দুনিয়াজুড়ে আলোচিত সব ভাস্কর্য-কাণ্ড

বাংলাদেশে সর্বত্র চলছে সর্বোচ্চ আদালতের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রীক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য অপসারণ সংক্রান্ত আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইনে চলছে প্রচুর লেখালেখি। পক্ষে বিপক্ষে আসছে অনেক মতামত। এমনকি পক্ষে বিপক্ষের লোকেরা যার যার মতামত জানাতে নেমে পড়েছেন রাজপথেও। সব মিলিয়ে ভাস্কর্য সংক্রান্ত আলাপ আলোচনায় সরগরম দেশ।

ভাস্কর্য এবং শিল্পকর্ম নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক এবং আলোচনা সমালোচনার ঘটনা আমাদের দেশের মতোই সারা বিশ্বেই হয়ে থাকে। আসুন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে ভাস্কর্য আর শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচিত কিছু ঘটনার দিকে দৃষ্টি ফেরাই।

ভাস্কর্য সংক্রান্ত আলোচিত ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের সামনে দাঁড়ানো ‘নির্ভিক বালিকা’র ভাস্কর্যটি। চলতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে লিঙ্গবৈষম্য এবং কর্পোরেট বিশ্বের বেতন বৈষম্যের বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল ওয়াল স্ট্রিটের ক্ষ্যাপা ষাড়ের ভাস্কর্যের সামনে। ম্যানহাটনের এ অদম্য ষাঁড়ের মূর্তি ‘ওয়ালস্ট্রিট চার্জিং বুল’ নামে পরিচিত। এর আরেকটি পরিচিয় হল ‘ওয়াল স্ট্রিট আইকন’।

১৯৮৯ সালে রাগান্বিত ষাঁড়ের ভঙ্গিমায় পিতলের এ ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়। আমেরিকার শেয়ার বাজারের বিপরীতে ‘মার্কিন জনগণের শক্তি ও সামর্থ্যের’ প্রতীক হিসেবে এ মূর্তিকে বিবেচনা করা হয়। মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা পায় এটি। নারী দিবসকে সামনে রেখে ওয়াল স্ট্রিট বুলের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় নির্ভিক বালিকার পিতলের ভাস্কর্যটিকে। ৪ ফুট উচ্চতার ছোট্ট মেয়েটির ঝুঁটি বাঁধা চুল, বাতাসে উড়ন্ত ফ্রক। কোমরে হাত রেখে যেন রেগে থাকা ষাঁড়টিকে রুখতে মগ্ন। অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে এ ‘নির্ভিক বালিকা’। প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থী এটির সঙ্গে ছবি তুলতে ম্যানহাটনে ছুটে আসছেন। কথা ছিল মার্চ মাস শেষেই সরিয়ে ফেলা হবে ভাস্কর্যটি। কিন্তু পর্যটকদের চাহিদা এবং বিরুদ্ধ শক্তির সামনে সাহসের প্রতিমুর্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাওয়ার কারNe কর্তৃপক্ষ এটিকে না সরানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাসিও নিজেই এ ভাস্কর্যটি পরিদর্শন করেন এবং এর সঙ্গে ছবি তুলে টুইটারে পোস্ট করেন।

নির্ভীক বালিকার সঙ্গে নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাসি

তিনি জানান, আপাতত সরানো হচ্ছে না এটি। মেয়র ব্লাসিওর মতে, “এটা নিউইয়র্কবাসীর কাছে অনেক বেশি কিছু। মূর্তিটি ভয় ও ক্ষমতার ঊর্ধ্বে উঠে নিজের ভেতরের সঠিক শক্তি খুঁজে পেতে সহায়তা করে। যে মুহূর্তে আমাদের উদ্দীপনা প্রয়োজন, সেসময় উদ্দীপনা জোগায়।

নিউইয়র্কের এই ভাস্কর্যটির মতোই দক্ষিণ কোরিয়ায় আলোচিত একটি ভাস্কর্যও নারীর। এটি হচ্ছে যৌনদাসী বা ‘কমফোর্ট উইমেন’ এর ভাস্কর্য। দক্ষিণ কোরিয়ার বন্দরনগরী বুশানে জাপানের উপ-দূতাবাসের সামনে এই ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপন করা হলে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এমনটি জাপান সিউল থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার পর্যন্ত করে। আর এ কারণেই বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয় এই কমফোর্ট উইমেন এর ভাস্কর্যটি। মূলত, ১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপ জাপানি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওই অঞ্চলের বহু নারী জাপানি সেনাদের কাছে নির্যাতিত ও ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এই নারীদেরই বলা হয় কমফোর্ট উইমেন।

বুশানে জাপানি উপ-দূতাবাসের সামনে কমফোর্ট উইমেনের ভাস্কর্য

দুই দেশের কূটনৈতিক টানাপোড়েনের অন্যতম কারণ এই ইস্যুটি। ২০১৫ সালে একটি চুক্তিতে এই কমফোর্ট উইমেনদের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয় জাপান। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর বুশানে উপ-দূতাবাসের সামনে কমফোর্ট উইমেনের ভাস্কর্য স্থাপন করা হলে আবারো কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। বিষয়টি এখনো অমিমাংসিত রয়ে গেছে।

আলোচিত নারী ভাস্কর্যের মধ্যে আরো রয়েছে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের মারিনা সমূদ্র সৈকতের একটি নারী ভাস্কর্য- কান্নাগী। তামিল ভাষার জনপ্রিয় প্রাচীন মহাকাব্য শিলাপাথিকারাম এর প্রধান চরিত্র এই কান্নাগী। সাহসী এই নারী যোদ্ধা তার স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেন। আর তাই তামিল সংস্কৃতিতে নারীর সাহস আর প্রতিবাদের প্রতীক কান্নাগী। মহাকাব্যে বর্ণিত একটি দৃশ্যের অনুকরণে তার একটি ভাস্কর্য রয়েছে চেন্নাইয়ের মারিনা সমুদ্র সৈকতে।

চেন্নাইয়ের মারিনা সমুদ্র সৈকতে কান্নাগী ভাস্কর্য

২০০১ সালে এই ভাস্কর্যটি অপসারণ করেছিল কর্তৃপক্ষ। তখন ফুঁসে উঠেছিল তামিলনাড়ুর সাধারণ জনতা। চেন্নাইয়ের রাজপথে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়েছিল। তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এম করুনানিধি তখন এই ভাস্কর্য অপসারণের ঘটনাকে তামিল গর্বের ওপর আঘাতরুপে অভিহিত করেন এবং তামিল ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ভাস্কর্য অপসারণের কারণ হিসেবে তৎকালীন তামিলনাড়ুর পুলিশ প্রধান জানান, ভাস্কর্যটির কারণে ট্রাফিক চলাচল ও নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিবিদ করুনানিধি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে চাপের মুখে সরকার তখন তামিল জনতাকে জানায়, বেদির সংস্কার করার জন্যই সরানো হয়েছে ভাস্কর্যটি। জনগণের চাপের মুখে আবারো ২০০৬ সালে ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপন করা হয়।

ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক হয়েছে আফ্রিকার দেশ সেনেগালেও। মুসলিমপ্রধান দেশ সেনেগালের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল এক বিশাল ভাস্কর্য উন্মোচন করা হয়। স্ট্যাচু অব লিবার্টির চেয়েও বড় এই ভাস্কর্য নিয়ে তখন দেশটিতে তীব্র বিতর্কও সৃষ্টি হয়ে। শিশু কাঁধে এক পেশিবহুল পুরুষ স্বল্পবসনা এক নারীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিমায় এ ভাস্কর্যকে ‘যৌনাত্মক’ বলে সমালোচনা করেন বিরোধীরা। তবে সমর্থকদের দাবি ছিল, এটি আফ্রিকার উত্থানের ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। ‘আফ্রিকান রেনেসাঁ’ নামের ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১৬৪ ফুট।

আফ্রিকান রেনেসাঁ ভাস্কর্য 

এটি উন্মোচনের সময় বিরোধীরা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা উন্মোচন অনুষ্ঠান বয়কটের আহ্বান জানান। ভাস্কর্যটি বানানোর বিশাল খরচও সমালোচনার অন্যতম কারণ। এটি তৈরিতে ব্যয় হয় দুই কোটি ৭০ লাখ ডলার। প্রেসিডেন্ট আবদৌলায়ে ওয়াদের ভাবনা থেকে ব্রোঞ্জ দিয়ে এই ভাস্কর্য তৈরি করেছে উত্তর কোরীয় ভাস্করদের একটি দল। ভাস্কর্য তৈরিতে উত্তর কোরিয়ানদের নিয়োগ দেয়ার সমালোচনা করে দেশটির বিশ্বখ্যাত ভাস্কর ওসমান সোউ বলেছিলেন, এটি আর যা-ই হোক, আফ্রিকার রেঁনেসার প্রতীক হতে পারে না এবং এর সঙ্গে শিল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরো বলেন, সেনেগালের নিজস্বতার চেয়ে সোভিয়েত আমলের ভঙ্গি ফুটে উঠেছে এতে।

মুসলিমপ্রধান সেনেগালে মুসলিম ধর্মীয় নেতারাও ভাস্কর্যটির সমালোচনায় যোগ দেন। তাদের মতে, ভাস্কর্যটি ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিরোধীদের ক্ষোভ আরো উসকে দেয়, ভাস্কর্যটির প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ প্রেসিডেন্টের নিজের নেয়ার ঘোষণা। প্রেসিডেন্ট আবদৌলায়ে ভাস্কর্য উদ্বোধনের সময় দাবি করেন, যেহেতু তার পরিকল্পনা ও ভাবনা অনুযায়ী এটি তৈরি করা হয়েছে, তাই রাজস্বের ৩৫ শতাংশ তিনি নিজে নেবেন। তবে ভাস্কর্যের সমর্থকদের মতে, অসহিষ্ণুতা ও বর্ণবৈষম্য থেকে আফ্রিকার উত্থানের প্রতীক এটি।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় বেকার হোস্টেলে ছিলেন ১৯৪৫-৪৬ সালে। ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বেকার হোস্টেলের ২৩ ও ২৪ নম্বর কক্ষ নিয়ে গড়া হয় বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ। সেখানেই স্থাপন করা হয় বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য।

বেকার হোস্টেল থেকে

বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য সরানোর দাবি তোলে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশন। কিন্তু তাদের দাবি নাকচ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু দুই বাংলার প্রেরণা। তার ভাস্কর্য সরানোর প্রশ্নই ওঠে না। কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তথ্যসূত্র

১) money.cnn.com/2017/03/27/news/fearless-girl-statue-2018/

২) edition.cnn.com/2017/02/05/asia/south-korea-comfort-women-statue/

৩) frontline.in/static/html/fl1901/19010320.htm/

৪) news.bbc.co.uk/2/hi/8601382.stm/

৫) thedailystar.net/country/bangabandhus-statue-will-stay-baker-hostel-mamata-1380160/

Related Articles

Exit mobile version