যুগ যতই আধুনিকতার দিকে যাক, সকলে যতই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ুক না কেন, পেন্সিলের ব্যবহার কিন্তু কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া চলে না। ছোটবেলায় হাতেখড়ি থেকে হাতে পেন্সিল নিয়ে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এর সাথেই থাকা। বাংলাদেশে ২য়-৩য় শ্রেণীর পর থেকে খাতায় পেন্সিলের পরিবর্তে কলমের ব্যবহার শুরু করানো হয়। কিন্তু ছবি আঁকতে, খসড়া তৈরিতে ঐ পেন্সিলই লাগে। তাছাড়া রঙ পেন্সিলের ব্যবহার তো আছেই। রয়েছে কাজল-পেন্সিলের ব্যবহার। একটা সময়ে কাঠের পেন্সিলই সব ছিল, এখন প্লাস্টিক বা অন্যান্য উপকরণের তৈরি পেন্সিলও পাওয়া যায় যা প্রযুক্তিরই অবদান। কীভাবে মানুষ অনুভব করলো এর প্রয়োজনীয়তা আর কীভাবেই বা তৈরী হয় এটি? চলুন ঘুরে আসা যায় পেন্সিলের জগতে।
পেন্সিল কী?
সহজ কথায়, পেন্সিল হলো একটি সরু খোলকের মাঝে কঠিন রঞ্জক পদার্থ, (যা পেন্সিলের মূল অংশ) দ্বারা তৈরি বস্তু, যা লেখার বা ছবি আঁকার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাগজ বা অন্য কোনো মসৃণ বস্তুর সাথে রঞ্জক বস্তুর ঘর্ষণের মাধ্যমে পেন্সিল দ্বারা চিহ্ন এঁকে দেওয়া যায় বা লেখা যায়।
মূল অংশের রকমফের
বেশিরভাগ পেন্সিলের রঞ্জক বস্তু বা মূল অংশটি গ্রাফাইট এবং কাদামাটির সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়, যা কাগজে ধূসর বা কালো রঙের দাগ কেটে যায়। শুধু তা-ই নয়, চাইলে দাগগুলো রাবার দিয়ে মুছেও ফেলা যায়। এই গ্রাফাইট পেন্সিলগুলো লেখার এবং ছবি আঁকার কাজে ব্যবহৃত হয়। মনে হতে পারে, গ্রাফাইটে পেন্সিলগুলোর দাগ যেহেতু মুছে ফেলা যায়, সেহেতু তা টিকবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গ্রাফাইটের পেন্সিলগুলোর দাগ দীর্ঘস্থায়ী। এগুলো আর্দ্রতা, রাসায়নিক প্রভাব, অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে বা সময়ের সাথে নষ্ট হয় না।
রঙ পেন্সিলগুলোতে মূল অংশে মোমের মিশ্রণ থাকে, যা দ্বারা কাগজে দাগ কাটলে তা মুছে ফেলা যায় না। এগুলো ছবি আঁকার কাজে এবং সংস্করণের কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও রয়েছে গ্রেজ পেন্সিল, যেগুলোর মূল অংশটি অনেকটা চকের ন্যায় কোমল এবং মোমের তৈরী। এগুলো সিরামিক বা কাঁচের বস্তুর উপরে দাগ কাটতে ব্যবহৃত হয়।
পেন্সিল কেস বা খোলকের রকমফের
পেন্সিলের কেস হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত কাঠ। সরু কাঠকে ষড়ভূজাকারে বা বেলনাকারে কেটে তাঁর মাঝ বরাবর শিস বা মূল অংশটি ভরে স্থায়ীভাবে আটকে দেওয়া হয়। কাঠের পরিবর্তে এখন প্লাস্টিক বা কাগজও ব্যবহৃত হচ্ছে। পেন্সিল ব্যবহারের পূর্বে কাঠ খোদাই করে শিষ বের করে তারপর লেখতে বা ছবি আঁকতে হয়। তবে আজকাল পরিবর্তনযোগ্য পেন্সিলের মূল অংশও রয়েছে, যেগুলোতে কেসের সাথে মূল অংশটি স্থায়ীভাবে আটকানো থাকে না।
পেন্সিলের ইতিহাস
ইংরেজি ‘পেন্সিল’ শব্দটি প্রাচীন ফারসি ভাষার ‘পিন্সেল’ অথবা ল্যাটিন শব্দ ‘পেনিসিলাস’ থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘ছোট লেজ’। এই নামকরণের পেছনে একটি কারণ আছে। সেই যুগের কথা ভাবুন, যখন পেন্সিল বা চক বা এ জাতীয় কোনো লেখার বা ছবি আঁকার বস্তু ছিল না। তো সেই সময়ে অনেকেই ব্রাশ হিসেবে উটের চুল বা লেজের অংশ ব্যবহার করতো। আদি সেই লিখন পদ্ধতিকে স্মরণ করেই এই পেন্সিল নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
আধুনিককালে আমরা যেটিকে পেন্সিল বলছি, সেটি প্রাচীন রোমানে ‘স্টাইলাস’ নামক লেখনী বস্তু হিসেবে পরিচিত ছিল। সে সময়কার লেখার কাগজ হিসেবে প্যাপিরাস নামক গাছের শুকানো বাকল ব্যবহৃত হতো। এই প্যাপিরাস কাগজে লেডের তৈরি স্টাইলাস দিয়ে দাগ দিলে তা পড়া যেত! ধারণা করা হয়, এই স্টাইলাসের গঠন থেকেই আজকের পেন্সিলের রূপলাভ।
১৫৬৪ সালের কথা। ইংল্যান্ডের বোরোডেল অঞ্চলে এক বিশাল গ্রাফাইটের খনি আবিষ্কৃত হয়। লেডের চেয়েও গাঢ় এবং স্থায়ী দাগ কাটতে পারে দেখে তখন লেখালেখির জন্য গ্রাফাইট ব্যবহার করা শুরু হয়। তখন কিন্তু কোনো কাঠের বা অন্য পদার্থের তৈরি কেসে গ্রাফাইট দন্ড রাখা হতো না, বরং সরাসরি হাতে ধরে বা সুতা পেঁচিয়ে ব্যবহৃত হতো।
১৫৬০ সালের দিকে সিমোনিও এবং লিন্ডিয়ানা নামক ইতালিয়ান দম্পতি সর্বপ্রথম কাঠের কেসে গ্রাফাইট রেখে আধুনিক পেন্সিল তৈরির নীলনকশা বানিয়েছিলেন। তাদের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি পেন্সিলটির তৈরি পদ্ধতি ছিল অনেকটা এমন- এক টুকরা কাঠকে দু’ভাগ করে মাঝে খোদাই করে জায়গা বানিয়ে গ্রাফাইটের ছড়ি রেখে তারপর আঠা দিয়ে কাঠের টুকরা দুটো লাগিয়ে দেয়া। বলতে গেলে এখনো এই পদ্ধতিই কিছুটা এদিক-সেদিক করে ব্যবহৃত হয়।
গ্রাফাইট প্রক্রিয়াকরণ এবং পেন্সিল
খনি থেকে প্রাপ্ত গ্রাফাইটের সাথে অন্যান্য খনিজ পদার্থ মিশ্রিত থাকতো। সেখান থেকে গ্রাফাইটকে আলাদা করতে গেলে আবার গুঁড়ো হয়ে যেত, যা থেকে পেন্সিল তৈরি করা সম্ভব ছিল না। তখন জার্মানির ন্যুরেমবার্গে সর্বপ্রথম গ্রাফাইট পাউডার থেকে গ্রাফাইট ছড়ি কাঠি বানানো শুরু হয় ১৬৬২ সালের দিকে। এখানে গ্রাফাইট, সালফার এবং অ্যান্টিমনি থাকতো। এটিই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম বৃহৎ আয়োজনে পেন্সিল তৈরির কারখানা। যদিও এখানকার তৈরি পেন্সিলগুলো ইংল্যান্ডেরগুলোর মতো ততটা ভালো ছিল না।
পেন্সিল জগতে নতুনত্ব!
১৮৫৮ সালে হাইমেন লিপম্যান সর্বপ্রথম পেন্সিলের নিচে এক টুকরো রাবার জুড়ে দেন। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি যে রাবার জোড়া সেই পেন্সিলটি ১৮৬২ সালে জোসেপ রেকেনডোফারের কাছে তিনি বিক্রি করেছিলেন এক লক্ষ ডলারে!
এই ছিল মোটামুটি পেন্সিলের ইতিহাস। এর পরবর্তীতে পেন্সিলের গঠনে, ধরনে এসেছে নানা পরিবর্তন।
নানা ধরনের পেন্সিল
প্রয়োজন, ব্যবহার এবং ভোক্তা আকর্ষণের কথা মাথায় রেখে এখন বানানো হচ্ছে নানা প্রকারের পেন্সিল।
গ্রাফাইট পেন্সিল
সাধারণত দৈনন্দিন কাজে কাঠের কেসে গ্রাফাইট এবং কাদামাটির বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণে তৈরি করা হয় গ্রাফাইট পেন্সিল। অনুপাত নির্ভর করে কতটুকু গাঢ় দাগ হবে তার উপর।
কেসবিহীন পেন্সিল
গ্রাফাইট পেন্সিলের মতোই, তবে এখানে কাঠের বা অন্য কিছুর তৈরি কেস থাকে না।
কাঠকয়লা পেন্সিল
পেন্সিলগুলো দেখতে অনেকটা কাঠির আকারের এবং কাঠকয়লা দিয়ে বানানো হয়। সাধারণত ছবি আঁকার কাজে এর ব্যবহার দেখা যায়।
কার্বন পেন্সিল
এর সাথে কাঠকয়লা এবং গ্রাফাইট মিশিয়ে গাঢ় বা হালকা রঙ করা হয়।
রঙ পেন্সিল
মোমের সাথে রঙের মিশ্রণে শিস তৈরি করে কাঠের কেসে তৈরি হয় এই পেন্সিল।
জলরং পেন্সিল
রঙ পেন্সিলের মতোই। তবে এর উপাদানগুলো পানিতে মিশে যেতে পারে।
কাঠমিস্ত্রির পেন্সিল
এগুলো শক্ত গ্রাফাইট দিয়ে বানানো হয়ে এবং অনেকটা ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। দীর্ঘস্থায়ী এবং আঘাত সহনীয় হয়ে থাকে এই পেন্সিলগুলো।
প্লাস্টিক পেন্সিল
১৯৬০ সালে গ্রসম্যান এই পেন্সিল তৈরি করেন। এই পেন্সিলগুলো নমনীয় হয়ে থাকে। চাইলে বাঁকিয়েও ফেলতে পারবেন, তবু ভাঙবে না।
এছাড়াও রয়েছে আরও নানা প্রকারের পেন্সিল।
পেন্সিল ব্যবহারকারী বিখ্যাত ব্যক্তিগণ
সকলেই পেন্সিল ব্যবহার করে। তবে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তা ব্যবহার করলে একটু উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে বৈকি।
- থমাস এডিসন ‘ঈগল পেন্সিল’ ছাড়া ব্যবহার করতেন না। পেন্সিলগুলো ছিল ৩ ইঞ্চি লম্বা মোটা এবং কিছুটা পুরু। কিন্তু এর গ্রাফাইট বেশ নরম ছিল।
- ভ্যান গগ ‘ফেবার পেন্সিল’ ব্যবহার করতেন, যেগুলো সেই সময়কার সর্বোৎকৃষ্ট রাজমিস্ত্রির পেন্সিল ছিল।
- আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে ব্যবহার করতেন ‘সেডার পেন্সিল’।
পেন্সিল হোক বা কলম, লেখার ভুবনে অস্বীকার করার উপায় নেই। হয়তো আরও অভিনব সব পেন্সিল আবিষ্কৃত হবে, পাওয়া যাবে পেন্সিলের বিকল্প আরও কিছু। কাজল কালো চোখে আসবে পেন্সিলের আরও সূক্ষ্ম ছোঁয়া।
ফিচার ইমেজ- cliparting.com