মার্কিন সিনেমা সাম্রাজ্যের কিংবদন্তি অভিনেতা আল পাচিনো। জনপ্রিয় সিনেমা সিরিজ ‘গডফাদার’ এর মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি পৌঁছে যান খ্যাতির চূড়ায়। বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই মার্কিন অভিনেতা ও পরিচালক ১৯৪০ সালের ২৫ এপ্রিল নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। ‘মাইকেল কর্লিওনি’ চরিত্রে রুপদান করা এই অভিনেতার পুরো নাম আলফ্রেডো জেমস আল পাচিনো।
ইতালীয় অভিবাসী দম্পতি সালভাতর পাচিনো ও রোজের ঘরে জন্ম এ শক্তিমান অভিনেতার। দুই বছর বয়সেই মা-বাবার বিচ্ছেদ দেখেন আল পাচিনো। দুরন্তপনার জন্য বন্ধুরা তাকে ‘সনি’ ডাকত। মহল্লায় দুর্নাম ছিল বখাটে, দুষ্টু ছেলে হিসেবে। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের যেমন অনেক সময়ই নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, মা-বাবা দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় থাকলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি আল পাচিনোর ক্ষেত্রেও। বন্ধুদের আড্ডায় বা মাঠে কোথাও মারামারিতে অবধারিত ছিল তার অংশগ্রহণ। স্কুলে মাঝেমধ্যে যেতেন, তবে মিস করতেন না ইংরেজি ক্লাস।
১৭ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে নাম লেখান অভিনয়ে। কারণ বন্ধুরা বলতো, তিনি জাত অভিনেতা। কিন্তু তার মা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন না। মায়ের বকাঝকায় ঘর ছাড়েন কিশোর পাচিনো। পিয়ন, বাসের হেলপার, ছোট অফিসের পিয়ন, ডাক বিভাগের কেরানিগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন আর অংশ নেন অভিনয়ের ক্লাসে। নিউইয়র্কের আন্ডারগ্রাউন্ড মঞ্চে অভিনয় করলেও পেশাদার অভিনয়সংস্থা ‘অ্যাক্টর স্টুডিও’তে প্রথমবারের অডিশনে অকৃতকার্য হন। এরপর এইচবি স্টুডিওতে যোগ দেন। আর এখানেই অভিনয় শিক্ষক চার্লস লাটনের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। পরবর্তী সময়ে চার্লসকেই পাচিনো তার মেন্টর ও বন্ধু হিসেবে পান।
জনপ্রিয় হওয়ার আগে পাচিনো যখন বেকার ছিলেন, সে সময় প্রায়ই তাকে পথে রাত কাটাতে হতো। মাঝেমধ্যে থিয়েটার কিংবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে দিন কয়েকের জন্য থাকার সুযোগ মিলত শুধু। এইচবি স্টুডিওতে বছর চারেক কাজ করার পর অডিশনের মাধ্যমে অ্যাক্টর স্টুডিওর সনদ পান তিনি। অভিনয় প্রশিক্ষক লি স্টারসবার্গের তত্ত্বাবধানে ‘মেথড অ্যাক্টিং’-এর ওপর পড়াশোনা করেন। ‘গডফাদার পার্ট টু’তে পাচিনোর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন লি।
১৯৬৯ সালে ‘মি, নাতালি’ ছবির সুবাদে প্রথম চলচ্চিত্রে উপস্থিতি। তবে ভূমিকাটি ছিল সামান্য একটি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের। মূল চরিত্র বলতে ১৯৭১ সালের ‘দ্য প্যানিক ইন নিডল পার্ক’। পরের বছরের কথা তো সবার জানা। তারপর আল পাচিনো হলেন ‘গডফাদার’! ১৯৭২ সালে ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা সৃষ্টি করেন মাইকেল কর্লিওনি চরিত্রটি। মজার ব্যাপার হলো, আল পাচিনোর পূর্বপুরুষ সিসিলির যে শহরটিতে থাকতেন, সেটির নামও কোর্লিয়ন। এ চরিত্রে সৌম্য, স্থির আল পাচিনোর যে বিকল্প নেই, স্বীকার করবেন সবাই। নিজের বেশির ভাগ কাজের জন্যই নানা পুরস্কারে মনোনীত ও ভূষিত হয়েছেন তিনি। তবে আল পাচিনো তার কাজের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি পান ‘সেন্ট অব অ্যা ওম্যান’ ছবিতে অভিনয় করে। ১৯৯২ সালে এ ছবির সুবাদে সপ্তমবারের মতো অস্কার মনোনয়ন পান। এর আগে ছয়বার কোডাক থিয়েটার থেকে শুন্য হাতে ফিরে গেলেও এবার স্বর্ণের মূর্তিটি ঘরে তোলেন আল পাচিনো।
আল পাচিনোর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘মি. নাটালি’, ‘দ্য পেনিক ইন নিডল পার্ক’, ‘গডফাদার পার্ট ট্রিলজি’, ‘সারপিকো’, ‘সি অব লাভ’, ‘সেন্ট অব অ্যা ওমেন’, ‘দ্য ডেভিলস অ্যাডভোকেট’, ‘দ্য ইনসাইডার’ ইত্যাদি। অভিনয়ের জন্য জিতেছেন গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, বাফটা অ্যাওয়ার্ড ও একাডেমি অ্যাওয়ার্ড। এবং পরিচালনায় পেয়েছেন ডিরেক্টর গিল্ড অ্যাওয়ার্ড। ‘দ্য টকস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া ‘গডফাদার’ অভিনেতা আল পাচিনোর একটি সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেয়া হলো।
মি. আল পাচিনো, আপনি আপনার সারাজীবনের সকল অর্জনগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন?
আল পাচিনো: আমি জানি না। এই জায়গায় আপনি থাকলেও ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। এমনকি এ সমস্ত জিনিসকে আপনি অর্জন বলতেন না। আপনার চিন্তায় থাকবে কিভাবে একটি চরিত্রকে ভালোভাবে রুপদান করা যায়। একজন অভিনেতা কখনই বলবে না, ‘আমি আর সামনে এগুতে চাই না, কারণ আমি আমার শেষ সিনেমার চেয়ে ভালো কাজ করতে পারব না। এখন আমার থামা উচিৎ।’ এই ব্যাপারটিকে আমরা বলি ‘অবসর গ্রহণ’। তবে আমার ধারণা, এই কাজটি কী করতে চাইবে না। আমি অনেকটা এমন। যদিও অবসরে গিয়ে মোটা অঙ্কের চেক নিয়ে অন্য পেশায় যাওয়ার বিষয়টি আমার পছন্দ না। তবে একটি কারণে আমি অতীতে গিয়ে এমন কাজ করতে চাই।
এর কারণ কি এই জন্য যে আপনি অন্য কোন পেশায় নতুন কিছু চেষ্টা করতে চান?
আল পাচিনো: হ্যাঁ। যদি আমি এমন কোনো কাজ খুঁজে পাই, যাতে আমি মনে করি ভালোভাবে কাজ করতে পারব, আমি অবশ্যই চেষ্টা করতে চাই। যদি আমি আমার মেধা ও জ্ঞানের মাধ্যমে অন্যদের সাহায্য করার মতো কোনো কিছু করতে পারি, তা আমি চেষ্টা করতে চাই। সেটি কোনো সিনেমার চরিত্র হলেও আমি করতে রাজি আছি। তবে আমি কখনও ‘অবসর’ শব্দটি বলতে চাই না। কারণ আমি মনে করি, এই শব্দটি কোনো শিল্পীর জন্য সৃষ্টি হয় নি।
শিল্পী খ্রিস্টোর মতে, শিল্পীরা অবসর নেয় না, তারা মারা যায়।
আল পাচিনো: হ্যাঁ, তবে এমন একজন শিল্পী আছেন যিনি অবসর নিয়েছিলেন। যেমন ফিলিপ রোথ। আমি তার বই থেকে নেয়া ‘দ্য হাম্বলিং’ সিনেমায় কাজ করেছিলাম। একসময় তিনি লেখা বন্ধ করে দেন, কিন্তু সেই সময়ে তিনি খুব সুখী ছিলেন। তিনি যা করেছিলেন, আমি তা বুঝতে পারি। তার ব্যাপারটি হয়ে গিয়েছিল একটি ধরাবাধা কাজের মতো। তেমনিভাবে একজন অভিনেতাকেও চিত্রনাট্য হাতে পেয়ে সেটি পড়তে হয়, বুঝতে হয়, শিখতে হয়। বারবার একই প্রক্রিয়ায় কাজ করে যেতে হয়। তখন সে অন্য কিছু করার চিন্তা করে। যেমন করে একজন পরিচালক আমাদের ব্যবহার করতে চায়।
কিন্তু সব নির্মাতারা নিঃসন্দেহে আপনাকেই চায়…
আল পাচিনো: ‘গডফাদার’ ছবিটিতে কাজ করার আগে আমাকে কেউ কাজে নিতে চাইত না। কিন্তু এই ছবির নির্মাতা কপোলা আমাকেই চাইতেন। কিন্তু কেন, তা বুঝতে পারতাম না। কোনো বড় ব্যানারে আমাকে নেয়া হত না, কেউ আমাকে চাইত না, কেউ আমাকে চিনত না। সে সময় একজন নির্মাতা যখন আমাকে কাজে নিতে চাইলেন, তখন ভাবলাম এখন আমাকে পিছিয়ে গেলে চলবে না। আমার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সামনে এগোনোর। ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে সবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে। একবার যদি হতাশ হও, বসে থাকলে চলবে না। উঠে দাঁড়াতে হবে এবং সামনে যেতে হবে।
কেন?
আল পাচিনো: কারণ যখন আপনি একাধিকবার এমন করবেন, তবেই আপনি নিজের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন। একবার এমন হলে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারবেন না। কারণ দুর্বলতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।
এমন কোনো সিনেমা আছে যাতে আপনি আপনার সাধ্যের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন, এবং এর জন্য আপনি অনুতপ্ত?
আল পাচিনো: আমি কখনও কোনো কিছুর জন্য অনুতপ্তবোধ করি না। এ জাতীয় ব্যাপারগুলোকে আমি ‘ভুল’ মনে করি। তখন আমি ভাবি, আমি ভুল সিনেমা হাতে নিয়েছি, অথবা চরিত্রটিকে আমি ধারণ করতে পারি নি। তবে আপনি যা কিছুই করবেন, সবই কিন্তু আপনার নিজের অংশ। তাই আমি কখনও অনুতাপ করি না।
‘স্টার ওয়ার্স’ ছবির ব্যর্থতাতেও অনুতপ্ত হন নি?
আল পাচিনো: হ্যাঁ। আমি মনে করি ওটা ছিল আমার প্রথম করা সবচেয়ে বড় ভুল।
আপনি বলেছেন, ‘নিজের কাছে নিজেকে মেলে ধরার পর নিজেকে গুটিয়ে নেয়া যায় না’। একথার মাধ্যমে আপনি কি আপনার আগের অভিনয়ের সাথে বর্তমানের পার্থক্য বোঝাতে চাইছেন?
আল পাচিনো: হ্যাঁ। মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমি আসলে কি? তবে এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারি না। আমরা শুধু আমাদের চারপাশের চক্রের মধ্যেই বারবার ঘুরপাক খেতে থাকি। আমি মনে করি আমাদের বয়সের ব্যাপারটিও এমনই। আমরা এখনই এখানে, পরক্ষণেই কোথাও নেই। যখন আমরা চলতে শুরু করি, আমরা চলতেই থাকি। কিন্তু আমরা কেউ জানি না কখন কোথায় এর শেষ সীমানা। আমরা শুধু চক্রের মধ্যেই থাকি।
আপনি কি আপনার জীবনের এই চক্র উপভোগ করেন?
আল পাচিনো: তুমি জানো না, কখন তুমি একটি গ্লাস দেখে বলবে- গ্লাসটি অর্ধেক খালি, নাকি অর্ধেক পানিতে ভর্তি। এরকম চিন্তা ভাবনার সমন্বয়ে আমরা সকলেই। অনেক কম দিন আছে, যা আমি সত্যিকার অর্থে উপভোগ করি। যদি আমি একজন চিত্রশিল্পী হতাম, আমাকে কেউ আমার বয়স জিজ্ঞেস করতো না। ‘আমি ছবি আঁকি, আমি একজন শিল্পী’- এমন কথা বলতে আমি পছন্দ করি না। অনেক আগে আমি একটি জিনিস শিখেছিলাম। একজন মহিলা আমাকে একবার বলেছিল, ‘তুমি যা-ই করো না কেন, কাউকে বোলো না তুমি একজন শিল্পী।’ আমি বলেছিলাম- আমি জানি, আমি তাই করার চেষ্টা করব। এবং বেশ অনেক বছর আমি বিষয়টি এড়িয়ে গেছি। আমি নিজেকে শিল্পী মনে করি। আশা করি সবার কাছে আমি একজন শিল্পী। কিন্তু আমার ধারণা আমি যদি চিত্রকর হতাম, প্রশ্নগুলো ভিন্ন হতে পারত।
কিন্তু সব অভিনেতাদের তো একই সমস্যা থাকার কথা।
আল পাচিনো: কারণ হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ আমাদের ইমেজের সঙ্গে নিজেদের ডিল করতে হয়। আমরা বিভিন্ন ধরণের চরিত্র ধারণ করি। আমাদের ইমেজ সকলের কাছে এমনই। আরেকটি বিষয় যখন আমরা খুব দম্ভ নিয়ে বলি- ‘আমি শিল্পী’। এটি কিন্তু আমাদের অংশ বা সত্ত্বা। কারণ আমরা চলচ্চিত্র তারকা। কিন্তু ব্যাপারটি ঠিক না। শিল্পীর দম্ভ থাকা উচিৎ নয়।