হিমালয়ের পাদদেশে বয়ে যাওয়া নয়নাভিরাম হ্রদ লুগু। চীনের ইউনান প্রদেশে অবস্থিত এই হ্রদ পার হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় রহস্যময় এক গ্রামে, যেখানে বসবাস করে ‘মসুও’ নামক এক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ভ্রমণপিপাসু ও গবেষকদের কাছে নানা কারণে রহস্যময় হয়ে ওঠা এই গ্রামটি খেতাব পেয়েছে ‘দ্য কিংডম অফ উইমেন‘ নামে। কী সেই রহস্য?
মসুও জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০,০০০। বছরের পর বছর ধরে তারা তিব্বত সীমান্তবর্তী এই লুগু লেকের তীরে বসবাস করে আসছে। এর অন্য দুই পাশে আছে সিংহুয়া ও ইউনান প্রদেশের সীমান্ত। মাঝখানের এই গ্রামটিকে পুরোপুরি ঘিরে রেখেছে পর্বতমালা। গ্রামটির বাসিন্দারা বসবাসের জন্য দলবদ্ধভাবে তৈরি করেছে নকশাখচিত কাঠের ঘর। সব মিলিয়ে গ্রামটি যেন প্রকৃতির বুকে এঁকে রাখা এক স্বর্গ রাজ্যের দৃশ্য।
সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে গ্রামটি প্রায় ২,৭০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। নিকটবর্তী যেকোনো শহর থেকে সেখানে যানবাহন যোগে পৌঁছাতে কমপক্ষে ছয় ঘন্টা সময় লাগে। সম্ভবত এই দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতাই এখানে আলাদা প্রথা ও রীতিনীতি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। আর হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো, মসুওরা চীনের সর্বশেষ ও বিশ্বের অন্যতম মাতৃতান্ত্রিক জনগোষ্ঠী।
চীন সরকার এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে এখনও যথাযথ মর্যাদা প্রদান করেনি। তারা মসুওদেরকে আরেকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী নাখীদের অন্তর্ভুক্ত বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ গবেষক একমত যে, মসুওরা স্বতন্ত্র এক আদিবাসী সম্প্রদায়।
মসুও আদিবাসীদের রয়েছে নানা রকমের অনুপম সংস্কৃতি। এর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে তাদের বিবাহ পদ্ধতি। অন্য সব অঞ্চলের বিবাহ পদ্ধতি থেকে যা একেবারেই ভিন্ন। তাদের বিবাহ পদ্ধতিকে ‘জউহুন’ বলা হয়। ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ নামে। বাংলায় হয়তো এর অর্থ করা যেতে পারে ‘হাঁটতে চলতে বিবাহ’। কিন্তু এতে মূল শব্দ থেকে অর্থের অনেক বিচ্যুতি ঘটে যেতে পারে। ইংরেজি অনুবাদ ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ দ্বারাও এর অর্থ অনুধাবন করা বেশ মুশকিল। তবুও আমরা বোঝার সুবিধার্থে এখানে ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করবো।
মসুওদের প্রথা অনুসারে, যখন কোনো মেয়ে বিয়ের বয়সে উপনীত হয়, তখন সে নিজের ইচ্ছামতো জীবনসঙ্গী বাছাই করে নিতে পারে। যত খুশি তত জনকে বাছাই করতে পারে। একই সাথে অনেক স্বামীও গ্রহণ করতে পারে। গবেষকগণ এ পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ‘ফ্রি লাভ’। বিয়ের দিন কন্যার পক্ষ থেকে বর পক্ষকে কন্যার বাড়িতে দাওয়াত দেয়া হয়। সেদিন কন্যা ও বর উভয়ে কন্যার বাড়িতে পৃথক দুটি কক্ষে রাত্রি যাপন করেন। উভয়ের কক্ষ ফুল দ্বারা সাজানো হয়। সকাল হলে বর নিজ বাড়িতে ফিরে যান। ফলে প্রথম দিন উভয়ের একসাথে থাকার সুযোগ হয় না। পরদিন তারা একসাথে কন্যার গৃহে থাকার সুযোগ পান।
এ তো গেল সাধারণ পদ্ধতিতে বিয়ের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ। মসুওদের বিয়ের আরেকটি প্রচলিত পদ্ধতি হলো ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’। ওয়াকিং ম্যারেজ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নানা ধরনের মতামত পাওয়া যায়। এর পেছনে কারণ হচ্ছে, তারা আংশিকভাবে মসুওদের বিবাহ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন বা পর্যবেক্ষণ করেছেন। সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, মসুওদের মধ্যে বিবাহের ৩টি মূল পদ্ধতি চালু রয়েছে।
মসুও প্রথা অনুসারে, ১৩ বছর বয়সে ছেলে-মেয়েরা সাবালক হয়। প্রতিবছর যেসব ছেলে-মেয়ে ১৩ বছর বয়সে উপনীত হয় তাদেরকে নিয়ে একটি উৎসব আয়োজন করা হয়। মসুও ছেলে-মেয়েদের জীবনে এই উৎসব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসবে সকল ছেলে একই ধরনের পোশাক পরিধান করে এবং সকল মেয়েও একই ধরনের পোশাক পরিধান করে। তারপর এক ছাদের নিচে তাদেরকে নিয়ে উৎসব শুরু হয়।
সারিবদ্ধ হয়ে বাদ্যের তালে তালে মৃদু নৃত্য করতে করতে ঘুরতে থাকে কিশোর-কিশোরীরা। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের আবেশ আসে। এ সময়ে তারা একে অন্যের প্রতি প্রেমে আকৃষ্ট হয়। নৃত্য করতে করতে যে যাকে পছন্দ করে তার হাত ধরে দুলতে থাকে। দুলতে দুলতে তারা প্রেমালাপে মগ্ন হয়। যদি পরস্পর আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়, তবে তখনই দৈহিক মিলনে লিপ্ত হতে পারে। এভাবেই মসুও সন্তানরা জীবনে প্রথম ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ এর স্বাদ গ্রহণ করতে পারে।
কিন্তু এই বিবাহই তাদের জীবনের একমাত্র বিবাহ নয়। তারা যখন ইচ্ছা তখন এই বিবাহ ভেঙে দিতে পারেন। বিশেষত, মেয়েরা চাইলেই এ বিবাহ ভেঙে যাবে। তারপর তারা নতুন কোনো সঙ্গীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন। পাশাপাশি নারীরা ঘরে স্বামী থাকা সত্ত্বেও রাতের বেলা অন্য পুরুষের সাথে মিলিত হতে পারবেন। মসুও সমাজ বিষয়টিকে মোটেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে না।
মসুও সমাজে পুরুষদের তেমন কোনো কাজ নেই। শুধুমাত্র সন্তান লালন-পালন ও পশু শিকারের কাজে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা দিনের বেলায় গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং নারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। যদি কোনো নারী তাদেরকে রাতের বেলা নিজ গৃহে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করে তবে সন্ধ্যার পর তিনি সেই নারীর ঘরে যেতে পারেন। তবে শর্ত হচ্ছে, সূর্যোদয়ের পূর্বেই সেই পুরুষকে নারী গৃহ ত্যাগ করতে হবে।
আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, রাত হলেই পুরুষরা নারীদের ঘরে ঘরে গিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেন। এ সময় যদি কোনো নারী তার সাথে রাত্রিবাস করতে চান তবে তিনি তাকে গ্রহণ করতে পারেন। পূর্বে বর্ণিত পদ্ধতির সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে নারী গৃহে পুরুষ প্রবেশের জন্য কোনো পূর্বানুমতির প্রয়োজন নেই, কিন্তু আগের পদ্ধতিতে রাত্রিবাসের জন্য সেই নারীর কাছ থেকে আগেই অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ সম্পর্কে মসুও আদিবাসীদের গায়ক ইয়ং যাক্সি বলেন,
একসময় এখানকার মানুষ ছিল অত্যন্ত গরীব। ফলে তারা একক পরিবার গঠন করতে পারতো না। তখন এটি ছিল ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ এর অন্যতম কারণ। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। বর্তমানে অধিকাংশ ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ ঐতিহ্য রক্ষার খাতিরেই হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন,
আমি মনে করি এ ধরনের বিবাহ পদ্ধতি আমাদের বহু বছরের সংস্কৃতিকে ধারণ করে। আমাদের পূর্ববর্তীদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
এভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেও মসুও নারীরা গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারেন। সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব থাকে নারীর উপর। সন্তানের মামা-খালারাই সন্তানের অভিভাবকত্বের বিবেচনায় প্রথমে আসেন। তারাই পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ সন্তানের উপর পিতার অধিকার থাকে খুব সামান্য পরিসরে। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানরা তাদের পিতার নামই জানেন না। মাতৃ পরিচয়ে বড় হয়ে ওঠে। নামের শেষে মায়ের বংশ পরিচয় যুক্ত করে।
মূলত এই ধরনের বহুগামী বিবাহ পদ্ধতি চালু থাকার কারণে মসুও সন্তানদের জন্মদাতা পিতার পরিচয় পাওয়া যায় না। সম্পদের উত্তরাধিকারী নারীদের বংশ অনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে। ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ পদ্ধতিতে স্বামী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পুরুষের সম্পদ কোনো ভূমিকা পালন করে না। ইয়ং যাক্সি বলেন,
কেউ কাউকে পছন্দ করলে সেখানে সম্পদ কোনো মুখ্য ভূমিকা পালন করে না। আমাদের মধ্যে সম্প্রতি গড়ে ওঠা সব পরিবারের গল্পটাই এমন। আমার মা ও তার ভাই-বোনরা রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ। ফলে তারা একে অন্যের প্রতি খুবই যত্নশীল এবং তাদের মধ্যে সব সময়ই খুব ভালো সম্পর্ক থাকতে দেখেছি।
বড় হওয়া পর্যন্ত সন্তানরা মায়ের পরিবারে বড় হয়। বড় হওয়ার আগে যদি তার পিতা-মাতার মধ্যে ‘তালাক’ হয়ে যায়, তবুও সন্তানের উপর এর কোনো প্রভাব পড়ে না। এমনকি সমাজও বিষয়টিকে খারাপভাবে বিবেচনা করে না।
তিনি আরও বলেন,
সমাজের বাহিরের মানুষরা মনে করেন, মসুও জনগোষ্ঠীর অধিবাসীরা এলোমেলো জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বাস্তব চিত্র কিন্তু ঠিক তা নয়। অধিকাংশ মসুও জীবনে একজন সঙ্গীকে গ্রহণ করে এবং তাদের সম্পর্ক আজীবন টিকে থাকে।
তিনি মনে করেন, ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ পদ্ধতি বেশ ভালো একটি পদ্ধতি, কেননা এর মাধ্যমে মানুষের নির্মল মন ও নৈতিক চরিত্র ফুটে ওঠে।
মূলত জটিলতা তৈরি হয় সন্তান লালন-পালনের বিষয়টি নিয়ে। একটু উদাহরণ দিলেই বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন, আপনি একজন নারী। আপনার প্রথম বিয়ের ফলে ২টি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। এরপর আপনার সেই স্বামীর সাথে আপনার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল। কিছুদিন পর আপনি আরেকটি বিয়ে করলেন। এই স্বামীর সংসারেও ২টি পুত্র সন্তান জন্মালো। এখন এই ৪টি সন্তানই আপনার বর্তমান স্বামী সমানভাবে লালন-পালন করবেন। এটিই মসুও জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রথা। অর্থাৎ যিনি বর্তমান স্বামী থাকবেন তিনিই স্ত্রীর গর্ভে জন্মানো সকল সন্তানের লালন-পালন করবেন। যাক্সি বলেন,
সত্যিকার অর্থে বিষয়টি মূলত নির্ভর করে পুরুষের উপর। পুরুষ যদি হৃদয়বান হন সেক্ষেত্রে বিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তিনি যদি বাচ্চাদের লালন পালন করেন, তাদের জন্য উপহার কিনে আনেন এবং তাদের শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের প্রতি যত্নশীল হন; সর্বোপরি সেসব বাচ্চাদের জন্মগত পিতা না হয়েও তাদের লালন-পালন করার দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করেন, তাহলে আর কোনো সমস্যা দেখা দেয় না।
ইয়াং কংমু নামের এক নারী বলেন,
একটা পর্যায়ে আসলে ভালোবাসার কাছে সবকিছু ম্লান হয়ে যায়। যদি আমার স্বামী আমার সন্তানদের লালন-পালন না করেন এবং তাদের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেন, তাহলে আর আমাদের সংসার টিকবে না। মসুও সংস্কৃতি অনুসারে এটিই নিয়ম। পারস্পারিক মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসাই সংসারের মূল কথা।
লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ প্রথা অনুসারে একজন নারী কোনো পুরুষকে একাধিকবার গ্রহণ করেন না। অর্থাৎ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর যদি কোনো পুরুষের সাথে একবার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, তাহলে তাকে আর কখনো পুনরায় গ্রহণ করেন না।
পরিবার পরিচালনার পাশাপাশি ব্যবসায়িক কাজেও নারীদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। মসুওদের প্রধান অর্থনৈতিক উৎস কৃষি। নারীরাই সেক্ষেত্রে কৃষক। তারা প্রতিদিন ৭ ঘন্টা ও বছরে ৭ মাস সময় কৃষি কাজে ব্যয় করেন। জমি চাষের পাশপাশি তারা পশু পালনও করে থাকেন। পশু পালনে পুরুষদের সম্পৃক্ততা দেখা যায়। অনেকে আবার লুগু হ্রদ থেকে মাছ আহরণের সাথেও জড়িত রয়েছে।
মসুওরা নিজস্ব পদ্ধতিতে ‘সুলিমা’ নামক এক বিশেষ মাদক উৎপাদন করে। তারা দৈনন্দিন জীবনে এই মাদকের ব্যবহার করে। বিশেষত তাদের নিজস্ব অনুষ্ঠানে এই মাদকের ব্যাপক পরিবেশন লক্ষ্য করা যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত মসুওদের অর্থনীতি ছিল বিনিময় ভিত্তিক। কিন্তু পরবর্তীতে পর্যটকদের আগমন ও অন্যান্য বৈশ্বিক বাস্তবতায় তারা মুদ্রা প্রথা চালু করে। তবে এখনও তাদের মধ্যে থেকে বিনিময় প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
মসুওদের মধ্যে দুটি ধর্মের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়- ‘দাবা’ ও ‘তিব্বতি বৌদ্ধ’ ধর্ম। অধিকাংশ পরিবার থেকে একজন সদস্যকে সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য বৌদ্ধ বিহারে প্রেরণ করতে দেখা যায়। তবে গবেষকগণ মনে করেন, দাবাই মসুওদের আদিধর্ম।
দাবা ধর্মের বিশ্বাসানুসারে, মসুওরা কুকুরকে অনেক বেশি ভক্তি করেন। কথিত আছে, একসময় কুকুরের জীবনকাল ছিল ৬০ বছর আর মানুষের জীবনকাল ছিল মাত্র ১৩ বছর। মানুষ কুকুরের কাছে জীবনকাল ভিক্ষা চায়। কুকুর এক শর্তে জীবনকাল ভিক্ষা দিতে রাজি হয়। শর্তটি হচ্ছে, জীবনকাল দানের বদৌলতে কুকুরের প্রতি মানুষ আজীবন সম্মান ও ভক্তি প্রকাশ করবে। মানুষ তখন কুকুরদের দেয়া এই শর্ত মেনে নেয়। এজন্য মসুওরা কখনো কোনো কুকুর হত্যা করে না। যেখানে তাদের আশেপাশের এলাকার মানুষেরা কুকুরের মাংস খায়, সেখানে তারা কুকুর সংরক্ষণ করে থাকে।
অনুসন্ধিৎসু মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এমন পর্বত বেষ্টিত উঁচু ভূমিতে মসুওরা কীভাবে এবং কখন থেকে বসবাস করে আসছে। এ বিষয়ে ইয়ং যাক্সি বলেন,
আমার নানা বলেছেন, অনেকদিন আগে এই পাহাড়ি পথ দিয়ে কোনো এক যুদ্ধের জন্য চেঙ্গিস খানের সেনাবাহিনী যাচ্ছিলো। এ সময় তারা লুগু হ্রদ ও এই গ্রামের সন্ধান পান। তারা এখানকার সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে পড়েন। তখন তাদের একটি অংশ এখানে থেকে যান এবং বসতি স্থাপন করেন। তাদের থেকেই মসুও জনগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে।
কিন্তু আরেকটি প্রশ্ন তো থেকেই যায়! নারীদের রাজ্য পাওয়া গেল, রানী কই? হ্যাঁ, মসুও সমাজে একজন রানী আছেন। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সমগ্র গ্রাম তার নির্দেশে পরিচালিত হয়। মসুওদের পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘আহ মি’। এসব কারণেই মসুওদের গ্রাম খেতাব পেয়েছে ‘দ্য কিংডম অফ উইমেন’ হিসেবে। ২০১৫ সালে ‘আহ মি’র রাজ্যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যুক্ত করে চীন সরকার। সেই থেকে মসুওদের রাজ্যে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে। বিষয়টি নিয়ে যাক্সি বলেন,
গ্রামবাসীরা হ্রদের পাশে পর্যটকদের জন্য হোটেল নির্মাণ করেছে। যেসব পরিবারের বাড়ি সুন্দর সুন্দর জায়গায় তারা ইতিমধ্যেই বেশ সম্পদশালী হয়ে উঠেছে। যানবাহন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে মসুওরা বাহিরের জগতের সাথে পরিচিত হতে পারছে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছে।
তবে আধুনিকায়নের যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ইতোমধ্যেই মসুও যুবক-যুবতীরা আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে নিজেদের প্রথা ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করেছে। অনেক যুবক গোত্রের বাহিরের মেয়েদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন। চীনা চলচ্চিত্রের প্রভাবে তাদের জীবনযাপন ও মানসিক বিকাশের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি আদিবাসীদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখাও জরুরি।
ফিচার ইমেজ- aljazeera.com