ভোরের আজান শোনা যাচ্ছে কাছের মসজিদ থেকে। দিন একটু একটু ফরসা হওয়া শুরু হয়েছে। হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ। এর মাঝে এক টুকরো রঙিন আকাশ। শত শত ঘুড়ি উড়ছে। পায়ে পায়ে বাসার ছাদে উঠে জড়ো হচ্ছে অনেক মানুষ। পৌষের শেষদিনটিতে এমনই উৎসবের রঙ এ সাজে ঢাকার খুব ছোট্ট একটা অংশ- পুরান ঢাকা। আর উৎসবটির নাম পৌষ সংক্রান্তি, যা শাকরাইন নামেই স্থানীয়দের কাছে পরিচিত বেশি।
বারো মাসের তেরশ’ পার্বণের এই দেশে পৌষসংক্রান্তির এই উৎসব অনেকটা লোকচোখের আড়ালেই ছিল অনেকদিন। পুরান ঢাকার স্থানীয়দের মাঝেই শুধু উদযাপিত হত এই দিনটি। কিন্তু আমাদের জেনারেশনের এর কাছে উৎসব মানে অন্য কিছু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোর মধ্যে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে ছবি- খবর আর আমাদের অনুভূতিগুলো। আমাদের এই প্রজন্ম যেমন রোজকার জীবনের সাথে মানিয়ে নিয়েছে পশ্চিমা উৎসবগুলো তেমনি এই উপমহাদেশের বিশেষ দিনগুলিও। তাই তাদের দেখা যায় যেমন হ্যালোয়িন কিংবা ক্রিসমাস উদযাপন করতে তেমনি দেখা যায় নবান্ন কিংবা শাকরাইনের অনুষ্ঠানে।
পুরান ঢাকার মূলত নারিন্দা, লক্ষ্মীবাজার, ফরিদাবাদ, ফরাশগঞ্জ, সূত্রাপুর, শাঁখারিবাজার, ডালপট্টির গলি গলিতে আনন্দের আবির লাগে পৌষের এইদিনে [১]। শোনা যায়, শীতের সময় জামাইবাবুরা যখন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে আসতো তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হত ঘুড়ি আর নাটাই [২]। সেখান থেকেই পরবর্তীতে প্রচলিত হয়েছে এই ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব। চক্ষুদার, মালাদার, চারবুয়া, মাছলেঞ্জা- কত গালভরা নামের ঘুড়িই না উড়াতে চলে আসে ছেলে-বুড়ো- সব বয়সের মানুষ [৩]। আর আজকাল দেখতে আসে তার থেকেও বেশি মানুষ। নতুন ঢাকা- পুরান ঢাকা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ঐ আকাশের নীলের মতই। এ কেটে দিচ্ছে ওর ঘুড়ির সুতো- হেরে গেলে দুয়ো দিচ্ছে ছাদ ভর্তি মানুষ- এভাবেই হাসি ঠাট্টা আর তামাশায় মেতে উঠে পাড়া প্রতিবেশিরা। নিজেদের ভেতর জানাশোনা আর সম্পর্কের গাঁথুনি আরো মজবুত হয় তাদের- পুরোন দালান কোঠার খোপে ভাগ করা জীবনে মেলে একটুখানি অবসরের আমেজ।
পৌষসংক্রান্তি উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয় শীতের শুরু থেকেই। নাটাই কেনা হয়, ঘুড়ি বানানো, মাঞ্জা মারা হয়… আরো কত কিছু! শুধু যে নিজের নিজের ঘুড়ি কেনা হয় তা কিন্তু নয়। পুরান ঢাকার অনেক ক্লাবের নিজেদের ঘুড়ি উড়ানো হয়। বিশাল বড় একেকটা ঘুড়ি- একেকটা ক্লাবের জন্য। র্যালিও বের হয় অনেক সংগঠন থেকে। পাল্লা দেয়া হয় কার চেয়ে কারটার জৌলুশ বেশি। এভাবে সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে বাড়ে সম্প্রীতির বন্ধন।
সারা দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এইরকম নাচ-গান আর ঘুড়ি উড়ানো চললেও, রাতে শাকরাইনের যেন অন্য আরেক রূপ দেখা যায়। দিনের বেলা বাচ্চার আঁকার খাতার মতন রঙ বেরঙ এর ঘুড়ি উড়লেও, রাতের আকাশ যেন রূপসী কোন নারীর শাড়ির জমকালো আঁচল। নিকষ কালো আঁধারের মাঝে শতশত আতশবাজি আরেকবার চমকিত করে মানুষদের। শুধু কি আগুনের খেলা দেখেই চোখ জুড়ায়? তাইতো ড্রাগন সেজে বসে কত কত মানুষ! সত্যিকারের ড্রাগন। তাদের মুখ থেকে আগুনের হলকা বের হতে থাকে গলগল করে- যার পোষাকি ইংরেজি নাম “ফায়ার ব্রিদিং”। এটি শাকরাইনের অন্যতম প্রধাণ আকর্ষন। বিশেষ করে তরুনরা সেদিন ভিড় জমায় এটার চারপাশে- একটু শঙ্কা, একটুখানি ভয় আর অনেকখানি আগ্রহ নতুন কিছু নিয়ে- তারুণ্যের ধর্মই তো এগুলো!
শাকরাইন তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত উৎসব হলেও দিনদিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে তরুনদের মাঝে। কেউ যাচ্ছে দেখতে- কেউ ছবি তুলতে আর কেউবা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে- নানান উদ্দেশ্যের মানুষগুলো জড়ো হয় ঢাকার ছোট্ট একটা অংশে। তাতে যেমন নতুন ঢাকার মানুষরা জানছে পুরান ঢাকার অদেখা- অজানা ঐতিহ্য কিংবা জীবন রীতি গুলো তেমনি ওই পাশের মানুষও চিনছে এপাশের মানুষকে। সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের জন্য এর থেকে চমৎকার আর কিই বা হতে পারে!
পুরোন ঢাকার মানুষদের কাছে বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে আসা একটা উৎসব হলেও, নতুন ঢাকার মানুষদের কাছে সেটা নেহাতই নতুন। কেউ জানছে কাছাকাছি বাসা দেখে- কেউ জানছে ফেইসবুক মারফত, আর কেউবা ফ্লিকারের ছবি দেখে। কৌতুহল থেকে প্রথমে গেলেও, পরেরবার এই মানুষগুলো আসে ভালবাসা থেকে, ভালোলাগা থেকে। আর এই নতুন অতিথির মুখগুলিও পুরান ঢাকার মানুষরা বরণ করে নেয় সাদরে। আদর, আপ্যায়ন, পিঠা-পুলি, মজাদার খাবার, গান-বাজনা, ঢোল-তবলা- কি থাকে না এই দিনে! মনের আর সম্পর্কের উষ্ণতার কাছে হার মেনে যায় পৌষের হাড় কাঁপানো শীতও।
শাকরাইনের রাতের গান বাজনার সবচেয়ে চমৎকার দিকটা হল সেখানে গান গাওয়ার সুযোগ পায় স্থানীয় ব্যান্ডগুলো। একদম নিজেদের পাড়ার ছেলেদের মধ্যে যারা গান গেয়ে বিশ্বজয় করার স্বপ্ন দেখে, সেসব ছেলেদের জন্য এটা অনেক বড় একটা প্ল্যাটফরম। দেশি গান যেমন তারা গায় বিদেশিও চলে সমানতালে। হয়তো গানগুলা পেশাদার শিল্পীদের মতন তাল-লয় মেনে নিখুঁত হয় না কিন্তু তাতে আবেগের কমতি নেই। আর নিজের ছেলেদের স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি গেঁথে দেয়া তো তাদের আশেপাশের মানুষদেরই!
তবে ভালো দিকগুলির পাশাপাশি কিছু খারাপ দিকও আছে। এই উৎসব কেন্দ্র রাতে মাদক সেবনের একটা অপসংস্কৃতি ধীরে ধীরে গ্রাস করছে এই প্রাণের জোয়ারকে। বিশেষ করে এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এধরনের অসামাজিক কার্যক্রম হয়ে আসে। এলাকাবাসীদের সচেতনতা আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্থক্ষেপই পারে এই সুন্দর উৎসবটিকে অকলুষিত রাখতে। সঠিকভাবে উপস্থাপন আর রক্ষণাবেক্ষণ করতে সক্ষম হলে এই অনুষ্ঠান দেখতে দূরদূরান্ত থেকে আসবে আরো মানুষ।
একটা দিনকে আমরাই সুন্দর বানাই আবার এই আমরাই সেটাতে কালিমার ছোপ ফেলি। অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো বাদ দিলে, শহরের বন্দী জীবনের মাঝে, শীতের সাদা-কালো আর ধূসর কুয়াশামাখা জীবনের মাঝে, এক টুকরো রঙ যেন এই শাকরাইন উৎসব। এই আলো, এই রঙ দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়বে শত মানুষের মাঝে, ভীড় বাড়বে প্রাচীন অলিগলিগুলিতে, জীবন আরেকবার সোল্লাসে জানান দেবে তার উপস্থিতি, তরুণদের জীবনযাত্রার এক অনবদ্য অংশ হবে শাকরাইন- এই কামনাই করা যায়।