রে সময় দেন।
১৯৯৬ সালে অবশেষে ক্যারেনের হিমাগারে রাখা সেই অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। রিচার্ড এরপর আরো এক দশক কাজ করে যান একক এবং দ্য কার্পেন্টার্সের নামে। তবে ক্যারেন মারা যাবার পর সত্তরের দশকের সেই সাফল্য আর ধরা দেয়নি তার হাতে।
রিচার্ড এখন সেভাবে সঙ্গীতের সাথে যুক্ত নন। তবে ‘দ্য কার্পেন্টার্সের গানের আবেদন কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। তাদের সঙ্গীত নিয়ে নতুন করে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। ক্যারেনের ঈশ্বরপ্রদত্ত গলার সাথে রিচার্ডের অসামান্য সঙ্গীতায়োজনকেই অনেক গবেষক রক অ্যান্ড রোলের সেই সময় এই জুটির সাফল্যের রহস্য বলে চিহ্নিত করেছেন।
২০২১ সালে রিচার্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘Carpenters: The Musical Legacy’ নামে আত্মজৈবনিক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাদের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এখানে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সঙ্গীত দিয়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া দ্য কার্পেন্টার্সরা ফুরিয়ে যাবার নয়।