সম্মুখ সমরে যারা যুদ্ধ করে, সামরিক পরিভাষায় এদের ফ্রন্ট লাইন বলে। বিশেষ ব্যক্তিত্বের আশেপাশে, গাড়ির আগে-পরে নিরাপত্তাকর্মীর হুড়োহুড়িকে ভ্যান গার্ড বলে, এমন মিলিটারি জার্গন আমাদের মোটামুটি জানা। ফরাসিতে এই শ্রেণিকে বলা হয় এভান্ট গার্ড। এভান্ট গার্ডের এই শব্দকে পুঁজি করে প্রগতিবাদ বেড়ে ওঠে বুদ্ধিদীপ্ত আন্দোলনে, শিল্পে, কলায়।
১৮৫০ সালের শুরুর দিকে শিল্পের নয়া রূপ খুঁজতে, নতুনকে সামনে আনতে; সহজ কথায় যা উদ্ভাবন বা আবিষ্কার বলা চলে, তাকেই এভান্ট গার্ড বলা হবে। গুস্তাভে কার্বেটের বাস্তববাদ দিয়ে শুরু হয় এই ধারা। শিল্পের আন্দোলন বহুমাত্রিক হবে, মহাযজ্ঞকে পেরিয়ে বহু জাগতিক হবে- এমনটা শুরুতে কেউ ভেবেছিল কি না, আমরা জানি না; যা জানি, সে আলাপ এরকম শঙ্কাকে উড়িয়ে দেয় না।
শিল্পযুগে, আধুনিকতার প্রাক্কালে, ১৯০৭ সালে পাবলো পিকাসোর চোখ দিয়ে দেখতে পাই, উদ্ভাবিত বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কিউবিজম অন্যরকম এক বিপ্লব। প্রতিটি বিপ্লব অচলায়তন ভাঙে, এ বিশ্বাস আজও ভীষণ রকমের পোক্ত, এ কথায় দ্বিমত করার লোক খোদ মার্কনিরাও নন। একটি বস্তুনিরপেক্ষ চিত্রকর্মকে যতগুলো বিষয়ে আমরা ভাবতে পারি, তার সবগুলোকে এক তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা যায়- এ আশ্চর্য আমাদের দেখায় কিউবিজম।
একটি ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট’-এর প্রতিটি ভিন্নমত ও ভিন্ন দর্শন সহাবস্থানে রেখে জর্জস ব্রাক ও পাবলো পিকাসো অনন্য শিল্পের ধারা জন্ম দেন। তা দেখতে চূর্ণ-বিচূর্ণ লাগে, ধবংসাবশেষ মনে হয়, অথচ ছবির কথা টের পাওয়া যায় সত্ত্বার মধ্য দিয়ে, এর নাম কিউবিজম। যদিও এ আলাপ অনেক বিস্তৃত ও প্রকট, প্রচ্ছন্ন নয়, আমরা তাই এখানেই ইতি টানব। আমাদের আলাপের বিষয় কিউবিজম থেকে প্রভাবিত হয়ে একদল বেয়াড়া কবির।
সৌরজগতে তিন নম্বর গ্রহ আমাদের পৃথিবী। এখানে আদিম রূপ থেকে মানুষের সভ্য হতে কেটেছে কয়েক কোটি বছর। দীর্ঘদিন শান্তির পর হঠাৎ মহাযুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সালের এই যুদ্ধ মানুষকে আঘাত দেয় ভীষণ, যার চোট থেকে জন্ম নেয় ‘ডাডাবাদ’।
যুদ্ধের ভয়াবহতা থামাতে, দমাতে বা কমাতে সাহিত্য-শিল্পের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে, অথচ মূল ধারার শিল্পীরা ছিলেন বদ্ধ। এই নিস্তেজ, স্থবিরতা উন্মাদ করে দিল ত্রিস্তান জারা, হুগো বলদের। যুদ্ধ যেকোনো শান্তিপূর্ণ জায়গাকে এলোমেলো করে দেয়, শৃঙ্খলকে ভেঙে আনে উন্মাদনা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইলেন ত্রিস্তান জারার মতো কবিরা, যে যুদ্ধ বিশৃঙ্খলা বয়ে আনে, তাকে মোকাবেলা করতেও বিশৃঙ্খলাকেই বেছে নিল ডাডাবাদ। এ নিয়ে হান্স আর্প পরে লিখেছিলেন,
১৯১৪ সালের বিশ্বযুদ্ধে কসাইরা যখন বিদ্রোহ করছে, তখন জুরিখে আমরা নিজেদের শিল্পকলায় নিয়োজিত করেছিলাম। বন্দুকের গুলি দূর-দূরত্বে ছড়িয়ে পড়ার সাথে, আমরাও জড়ো হয়েছি সবাই, আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে গান গাইলাম, রং করলাম এবং কবিতা লিখলাম।
জুরিখে ক্যাবারে ভলতেয়ার নামে এক রেস্তোরাঁয় হুগো বল এক সন্ধ্যায় তার মতো একই আদর্শ ও ভাববাদী মানুষদের জড়ো করেন। সেখানে আর্প, মার্সেল ডুচাম্প, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, কার্ট, ত্রিস্তান জারার মতো ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। হুগো তামাশার এক কবিতা শোনান রেস্তোরাঁর মঞ্চে। যে কবিতা শুধুই এলোমেলো অক্ষর বসিয়ে অর্থহীন কিছু শব্দের অর্থহীন বাক্য রচনা করা। হুগো জোর গলায় পেশ করেন,
“এখানে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ আমাদের কমপক্ষে এটি নিশ্চিত করে, যুদ্ধ আমাদের কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। মহারথী নেতারা যতই এই যুদ্ধকে মহত্বের দাবি করেন, আমরা এ মিথ্যেকে অস্বীকার করব। যেখানে বোঝানো হয়- দুনিয়ার এত অর্থহীন কাজে জনতা আত্মতুষ্ট, নির্বোধ পুঁজিবাদী সমাজ, যুদ্ধের মতো নৃশংসতাকে মানুষ মেনে নিচ্ছে, তবে এই অর্থহীন কবিতা মানতে, শুনতে ও উপভোগ করতে জনতা বাধ্য নয় কেন?
শুধুই যুদ্ধবিরোধী নয়, তারা ছিলেন বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেও। এই নতুন, যুক্তি ও বোধ-বর্জিত শিল্প-আন্দোলনের নাম ডাডা রাখা হয়। জার্মান শিল্পী রিচার্ড হিউলসনবেক ফরাসি-জার্মান অভিধানে এই শব্দটি খুঁজে পান, আর হুগো বল বললেন, এটাই চলনসই। ডাডা রুমানিয়ায় সম্মতি অর্থে “হ্যাঁ, হ্যাঁ”, ফরাসি ভাষায় শখের ঘোটক বা যে ঘোড়া পেন্ডুলামের মত ছোটে। মূলত ডাডা দৈবচয়নে ঠিক করা এক নাম, যার সঠিক কোনো অর্থ করা যায় না।
ডাডা খুব অল্প সময় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জুরিখ থেকে টোকিও, নিউ ইয়র্কে ডাডাবাদীরা উন্মাদনা ছড়ায়। ত্রিস্তান জারা এক ইশতেহারে বলেন, “ডাডাবাদীরা কী চায়? কিছুই না।” কিছু চাই না বলে তারা, চাওয়ার মতো তুমি কোনো হেতু নও- এমনটাই জানান দেয়। এমন ইশতেহার, যা কোনো ইশতেহার নয়, সবরকম নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও যে একটা নিয়ম- এ নিয়মই শ্রেষ্ঠ, সেসব কথাই আমরা শুনি ত্রিস্তান জারার মুখ থেকে।
ডাডাবাদের কবিতা হবে এলোমেলো, যা যে কেউ লিখতে পারেন। “সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”- এ কথাকে অস্বীকার করে তারা বললেন, এক খণ্ড খবরের কাগজকে টুকরো টুকরো করে এর প্রতিটি শব্দকে কেটে আলাদা করুন। এরপর কাটা শব্দগুলোকে একটা পাত্রে নিয়ে ভালো করে ঝাঁকুন, শব্দগুলোকে নিয়ে একের পর এক বসান, কবিতার আদলে সাজান। যা হবে, তা-ই ডাডাবাদী কবিতা। ডাডার কোলাজগুলো দেখতে অনেকটা এখনকার ফটোশপের মতো লাগে। ডাইমেনশন বদলে দেয়, দেখতে কোনোরকম অর্থ প্রকাশ করে না, অ্যাবসার্ড লাগে। জ্যামিতিক, মেকানিকাল, আর্কিটেকচারাল এমন কোনো খাত নেই যেখানে ডাডা প্রবেশ করেনি, সবখানে ডাডার ধবংসযজ্ঞ চোখে পড়ার মতো। ডাডাবাদীরা বলেন,
“সব কিছু ঠিক হয়ে এসেছে আমরা মানলাম, তবে একবার আমাদের ভুল করার সুযোগ দিন, যদিও ডাডাবাদীরা কোনো ভুল করছেন না।”
ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল গ্যালারি অভ আর্টের ডাডা প্রদর্শনীতে প্রায় ৪০০টি চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফ, কোলাজ, লিফলেট এবং ৪০টিরও বেশি শিল্পীর চিত্র ও রেকর্ডিং উপস্থাপন করা হয়েছে। ডাডাকে আরও সহজ করার প্রয়াসে আমেরিকান কিউরেটর, ন্যাশনাল গ্যালারি, লেয়া ডিকম্যান এবং এমএমএ-র অ্যান উমল্যান্ড ২০০৫ সালে পুনরায় এই প্রদর্শনীগুলোকে সংরক্ষণ করেন, যে শহরগুলোর চারপাশে আন্দোলনটি বিকশিত হয়েছিল— সেই জুরিখ, বার্লিন, হ্যানোভার, কোলন, নিউ ইয়র্ক এবং প্যারিসের সব ধবংসাবশেষ তুলে আনেন।
শুধুমাত্র যুদ্ধ নয়, যন্ত্রের উপর ব্যাপক নির্ভরতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত নতুন শিল্পও ডাডাবাদীদের উস্কে দিয়েছে। যেমন আর্প একবার অভিযোগ করেছিলেন,
“মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে তার বানানো দানবীয় অস্ত্র, এক ট্রিগার ছাড়া যেখানে নিয়ন্ত্রণের কিছু নেই”।
ডাডাবাদীরা এমন নৈরাজ্য অব্যাহত রেখেছে। রাস্তা বন্ধ করে কবিতা পাঠের আসর, সিনেমা হলে শো চলাকালীন পর্দার সামনে গিয়ে নাচ-গান, সভা-সমাবেশ , ছাপানো ম্যগাজিন, ক্রোড়পত্র, নগ্নতা একরকম মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠে যথাযথ কর্তৃপক্ষের। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে, ডাডা বার্লিন, কোলোন, হ্যানোভার এবং প্যারিসে শান্তি বিঘ্নিত করা শুরু করে। বার্লিনে শিল্পী হান্না হ্যাচ ডাডার কোলাজে একটি বিদ্রূপাত্মক দেয়ালিকা বানান ফ্যাশন ম্যাগাজিন থেকে তোলা ছবি, পত্রিকা ও সামরিক প্রকাশনা থেকে, যেখানে জার্মান সামরিক এবং শিল্প সমাজকে তিরস্কার করা হয়। বার্লিন বা প্যারিস যেকোনো শিল্প আন্দোলন সহ্য করলেও নিজের গায়ে কাদা ছিটানো সহ্য করবে না।
শুরু হলো ‘ডাডাবাদ হটাও’ পদক্ষেপ। ১৯২০ সালের শেষদিকে প্যারিসে ডাডাবাদের শেষ চিৎকার শোনা যায়, আর ডাডাবাদীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ডাডাবাদ কি আসলেই শেষ? শিল্পের উন্মাদনা এত ভঙ্গুর? যদিও সেখান থেকে শুরু হয় পরবাস্তববাদ, সে আলাপ অন্য এক কোথাও তোলা থাক, ভিন্ন সুরে, কিন্তু একই।
“আমি কেবল আমার কথাই বলি, অন্য কারো কথার সুর আমার গলায় নেই। আমিও অন্য কারও নদীতে যাই না, কেউ আমার। শিল্প চলে তার বিধি মেনে, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যে। এ আলাপ নতুন বা পুরাতন নয়, প্রয়োজনীয়।”
– ত্রিস্তান জারা , ডাডা মেনিফেস্টো , ১৯১৮