দ্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৪ সালে। তবে তখন এর নাম ছিল দ্য গিনেস বুক অব রেকর্ডস। পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা, যেগুলো মানুষের চিন্তার চাইতেও একটু বেশি কিছু, পাগলাটে এবং অন্যরকম- এমন সব তথ্য নিয়েই এদের কাজকারবার। গিনেস বুকের মতো কিছু করার চিন্তা প্রথম মাথায় আসে হে বিবারের। সাথে ছিলেন নোরিস এবং রস ম্যাকুইটার নামে দুই ভাই। এখন পর্যন্ত সর্বাধিক বিক্রিত বই হিসেবে নিজেই রেকর্ড করেছে গিনেস বুক। প্রতি বছর নানারকম নতুন রেকর্ড নিয়ে সামনে আসে দ্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। গত বছরেও সেই ধারাবাহিকতা চলেছে যথানিয়মে। ফলে ২০১৭ সালে, অর্থাৎ গিনেজ বুকের ৬২ তম প্রকাশনার বছরে এসেও নিজেদের সেরাটা দিয়েছে তারা। তবে সেসব রেকর্ডের মধ্য থেকে সেরা কিছু রেকর্ডকে বাছাই করেছে তাঁরা। চলুন দেখে আসি একনজরে গিনেজ বুকের চোখে ২০১৭ সালে তৈরি হওয়া সেরা কিছু রেকর্ড। এই অনন্যসাধারণ রেকর্ডগুলো কেবল নিজেদেরই পরিচয় প্রকাশ করেনি, সেইসাথে গিনেস বুককেও করেছে সমৃদ্ধ।
সর্বোচ্চ কাপকেকের টাওয়ার
শুনে আপনার মনে হতেই পারে যে, ব্যাপারটা খুব হাস্যকর কিছু। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? কতগুলো কাপকেককে একত্রে একটার পর একটা রেখে সাজানো সম্ভব? একটুখানি বিজ্ঞান, একটুখানি চিন্তা করার অভ্যাস আর পাগলামি- সবকিছু মিলিয়ে তবেই সম্ভব হয়েছে ৬,৩৭০ টি কাপকেক দিয়ে সাজানো এই টাওয়ারটি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিনেজেংয়ে তৈরি এই টাওয়ারটি তৈরির সময় ঠিক কতগুলো কাপকেক নির্মাতাদের পেটে গেছে সে হিসেব না থাকলেও এর উচ্চতার হিসেবটি শুনলে চক্ষু চড়কগাছ হবে আপনারও। সবমিলিয়ে শেষমেশ টাওয়ারটির উচ্চতা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৫ ফুট ৪ ইঞ্চিতে। হোপ ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বাচ্চাদের জন্য করা এই কাজটিতে সাহায্য করেছিলেন অনেকেই। প্রতিষ্ঠানের বাচ্চারা নিজেরা গিয়ে গিয়ে অনেকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। তবে এতে কারো আগ্রহেরই কমতি ছিল না। চিকিৎসার জন্য করা হয় এই অর্থ সংগ্রহ। তবে তার চাইতেও অনেক বেশি আনন্দ এনে দেয় এটি। টাওয়ার তৈরির সময় কতগুলো কাপকেক মানুষের পেটে গিয়েছিল সেটা জানা না থাকলেও এটি ভাঙার পর সবাই মিলে সেই কেকগুলো অতিথি ও স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়। খাওয়া হলো, আনন্দ হলো, সেইসাথে গিনেস বুকে নাম ওঠানোর কাজটাও সেরে ফেলা গেল!
দীর্ঘতম বালুর প্রাসাদ
প্রতি বছরই বালুর প্রাসাদ তৈরির প্রতিযোগিতা চলে। সমুদ্রের ধারে গেলে নিশ্চয়ই বালু দিয়ে কিছু না কিছু একটা মনের মতো করে বানিয়ে ফেলেন আপনিও? তবে তেমন কিছু নয়, বরং পূর্ব পরিকল্পনানুসারেই গত বছর বালু দিয়ে প্রাসাদ তৈরি করা হয়। ২০১৭ সালের বিশ্ব রেকর্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ছিল এই রেকর্ডটি। মোট দু’বার নতুন উচ্চতার মান তৈরি হয় বালুর প্রাসাদ নিয়ে এই এক বছরেই। প্রথমটি নির্মাণ করেন ভারতীয় শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়েক। উড়িষ্যার পুরিতে সমুদ্রের পারে বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করার আহ্বান নিয়ে ৪৮ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার এবং পরিধিতে প্রায় ৫৩০ ফুটের এই প্রাসাদটি। তবে ফেব্রুয়ারির এই রেকর্ড ভাঙতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। একই বছরের অক্টোবরে জার্মান পর্যটন পরচালনা এবং ভ্রমণ সংস্থা নতুন করে রেকর্ড তৈরি করে। প্রায় ৩,৫০০ টন বালু ব্যবহার করে তারা, যাতে ব্যবহার করা হয় ১৬৮টি ট্রাক। এক মাসের মধ্যেই ৫৪ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার একটি বালুর প্রাসাদ নির্মান করে সংস্থাটি। পর্যটকদের আকর্ষণ করা এবং নিজেদের নামকে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাঁদের প্রধান লক্ষ্য। নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি, সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দেওয়ার দরকার পড়বে না!
একসাথে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোবটের নাচ
অদ্ভুত এই রেকর্ডটি করা হয় চীনের গুয়াংঝোতে। অবশ্যই এটি এক প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট সংস্থার পক্ষেই করা সম্ভব হয়েছে। ডব্লিউএল ইন্টেলিজেন্ট টেকনোলজি কোম্পানির সুবাদেই এমন এক রেকর্ড নিজেদের তালিকায় রাখতে সক্ষম হয়েছে গিনেস বুক। মোট ১,০৬৯টি রোবট অংশ নেয় এই নিয়ম মেনে করা নাচের অনুষ্ঠানে। আরো কিছু রোবট অবশ্য ছিল সাথে। তবে নাচতে তো আর সবাই পারে না। কোনো না কোনোভাবে পড়ে গেছে তারা। এই নাচের রেকর্ডটিতে অংশগ্রহণ করা সব রোবটই ছিল ডোবি। মজার ব্যাপার হল, ডোবি নামের এই রোবটগুলো কেবল নাচতেই জানে না, তারা কথাও বলতে পারে। মানুষের মতো এমন অনেক কাজ করার বৈশিষ্ট্য আছে এদের মধ্যে।
বৃহত্তম বাক্স খোলার রেকর্ড
কী? বিশ্বাস হল না? হ্যাঁ, এমন রেকর্ডও করা হয়েছে ২০১৭ সালে। জন্মদিনে বা কোনো বিশেষ দিন উপলক্ষে উপহার তো পেয়েই থাকি আমরা। তবে সেই উপহারের বাক্সটা কতই বা আর বড় হতে পারে? কেউ নিশ্চয় বাক্সে মুড়ে প্লেন উপহার দিতে যাবে না। তবে প্লেন না দিলেও এবার বাক্সবন্দী করে গোটা একটি ট্রাক উপহার দেওয়া হয়েছে। যদিও সেটা কিছুক্ষণর জন্যেই কেবল! আর সেটা খুলে পৃথিবীর সবচাইতে বড় উপহারের বাক্সটি খোলার রেকর্ড গড়েছে জোল জোভিন নামের এক তিন বছরের শিশু। গত মার্চ মাসে আমেরিকার উত্তর ক্যারোলিনার শার্লোটে এই বিশাল কাজটি সম্পন্ন করে জোল, আর নাম লিখিয়ে নেয় গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। ভলভো ট্রাকের নতুল ভিএনএল মডেল প্রকাশ করার দরকার ছিল। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি জোলকেই নির্বাচিত করে। জোলের যে পুরো ব্যাপারটি বেশ ভালো লেগেছে, সেটা উপহার খোলার সময়ে তোলা তার ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
দীর্ঘতম ওয়াটার স্ক্রিন প্রজেকশন
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০১৭ সালের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হওয়া দুবাই ফেস্টিভ্যাল সিটির কথা মনে আছে? এই রেকর্ডটি সেখান থেকেই করা। এখানেই এটি নতুন মাল্টিমিডিয়া আকর্ষণ ইমাজিনের সাথে সবাইকে পরিচিত করে দেয়। কে এই ইমাজিন? আর কিছু নয়, এটি শুধু পানির মধ্যে তৈরি করা ছাপ, কোনো ছবি, ওয়াটার স্ক্রিন প্রজেকশন। আর এই ঘটনাটির মাধ্যমেই আগের সবগুলো রেকর্ডকে ভেঙ্গে ফেলা হয়। প্রায় ৯,৬১২.১৭ বর্গ ফুট আলোর প্রজেকশন করা হয় মলের সামনেই রাখা ৩০টি পানির ফোয়ারার পর্দা আর কুয়াশায়। শুধু তা-ই নয়, ৩৬০ ডিগ্রির এই আলোর উৎসবে স্টার ড্যান্সার নামের পানির ছায়াটি দর্শকদের সাথে নাচ-গানেও অংশ নেয়। অসম্ভব উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় পৃথিবীর সবচাইতে দীর্ঘ পানির খেলা।
সর্বাধিক দূরবর্তী গাড়ি নিক্ষেপ
প্রচন্ড গতিতে গাড়ি ছুটে আসছে সামনের দিকে। এ পাশটা উঁচু, ঐ পাশটাও উঁচু। মাঝখানে খানিকটা গর্ত। মোটেও চিন্তা করলো না দুর্ধর্ষ নায়ক। গাড়িকে নিয়ে সোজা লাফ না দিয়ে ঐটুকু ফাঁকা স্থানের মধ্যেই দুই পাক গোত্তা খাইয়ে গাড়িকে ঠিক স্থানে নামিয়ে আনলো সে। কেমন লাগলো শুনতে? শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল কি?
এমনটা ছবিতে, বিশেষ করে জেমস বন্ডের চলচ্চিত্রগুলোতে তো হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়, তা-ই না? কিন্তু বাস্তবেও তো সেই দৃশ্যগুলোকে কেউ না কেউ করে। আর এমন স্ট্যান্টের কারণেই ১৫.৩ মিটার অতিক্রম করে সর্বাধিক দূরবর্তী ব্যারেল রোল করার রেকর্ড ছিনিয়ে নিয়েছেন তিনি।
ফিচার ইমেজ: cover to cover