বিশ্বজুড়ে নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর যত আজব রীতি

সময় ঘুরে আবার চলে এলো নতুন একটি বছর। নতুন এই বছরকে স্বাগতম জানাতে তাই বিশ্বের নানান প্রান্তে চলে নানান আয়োজন। এদের মধ্যে কিছু কিছু উদযাপনের আঙ্গিক একেবারেই ভিন্ন। চলুন তবে জানা যাক নতুন বছরের উদ্ভট কিছু উদযাপন সম্পর্কে।

ডেনমার্ক: প্লেট ভাঙা

প্রায় সব বাসায় এমন কিছু প্লেট থাকে যা ব্যবহার করা হয় না, তাই অব্যবহৃতই রয়ে যায়। তবে ডেনমার্কের ক্ষেত্রে বিষয়টি একদমই এরকম নয়। ডেনমার্কের অধিবাসীরা এই সব অব্যবহৃত প্লেট দারুণভাবে ব্যবহার করার পদ্ধতি বের করেছেন। ইংরেজি নতুন বছরের প্রাক্কালে তারা এসব প্লেট তাদের বন্ধুদের বাসার দরজার সামনে খুব আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সাথে ভাঙে! তাদের বিশ্বাস এতে করে তাদের বন্ধুদের জীবন থেকে সব ধরনের অশুভ শক্তির ছায়া চলে যাবে এবং নতুন বছর শুভ ও আনন্দের কাটবে। নতুন বছরের শুরুতে তারা আরও একটি রীতি পালন করে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে সময় মধ্যরাতে গিয়ে পৌঁছাতেই তারা বাসার ভেতর সবচাইতে উঁচু জায়গা; চেয়ার, টেবিল যা-ই হোক সেখান থেকে খুশিতে লাফ দেয়। তাদের মতে, এতে করে তারা আনন্দের সাথে নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানায়।

প্লেট ভাঙাও নাকি উদযাপনের পন্থা!; Image Source: FB.ru

থাইল্যান্ড: বন্ধুর গায়ে পানি ছোড়া

থাইল্যান্ডে নতুন বছরে যাওয়ার আগে সঙ্গে সুইম স্যুট নিতে ভুলবেন না যেন! অবশ্য এখানে নতুন বছর বলতে ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখকে বোঝানো হচ্ছে না কিন্তু! থাইল্যান্ডের নতুন বছর হলো ১৩ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল। থাইল্যান্ডে এই উৎসবটি ‘সংক্রান ফেস্টিভ্যাল’ নামে পরিচিত। নতুন বছরের আগমনী এই আনন্দ উপভোগ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন সেখানে ছুটে যান। এই উৎসবের সময়ে মনে হয় যেন চারিদিক থেকে পানি আসছে। এই অবস্থা দেখে মনে হয় সামার ক্যাম্পের পানির লড়াইয়ের মতো কিছু একটা চলছে সেখানে। থাইল্যান্ডের এই ঐতিহ্যটির মূল বিষয়বস্তু হলো ‘ভালো ইচ্ছাশক্তির সাথে প্লাবিত হওয়া’। সেই সময় কারো গায়ে এভাবে পানি ছুঁড়ে মারাকে সম্মানের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং মনে করা হয়, কারো গায়ে এভাবে পানি দিলে তাকে শুভকামনা করা হয়। এছাড়াও তারা বিশ্বাস করে যে, এতে করে গত বছরের সব খারাপ বিষয়গুলো মুছে যায়।

দক্ষিণ আফ্রিকা: জানালা দিয়ে আসবাবপত্র ছুঁড়ে মারা

নতুন বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকায় সফর করার সময় উপরের দিকে খেয়াল রেখে চলতে হবে! কারণ যেকোনো সময়ে মাথার উপর এসে পড়তে পারে ভারী কোনো আসবাবপত্র। আর এর জন্য কিন্তু কাউকে দোষারোপও করা যবে না। তাই আঘাত পাওয়া থেকে বাঁচতে হলে নিজেরই সতর্কতা চাই। এ সময়টাতে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসীদের এমন করার কারণ হলো তাদের নতুন বছরের রীতি পালন করা। যদিও পুরো দক্ষিণ আফ্রিকার সব নয়, কিছু কিছু জায়গায় প্রচলিত রয়েছে এই রীতি। তাদের বিশ্বাস যে, এভাবে কাঠের আসবাবপত্র ঘর থেকে ছুঁড়ে ফেলে তারা পৃথিবীর মানুষকে জানায় যে, তারা অতীতের সব কষ্ট দুর্দশা ভুলে আশাবাদী হয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন বছর পালনের নমুনা; Image Source: Fruit of Adventure

স্কটল্যান্ড: ঘরের প্রথম অতিথি নির্বাচনে খুঁতখুঁতে হওয়া

বছরের প্রথম দিন, জানুয়ারির এক তারিখে কে প্রথম আপনার ঘরের কড়া নাড়বেন? এই বিষয় নিয়ে আপনি চিন্তিত না হলেও স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা কিন্তু বেশ চিন্তিত থাকেন! তাদের মাঝে ‘প্রথম কদম’ বিষয়টি বেশ চর্চা করা হয় এবং এতে রয়েছে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। সেখানকার বাসিন্দারা আশা করেন যে, বছরের প্রথম দিনে তাদের ঘরে প্রথম পা রাখবেন লম্বা গড়নের কালো বর্ণের কোনো মানুষ! শুধু তা-ই নয়, সে সময়ে সেই অতিথিদের সঙ্গে করে আনতে হবে লবণ, ছোট পাউরুটি বা হুইস্কি। আর এভাবেই অতিথিরাই যেন ঘরের জন্য আগামী বার মাসের শুভকামনা নিয়ে আসেন। তবে সেই অতিথিরা যে কেউ যে হতে পারবেন তা কিন্তু নয়, বরং তাদেরকেই অতিথি হয়ে আসতে হবে যাদেরকে ঘরের মানুষেরা আমন্ত্রণ জানাবেন। আর যে অতিথিকে নির্বাচন করা হয় তাদেরকে তো অবশ্যই সঙ্গে করে ঐতিহ্যবাহী কোনো কিছু তাদের বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের জন্য আনতে হবে।

ইকুয়েডর: ক্ষোভ-দুর্দশাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়

ইকুয়েডরের স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে নতুন বছরের অনুষ্ঠানটি ‘লস আনোস ভিয়েজোস’ নামে পরিচিত যার ভাবার্থ দাঁড়ায় ‘পুরাতন বছরগুলো’। তাদের বিশ্বাস মতে, এটি এমন একটি রীতি যার মাধ্যমে পূর্ববর্তী সব অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এই সময়টাতে সেখানে গেলে দেখা যাবে যে, মানুষজন বসে বসে পুতুল বানাচ্ছে যেগুলো দেখতে আমাদের দেশের কাকতাড়ুয়ার মতো। কেউ সেটাকে বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন, কেউ নিজেদের অপকর্মের বর্ণনা আর কেউবা ভয়ানক দোষী সাব্যস্ত মানুষদের ছবি দিয়ে সেসব পুতুলগুলোকে সাজায়। সেই পুতুলগুলো কাঠের মিহি গুঁড়ো, পত্রিকা বা কাপড় দিয়ে বানিয়ে শেষমেশ একটি মুখোশ পরিয়ে রাখে। সময় গড়িয়ে যখন মধ্যরাত আসে এবং উৎসবের আমেজ শুরু হয়, তখন সবার বাসার সামনে ঝোলানো এসব পুতুলগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, একটি বছরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পেছনে ফেলে প্রফুল্লতা আর উদ্যম নিয়ে সবাই নতুন বছরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

তাদের ধারণা, এতে পূর্ববর্তী সব অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়; Image Source: Lead Adventures

স্পেন: ১২ সেকেন্ডে ১২টি আঙ্গুর ফল খেতে হবে

নতুন বছরের উৎসবের সময় স্পেনে গেলে পেটে ক্ষুধা নিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়! স্পেনের বাসিন্দাদের মতে বা তাদের এক ধরনের কুসংস্কারই বলা চলে যে, পুরনো বছরের শেষের ১২ সেকেন্ড আগামী বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করে। তবে অবশ্যই তা নির্ভর করে এই অল্প সময়ের মধ্যে আপনি কয়টি আঙ্গুর খেতে পারছেন তার উপর। এই প্রথার উদ্দেশ্য হলো মধ্যরাতের আগেই ১২ সেকেন্ডের মধ্যে ১২টি আঙ্গুর খেয়ে নিজের জন্য শুভকামনা প্রত্যাশা করা।

আপনি ১২ সেকেন্ডে ১২টি আঙ্গুর ফল খেতে পারবেন? Image Source: NPR

ফিলিপাইন: ১২ রকমের গোলাকৃতির ফলমূল খুঁজে বের করা

রং, আয়তন বা গঠনবিন্যাস কোনোটিই নয়! ফিলিপাইনে নতুন বছরের সৌভাগ্য নির্ধারণের প্রতীক হিসেবে বছে নেয়া হয় আকৃতিকে। আর সেক্ষেত্রে গোলাকৃতিটাকেই শুধুমাত্র প্রাধান্য দেয়া হয়। তাদের ধারণা, পয়সার আকৃতি গোল এবং তা ধন-সম্পদের আগমন ঘটায়। তাই যত বেশি গোলাকৃতির জিনিস একজন ব্যক্তি সংগ্রহ করতে পারেন, তাকে তত বেশি সৌভাগ্যবান মনে করা হয়। ফিলিপাইনের লোকজন তাই ১২টি গোলাকারের ফলমূল সংগ্রহ করেন যার প্রতিটিকে বছরের এক একটি মাস হিসেবে ধরা হয়।

ব্রাজিল: সাদা পোশাক

একটি বিষয় একেবারেই স্পষ্ট যে, ব্রাজিলের নাগরিকেরা উৎসবে মেতে থাকতে এবং সেই উৎসবগুলোতে জমকালো কাপড় পরতে ভালোবাসে। তবে নতুন বছরের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। অন্যান্য দেশবাসীদের মতো তারা নতুন বছরের সৌভাগ্য, বিস্ময় ও দুঃসাহসিকতায় জীবন পার করার কামনা করে না, বরং সেদিন তাদের কাপড়ে থাকা চাই একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য! আর তা হলো পোশাকের রঙটি অবশ্যই সাদা হতে হবে! তবে পোশাকের শুধুমাত্র একটি অংশই সাদা হলে চলবে। আর বাকিগুলো পরার ক্ষেত্রেও কিছুটা বিচার বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়, কেননা প্রতিটি রঙেরই রয়েছে আলাদা অর্থ। যেমন- সবুজ রং স্বাস্থ্যের, হলুদ রং টাকা-পয়সার, নীল রং অনুপ্রেরণার এবং লাল রং ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে মানা হয়।

নতুন বছরকে স্বাগতম জানানো হয় শুভ্রতায়; Image Source: Sweet Rockk – blogger

জাপান: ১৮০ বার বেল বাজানো

জাপানের কিওটো শহরে নতুন বছরের আগের মধ্যরাতে বাসার দরজায় ১৮০ বার বেল বাজানো হয়! এই ঐতিহ্য অনুযায়ী গৌতম বুদ্ধের বিশ্বাসকে সম্মান জানানো হয়। তাঁর বিশ্বাস ছিলো যে, এর মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা ও নির্মলতা বয়ে আসে। আর এই পরিচ্ছন্নতা বলতে বোঝায় মন, আত্মার সব ময়লা, ক্লেশ ও খারাপ চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে দেয়া। এই রীতিকে বলা হয় ‘জয়া নো কানে’ এবং ১৮০ বার বেল বাজানোর মাধ্যমে মানুষের ১৮০ রকম জাগতিক চাহিদাকে বোঝানো হয়। বেল বাজানোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পুরাতন বছরে নিজের সব ভুল ভ্রান্তিকে শুধরে নিয়ে স্বচ্ছ মন মানসিকতা নিয়ে সামনের বছরের দিনগুলো কাটাবে সেটাই কামনা করা হয়।

এই রীতিকে বলা হয় ‘জয়া নো কানে’; Image Source: Scholarship.in.th

Feature Image Source: theimaginativeconservative.org

Related Articles

Exit mobile version