সুপারহিউম্যান বা সুপারহিরোদের বসবাস এখন আর কমিক্স, কার্টুন, গেমস কিংবা চলচ্চিত্রের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নেই, এরা বের হয়ে এসেছে বাস্তব জীবনে। সাধারণ মানুষই তারা, তবে তাদের রয়েছে অসাধারণ কিছু ক্ষমতা। এমনই একজন ‘রিয়েল সুপারহিরো’র নাম স্টিফেন উইল্টশায়ার। যাকে বলা হয় ‘ক্যামেরা মানব’ বা ‘জীবন্ত ক্যামেরা’। আজ তার আদ্যোপান্ত তুলে ধরব আপনাদের সামনে।
এটা কি বিশ্বাস্য যে, মাত্র একবার কোনো একটা জিনিস দেখে সেটার আকৃতি হবহু মনে রাখা যায়? আবার সেই জিনিসটা কখনোই বিস্মৃত হয় না? আসলে এমনটা ভাবতেও পারি না আমরা। আমাদের স্বাভাবিক মস্তিষ্ক এই কাজটা করে না বলেই, আমরা এমনটা ভাবতে পারি না। অথচ আমাদের মস্তিষ্কের এমন ক্ষমতা ঠিকই আছে। স্টিফেন উইল্টশায়ার এমনই একজন মস্তিষ্কের আর্টিস্ট, যিনি একবার যা দেখেন তা কখনোই ভোলেন না।
স্টিফেন উইল্টশায়ার একজন ব্রিটিশ স্থাপত্য শিল্পী। প্যানোরমিক সিটিস্কেপ করে থাকেন তিনি। প্যানোরমিক মানে, বিস্তারিতভাবে যা চিত্রায়িত করা হয়। আমরা মোবাইল বা ক্যামেরা দিয়ে যখন তিনশো ষাট ডিগ্রী ছবি তুলে থাকি, তখন এটাকে প্যানারমিক ছবি বলা হয়। স্টিফেন উইল্টশায়ার তার চোখকে অবলম্বন করে যেকোনো কিছু শুধুমাত্র একবার দেখে মুহূর্তেই ছবি তুলে ফেলেন মানস পটে, তারপর সেই স্মৃতি থেকে অবিকল ছবি এঁকে ফেলতে পারেন ক্যানভাসে। সব ধরনের স্কেচ করলেও তিনি প্যানোরমিক সিটিস্কেপ বা ল্যান্ডস্কেপ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
তার অঙ্কন বা ল্যান্ডস্কেপ অবিকল আসল শহরের মতো দেখতে। তার স্কেচে আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিটি একক ভবনই এর সঠিক জায়গায় থাকে এবং বিল্ডিং, জানালা, খিলান, প্রবেশদ্বার- প্রায় প্রতিটির বিবরণ, আকার ও স্থানের ব্যবধান পুরোপুরি বাস্তব অনুপাতে হয়ে থাকে। আর আঁকার পুরো কাজটিই তিনি মেমরি বা স্মৃতি থেকে করে থাকেন।
গত বছর, অর্থাৎ ২০১৬ এর অক্টোবরে স্টিফেন উইল্টশায়ার মেক্সিকো গিয়েছিলেন শহরটির প্যানোরমিক সিটিস্কেপ করতে। হেলিকপ্টারে ঘুরে শহরটাকে একবার দেখে নিয়ে পুরো শহরের একদম অবিকল স্কেচ করেছেন ১৩ ফুট একটা ক্যানভাসে। সময় লেগেছিল মাত্র ৫ দিন।
এর আগে ২০০৯ সালে হেলিকপ্টার দিয়ে মাত্র ২০ মিনিট নিউইয়র্ক সিটি ঘুরেছিলেন। ২০ মিনিটে হেলিকপ্টারটি নিউইয়র্ক সিটির ৩০৫ বর্গমাইল অতিক্রম করে। আর ২০ মিনিটের ভ্রমণে ৩০৫ বর্গমাইলে যা কিছু উইল্টশায়ার দেখেছেন, অর্থাৎ নিউ জার্সির সমুদ্রতটের হুডসন সিটি, ফিন্যানশিয়াল ডিস্ট্রিক্ট, এলিস আইল্যান্ড, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি এবং ব্রুকলিনের রাস্তাঘাট, অলিগলি, গাড়ি, নদী সব অবিকল এঁকেছেন ১৯ ফুটের বিরাট এক ক্যানভাসে।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে উইল্টশায়ার সংক্ষিপ্ত এক হেলিকপ্টার ভ্রমণের পর সিঙ্গাপুর স্কাইলাইনের একটি (১X৪ মিটার) প্যানোরমিক স্কেচ সম্পন্ন করেন মাত্র পাঁচ দিন সময় নিয়ে। ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুরের পঞ্চাশতম জন্মদিন উদযাপনের জন্য মূলত উইল্টশায়ার স্কেচটা করেছিলেন।
২০০১ সালে তিনি লন্ডনের ১২ টি ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক ও ২০০ টি সুপ্রাচীন ভবন পুরোপুরিভাবে বাস্তব মাপের অনুপাতে স্কেচ করেন মাত্র তিন ঘণ্টায়।
তিনি শহরগুলোতে ঘুরে ঘুরে সিটিস্কেপ বা প্যানোরমা করা শুরু করেছিলেন ২০০৫ সাল থেকে। প্রথমে টোকিও, এরপর ভেনিস, রোম। রোম শহরে হেলিকপ্টার ভ্রমণ ছিল ৪৫ মিনিটের। এরপর হংকং, মাদ্রিদ, দুবাই, জেরুজালেম, লন্ডন, সিডনি, সাংহাই ও ব্রিজবন ইত্যাদি শহরের প্যানোরমিক সিটিস্কেপ করেছেন তিনি। যখন তিনি স্কেচ করতে থাকেন, তখন দর্শকরা সেই স্কেচ করার দৃশ্য উপভোগ করে। বিরাট একটা ক্যানভাস এর সামনে উঁচু একটা টুল নিয়ে বসেন, কানে একটা হেডফোন থাকে, ক্যানভাসের উপর কলম চালিয়ে দিতে দিতে উইল্টশায়ার একসময় পুরো ক্যানভাস জুড়ে বিরাট এক নগরী জাগিয়ে তুলেন। দর্শকরা তার চারপাশে ঘিরে সেই দৃশ্যে শুধু পুলকিত হতে থাকে। তিনি কাল্পনিক বা ফিকশন দৃশ্যও আঁকেন। সেন্ট পল এর ক্যাথিড্রাল তিনি এঁকেছেন কল্পনার আদলে, অবিকল বাস্তবটির মতো করে নয়।
কেন স্টিফেন উইল্টশায়ার ব্যতিক্রমী?
আমাদের সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক আর উইল্টশায়ারের মস্তিষ্কের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের পার্থক্য। উইল্টশায়ার হলেন একজন অটিস্টিক আর্টিস্ট।
সাধারণ মস্তিষ্কের যেই সেল বা টুলগুলো অন্যের সাথে কমিউনিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই টুলগুলো উইল্টশায়ারের মস্তিষ্কে থাকলেও সাধারণ মস্তিষ্কের মতো কাজ করে না। তাই তিনি সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক ভাষাগত যোগাযোগ করতে পারেন না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এমন মানুষের মস্তিষ্কের কিছু অংশ বা সেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মস্তিষ্কের অন্য অংশগুলো এর ভেতরে থাকা শৈল্পিক জীবাণুকে উদ্দীপিত করে। এভাবেই তারা অনন্য আঁকিয়ে হয়ে উঠেন। অটিজম এবং ডিমেনশিয়া রোগীদের অধ্যয়ন করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে একজন অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষও একদিন এই সামর্থ্যকে এবং তাদের অন্তর্বর্তী ক্ষমতাকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবকের মস্তিস্কের নির্দিষ্ট এলাকাকে অস্থায়ীভাবে ‘সুইচ অফ’ করে দেয়ার পর তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতার উন্নতি ঘটে। সানফ্রান্সিসকোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ডিমেনশিয়া বিশেষজ্ঞ ডাঃ ব্রুস মিলার দেখেছেন, তার কয়েকটি রোগী শৈল্পিক প্রতিভা গড়ে তুলেছিল।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অফ দ্য মাইন্ডের পরিচালক অ্যালেন স্নাইডারের মতে এই ব্যাপারে তত্ত্বটি হলো, মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ সঠিকভাবে কাজ না করলে অন্য এলাকার ক্ষমতা বা এবিলিটি আনলক বা অবমুক্ত হতে পারে।
মানুষ যেহেতু অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পছন্দ করে, তাই উইল্টশায়ারও তার যোগাযোগ দক্ষতার অভাব নিয়ে বসে থাকলেন না। তিনি তার আর্ট দিয়ে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। আর্টের মাধ্যমেই মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকেন। আসলে তার অটিস্টিক মস্তিষ্কের যোগাযোগ-অক্ষমতাই তাকে আর্টের জগতে এত সফল করেছে।
প্রাথমিক জীবন
স্টিফেন উইল্টশায়ার ১৯৭৪ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন এক ক্যারিবিয়ান পরিবারে। তার বাবা ক্যারোলিন ছিলেন বারবারাজের নাগরিক এবং তার মা জিনেভা ছিলেন সেন্ট লুসিয়ার নাগরিক। তিনি বেড়ে উঠেছেন ইংল্যান্ডের লিটল ভেনিস, মায়া ভেল ও লন্ডন- এই শহর তিনটিতে। ছোটবেলা থেকেই তিনি কথা বলতে পারতেন না। তার তিন বছর বয়সে ডাক্তাররা নিশ্চিত হলেন স্টিফেন উইল্টশায়ার অটিস্টিক বেবি। ভাগ্যের কী নির্মমতা, সেই বছরই তার বাব এক মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মারা যান।
পাঁচ বছর বয়সে, উইল্টশায়ারকে লন্ডনে কুইন্সমিল স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। স্কুলে তিনি আর্ট করার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি প্রথম দিকে প্রাণী ও বিভিন্ন গাড়ি স্কেচ করতে পছন্দ করতেন। এখনও আমেরিকান বিভিন্ন গাড়ির স্কেচ করা অত্যন্ত পছন্দ তার। যখন তার বয়স প্রায় সাত বছর, তখন তিনি লন্ডনের ল্যান্ডমার্ক ও বিভিন্ন স্থাপত্য স্কেচিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। উইল্টশায়ারকে একবার ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছু চিত্র সম্বলিত ফটোবুক দেখানো হলে, তিনি কল্পনা থেকে বিস্তারিতভাবে স্থাপত্যগুলা আঁকা শুরু করেন এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলো পুননির্মাণের সুবিধার্থে সিটিস্কেপ তৈরি করে দেন।
কুইন্সমিল স্কুলের প্রশিক্ষক সাময়িকভাবে তাকে স্কেচ আর আর্ট থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন, যাতে করে উইল্টশায়ার মৌখিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয় এবং কথা বলা শিখতে পারে। মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতার অভাব মোকাবেলা করার জন্য এই কৌশল ফলপ্রসূ হয়। ফলে উইল্টশায়ার কিছু ভাঙা ভাঙা কথা বলতে সক্ষম হন। উইল্টশায়ার যে দুটি শব্দ তার জীবনে প্রথম উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন সে দুটি শব্দ হল ‘কাগজ’ ও ‘কলম’। এ দুটি জিনিসই তার জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তার শিক্ষকরা তাকে আর্ট করতেও প্রচণ্ড উৎসাহিত করতেন এবং শিক্ষকদের সাহায্যের কারণেই উইল্টশায়ার ৯ বছর বয়সে সম্পূর্ণরূপে কথা বলতে শিখেছিলেন।
বর্তমান
উইল্টশায়ারের বয়স এখন ৩৭। তিনি তার মা ও বোনের সাথেই থাকেন লন্ডনে। বিয়ে করেননি, ব্যবসা আছে কিছু। শিল্পকর্মের সম্মাননা হিসেবে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ এর সদস্যপদ দেয়া হয়েছে তাকে। তার রয়েছে লন্ডনের রয়েল অপেরা আর্কেডে একটি স্থায়ী গ্যালারি।
উইল্টশায়ার সবসময় কলম দিয়ে স্কেচ করায় অভ্যস্ত। তাই গাড়ি কোম্পানি নিশান তাকে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। সেটা হলো, গুগলের ভার্চুয়াল রিয়ালিটির পেইন্টিং ব্রাশ টিলট দিয়ে গাড়ি আঁকার চ্যালেঞ্জ। আপনারাই দেখে নিন স্টিফেন উইল্টশায়ার কী করলেন এরপর!
স্টিফেন উইল্টশায়ারের কাজগুলো আমাদের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্যই প্রেরণা দেয়। এমন অসাধারণ মস্তিষ্কের মানুষদেরকে যখন আমরা যুগে যুগে পাই, তখন আমরা আমাদের মাথার ক্ষমতা সম্পর্কে আরো গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি। নিজেদের মস্তিষ্কটাকে আরো কার্যকরীভাবে ব্যবহার করার উৎসাহ পাই।
ফিচার ছবিসূত্র: elsewhere.nine.com.au