বাংলার প্রাচীন নৃত্যশৈলীর উৎস সন্ধানে

বাংলার প্রাচীন নৃত্যশিল্পের উৎস কোথায় রয়েছে লুকিয়ে? সামাজিক-রাষ্ট্রিক বিপর্যয়ের ফলে সেই নৃত্য যদি লুপ্ত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তার উৎস সন্ধানে আমাদের যেতে হবে কত দূর! রাজনৈতিক, সামাজিক নানা উত্থান-পতনের ভেতরে সংস্কৃতির যে ধারা থাকে চির প্রবাহমান, সেখানেই রয়েছে তার উৎস। প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কার, রীতি পদ্ধতির বিশ্লেষণ থেকেই করতে হবে তার অনুসন্ধান।

অন্যতম প্রাচীন এক শিল্প নৃত্য; Image Source: Wikiquote

বর্তমানকালে বাংলাদেশে প্রাচীন নৃত্যশিল্পের যে অভ্যুদয় দেখা যায়, তার সঙ্গে বাঙালির নৃত্যশিল্প সাধনার নিজস্ব ধারার কোনো যোগ নেই, একে পুনরভ্যুত্থান বা Revival বলা যায় না, কারণ এই নৃত্যচর্চা বাঙালি জাতির বিলুপ্ত একটি শিল্পের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নয়, বরং একদিক থেকে দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যের অনুকরণ, অন্যদিকে আধুনিক নৃত্যের নব-রূপায়ন।

প্রাচীন বাংলার নৃত্যশৈলীর স্বরূপ সন্ধানে এ মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ শ্রদ্ধেয় আশুতোষ ভট্টাচার্য। আসলে মধ্যযুগে তুর্কী অভিযানের সম্মুখে রাষ্ট্রের সহানুভূতি বঞ্চিত বাংলার যেসকল চারুকলা বিলুপ্ত হয়ে পড়েছিল, বাংলার নৃত্যশিল্প ছিল তাদের অন্যতম। এ সময়ের পর বাংলার কোনো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোকনৃত্যের ধারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলেও শিল্পসম্মত শাস্ত্রীয় নৃত্যের ধারা যে এগোচ্ছিল অবলুপ্তির পথে, তা অস্বীকৃত নয়।

মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক দেশেই ক্ষেত্রবিশেষে তার ঐতিহাসিক উপাদান ভিন্ন হয়ে থাকে। উড়িষ্যা থেকে আরম্ভ করে সমগ্র দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে যে অগণিত হিন্দু মন্দিরগুলো হাজার হাজার বছর ধরে আজও অক্ষত রয়েছে, তাতে উৎকীর্ণ মন্দিরগুলোর নৃত্যভঙ্গিমা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় ভারতীয় নৃত্যশিল্পের ক্রমবিকাশের ধারা এগোচ্ছিল কোন পথে। এই মন্দিরগুলোতে একসময় প্রত্যক্ষভাবে নৃত্যশিল্পের অনুশীলন যেমন হতো, তেমনই যুগ যুগ ধরে সেই নৃত্যচর্চা রাষ্ট্রের সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভ করে সমৃদ্ধ হয়েছিল।

ফলে দূরাগত কাল থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতীয় জনজীবনে নৃত্যের সংস্কার রয়েছে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। শুধু দক্ষিণ ভারত কেন, ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুরেও সঙ্গীত-নৃত্যকলা সাংস্কৃতিক জনজীবনের সঙ্গে যেভাবে মিশে রয়েছে; প্রত্যেক নারী নৃত্যবিদ্যায় পারদর্শী, প্রত্যেক পুরুষ পুং (মৃদঙ্গ) চালনায় দক্ষ, অধিকাংশ পুরুষ জানেন থাং তা (মার্শাল আর্ট)-এর ক্রিয়া কৌশল; তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু উত্থান-পতনের ধাপ পেরিয়ে আজও সেই নৃত্যশৈলী সমাজদেহ থেকে যে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ আমাদের সামনে স্পষ্ট।

মণিপুরী মার্শাল আর্ট থাং তা; Image source: pinkzamazingmanipur.com

কিন্তু এদেশে প্রাচীন নৃত্যশৈলীর ঐতিহ্যের ধারা কেবল ভাস্কর্য কিংবা স্থপতির নশ্বর কীর্তিতে নয়, অনুসন্ধান করতে হবে বাংলার সমাজজীবন সম্পর্কিত ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কার, সামাজিক রীতি পদ্ধতির সন্ধানী বিশ্লেষণ থেকে।

একই কারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ লোকধর্মগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ, আদিমকাল থেকে যার আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে নৃত্যপ্রক্রিয়া রয়েছে গভীরভাবে জড়িত। একসময় আদিমসমাজে ধর্মীয় আচারমূলক অনুষ্ঠানের প্রথা হিসেবে ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া সংগঠনের জন্য নৃত্যের যে আবশ্যকতা দেখা দেয়; নৃত্য সেখানে ধর্মীয় আচারমূলক অনুষ্ঠান ছাড়া তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু ক্রমেই এই নৃত্যধারা তার ধর্মীয় সংস্কারের সংকীর্ণ বেড়াজাল পেরিয়ে উত্তীর্ণ হয় নান্দনিক শিল্পবোধে। মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ সম্পর্কিত ওঝানৃত্যের কথাই যদি এখানে ধরা হয়, লোকনৃত্যের মধ্যে ব্যতিক্রমী এই এককনৃত্যটি আগে ওঝা বা পুরোহিত শ্রেণীর লোকদের মধ্যে ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়ানুষ্ঠানের অংশস্বরূপ ধর্মীয় আচার বা ম্যাজিক্যাল ড্যান্স হিসেবে পরিচিত ছিল।

তারা ঐন্দ্রজালিক নৃত্যের সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা মেঘের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন বলে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল জনমনে। প্রাকৃতিক নানা ভেষজ উপাদান দ্বারা রোগ নিরাময়ের ক্ষমতাও এদের ছিল। পূর্ববাংলার পল্লী অঞ্চলে এদের পসার ছিল বিস্তৃত। এছাড়া ছোটনাগপুর এবং উড়িষ্যার উপজাতি অঞ্চলেও এই নৃত্যের প্রচলন ছিল বহুল। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো, নৃত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আচারটি সমাজ থেকে লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরেও নৃত্যটি কিন্তু লুপ্ত হয়ে যায়নি। উপরন্তু অনেকটা পরিবর্তন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এই ওঝা-নৃত্য ক্রমে হয়ে উঠল নান্দনিক শিল্পকলার এক অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। 

এর থেকে ধারণা করা যেতে পারে এই নৃত্য একসময় রাষ্ট্রিক অনুমোদন লাভে সমর্থ হয়েছিল। মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলার নৃত্য-গীতচর্চার বর্ণনা থেকে এমনকি স্বয়ং মনসার নৃত্যগীত অভ্যাসের প্রসঙ্গ থেকেও বাঙালির আজন্ম সংস্কার সঞ্জাত নৃত্যচর্চার প্রমাণ এখানে দুর্লভ নয়। অটুট নিষ্ঠা, সংযম, লক্ষ্য, নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা শাস্ত্র আধারিত নৃত্যচর্চার ঐতিহ্য যে তখন সমাজে প্রচলিত ছিল এবং তাতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা  নৃত্যকালীন শিল্পীর তালভঙ্গ যে হতো সমাজে গুরুতর অপরাধ– দেবসভায় বেহুলার নৃত্য প্রদর্শনের বর্ণনা থেকে এমন ধারণা অমূলক নয়।

এসব নৃত্যের একটা স্বরূপ অনুমান করে মনে হয় না যে প্রাচীন সমাজে নৃত্যের প্রয়োজন শুধু ধর্মীয় প্রেরণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ শাস্ত্রীয় বিধি-নির্দেশ দ্বারা গণ্ডিভুক্ত হয়ে শৈল্পিক বিনোদনের উপকরণ হিসেবেও নৃত্য চর্চিত হয়েছে সেই সমাজে। ‘শাস্ত্র’- শব্দটি যদি শাসন শব্দের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়, তবে শাসক রাষ্ট্রশক্তির প্রসন্নতা ও অনুমোদন স্বীকৃতির জন্যও নৃত্যচর্চার আবশ্যকতা যে সেই সমাজে ছিল, তা অস্বীকার করা কঠিন।

কাছাড়-বরাক উপত্যকার ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান 'নৌকাপুজা'-য় ওঝার নৃত্য । ছবিঃ নিজস্ব সংগ্রহ থেকে।
কাছাড় বরাক উপত্যকার ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ‘নৌকাপূজা’য় ওঝার নৃত্য; Image Credit: Partha Sheel

আসলে বাংলার প্রাচীন নৃত্যশৈলী সামাজিক, রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে সমাজের মধ্য থেকে যদি লুপ্ত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তার উৎস সন্ধানে যেতে হবে আরও বহুদূর। প্রাচীন বহু সাহিত্য গ্রন্থাদি থেকে গৌড়বাংলার অধিবাসীদের নাট্যশাস্ত্র অনুমোদিত নৃত্যচর্চার পরিচয় পাওয়া গেলেও লোকসাধারণের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত, লোকমানসে সৃজিত ও লালিত যে নৃত্যধারা, তার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে সর্বাগ্রে। তথ্য-প্রমাণের জন্য নির্ভর করতে হবে সেসব লোক গৌণধর্মগুলোর উপর, সমাজ ভাঙনের কালেও যার প্রবাহের গতি ছিল অব্যাহত। এই লোকধর্মগুলোর মতোই তার সঙ্গে জড়িত নৃত্যগুলোও সমাজ বিপর্যয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়নি কখনোই, বরং আত্মগোপন করে প্রবলভাবে অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল লৌকিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আড়ালে।

আদিম সমাজে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অন্যতম অঙ্গ ছিল যে নৃত্যগুলো, তাকে বলা হতো আচারনৃত্য। অনেক সময় দেখা যায়, নৃত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় আচারটি যতদিন না সমাজ থেকে পরিত্যক্ত হয়, ততদিন নৃত্যের প্রয়োজনীয়তা সেখানে বজায় থাকে; আবার অনেক সময় নৃত্যের সঙ্গে জড়িত বিশেষ আচারটি লুপ্ত হয়ে গেলেও নৃত্যটি লুপ্ত হয়ে যায় না। যেমন- পূর্বে ছৌ-নাচ পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের গাজনোৎসবেরই একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। মুখোশ ধারণ করে নৃত্য প্রদর্শন করার উদ্দেশ্য আনন্দ দান করা নয়; কোনো ঐন্দ্রজালিক পদ্ধতিতে সমাজের মঙ্গল বিধান করা। কিন্তু ক্রমেই এ অনুষ্ঠানটি গাজনের আচারমূলক অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন আনন্দানুষ্ঠানে পরিণত হয়।

ঠিক একইভাবে গাজন পরব উপলক্ষ্যে প্রচলিত নারীবর্জিত পুরুষদের চড়কনাচ একসময় আদিমসমাজে কতগুলো বীভৎস ও প্রাণহানিকর আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু ক্রমেই বীভৎস প্রথাগুলো লোপ পেয়ে বর্তমানে নৃত্যগীতে ভরপুর এক আনন্দময় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রণকৌশল প্রয়োগ করে নৃত্য প্রদর্শন করা হতো যে নৃত্যগুলোতে, যেমন – অঙ্গদানি নৃত্য, ঢাক বাজিয়ে নৃত্য, রাঁয়বেশে, পাইক নৃত্য, জারী নাচ, প্রত্যেকটিই এখন স্বাধীন নৃত্যানুষ্ঠানে পরিণত।

ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়ারই লৌকিক রূপান্তর যদি হয় মেয়েলি ব্রতগুলো, তবে আচারনৃত্যকে ব্রতনৃত্য বলতে বোধহয় বাধা নেই কোথাও। তফাৎ অবশ্যই আছে। ঐন্দ্রজালিক নৃত্যগুলোর মধ্যে একধরনের রহস্যময়তা আছে, ওঝা বা পুরোহিত শ্রেণীর ব্যক্তির দ্বারা তা গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রতনৃত্যের মধ্যে গোপনীয়তা বা Mysticism কিছুই থাকে না,  প্রকাশ্যে সেই নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ব্রত একটি সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠান বলে নৃত্যে সমাজের যেকোনো স্তরের এক বা একাধিক নারী তাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। পূর্ববাংলায় এবং কাছাড়ের প্রান্তিক অঞ্চল বরাক উপত্যকায় সূর্যব্রত বা ঠাকুরব্রত উপলক্ষ্যে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে একাধিক নারী দ্বারা বৃত্তাকারে অনুষ্ঠিত ধামাইলনৃত্য, যাকে ব্রতনৃত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায় অনায়াসেই। যদিও এই ব্রতটিকে খাঁটি মেয়েলি ব্রত বলা যায় না, ব্রাহ্মণ পুরোহিত ব্যক্তির উপস্থিতিতে আর্যীকরণের প্রভাব এতে স্পষ্ট।

আজ থেকে প্রায় ৫০/৫৫ বছর আগে শ্রীহট্ট-কাছাড়ের জনপ্রিয় মাঘমণ্ডল ব্রতের একটি ছবি, রয়েছেন দুই ব্রতিনী;
Image source : Author’s Personal Collection

কিন্তু অবাক হতে হয় যখন দেখা যায়, এই শাস্ত্রীয় রীতি-পদ্ধতির পাশেই মহিলাদের একত্র হয়ে বড় বড় করতাল বাজিয়ে নৃত্যগীতের সঙ্গে দ্রুত পদচারণা ও করতালি কোথাও যেন ব্রাহ্মণ্য পুরোহিততন্ত্রকে ছাপিয়ে ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’কে মুখ্য করে তোলে। সমাজের দুটো স্রোতকেই আমরা এখানে একসাথে পাশাপাশি দেখতে পাই; পুরোহিত ব্রাহ্মণ্য শাসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং শ্রেণীবৈষম্যহীন শাস্ত্রধর্ম বহির্ভূত নারী সমাজ, যারা নিজেদের ধর্মসাধনায় পৌরোহিত্য করেন নিজেরাই। ধর্মীয় সাধনাই ঈশ্বরের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির জন্য কোনো মধ্যপন্থা, কোনো বৈদিক মন্ত্র বা কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত ব্যক্তির উপর তারা নির্ভরশীল নন। নিজেরাই নৃত্যগীতের মাধ্যমে আনন্দানুষ্ঠানকে পূর্ণতার মাত্রায় পৌঁছে দেন।

খাঁটি মেয়েলি ব্রতগুলোতে যেমন তাল ছড়ায়, আল্পনায় একটা জাতির মনের, চিন্তার সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়– সূর্যব্রতের সঙ্গে জড়িত গান, নৃত্য এবং চিত্রকলা থেকেও বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের উদ্যম উৎসাহের এক স্পষ্ট রূপ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। সূর্যব্রত ছাড়া যশোর অঞ্চলের শীতলাব্রতের নাচ, বীরভূম,পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান প্রভৃতি অঞ্চলের ভাদুনাচ, বর্ধমান জেলার ভাঁজো ব্রতের নাচ প্রভৃতি ব্রতনৃত্যের নিদর্শন। পূর্ববাংলার মাঘমণ্ডল ব্রতটিও একটি সম্পূর্ণ লোকনৃত্যানুষ্ঠান।    

অতএব বাংলার প্রাচীন নৃত্যশৈলীর উৎস অনুসন্ধান করতে হবে বিশাল গ্রামীণ জনজীবনের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে। যদিও সীমিত কিছু নৃত্য ছাড়া অধিকাংশ নৃত্যের উল্লেখ পর্যন্ত আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে। যেমন- শিকার নৃত্য, যুদ্ধ নৃত্য, নবান্ন উৎসবের নৃত্য, মুখোশ ধারণ করে নৃত্য এবং আরও অনেক। কিন্তু কোনো নৃত্যই যেমন ধর্মীয় লোকনৃত্য নয়, তেমনি ধর্মীয় প্রভাবমুক্তও নয়। এ ধর্ম অবশ্যই মানবধর্ম। তবু ব্রতকেন্দ্রিক নৃত্যগুলোকে আলোচনার বিষয় করে তোলা হলো এই কারণে, ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয় জীবনের ইতিহাসে দীর্ঘ বছর ধরে ক্ষমতার অধিকার, লুণ্ঠন, নরহত্যা, শঠতা আর বহু উত্থান-পতনের মধ্যে মানুষকে যা বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে, তা এই লোকধর্মানুষ্ঠানগুলো।

তাছাড়া, এই ব্রতগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আরো একটি প্রসঙ্গে– যে কারণে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে নৃত্যে নারীর অধিকার লুপ্ত হয়ে যায় অথচ বেঁচে থাকে পল্লী গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে। এসব ধর্মকেন্দ্রিক লোকাচার অনুষ্ঠানের আচ্ছাদনেই মানুষ সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে করেছে গণ-মানসের আরাধ্য দেবতার আরাধনা। নৃত্য সেখানে সংযোজন করেছে মুক্তির আস্বাদ। মুক্তি ধর্মীয় কলহ থেকে; মুক্তি সবধরনের ক্রূরতা, লোভ, হিংস্রতা থেকে; মুক্তি ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে, মুক্তি ভক্ত সাধকের সঙ্গে ভগবানের একাত্মতার চরমতম মুহূর্তে।

ধামাইল নাচ; Image Source: The Business Standard

শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এমন অসংখ্য ব্রতানুষ্ঠান এবং তার সঙ্গে জড়িত নৃত্যশৈলী রয়েছে এখনও অনাবিষ্কৃত, যা সামাজিক দুর্যোগের কালেও সমাজের বহু নিচে, তলদেশে আত্মগোপন করে সমাজের উঁচু শাখা-প্রশাখাগুলোকে করেছে প্রাণরসে উজ্জীবিত। বাংলার প্রাচীন নৃত্যশৈলীর উৎস আলোচনায় যার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা রইলাম তাকিয়ে ভূ-গর্ভস্থিত সেই সমস্ত লোকধর্ম ও নৃত্যানুষ্ঠানগুলো যেদিন অন্ধকার ভেদ করে উজ্জ্বল সূর্যালোকে আবিষ্কৃত হবে, সে অপেক্ষায়।

This article is in Bangla. It is about ancient bengali dance, its origin and present condition.

Reference Books:

1. বঙ্গীয় লোকসঙ্গীত রত্নাকর - আশুতোষ ভট্টাচার্য

2. গ্রামীন নৃত্যকলা - মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য

3. বাঙালীর ইতিহাস - নীহার রঞ্জন রায় 

Related Articles

Exit mobile version