দু’জন নারী একজন শক্ত-সামর্থ্যবান পুরুষকে বিছানার উপর শক্ত করে চেপে ধরে আছে। পুরুষের চুলসমেত চেহারাটা মুষ্টিবদ্ধ করে বিছানাতে চেপে ধরে আছে একজন এক হাত দিয়ে। আর অন্যজন পুরুষের বুক আর ধড়টাকে শক্ত করে চেপে আছে, যাতে সে বিছানা ছেড়ে নিজের মাথা ওঠাতে বা নড়াতে না পারে।
নারী দু’জনের বাহুগুলো যেমন শক্তির পরিচয় দিচ্ছে, তেমনি সৌন্দর্যেরও। সম্মুখে আর মাথা চেপে ধরে থাকা নারীর আরেক হাতে একটি চকচকে ধারালো তলোয়ার। সেটি পুরুষের গলা ভেদ করে অপরপাশে বের হয়ে গেছে। গাঢ় লাল রক্তের ধারা বিছানা বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। লোকটির চোখজোড়া অবাক বিস্ময় আর আতঙ্কে বড় হয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে, তার সঙ্গে কী ঘটতে যাচ্ছে। মৃত্যুর ভয় আর বেঁচে থাকার আকুলতায় সে ছটফট করছে। কিন্তু দুই রমণীর শক্তির কাছে পরাজিত সে। তাই মৃত্যুযন্ত্রণার এক নিদারুণ অভিব্যক্তি তার চোখে ফুটে উঠেছে। তলোয়ার হাতে থাকা নারীর অভিব্যক্তিতে বেশ কঠোর আর রুক্ষ একটা ভাব আছে, যেন পুরুষটার শিরচ্ছেদ না হওয়া অবধি সে কোনোভাবেই থামবে না।
শিরচ্ছেদ হওয়া লোকটি হলোফার্ন্স। ওল্ড টেস্টামন্টে তাকে ‘ইহুদীদের শত্রু’ বলে গণ্য করা হয়। আর যে তরুণী তার শিরচ্ছেদ করছে, তার নাম জুডিথ। যে কিনা স্বর্গীয়ভাবে হলোফার্ন্সের ঘাতক হিসেবে নিযুক্ত। তবে এ পরিচয় বাদেও এই নর আর নারীর আলাদা পরিচয় আছে। ইতিহাসে পৌরাণিক চরিত্র দুটোর একদম জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন রক্তমাংসের এই নর আর নারী। আজকের আয়োজন মূলত এই দু’জনকে নিয়েই। তবে তার আগে চলুন ওল্ড টেস্টামেন্টের মূল গল্পটা জেনে আসা যাক।
জুডিথ আর হলোফার্ন্সের গল্পটা এসেছে বাইবেলেও- বুক অভ জুডিথে। বাইবেল অনুসারে, নেনেভাহর রাজা নেবুচাঁদনেজার তার সেনাপতি হলোফার্ন্সকে ইহুদীদের দমনের জন্য পাঠান। ইহুদীরা বেথুলিয়া অবরোধ করে রেখেছিল। তবে ধীরে ধীরে তাদের বেঁচে থাকার আশা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছিল। এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষ তাদেরকে আরো কোণঠাসা করে ফেলে। ফলে তারা আত্মসমর্পণের কথা ভাবতে শুরু করে।
‘জুডিথ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ইহুদী নারী। জুডিথ ছিল বেথুলিয়ার আলোচিত এক নারী। প্রথমত, সে বিধবা ছিল, আর দ্বিতীয়ত, অত্যন্ত রূপবতী। আত্মসমর্পণের কথা সে-ও জানতে পারে এবং সিদ্ধান্তও নেয় সে মোতাবেক। নিজের রূপের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আসিরিয়ান শিবিরে যায় জুডিথ। সৌন্দর্য দিয়ে হলোফার্ন্সকে বিমোহিত করে ফেলে মুহূর্তের মধ্যেই। খুশিতে গদগদ হয়ে হলোফার্ন্স মদ ঢালতে থাকে গলায়। জুডিথ অপেক্ষায় থাকে, কখন হলোফার্ন্স পূর্ণরূপে মাতাল হবে।
জুডিথ যখন আসিরিয়ান শিবির থেকে বের হয়ে আসে, তখন তার পুরো শরীর রক্তাক্ত। এক হাতে তলোয়ার আর অন্য হাতে হলোফার্ন্সের চোখ খোলা ছিন্ন মুণ্ডু। তলোয়ার আর ছিন্ন মুণ্ডু থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছিল। পুরো শিবির, এমনকি পুরো শহর জুডিথের সাহসিকতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই ইহুদীরা নিজেদের সাহস আর অঞ্চল দুটোই ফিরে পেয়েছিল এবং আসিরিয়ান শিবির আক্রমণ করে শত্রুদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। জুডিথই একমাত্র নারী নয়, যে নিজের গোত্রের স্বার্থে রক্তপাত ঘটিয়েছিল। বুক অভ জাজেসে আছে, জেইল ক্যানোনাইটের সেনাপতি সিসেরাকে প্রথমে তার তাঁবুতে আমন্ত্রণ জানায়, তাকে খাবার পরিবেশন করে এবং পরে তাকে হত্যা করে। যুগে যুগে নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে গিয়ে জুডিথ এবং জেইলের কথা বারবার উঠে এসেছে শিল্প আর সাহিত্যে। মধ্যযুগের শিল্পকর্মে জুডিথকে চিত্রিত করা অত্যন্ত প্রচলিত একটা ব্যাপার ছিল।
এখন আমরা আবার উপরিউক্ত সেই চিত্রকর্মে ফিরে যাই, যেখানে জুডিথ হলোফার্ন্সের শিরচ্ছেদ করছে। আদতে এটি ছিল আত্মপ্রতিকৃতিমূলক চিত্রকর্ম। হলোফার্ন্সের চরিত্রে থাকা লোকটি নিজেও একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন; তার নাম অ্যাগাস্তিনো তাসসি। তবে চিত্রশিল্পীর মর্যাদা মাড়িয়ে ইতিহাসে তিনি একজন ধর্ষক হিসেবেই বিবেচ্য। আর অ্যাগাস্তিনোর লালসার শিকার মেয়েটিই মূলত চিত্রকর্মে তার শিরচ্ছেদ করছে নিজের ভেতরে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। চিত্রকর্মে জুডিথ চরিত্রে থাকা নারীটি হচ্ছেন আর্তেমিসিয়া জিনতিলেস্কি।
আর্তেমিসিয়া জিনতিলেস্কি ছিলেন বারোক যুগের এক সাহসী আর প্রতিভাবান শিল্পী। জুডিথ আর হলোফার্ন্সের উপর করা আর্তেমিসিয়ার বীভৎস দু’টি চিত্রকর্ম এখন অবধি টিকে আছে- একটি নেপলসে আর অন্যটি ফ্লোরেন্সে। প্রতিনিয়ত যে দুঃস্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি, সেটারই যেন চিত্রিত রূপ হচ্ছে সেই দুটো চিত্রকর্ম। শব্দ আর চিত্রের সাহায্যে পুরুষ সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন আর্তেমিসিয়া আর সেজন্যই জীবদ্দশায় স্বাধীন এক নারীর জীবন যাপন করতে পেরেছিলেন তিনি।
বারোক যুগের অন্যতম সাহসী আর প্রতিভাবান ইতালিয়ান শিল্পী আর্তেমিসিয়া জিনতিলেস্কি তার শিল্পকর্মে ‘মেয়েলি’ বা ‘নারীসুলভ’ বিষয়গুলোকে আঁকড়ে ধরেননি। এর পরিবর্তে তিনি এমন এক পৃথিবী চিত্রিত করেছিলেন, যেখানে একজন ধর্ষক বিনা শাস্তিতে দম্ভ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর একজন নারী সেই দুঃস্বপ্নময় জীবনকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। তবে তার দুনিয়াতে তিনি ধর্ষককে শাস্তি দিয়েছেন। পৌরাণিক গল্পের আশ্রয়ে তিনি এমন নিষ্ঠুর উপায়ে ধর্ষকের শাস্তি দিয়েছেন, যা দেখে যে কারো অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে।
তবে অবাক করা হলেও এটাই সত্যি যে, এসবই ছিল তার নিজের ভেতরকার যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। তার দুঃস্বপ্নময় জীবন থেকে খানিকটা মুক্তির প্রয়াস। তার ভেতরকার ক্রোধের চিত্রিত রূপ ছিল। ধর্ষককে বারংবার শাস্তি দিয়েছেন তিনি নিজের চিত্রকর্মে। ১৮ বছর বয়সে নিজের শিক্ষকের কাছে ধর্ষিত হবার পরও বিচার পাননি আর্তেমিসিয়া। বরং শিক্ষককে দেয়া হয়েছিল সম্মান আর তাকে দেয়া হয়েছিল বদনাম। এ যন্ত্রণা আর পুষে রাখা ক্রোধই ছিল তার সারাজীবনের চিত্রকর্মের উপাদান। শিল্প ইতিহাসে আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি একইসঙ্গে বীভৎস এবং আকর্ষণীয় চিত্রকর্মের জন্মদাতা এক শিল্পীর নাম।
১৫৯৩ সালের জুলাই মাসের ৮ তারিখ, ইতালির প্রাচীন শহর রোমে জন্মগ্রহণ করেন আর্তেমিসিয়া। ১৬০৫ সালে আর্তেমিসিয়ার যখন ১২ বছর বয়স, তখন তার মা, প্রডেনসিয়া মন্তনি সন্তান প্রসবের সময় মারা যান। আর্তেমিসিয়ার পিতার মেয়েকে নিয়ে প্রাথমিকভাবে কোনো শৈল্পিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি বরং ভেবেছিলেন, নান হয়েই হয়তো জীবন কাটিয়ে দেবে তার মেয়ে। কিন্তু রোমের অলি-গলি ঘুরে বেড়িয়ে আর্তেমিসিয়া যখন বেড়ে উঠছিলেন, তখন কারাভাজ্জো (১৫৭১-১৬১০) নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে পুরো ইতালি মাতাচ্ছিলেন। কারাভাজ্জোর করা ক্যানভাসে রঙ-তুলির ছোঁয়াতে আঁধার আর আলোর নাটকীয় আবহ আর্তেমিসিয়ার ছোট্ট মনটাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এ প্রভাব দিনকে দিন আরো বাড়তে থাকে। কারাভাজ্জো ছিলেন তাদের পারিবারিক বন্ধুও। আর্তেমিসিয়ার বাবা ওরাজ্জো জিনতেলেস্কির সঙ্গে তার ছিল বেশ সখ্যতা। প্রায় সময়ই প্রপস নিতে ওরাজ্জোর বাসায় আসতেন কারাভাজ্জো। আর সেসময় এই ক্ষুদে শিল্পীর খোঁজখবরও নিতেন তিনি।
ওরাজ্জো নিজেও একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। শুরুতে মেয়ের প্রতি শৈল্পিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলেও কারাভাজ্জোর বদৌলতে মেয়ের শৈল্পিক মনটা দ্রুতই প্রকাশ পায় পিতার কাছে। তখন থেকেই মেয়েকে এ বিষয়ে দারুণভাবে উৎসাহ দিতে শুরু করেন। এমনকি নিজে শিক্ষাও দিতে শুরু করেন, যখন শিল্পের প্রতি মেয়ের ঝোঁকটা উপলব্ধি করেন। ছোট বয়স থেকেই আর্তেমিসিয়া কারাভাজ্জোর প্রভাবেই হোক আর নিজের শিল্পীসত্ত্বার কারণেই হোক, দারুণ সব ছবি আঁকতেন। এ নিয়ে তার বাবার গর্বের শেষ ছিল না। সেসময় তিনি চাইতেন, তার মেয়েও একজন শিল্পী হোক, তাও আবার বারোক যুগের। কথিত আছে, ওরাজ্জো পুরো এলাকায় নিজের মেয়ে গুণকীর্তন করে বেড়াতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬১২ সালে আর্তেমিসিয়ার বাবা একদম জনসম্মুখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ঘোষণা দেন যে,
আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আমার মেয়ের দক্ষতার সমকক্ষ অন্তত এ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঘটনাক্রমে এক ঝামেলায় পড়ে কারাভাজ্জোর হাতে এক লোক খুন হলে তিনি পালিয়ে যান। আর্তেমিসিয়ার শিল্পচর্চায় কিছুদিনের জন্য ব্যাঘাত ঘটে তাতে। ওরাজ্জো ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্পী অ্যাগাস্তিনো তাসসির সঙ্গে বেশ কিছু চার্চের কাজ করেছিলেন সে সময়টাতে। তাসসির কাজের ধরনে ক্যারাভাজ্জোর একটা প্রভাব লক্ষ করেছিলেন ওরাজ্জো; তাসসি ছিলেন কারাভাজ্জোর ব্যবসায়িক সহযোগী এবং তার শিষ্য।
তাই, ওরাজ্জো নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাসসিকে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন। পরিচয় করিয়ে দেন আর্তেমিসিয়ার সঙ্গে। গৃহশিক্ষক হিসেবে তাসসি নিয়োগ পান। ওরাজ্জো পোপের কমিশনপ্রাপ্ত ছিলেন, তাই নিয়মিত তাকে কাজে যেতে হতো। কিন্তু তাসসিকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। এই বিশ্বাসটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। কেননা, তাসসি তার মেয়েকে ধর্ষণ করে। ১৮ বছর বয়সে আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি অ্যাগাস্তিনো তাসসির লালসার শিকার হয়। ওরাজ্জো তাসসির বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন।
প্রথমে সে আমার ঘরে আসে। যদিও আমার ঘরে আসা তার নিষেধ ছিল। এসেই সে চেঁচিয়ে বলে, “তুমি কিছুই শেখোনি। কিছুই পারো না তুমি।” তারপর আমার রঙের প্যালেট আর রংতুলি ছুঁড়ে ফেলে দেয় আমার হাত থেকে নিয়ে। এরপর সে আমাকে নানাভাবে অশ্লীল ইঙ্গিত দিতে শুরু করে। আমি মানা করলে পরে সে আমাকে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে আমার বুকের উপর হাত দিয়ে চাপতে শুরু করে। আর তারপর আমার দু পায়ের মাঝে নিজের হাঁটু রাখে যেন আমি তা আটকে দিতে না পারি। আমার কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে অসভ্য লোকটা। আমি চিৎকার করতে চাইলে একটা রুমাল আমার মুখে দিয়ে চাপা দিয়ে ধরে, যেন কোনো শব্দ করতে না পারি আমি।
আদালতকক্ষে বিচারকের কাছে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এভাবেই নিজের উপর হওয়া লাঞ্ছনার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছিলেন জিনতেলেস্কি। ১৬১২ সালে রোমের আদালতকক্ষে মামলাটির তদন্ত শুরু হয়। টানা আটমাস ধরে বিচারকাজ চলে। তখনকার সময়ে পুরো রোমকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল মামলাটি। জিনতেলেস্কি হয়ে উঠেছিলেন এক পরিচিত নাম। এই আদালতের সবগুলো শব্দ আর অনুভূতি কেবল এর চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি ছিল না। সেগুলো ফুটে উঠেছিল আর্তেমিসিয়ার প্রতিটি চিত্রকর্মে। প্রাক-আধুনিক যুগের কোনো নারী নিজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এমন সাহসীপূর্ণ প্রতিবাদ করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় বিরল এক উদাহরণে পরিণত হয়েছে।
আমি উপায়ান্তর না দেখে তার চেহারাতে খামচি দেই। চুল ধরে ইচ্ছেমতো টানতে শুরু করি। এমনকি সে আবার আমাকে লাঞ্ছিত করতে চাইলে আমি শক্ত করে তার যৌনাঙ্গ চেপে ধরেছিলাম। এতটাই শক্ত করে চেপে ধরেছিলাম যে, আমার হাতে এক টুকরো মাংসও চলে এসেছিল। কিন্তু লম্পটটাকে আমি কোনোভাবেই আটকাতে পারিনি।
বিচার চলাকালীন সত্যতা যাচাইয়ের জন্য জিনতেলেস্কিকে নির্যাতনের শিকারও হতে হয়েছে। বারংবার তার লাঞ্ছনার কথা জিজ্ঞেস করে মানসিকভাবে তো যন্ত্রণা দেয়া হয়েছেই। এছাড়া, তাকে শারীরিকভাবেও নির্যাতন করা হয়েছে। সে সময় সত্য-মিথ্যা পরীক্ষা করার জন্য লাই-ডিটেক্টর মেশিন ছিল না। কিন্তু ছিল সিবিল। এর মধ্যে হাত বেঁধে রাখা হতো এবং আঙুলগুলো টানটান করে বেঁধে রাখা হতো। আবার অনেকক্ষেত্রে সঙ্গে থাম্বস্কুও থাকত,যা দিয়ে আঙুলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হতো জেরার সময়ে; যাতে বক্তব্যদানকারী যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সত্যি বলে ফেলে মুখ ফসকে।
জিনতেলেস্কির বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তেমন পদ্ধতিই গ্রহণ করা হয়েছিল আদালত থেকে। খোদ বিচারক বলেছিলেন আর্তেমিসিয়ার এ নির্যাতন খানিকটা শিথিল করার জন্য। আর্তেমিসিয়ার অপর পাশেই সেই একই কক্ষে বসে ছিল ধর্ষক তাসসি। কিন্তু কেউই তার সত্যতা যাচাই করার কথা বিবেচনাও করেনি। যেখানে ধর্ষকের শাস্তি পাবার কথা, ধর্ষকের সত্যতা যাচাই করার কথা; সেখানে সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে ধর্ষিতার নির্যাতন সহ্য করছিল আর লাঞ্ছিত হবার সেই ভয়াবহ বর্ণনা শুনছিল। জিনতেলেস্কি আদালত আর উপস্থিত সবার সামনে মানসিক আর শারীরিক যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এবং নিজের ধর্ষণকে নির্ভরযোগ্য করার জন্য বারংবার বলছিলেন,
এটাই সত্যি। এটাই সত্যি। এটাই সত্যি।
পরে আদালতে বিচারের রায় হয় আর্তেমিসিয়ার পক্ষেই। তাসসি দোষী সাব্যস্ত হয়। তাকে রোম থেকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হয়। তবে বিচারকার্য শেষে ক্ষমতাশালী এক বন্ধুকে কেবল ধন্যবাদ দেয়ার বিনিময়ে বেকসুর খালাস পেয়ে যায় তাসসি। নিষিদ্ধ হওয়া তো দূরেই থাক, উল্টো তাকে সম্মান দেয়া হয়েছিল। তার সেই ক্ষমতাশালী বন্ধু ছিলেন স্বয়ং পোপ।
তাসসির শিল্পকর্ম এখনকার সময়ে ভুলে যাওয়া হলেও সে সময়ে তার শিল্পকর্মের ব্যাপক ভক্ত ছিল। আর তাই অন্য শিল্পীরাও পুরো ঘটনাটা জেনেও কেমন না জানার ভান করেছিলেন। তবু পোপের বন্ধুসুলভ তাসসিকে নিয়ে কেউ একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কেননা, আদালতে সবার সম্মুখে অ্যাগাস্তিনো তাসসির সম্পর্কে তৎকালীন পোপের দায়িত্বে থাকা পোপ দশম ইনোসেন্ট বলেছিলেন,
তাসসি সেই সব শিল্পীদের মধ্যে একজন, যারা কখনোই আমাকে হতাশ করেনি।
আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি তার ধর্ষককে এমন মুক্তভাবে চলাফেরা করতে দেখে বেশ যন্ত্রণা পেয়েছিলেন। সমাজের এহেন অবিচারমূলক কর্মকাণ্ড তার ভেতরের ক্ষতটাকে আরো বেশি দগ্ধ করেছিল। ভেতরে ভেতরে তাসসি আর তথাকথিত এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি প্রবল ঘৃণা আর ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করে তার মধ্যে। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, তার কী করা উচিত। একমাত্র ক্যানভাসই তাকে সব যন্ত্রণা মুছে ফেলতে সাহায্য করে; ক্রোধ আর ক্ষোভগুলো রঙ আর তুলি হয়ে ক্যানভাসে আঁচড় দিতে সাহায্য করে তাকে। তাই বাকিটা জীবন ছবি আঁকার জন্যই উৎসর্গ করেন। তবে এ সিদ্ধান্ত নেয়ামাত্রই তিনি একটা চিরকুট পাঠান রোমের এক পেট্রোনের কাছে। সে চিরকুটে তিনি লিখেছিলেন,
আমি শপথ করে বলছি, এই নারীসত্ত্বার মধ্যে তুমি বা তোমরা সিজারের আত্মা খুঁজে পাবে।
এর পরপরই রোম শহরটা চরম বিষাদময় হয়ে উঠে জিনতেলেস্কির কাছে। যে শহরে তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা, সে শহরেই তার দমবন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে। শহরের বাতাস বিষাক্ত হয়ে ওঠে তার কাছে, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় তার। তার বাবা দ্রুত তার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করেন। উপায়ান্তর না দেখে প্রিয় শহরটাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। চিরকালের জন্য রোম ছেড়ে ফ্লোরেন্সে চলে যান তিনি। তবে জানা যায়, তিনি পরে রোমে ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু কিছু ঝামেলায় পড়ে শেষে নেপলসে চলে যান এবং সেখানেই বাকিটা জীবন কাটান।
ফ্লোরেন্সে এসে মুহূর্ত দেরি না করে কাজে মন বসানোর জন্য আর ব্যস্ততা বাড়ানোর জন্য নিজের স্টুডিও তৈরি করে আঁকতে শুরু করেন। এ সময় বাইবেলের জুডিথ আর হলোফার্ন্সের গল্পটা তাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। গল্পের বিধবা অথচ সাহসী নারীর মধ্যে নিজেকেই খুঁজে ফেরেন জিনতেলেস্কি। ক্যানভাসে রঙ চাপান তিনি। একের পর এক তুলির আঁচড় দিতে থাকেন, ক্যানভাসের উপর নিজের ভেতরে থাকা সব রাগ, ক্ষোভ আর যন্ত্রণাগুলোকে ঢালতে শুরু করেন তিনি। একের পর এক চিত্রকর্ম সৃষ্টি হতে থাকে তার মাধ্যমে। অবশেষে যখন থামলেন, তখন তার কাঙ্ক্ষিত চিত্রকর্ম পেয়ে গেছেন তিনি। জুডিথ আর হলোফার্ন্সের সেই চিত্রকর্ম তার সামনে। সেখানে হলোফার্ন্স তাসসি আর জুডিথ হয়ে তিনি তার শিরচ্ছেদ করছেন।
এমন নয় যে, জুডিথ আর হলোফার্ন্সের এই গল্প নিয়ে এর আগে কেউ কাজ করেনি। বরং মধ্যযুগে গল্পটা বেশ জনপ্রিয় ছিল বলা যায়। বেশিরভাগ শিল্প আর সাহিত্যেই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিতে এই গল্পটাকে উপস্থাপন করা হতো। এমনকি জিনতেলেস্কি যার চিত্রকর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, সেই ক্যারাভাজ্জোও বেশ ভয়াবহ ধরনের চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন এই গল্পকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস আর ভয়াবহ জুডিথ আর হলোফার্ন্সের চিত্রকর্মের কথা উঠলে ক্যারাভাজ্জোকেও ছাপিয়ে আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কির নাম শোনা যায়। তার মতো এত গভীরভাবে, এত নিখুঁতভাবে আর এত ভয়াবহভাবে জুডিথের গল্প খুব কম শিল্পীই তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তার চিত্রকর্মে ক্যানভাস জুড়ে থাকত রক্ত, হিংস্রতা, মৃত্যুযন্ত্রণা আর তার ভেতরের আক্রোশ।
ক্যারাভাজ্জোর জুডিথ এবং হলোফার্ন্সের চিত্রকর্মে জুডিথ চরিত্রকে কেমন কুণ্ঠিত মনে হয়। কেমন একটা নিষ্প্রভ ভাব লক্ষ করা যায় তার মধ্যে। যেন কেবল মারার জন্য হলোফার্ন্সকে মারা। অথচ জিনতেলেস্কি তার চিত্রকর্মে এমনটা ভাবার সুযোগই দেননি কাউকে। হয়তো নিজের গল্পটাকে চিত্রকর্মে তুলে ধরেছিলেন বলেই এত গভীরভাবে চিত্রকর্মটাকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। তার চিত্রকর্মে তিনি জুডিথকে যেমন সুন্দরীর রূপ দিয়েছেন, তেমনি তার পেশীগুলোকে এতটাই শক্তিশালী দেখিয়েছেন যে, সেগুলো হত্যা করতেও নড়ে ওঠে না। চিত্রকর্মে জিনতেলেস্কির পাশে আরেকজন নারীকে দেখা যায়। কারো মতে, তিনিই জিনতেলেস্কি আর তরবারি হাতে থাকা নারূ স্বয়ং জুডিথ। আবার অনেকক্ষেত্রে তাকে হলোফার্ন্সের পরিচারিকা বলা হয়ে থাকে, যিনি আসলে তার মনিব কর্তৃক কাটামুণ্ডু সংগ্রহ করতেন।
তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হচ্ছে, পাশে থাকা তার কাজের লোক কিংবা বান্ধবী যে-ই হন না কেন, আদতে জিনতেলেস্কি তাকে নারী সমাজের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। জিনতেলেস্কি নিজে জুডিথের চরিত্র নিয়ে যেন নারী সমাজকে জানান দিচ্ছেন, যদি সমাজ তোমার বিরুদ্ধে করা অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে পারে, তবে জেনে রেখো নারী, তোমার মধ্যে আছে লিলিথ, জুডিথসহ হাজারও নারীর শক্তি। এজন্যই হলোফার্ন্সের চোখজোড়া খোলা, অসহায় আর মৃত্যুযন্ত্রণায় ফুটে আছে সেই চোখের মণিতে। এ চিত্রকর্মে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। মুখ ফুটে একবার বলেওছিলেন এই সাহসী শিল্পী,
কী হবে, যদি নারীরা সব সংঘটিত হয়ে যায়? যদি তারা পুরুষশাসিত এই বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে?
জুডিথ আর হলোফার্ন্সের গল্পটাকে কেন্দ্র করে জিনতেলেস্কির আঁকা চিত্রকর্মের দু’টি অভিন্ন সংস্করণ এখনো অবধি টিকে আছে। একটি ফ্লোরেন্সে, আর অন্যটি নেপলস শহরে। এর মধ্যে একটাতে তিনি নিজেকে জুডিথের চরিত্রে এঁকেছিলেন। বিচারকার্যের পর দু বছর সময় লেগেছিল তার নিজেকে সামলে নেবার জন্য। দু বছর পর প্রথম চিত্রকর্ম যেটি তৈরি করেছিলেন, তার নাম ছিল ‘সুজানা অ্যান্ড এল্ডারস’।
এ চিত্রকর্মে তিনি বয়স্ক পুরুষদের পীড়ার শিকার এক তরুণীর মর্মবেদনার উপর জোর দিয়েছিলেন। চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু ছিল এক তরুণীর স্নানের দৃশ্য উঁকি মেরে দেখছেন দু’জন পুরুষ। পুরুষের সহিংসতায় জর্জরিত এক নারীর প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলার বিপরীতে পূর্বের শিল্পীরা সুজানাকে উত্তেজক এক নারীর রূপ দিয়েছিলেন। আর জিনতেলেস্কি ঠিক এ জায়গাটাতেই আঘাত করেছিলেন। পূর্বের সব শিল্পীদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের প্রতিবাদ তিনি করে গেছেন এভাবেই। আমেরিকান ইতিহাসবিদ মেরি গার্ডার্ড জিনতেলেস্কি সম্বন্ধে বলেন,
জিনতেলেস্কির চিত্রকর্মগুলো ভিলেনের প্রত্যাশিত আনন্দকে ছাপিয়ে নায়িকার সঙ্কটপূর্ণ দশা আর নয়তো তার প্রতিশোধপরায়ণ সত্ত্বাকে ফুটিয়ে তুলেছে।
ধর্ষণের পর জিনতেলেস্কির চিত্রকর্মের ধরনটাই পালটে গিয়েছিল। ধর্ষণ আর বিচারের ব্যাপারটা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরছিল। তাই ন্যায্য বিচার পাবার একটা রাস্তা তিনি নিজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন। এমন নয় যে, শুধু জুডিথের চিত্রই এঁকেছেন; বরং আরো অনেক চিত্রকর্মেই তিনি প্রতীকীরূপে ভিন্ন বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার একমাত্র জুডিথকে দিয়েই হত্যার চিত্র আঁকেননি তিনি। বাইবেলের আরেকটি গল্প অবলম্বনে জেইল কর্তৃক সিসেরার হত্যার চিত্রও এঁকেছেন তিনি। রোমান সংস্কৃতির লুক্রেশিয়াকে নিয়ে চিত্রকর্ম এঁকেছেন তিনি; যেখানে ধর্ষণের পর লুক্রেশিয়া আত্মহত্যা করছে। আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি তার ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় আর সব চিত্রকর্মই নারীদের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। ম্যারি ম্যাগডালিন, ক্লিওপেট্রা এবং ভার্জিন ম্যারির চিত্রকর্মও আছে তার। আত্ম-প্রতিকৃতিও করেছেন তিনি, যেখানে নিজেকে একজন শক্তিশালী নারী আর একজন আত্মবিশ্বাসী শিল্পীর রূপ দিয়েছেন।
১৭শ শতকে ইউরোপের সর্বাধিক বিখ্যাত নারী চিত্রশিল্পী ছিলেন আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি। ফ্লোরেন্সের শিল্পীদের জন্য সবচাইতে সম্মানজনক আর মর্যার্দাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘দ্য একাডেমি অফ ডেল ডেসিগনো; আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কিকে প্রথম নারী সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে ১৬১৬ সালে। তিনি তখনকার দিনের এমন একটা সম্মানজনক সংস্থায় ছিলেন, যেখানে মাইকেলএঞ্জেলো এবং চিল্লেনির মতো শিল্পীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কির কাছে একাডেমির সদস্যপদ পাওয়া সম্মানের চাইতেও বেশি কিছু ছিল।
কারণ, সদস্যপদ পাওয়ার পর তাকে যেকোনো কিছু ক্রয় করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছিল; এতে কোনো পুরুষের স্বাক্ষরেরও দরকার ছিল না। এমনকি তিনি প্যাট্রনদের সাথে নিজের নামে স্বাক্ষর করে চুক্তিও করতে পারতেন। আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কির যা জরুরি ছিল, ঠিক সেটাই একাডেমি তাকে দিয়েছিল- নিজের জীবনের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং অবাধ নিয়ন্ত্রণ তথা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তার জীবনের বাকি সময়টাতেও ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়েই জীবনযাপন করেছেন। জিনতেলেস্কির দুই মেয়ে ছিলেন, যাদের দু’জনকেই তিনি চিত্রশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
জিনতেলেস্কি খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, কিন্তু এই সাধারণত্বই তাকে করে তুলেছিল অসাধারণ। তিনি ষোড়শ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে যা অর্জন করেছিলেন, তা ছিল এককথায় অসম্ভব। তিনি সেই সময়টার সফল একজন নারী শিল্পী ছিলেন, যখন সংস্থা আর একাডেমিগুলো নারীদের জন্য নিজেদের দরজা। এমনকি জানালাগুলোও বন্ধ করে দিয়েছিল। অন্য শিল্পীদের যেখানে আত্মীজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখতে হয়েছে কিংবা অন্য কেউ তা লিখে দিয়েছে। আর্তেমিসিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটার দরকারই হয়নি। কেননা, তার প্রতিটি চিত্রকর্মই ছিল তার আত্মজীবনী। ফ্রিদা কাহলো, লুইস বুর্জোয়া কিংবা ট্রেসি এমিনের মতো কেবলমাত্র শিল্পের জন্যই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন জিনতেলেস্কিও।
ফ্লোরেন্সের ম্যাডিসি গ্রান্ড ডিউক দ্বিতীয় কসিমো জিনতেলেস্কির প্যাট্রন হিসেব কাজ করতেন। ১৬৩৯ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস তাকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানান এবং সেখানে তিনি রূপক অর্থে আত্মপ্রতিকৃতিমূলক একটি চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন। রংতুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রকর্মের আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কিকে তিনি একজন শক্তিশালী আর আত্মবিশ্বাসী নারীর চরিত্র দিয়েছিলেন।
এখানেও নারীদের স্ট্যান্ডার্ড রূপকচিত্রের এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করেছিলেন তিনি। ষোড়শ শতাব্দীর আইকোনোলোজির একটি বইয়ে ‘একজন সুন্দরী নারী’ হিসেবে এমন একজন নারীর কথা বয়ান করে, যে নারীর ভ্রুজোড়া ধনুকের মতো বক্র; যেখানে কল্পনাপ্রসূত চিন্তাভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। আর তার মুখ সবসময় কানের পেছন থেকে বাঁধা একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে সর্বদা।
জিনতেলেস্কি তার কোনো চিত্রকর্মেই নারীর এমন রূপ তুলে ধরেননি। বরং তিনি নারীর পেশিগুলোকে চিত্রিত করতেন শক্তসামর্থ্য রূপে। আবার একইসঙ্গে সেই নারীকেই সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবেও চিত্রিত করতেন। আর মুখটা কখনোই কাপড় দিয়ে ঢাকেননি। কেননা, তিনি নিজেও তো একজন নীরব শিল্পী ছিলেন না। নীরব থাকার এমন চিত্রকর্ম করাটা একইসঙ্গে তার নারীসত্ত্বা আর শিল্পীসত্ত্বাকে আঘাত করেছিল। জিনতিলেস্কির চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে – সেলফ পোট্রেইট অ্যাজ সেইন্ট ক্যাথারিনা আলেক্সান্ডার, লুক্রেশিয়া, সুজানা অ্যান্ড এল্ডারস, ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড, ক্লিওপেট্টা, জুডিথ স্লেয়িং হলোফার্ন্স, ম্যারি ম্যাগডালেন, জেইল অ্যান্ড সিসেইরা এবং সেলফ-পোর্ট্রেট অ্যাজ দ্য অ্যালিগরি অভ পেইন্টিংস।
পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে এই প্রতিবাদী নারী শিল্পী তার শিল্পকর্মগুলো রেখে গিয়েছিলেন সমাজের তরে। কিন্তু সেই সমাজ যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষের প্রতি এহেন গর্হিত শিল্পকর্ম কি আর টিকে থাকতে পারে? তাই আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি মারা যাওয়ার পর তার শিল্পকর্মগুলোকে উপেক্ষা করা হয়। অবহেলায় তার অনেক মহান শিল্পকর্মও হারিয়ে গেছে কিংবা ধ্বংস হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কির চিত্রকর্মগুলো ৪০০ বছর আগেও যেমন আর যতটা শক্তিশালী আর জোরালো কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিল; আজো ততটাই উচ্চ নিনাদে প্রতিবাদ করে চলেছে।
নারীবাদ জন্মেরও বহু শতাব্দী আগেই আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি মহাকাশ সমান উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীর সংগ্রাম আর প্রতিবাদের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তিনি। বর্বর এক সমাজে নিজের ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়ে নারী হয়েও স্বাধীন জীবন যাপন করেছিলেন তিনি। ভবিষ্যতের নারীদের জন্য প্রতিবাদ করার এক মন্ত্র ফুঁকে দিয়েছিলেন আর্তেমিসিয়া জিনতেলেস্কি। তিনি মারা যাবার পর দু’জন কবি তার জীবন নিয়ে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। সেই কবিতার চারটি লাইন বাংলায় অনুবাদ করে লেখাটার ইতি টানা হলো-
চিত্রকর্মে প্রতিকৃতিগুলো আঁকার শিক্ষা
আর অসীম মেধা অর্জন করেছি আমি এই বিশ্ব থেকেই।
কেননা স্বামীকে দিয়েছিলাম আমার অসতী সত্ত্বা
বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছিলাম রঙতুলি…!!