‘আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম রাবণ আছে
দেখে যা নিজের চোখে হনুমান কেমন নাচে।
এ সুযোগ পাবেনা আর, বল ভাই কি দাম দেবে-
পুতুল নেবে গো, পুতুল…।’ (শ্যামল মিত্র)
আবহমানকাল ধরে পুতুল খেলা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে উৎসবের থেকে কম কিছু নয়। “মেয়ে আমার বড় হয়েছে, আর ঘরে রাখতে পারি না, তাই আজ রাতে পাশের বাড়ির ছেলে পুতুলের সাথে আমার মেয়ে পুতুলের বিয়ে” এ যেন গ্রাম বাংলার এক সাধারণ রূপ। দুই বাড়ির এই উৎসবে অনেক সময় অত্যন্ত উৎসাহের সহিত যোগ দিত বড়রাও। পুতুলখেলা ছোটদের কাছে আবেশের মতো। আর তার সাথে যদি সেই জড় পুতুল নাচে, কথা বলে তাহলে ছোট থেকে বড় সবাই যেন তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখাতে থাকে। এই জড় পুতুলের নাচ, কথা বলা, রঙ্গ-তামাশা পুতুল নাচ বা পাপেট্রি নামে গ্রাম বাংলায় পরিচিত হয় মানুষের শ্রেষ্ঠ বিনোদন হিসাবে।
আনুমানিক ষোলশ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে পুতুল নাচ শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিতাস নদীর পাশে গড়ে উঠা কৃষ্ণনগর গ্রামে বিপিন পাল নামক এক ব্যক্তি প্রথম এই পুতুল নাচের উদ্ভব করেন বলে জানা যায়। তিনি তৎকালীন প্রেক্ষাপটে সামাজিক, পৌরণিক কাহিনী অবলম্বনে পুতুল নাচের আসর সাজাতেন। ধীরে ধীরে আরো অনেকে যোগ দেন এই শিল্পে। তাদের মধ্যে গিরীশ আচার্য্য, মোতারু মিয়া, মেরুড়া এলাকার ধন মিয়া, কালু মিয়া, মো. রাজ হোসেন ও শরীফ মালদার নামক ব্যক্তিদের নাম উল্লেখযোগ্য।
এদের মধ্যে দেশ-বিদেশে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করে ধন মিয়ার পুতুল নাচের দল। তার দলের নাম ছিল রয়েল বীণা অপেরা। এছাড়া সুমি বীণা পুতুল নাচ, ঝুমুর নাচ নামক দলও বেশ সুনাম অর্জন করে বলে জনশ্রুত আছে। পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনায় আজও পুতুল নাচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য ধারণ করে রয়েছে। এখনও বিভিন্ন মেলা বা শিল্প বাণিজ্যে পুতুল নাচের প্রদর্শন হয়ে থাকে। মাঝে বেশ কিছুকাল এই নাচের পশার কম হলেও বর্তমানে উপমহাদেশের বাঙালি বিভিন্ন মেলায় আবারও পুতুল নাচ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
তখনকার গ্রামীণ জীবনযাত্রায় যাত্রাপালা ছিল বিনোদনের একমাত্র উপায়। কিন্তু যাত্রাপালার আসর তৈরি করতে খরচও নেহাত কম ছিল না। তখন বিকল্প হিসাবে পুতুল দিয়ে আসর সাজানোর চিন্তা আসে। প্রথমদিকে পুতুল তৈরি হত মাটি আর কাঠ দিয়ে। পুতুলের উপরের বা নিচের অংশ কাঠের তৈরি থাকত। উপরে রঙ তুলিতে মুখের অবয়ব তৈরি হত আর নিচে কাপড় দিয়ে পোশাক পড়ানো হত। চুল বানানো হত কচুরীপানার শিকড় দিয়ে। কিন্তু এভাবে কাঠের তৈরি পুতুলের অঙ্গভঙ্গি বেশ কঠিন হত। যখন দেখা গেল দর্শক এই পরিবেশনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে তখন পুতুল নাচকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য বিশেষভাবে পুতুল তৈরির পরিকল্পনা আসে। পরবর্তিতে কারিগররা সহজ উপায় পেয়েও যান। তারা এই বিশেষ ধরনের পুতুল তৈরি করে শোলা আর হাল্কা কাঠ দিয়ে। গ্রামে নদী-বিলের ঝোঁপঝাড় থেকে এসব শোলা সংগ্রহ করা হত। তারপর সেগুলোকে গল্পের ধরণ অনুযায়ী কাপড়, অলংকার, টোপর পরিয়ে সূক্ষ্ম তার আর সুতার ব্যবহারে নাচ করানো হত মঞ্চে।
শুধু মানুষের অবয়ব নয়, শোলা দিয়ে তৈরি করা হতো গাছ এবং পশু-পাখিও। গল্পের প্রয়োজনে সেগুলোকে সুতা ব্যবহার করে মঞ্চে আনা হতো। নির্দিষ্ট কোনো কাহিনী অবলম্বনে প্রদর্শিত হতো এক একটি আসর। যাত্রাপালার বিশেষ ঢঙে সংলাপ, সাথে অট্টহাসির মিশ্রণ আসরকে করে তুলতো মোহনীয়। মঞ্চের একপাশে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাদক আর কালো কাপড়ে ঢাকা মঞ্চের উপর থেকে গান আর সংলাপের সাথে মিল রেখে নৈপুণ্যের সাথে সূক্ষ্ম সুতার সাহায্যে পুতুল নাচাত শিল্পীরা। পুতুল নাচানোর এই কৌশল আয়ত্ত করতে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হতো। পুরো প্রদর্শনটি একটি টিমওয়ার্কের মত। শিল্পীর দক্ষতায়, বাদকের বাজনায় আর পুতুলের নাচে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। যেন মনে হয় ঐ জড় পুতুলগুলো প্রাণ পেয়েছে।
জানা যায় যে, পর্দার আড়ালে যেসব শিল্পী পুতুল নাচাতেন তাদের প্রায় ৩-৬ টা সুতা ব্যবহার করতে হত। এমনকি পুতুলের কথা হৃদয় গ্রাহী করতে কণ্ঠের সাথে মিশ্রণ ঘটাতো তালপাতার বাঁশির মনোমুগ্ধকর আওয়াজ।
লোক-সংস্কৃতির অন্যতম ধারক এই পুতুল নাচ ছিল মানুষের জীবনযাত্রারও সংমিশ্রণ। পুতুল নাচে রাধা কৃষ্ণের লীলা, সীতাহরণ, রামায়ন মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী তুলে ধরা হতো। সেই সাথে তুলে ধরা হতো সামাজিক প্রতিচ্ছবি। বিয়ের অনুষ্ঠান, ঘটকালি থেকে কন্যা বিদায়, সুখী পরিবার, নারী শিক্ষা, দাম্পত্য কলহ সমাধানের উপায়, ঐতিহাসিক ঘটনা, কৃষিশিক্ষায় উন্নয়নের বিভিন্ন পন্থা এগুলো পুতুল নাচের মাধ্যমে প্রচারও ছিল পুতুল নাচের উদ্দেশ্য। যৌতুক আর বাল্যবিবাহ বন্ধ করার শিক্ষণীয় মাধ্যম ছিল এই পুতুল নাচ। লোকজ জীবনের বিভিন্ন কিসসা পালাগানও প্রদর্শিত হত।
সামাজিক পালাগানের পুতুল নাচে মানুষ তার জীবনের প্রতিফলন খুঁজে পায়। এজন্য বলা হয়ে থাকে, মানুষের জীবন পুতুল নাচের মতোই। উপর থেকে সুতার টানে মানুষ ছুটে চলে জীবনের সব উত্থান-পতন নির্বিকারে সহ্য করে। বিংশ শতাব্দীতে পুতুল নাচ আধুনিক শিল্পকলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু সেভাবে বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। বেশ কিছুদিন টিভিতে জাঁকজমক দেখা গেলেও সেভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। বর্তমানে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক কারণে দেশে গোটা ত্রিশেক শিল্পীদলের সন্ধান পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর এবং বাগেরহাটের কয়েকটি দল শিল্পকলা একাডেমিতে মাঝে মধ্যে পুতুল নাচ পরিবেশন করে থাকে।
পুতুল নাচ সম্পর্কে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার বলেন,”বাংলাদেশে গ্রামীণ ঐতিহ্য পুতুল নাচের যে বিশেষ স্থান ছিল, কালের বিবর্তনে যান্ত্রিক বিনোদনের আগ্রাসনে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পুরনো ঐতিহ্যকে অপরিবর্তিত রূপে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। তাকে অন্তরের মধ্যে রেখে শৈল্পিক শ্রদ্ধাবোধ থেকেই নতুন কিছুকে সংযোজন করা যায়।” তিনিই বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ঐতিহ্য ধরে রাখতে বিভিন্ন পাপেট্রি প্রচারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরুর পরবর্তী বছরেই পুতুল নাচ নিয়ে হাজির হন তিনি।
২০০৪ সালে ‘সিসিমপুর’ পাপেট্রি শুরু হয়, যা দুই বছরে ৪০ লক্ষেরও বেশি শিশুকে বিনোদন দিয়ে এসেছে। হালুম, ইকরি মিকরি, টুকটুকি, শিকু, লাল মিয়া চরিত্রগুলো ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সাজান তিনি। ফলে সেগুলো শিশুদের পছন্দের চরিত্র হয়ে উঠে। তিনি সেখানে তরুণদের কাজের উৎসাহ দেখেছেন। তাদের সঠিক প্রশিক্ষণে পুতুল নাচ আবার তার জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে বলে তিনি আশা রাখেন।
বর্তমানে শিশুরা মোবাইল, কম্পিউটার, ফেসবুক, ইন্টারনেট এর ব্যবহারে হাতের মুঠোয় দিন অতিবাহিত করে। ফলে তাদের সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। তাদেরকে সৃষ্টিশীল হিসাবে গড়ে তুলতে চাইলে তাদেরকে আমাদের ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করাতে হবে। এতে তারা বিনোদনের সাথে শিক্ষণীয় তথ্যও জানবে। আর এক্ষেত্রে আমাদের দেশজ ঐতিহ্য পুতুল নাচ বিনোদন এবং শিক্ষা দুইদিকেই সমান প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবে।
ফিচার ইমেজ- Youtube