দেশে-বিদেশে ঈদ-উল-আযহার উদযাপন রীতি

পবিত্র হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতার পর সারা বিশ্বে শুরু হয় ঈদ-উল-আযহার উৎসব। একেক দেশে একেক নামে ও একেক ঢঙে পালন করা হয় এই ঈদ। বিশ্বের নানা দেশে এই ঈদের পালন রীতি নিয়েই চলুন হয়ে যাক কিছু কথা।

বাংলাদেশ

Source: banglanews24.com

এই দেশে ঈদ-উল-আযহাকে ‘কোরবানির ঈদ’ ও বলা হয়ে থাকে। ঈদের এক মাস আগে থেকেই বিভিন্ন দোকানপাটে কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। কোরবানির পশু হিসেবে বাছাই করে নেয়া হয় গরু, ছাগল বা মহিষ। এছাড়া কিছু কিছু উটও কোরবানি দিতে দেখা যায়। এসব উট বিশেষত কোরবানির ঈদকে সামনে রেখেই আমদানি করা হয়ে থাকে। ঈদের নামাজের পরপরই শুরু হয়ে যায় কোরবানির সব কার্যক্রম। এরপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে কোরবানির সব আয়োজন। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তিন দিন ব্যাপী চলে ঈদ-উল-আযহার উৎসব।

সৌদি আরব

ঈদ-উল-আযহার মৌসুমে সারা বিশ্বের লাখো মুসল্লি একত্র হন এই দেশটিতে হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা মুসলিমদের সাদরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভিন্ন এক আঙ্গিকে সেজে ওঠে দেশটি। সৌদি আরবের নাগরিকেরা এমনিতেই সোনার জিনিস কিনতে পছন্দ করেন। আর উৎসবের এই সময়ে তারা বেশ আয়োজন করেই সোনার জিনিস কিনতে চান। তাই এই সময়টাতে সেখানে হজ্জ্ব পালন, পশু কোরবানির সাথে সাথে সোনার জিনিস বাণিজ্যের পরিমাণও বেড়ে যায়।

ঈদের জামাতে সৌদিবাসী, Image Source: MangoBaaz

মিশর

মিশরে ঈদ-উল-আযহাকে বলা হয় ‘ঈদ-ইল-কিবর্‌’। ঈদের নামাজের পর থেকে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পুরো শহর। এছাড়াও নানান ধরনের আয়োজন করা হয় পুরো দেশ জুড়ে। এই দেশের দাতব্য সংস্থাগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে গোশত বিতরণ করা হয়। এই দিনে সবাই পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সম্বোধন করে বলে, “কোল সানা ওয়া ইন্তা তায়েব”। যার অর্থ দাঁড়ায়- “আশা করি আপনার প্রতিটি বছর ভালো যাবে”।

ভারত

ভারতে ঈদ-উল-আযহাকে ‘বকরি ঈদ’ও বলা হয়। উৎসবের এই দিনটি বেশ আনন্দ আর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করা হয় এই দেশটিতে। তবে মহারাষ্ট্রতে গরুর গোশত নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে সেখানকার মুসলমানেরা কোরবানির বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিতই থাকেন। মুম্বাই হাইকোর্টে পেশ করা এক আবেদন নাকচ করে দেয়া হলে পরে জাতিসংঘের সহযোগিতা কামনা করা হয়। কারণ এই নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার আদায়ের পথে একটি বাধা হিসেবে থেকে যায়।

ইন্দোনেশিয়া

এই দেশের খোলামেলা জায়গাগুলোই বিশেষত ঈদের জামাতের জন্য খুব জনপ্রিয়। এই দেশে ঈদ-উল-আযহাকে ‘লেবারান হাজী’ও বলা হয়ে থাকে। ত্যাগের মূর্ত প্রতীক স্বরূপ এখানে একটি পাহাড়ের মতো জিনিস তৈরি করা হয় যাকে ‘গুনুনগান’ বলা হয়। এই পাহাড়ের মতো জিনিসটি মূলত বানানো হয় বিভিন্ন রকমের সবজি ও ফলমূল দিয়ে। নামাজের ঠিক পরপরই এই গুনুনগান থেকে সবাই সবজি ও ফলমূল খায়। বলা হয়ে থাকে, ঈদ-উল-আযহার দিনে গুনুনগান থেকে সবজি ও ফলমূল খেলে সারা বছর সুখ ও সমৃদ্ধিতে কাটে।

ইন্দোনেশিয়ায় ঈদের দিন ‘গুনানগুন’ ঘিরে সবাই, Image Source: MangoBaaz

বসনিয়া ও হারজেগোভিনা

এখানে ঈদ-উল-আযহাকে ‘কুরবান বাজরাম’ও বলা হয়। বালকান মুসল্লিরা সকালে ঈদের জামাতের মাধ্যমে শুরু করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ঈদ পালন করে। ঈদের জামাতগুলো সাধারণত অনুষ্ঠিত হয় রাস্তাঘাট, পার্ক ও সিটি সেন্টারগুলোতে।

কাজাখস্তান

কাজাখস্তানে এই ঈদকে স্থানীয় ভাষায় ‘কুরবান বাইরাম’ বা ‘কুরবান আইত’ বলা হয়ে থাকে। ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে সেখানকার প্রধান শহরগুলোতে খেলাধুলার বিশেষ আয়োজন করা হয়ে থাকে। এর কারণ মূলত এই উৎসবগুলোর স্মৃতি রক্ষা করা। এছাড়াও ব্যবস্থা করা হয় ঐতিহ্যবাহী ‘কাযাক কুজিন’-এর! খুবই সাদাসিধে এবং দামটাও আয়ত্তের মধ্যেই থাকে এই কুজিনের আয়োজনে থাকা সব খাবারের।

জার্মানি

পৃথিবীর সকল মুসলিমের জন্য এই দেশটি ত্যাগ ও মহিমার এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আর এই ত্যাগ এবং মহিমাই কিন্তু পবিত্র ঈদ-উল-আযহার মূল উদ্দেশ্য। ২০১৫ সালে ১ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি সিরিয়ার শরণার্থীরা জার্মান নাগরিকদের সাহায্যার্থে শান্তিময় একটি ঈদ উদযাপন করতে পেরেছিলো।

মুসলিমদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে জার্মানবাসী, Image Source: Eid Ul Fitr and Eid Ul Adha Mubaraak

ইরাক

সেখানকার ঈদ ঠিক কেমন যায়, সেটা হয়তো বা আর আলাদাভাবে বলার কিছু নেই। নীরব, স্তব্ধ, নির্বিকার, ভীতসন্ত্রস্ত ও আশংকা ঘিরেই কাটে ইরাকের মানুষের ঈদের আয়োজন। কখন না আবার যেন কোথায় হামলায় প্রাণ হারিয়ে বসে প্রাণপ্রিয় কোনো মানুষ! এই ভয়ে থাকলে যেমন কাটে সময়টা ঠিক তেমনিই কেটে যায় তাদের ঈদ।

যুক্তরাষ্ট্র

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে কিছু আইনগত নিয়ম-কানুন থাকার কারণে সেখানে যেকোনো জায়গায় পশু কোরবানি করা সম্ভব হয় না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমরা কসাইখানাতে গিয়েই ত্যাগের এই মহিমান্বিত আনুষ্ঠানিকতা পালন করে থাকে।

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়াতে ঈদ-উল-আযহা ‘হরি রায়া হাজী’ নামে পরিচিত। আর পবিত্র ঈদের এই আয়োজনে তাদের সরকারি ছুটি থাকে একদিন। পরিবারের সবাই একত্র হয়ে ঈদ আনন্দে মেতে ওঠাই সেখানকার মুসলিমদের জন্য মূল আকর্ষণ।

মালয়েশিয়ার ঈদের দিন ছোট বাচ্চারা, Image Source: MangoBaaz

মরক্কো

এই দেশে ঈদ-উল-আযহাকে বলা হয় ‘ঈদ-আল-কাবির’। এই কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো- বড়সড় ছুটি। আর এই ঈদটি মরক্কোবাসীদের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। ঈদের আগে থেকে খাবারের আয়োজনে বানানো হয় নানা প্রকার মিষ্টি ও বিস্কুট। মরক্কোর বেশিরভাগ ও জনপ্রিয় সব আইটেমই কিন্তু গরুর মাংস দিয়ে বানানো হয়। আর সেখানে ঈদের আয়োজন বলে কথা! তাই মরক্কোতে এই ঈদে মাংস দিয়ে বানানো আইটেমের হিড়িক পড়ে যায় চারিদিকে। অন্যান্য বিভিন্ন মুসলিম দেশের মতো মরক্কোতেও ঈদ পালন করা হয় তিন দিন ব্যাপী। কোরবানির পশু হিসেবে গরু, ভেড়াকেই বেছে নেন মরক্কোবাসীরা।

চীন

মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিক দিয়ে এই দেশটি দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে আছে। সেখানে রমজান মাসে মুসলিমদের রোজা রাখার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা রয়েছে। কিন্তু ঈদ-উল-আযহায় পশু কোরবানি দেয়াতে কোনো বাধা নেই। তবে এই বিষয়েও মুসলিমদের কিছু দিক মেনে চলতে হয়

মুসলিম জনগোষ্ঠীর হিসেবে দেশটি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, Image Source: astroawani.com

যুক্তরাজ্য

পুরো যুক্তরাজ্যের মধ্যে বারমিংহাঁমেই রয়েছে সবচাইতে বেশি মুসলিমের জমায়েত। সেখানে প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় ছোট একটি হেলথ পার্কে। তবে ঈদ-উল-ফিতরের মতো ঈদ-উল-আযহাতে বিভিন্ন পার্কে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না। শুধুমাত্র ঈদের জামাতই এই ঈদ আয়োজনের বড়সড় এক মিলনমেলা।

পাকিস্তান

এই দেশটিতে ঈদ-উল-আযহা পালন করা হয় চারদিন ব্যাপী। সেখানে ঈদের দিন জামাতে খুতবার পর শুরু হয় নামাজ। সামর্থ্য অনুযায়ী মুসল্লিরা পশু কুরবানি দিয়ে থাকে। এরপর চলে মাংস বিলি করার পালা।

রাশিয়া

রাশিয়াতে ঈদ-উল-আযহাকে ‘কুরবান বেরাম’ বলা হয়ে থাকে। নানান ধরনের স্পেশাল মুখরোচক খাবারই এই ঈদের আয়োজনে মূল আকর্ষণ। সাধারণত কোরবানির পশু হিসেবে ছাগল বেছে নেয়া হয়। তবে গরুও কুরবানি দেয়া হয়ে থাকে। সেখানে এই ঈদ পালন করা হয় ২-৩ দিন ব্যাপী।

রাশিয়ার ঈদ উদযাপন, Image Source: CNN.com

ইরান

ইরানে ঈদ-উল-আযহাকে ‘ঈদ-এ-কুরবন’ বলা হয়ে থাকে। আর ইরানের রাজধানী তেহরানে এই ঈদটি ‘ইদ-এ-ঘোরবান’ নামে পরিচিত। সেখানে জামাতে নামাজ পড়ার পর সবাই শুরু করে কুরবানির আনুষ্ঠানিকতা। এরপর এই আনুষ্ঠানিকতা শেষে চলে সবার মাঝে মাংস বিলি করা।

এছাড়াও নানান দেশে ঈদ-উল-আযহা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- তুরস্কে ‘কুরবান বায়রামি’, ইয়েমেন, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও আলজেরিয়াতে ‘ঈদ-আল-কাবির’ বলা হয়। আবার সেনেগাল ও পশ্চিম আফ্রিকাতে ‘তাবাস্কি’ বা ‘তোবাস্কি’ বলা হয়ে থাকে।

Related Articles

Exit mobile version