বিশ্বজুড়ে মৃত পূর্বপুরুষদের স্মরণে পালিত হয় অদ্ভুত সব অনুষ্ঠান। প্রাচীনকালে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষের মাঝে একটি সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, বছরের শেষে পাকা ফসল তোলা হয়ে গেলে রিক্ত মাটির বুকে শায়িত আত্মাদের পৃথিবীতে ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত হয়। ফলে সেসব আত্মাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য মানুষ নানা প্রথা পালন করতে শুরু করে। দু’হাজারেরও বেশি বছর আগে রোমানরা ‘লুমেরিয়া’ নামে এক উৎসব পালন করতো, যেখানে মৃত পূর্বপুরুষের আত্মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলি দেয়া হতো। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মৃত পূর্বপুরুষের আত্মাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আয়োজন করা হয়ে থাকে ব্যতিক্রম সব ভূত উৎসব।
এই ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন ভূত চতুর্দশী, ঠিক তেমনই ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে হ্যালোইন উৎসব আজ সারাবিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত এক উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এভাবে সেই প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ নিজেদের পরিবারকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নিয়ম পালন করে আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রিয় কিছু ভূত উৎসব নিয়ে সাজানো আজকের এই লেখা।
এল ডিয়া দে লস মুর্তোস, মেক্সিকো
মেক্সিকোর বিভিন্ন প্রান্তে পালিত হয়ে থাকে জনপ্রিয় এই উৎসব। এর স্থানীয় নাম ‘এল ডিয়া দে লস মুর্তোস’, বহির্বিশ্বে যা ‘ডে অফ ডেথ’ হিসেবে পরিচিত। মৃত আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের স্মরণে এবং তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই উৎসবটি পালন করা হয়। এটি শত শত বছরের পুরনো অ্যাজটেক সভ্যতার এক উৎসব। প্রাচীন অ্যাজটেকে প্রায় দু’মাস ধরে এই উৎসব চলতো। এখন এই উৎসব চলে দু’দিন ধরে।
পহেলা ও দোসরা নভেম্বর যথাক্রমে ‘অল সেন্টস ডে’ ও ‘অল সোলস ডে’ একসঙ্গে ডে অফ ডেথ হিসেবে পালন করা হয়। উৎসবের দু’দিন বাড়ি-ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিভিন্ন রকমের ফুল, খাবার, খেলনা, মিষ্টি দিয়ে বাড়ি সাজানো হয়। উৎসবের দিনগুলোতে আত্মাদের জন্য পরিষ্কার বাসনপত্রে খাবার সাজিয়ে রাখা হয়। স্থানীয়রা স্কেলেটন কস্টিউমসহ বৈচিত্র্যময় মুখোশ পরে আনন্দ মিছিলে যোগ দেয়। অনেকে উপহার হিসেবে বন্ধু-বান্ধবদের চিনির দানায় তৈরি বিশেষ খুলি দেয়। এভাবে নানা আনন্দ আয়োজনের মাধ্যমে স্থানীয়রা উৎসবটি উদযাপন করে ।
স্যামউইন, ইউরোপ
স্যামউইন বা সা-উইন ইউরোপের সেলটিক সভ্যতার উত্তরাধিকারীদের এক প্রাচীন উৎসব, যা আজও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয়ে থাকে। স্কট এবং আইরিশরা বিশ্বাস করতেন, শীতকালে মানুষ এবং তাদের প্রাণীসম্পদ রক্ষার জন্য অশুভ আত্মাদের সন্তষ্ট রাখা প্রয়োজন। তাই ঘরে ফসল ওঠার পর শীত শুরুর আগে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হতো।
বিশেষ প্রার্থনার পর আলাদা একটি টেবিলে খাদ্য ও পানীয় রেখে আত্মাদের আহবান করা হতো। অনুষ্ঠানের শেষে সকলে মিলে বিশেষ ভোজ ও পানীয়ের আয়োজন করা হতো। এসব অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই বর্তমানে ফিকে হয়ে গেছে। এখন সকলে মিলে বর্ণিল পোশাক পরে বন্ধুদের সাথে নেচে বেড়ানো আর নানা আমোদ-প্রমোদে মেতে থাকাই উৎসবের মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওবন, জাপান
জাপানের জনপ্রিয় ভূত উৎসব। এই উৎসব তিনদিন ব্যাপী উদযাপিত হয়। লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বছরের সপ্তম মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫তম দিনে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। জাপানীরা মনে করেন, এই দিনে তাদের পূর্বপুরুষরা তাদের সাথে দেখা করতে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসেন। তাই উৎসবের দিনগুলোতে পরিবারের সব সদস্য একসাথে হয়ে তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনকে স্মরণ করেন। উৎসব উপলক্ষে পরস্পরকে উপহার দেয়ার এক পরম্পরা ঐতিহ্য জাপানীরা এখনও পালন করে আসছে।
এই দিনগুলোতে জাপানীরা তাদের বাড়িঘর, পূর্বপুরুষদের কবর পরিষ্কার করে তার পাশে ফুল ও মিষ্টি দিয়ে সাজিয়ে রাখে। উৎসবের শুরুর দিন আত্মাদের অভিবাদন জানানোর জন্য ঐতিহ্যবাহী ওবন নৃত্য পরিবেশন করা হয়। তারপর উৎসবের শেষ দিন আত্মাদের বিদায় জানানোর জন্য কাগজের লণ্ঠন বানিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় আর তার সাথে ‘বিদায় ওবন নৃত্য’ পরিবেশন করা হয়।
বন কান বেন, কম্বোডিয়া
এই উৎসবটি পালিত হয় কম্বোডিয়াতে। কম্বোডিয়ার প্রাচীন খেমার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বছরের দশম মাসে ১৫ দিন ধরে চলে এই ভৌতিক উৎসব। এই উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, উৎসব শুরু হওয়ার আগের রাতে সন্ন্যাসীরা সারারাত জেগে প্রার্থনা করেন। স্থানীয়রা মনে করেন, উৎসবের পূর্ব রাতে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে স্বর্গের দ্বার খুলে যায় এবং প্রত্যেক পরিবারের মৃত সাতপুরুষের আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে।
উৎসবের দিনগুলোতে কম্বোডিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ সকালে নিকটবর্তী প্যাগোডায় গিয়ে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে ফল আর উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। সন্ন্যাসীরা সেসব পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রার্থনা করেন, যাতে পরিবারের সদস্যদের কথা তাদের পূর্বপুরুষরা শুনতে পান। প্রত্যেকেই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী গরীব-দুঃখীদের জন্য মন্দিরে অর্থ আর ফুল রেখে আসেন। কম্বোডিয়ার অধিবাসীরা মনে করেন, পূর্বপুরুষের আত্মা উপহার পেয়ে খুশি হলে সেই পরিবারের সব সদস্যদের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে।
ইউ লান বা হাংরি গোস্ট ডে, চীন
চীনারা তাদের সপ্তম চান্দ্রমাসের ১৫তম দিন এই উৎসব পালন করে। এই সপ্তম মাসকে বলা হয় ‘গোস্ট মান্থ’। চীনারা মনে করেন, এই ১৫ নম্বর দিনে নরকের দরজা খুলে যায় আর যেসব মানুষের মৃত্যুর সময়ে যথাযথ নিয়মকানুন অনুরণ করা হয়নি, তাদের অতৃপ্ত আত্মা ফিরে আসে। এই দিনে সেসব অতৃপ্ত আত্মাদের জন্য বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে প্রথম সারির আসন ফাঁকা রাখা হয় সেসব অতৃপ্ত আত্মার জন্য।
পরিবারের লোকজন অতৃপ্ত আত্মাদের সন্তুষ্টির জন্য তাদের উদ্দেশ্যে সোনার কাগজ বা টাকা ইত্যাদি মূল্যবান সামগ্রী পুড়িয়ে উৎসর্গ করা হয়। একটি টেবিলে ধূপ, সুগন্ধি ছিটিয়ে স্থানটিকে পবিত্র করা হয়। তারপর আত্মাদের উদ্দেশ্যে সেখানে অনেক ফুল ও খাবার উৎসর্গ করা হয়। উৎসবের শেষ দিনে একটি কাগজের নৌকায় আলো জ্বালিয়ে তা জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আলোটি নিভে গেলে মনে করা হয়, যে আত্মা এসেছিল সে ফিরে গিয়েছে নিজের জায়গায়।
দিয়া দে ফিনাদোস, ব্রাজিল
প্রতি বছর ২রা নভেম্বর ব্রাজিলে জনপ্রিয় এই ভৌতিক উৎসব পালিত হয়। এই দিনটি ব্রাজিলে জাতীয় সরকারি ছুটি হিসেবে পালন করা হয়। ব্রাজিলিয়ানরা এই উৎসব জাঁকজমকের পরিবর্তে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে পালন করে থাকেন।
এই দিনে সকল ব্রাজিলিয়ান তাদের পিতৃপুরুষের কবরস্থান পরিদর্শন করেন। কবরস্থানে ফুল ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়। কেউ কেউ আবার মৃত আত্মাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনাও করে থাকেন। দিনটি উপলক্ষে বাড়িতে বিশেষ রান্নাবান্নার আয়োজন করে আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে পরিবেশন করা হয়।
চুসেওক, কোরিয়া
কোরিয়ানদের কাছে এটি থ্যাঙ্কস গিভিং উৎসব হিসেবেও পরিচিত। এটি কোরিয়ার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব। লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত দু’দিন ব্যাপী এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের আগের দিন পূর্বপুরুষদের সমাধিক্ষেত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।
উৎসব উপলক্ষে পরিবারের সব সদস্য বাড়িতে জড়ো হয়ে প্রার্থনার আয়োজন করে। এর মধ্য দিয়ে কোরিয়ানরা তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালো ফসলের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। প্রথা অনুযায়ী, প্রার্থনার পর অনেকে পূর্বপুরুষদের কবরে ফুল উৎসর্গ করে আসেন। এরপর সকলের জন্য বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমান সময়ে অনেক কোরিয়ানরা বন্ধু আর আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে উপহার দেয়ার চল শুরু হয়েছে।
পিতৃপক্ষ, ভারত
ভারত, নেপাল এবং বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে পালিত হয় এই অনুষ্ঠান। পিতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হয়। অনুষ্ঠানটি নিয়ে মহাভারতে একটি সুন্দর গল্প রয়েছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে পৌঁছলে, সেখানে তাকে নানা রকম ধনরত্ন দিয়ে আপ্যায়িত করার ব্যবস্থা করা হয়। তখন কর্ণ দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে এর কারণ জানতে চান। ইন্দ্র জানান, কর্ণ সারাজীবন ধনরত্ন দান করেছেন, কিন্তু নিজের পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে কোনোদিন কিছু প্রদান করেননি। কর্ণ বলেন, পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি মৃত্যুর কয়েকদিন আগে মা কুন্তীর কাছ থেকে জানতে পারেন। ফলে তার পক্ষে পিতৃপুরুষদের জন্য কোনো কিছু উৎসর্গ করা সম্ভব হয়নি।
ইন্দ্র তখন পিতৃপুরুষদের জল ও খাবার দিতে কর্ণকে পনের দিনের জন্য মর্ত্যে যাওয়ার অনুমতি দেন। মর্ত্যে ফিরে এসে কর্ণ পিতৃপুরুষদের অন্নজল প্রদান করে পাপমুক্ত হন। যে পনেরদিন ধরে কর্ণ তার পিতৃপুরুষদের অন্নজল দেন, তা-ই পিতৃপক্ষ হিসেব পরবর্তীকালে পরিচিতি পায়। সাধারণত আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে ‘পিতৃপক্ষ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ধারণা করা হয়, এসময় পিতৃপুরুষেরা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন করেন। তাদেরকে তৃপ্ত করার জন্য অন্নজল দান করা হয়। তাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য উল্কাদান করা হয়। এসব লোকাচারের মাধ্যমে অনেকে তাদের পিতৃপুরুষদের স্মরণ করে থাকেন। তাই এটি স্মরণ উৎসব নামেও অনেকের কাছে পরিচিত।