প্রাচীন গুহাচিত্র- এই শব্দটি মাথায় আসলে চোখের সামনে ঘুরতে থাকে বড় বড় সব গুহা এবং তার বিশাল বিশাল সব প্রাচীরে অংকিত চিত্রকর্ম ও চারপাশে বন্যপরিবেশ। এরকম একটি ছবি হয়তো নিজের কল্পনায় তৈরি হয়ে থাকে। কারণ আমরা যা জানি বা কোন সময়ে একটু হয়তো দেখে থাকি, তারই হয়তো একটা কাল্পনিক ছবি আমাদের মাথায় জমা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এরকম কোনো বিষয় আমাদের সামনে আসলে হয়তো আমাদের মস্তিস্ক আমাদের কল্পনায় ঐ ছবিগুলোই প্রতিফলিত করতে থাকে।
তবে যা-ই হোক না কেন, প্রাচীন এই গুহাচিত্রগুলোর এক সুবিশাল ইতিহাস আছে। এবং গুহাচিত্রগুলোর মাধ্যমে যে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে একটু হলেও জানতে পারি তা ভাবতেই ভালো লাগে। যেহেতু আমরা জানি, জিনের মাধ্যমে মানুষের বৈশিষ্ট্য বংশ পরম্পরায় ছড়িয়ে পড়ে, তাই খুব জানতে ইচ্ছা করে, আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষরা কী করেছে আর আমরা এখন কী করছি? এর মধ্যে একটু হলেও কি যোগসূত্র পাওয়া যায়?
ভীমবেটকা শব্দটি এসেছে হিন্দি শব্দ ভিমবাইথকা থেকে, যার অর্থ ভীমের (মহাভারত কাব্যের পঞ্চ পাণ্ডবদের এক ভাই) বসার স্থান। এটি ভারতের মধ্য প্রদেশে রাইসেন জেলায় অবস্থিত এবং ভোপাল শহরের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বিন্ধ্য (মধ্য ভারতের একটি নিম্ন উচ্চাতার পর্বতমালা) পর্বতের দক্ষিণ ঢালে এর অবস্থান। ভীমবেটকা গুহাতে পাথরের প্রাচীরের উপর যে চিত্রগুলো পাওয়া যায়, তা নিঃসন্দেহে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এখানে প্রাপ্ত কিছু কিছু চিত্রের বয়স খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৩০ হাজার বছর আগেকার!
২০০৩ সালে ইউনেস্কো ভীমবেটকা গুহাকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষণা করে। প্রতিবেদন এ বলা হয়, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের নথিতে এই স্থানটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধ মঠ হিসাবে। তারা এই তথ্য সংগ্রহ করেছিল স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে।
ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ভি. এস. বাকঙ্কর (১৯১৯-৮৮) ট্রেনে করে ভোপালে যাওয়ার পথে জানালা দিয়ে পাহাড় সম্বলিত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিলেন। হঠাৎ করে কিছু প্রস্তরক্ষেত্র বিশেষভাবে তার নজর কাড়ে। তিনি ফ্রান্স ও স্পেনে দেখা প্রাচীন গুহা ও প্রস্তরক্ষেত্রের সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পান। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে তিনি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল নিয়ে সেখানে আবার আসেন। কিন্তু এবার এসেছিলেন আবিষ্কারের নেশায়। আর আবিষ্কার করেন আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন গুহাচিত্র, যেখানে প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বসবাস করেছে এবং গুহাগুলোর প্রস্তর-প্রাচীরগুলো চিত্রিত করেছে তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড।
ভীমবেটকা গুহার প্রস্তরে অংকিত চিত্রের বিষয়বস্তু
ভীমবেটকা গুহাতে আঁকা চিত্রের বিষয়গুলো প্রাচীনকালে অংকিত অন্য যেকোনো গুহাচিত্রের চেয়ে বেশ সমৃদ্ধ। এই গুহার প্রাচীরগুলোতে শুধু একটি বিষয়েই নয়, বরং বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আঁকা হয়েছে। এখানে মানুষের প্রতীকী অবয়ব থেকে শুরু করে শিকারের দৃশ্য, ধর্মীয় চিহ্নসহ অনেক বিষয়ই স্থান পেয়েছে।
চিত্রগুলোকে বোঝার সুবিধার্থে কয়েক শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন- মানুষের অবয়ব (নর-নারী), প্রাণী (বিভিন্ন প্রজাতির), শিকারের দৃশ্য, রণসংগীত, নৃত্যানুষ্ঠান, পৌরাণিক কাহিনী এবং বিভিন্ন নকশার মাধ্যমে অলংকারিক সাজসজ্জা।
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ মথপালের মতে, এখানে প্রাপ্ত মানুষের অবয়বের এর সংখ্যা ২,৩৩০ এবং তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত; যেমন- পুরুষ, মহিলা, ছেলে, মেয়ে, শিশু, মানুষের প্রতীকি অবয়ব, শিকারি, ঘোড়া চালক, হাতি চালক, ষাড় চালক, সৈন্য, বাদ্যযন্ত্র বাদক, কুঠার হাতে মানুষ, বিভিন্ন কর্মকান্ডে ব্যস্ত মানুষ, আচার-অনুষ্ঠান এবং মা দেবী।
এসব চিত্রে পুরুষের সংখ্যা ২০৭৬, নারী ৭১, ছেলে ২৪, মেয়ে ২, শিশু ৬ এবং ১৫১টি খন্ডিত অবয়ব। এখানে মানুষের ছবির চেয়ে বিভিন্ন পশুপাখির ছবি কম, ১৩৭৭টি। চিত্রিত পশুপাখির মধ্যে আছে সিংহ, বাঘ, চিতা, গন্ডার, বন্যমহিষ, ষাড়, গরু, বাইসন, নেকড়ে, ছাগল, পেচা, বন্য শূকর ইত্যাদি।
তবে এ থেকে একটি বিষয় ধারণা করা যেতে পারে যে, প্রাচীন এই জাতিগোষ্ঠী পশুপাখির পাশাপাশি নিজেদেরও অনেক গুরুত্ব দিয়েছিল চিত্রিত করার ক্ষেত্রে। আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। আমরা যদি ভীমবেটকা গুহাতে মনুষ্য অবয়বের সংখ্যা নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে- পুরুষের অবয়বের সংখ্যা এখানে নারীদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ধারণা করা যায়, প্রাচীন এই ভীমবেটকা গুহার পরিবারগুলো যে পিতৃপ্রধান প্রধান ছিল তা বলা যেতেই পারে।
ভীমবেটকা গুহাতে অনেক ধরনের কম্পোজিশনের ছবি আছে। তারা শিকার, যুদ্ধ, নৃত্য, পারিবারিক জীবন চিত্রিত করেছে। ২০টি শিকারের দৃশ্য পাওয়া যায়, যেখানে ২৮৫টি আছে মানুষের অবয়ব। তবে একটি বিষয় অবাক করার মতো। সেখানে ৯টি নারী-অবয়বও ছিল যাদের শিকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
যুদ্ধের দৃশ্য এবং যোদ্ধাদের ছবি পরবর্তীকালে এসেছে। এই দৃশ্যগুলোতে দেখা যায়- ঘোড়া চালক, হাতি চালক, চালকদের পাশাপাশি হেঁটে আস কিছু সৈন্য, যাদের সাথে তরবারি ছিল, এবং কিছু সময় দেখা যায় তাদের শরীরে বর্মও ছিল।
যুদ্ধের দৃশ্যগুলো যেহেতু কিছুটা পরবর্তী সময়ে চিত্রিত হয়েছে, তাই ধারণা করা যেতে পারে, ভীমবেটকা গুহা বা এই অঞ্চলে প্রথম যে প্রাচীন জনগোষ্ঠী এসেছিল তারা প্রথমদিকে এখানে শান্তিপ্রিয় জীবনযাপনই করেছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে সভ্যতা বিকাশের ফলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী আসায় তারা হয়তো অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের অঞ্চল ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
নৃত্য এবং সংগীতের দৃশ্যগুলো তাদের সময়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দৃশ্যগুলোকে তুলে ধরে। এখানে দেখা যায়, পুরুষ এবং মহিলা একত্রে নৃত্য করছে বাহুতে বাহু রেখে। এবং বাদ্যযন্ত্র বাদকরা তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সঙ্গ দিচ্ছে। এছাড়াও দেখা যায়, বাদকেরা অগ্রগামী সৈন্যদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। পারিবারিক দৃশ্যগুলোতে দেখা যায় গর্ভবতী মহিলা, শিশু, বালক ও মুখোশ পরা পুরুষকে।পৌরাণিক দৃশ্যগুলোতে দেখা যায় কয়েকজন হিন্দু পৌরাণিক দেবতাকে, যেমন- গণেশ ও শিব। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতীকী চিহ্নও পাওয়া যায়, যেমন- স্বস্তিকা, নন্দী (শিবের বাহন), ত্রিশূল প্রভৃতি।
অঙ্কনশৈলী
শিল্প হচ্ছে একজন শিল্পীর মাথায় কল্পিত ধ্যানধারণার বাস্তবরূপ। আর শৈলী (Style)-কে বলা যেতে পারে শিল্পীর শিল্প রচনার নিজস্ব বুদ্ধিভিত্তিক কৌশল। এককথায়, তিনি কীভাবে তার চিন্তাভাবনাকে বাস্তবে রূপ দান করবেন। এতে করে একজন শিল্পীর নিজস্ব শৈলী ও কৌশল প্রকাশ পায়। আর যেহেতু আমরা এক মানুষ থেকে অন্য মানুষ ভিন্ন এবং চিন্তাভাবনার ধরনও ভিন্ন, তাই আমাদের অঙ্কনশৈলীও জনে জনে ভিন্ন হবে। সর্বোচ্চ হয়তো প্রভাবিত হতে পারে।
ভীমবেটকায় প্রাপ্ত চিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করলে প্রধানত তিন ধরনের শৈলীর চিত্র লক্ষ্য করা যায়।
- ন্যাচারিলিস্টিক কৌশল: মশিবর্ণ ছায়া-পরিলেখা (Silhouetted), সুন্দরভাবে সজ্জিত, চিত্রগুলো আংশিকভাবে পরিপূর্ণ, রেখার মাধ্যমে ন্যাচারিলিস্টিকভাবে অংকিত।
- জিওমেট্রিক কৌশল: মশিবর্ণ ছায়া-পরিলেখা (Silhouetted), সুন্দরভাবে সজ্জিত, চিত্রগুলো আংশিকভাবে পরিপূর্ণ, রেখার মাধ্যমে জ্যমিতিক প্যাটার্নে অংকিত।
- বিমূর্ত পদ্ধতি: মশিবর্ণ ছায়া-পরিলেখা (Silhouetted), সুন্দরভাবে সজ্জিত, চিত্রগুলো আংশিকভাবে পরিপূর্ণ, রেখার মাধ্যমে অংকিত।
ভি. এস. বাকঙ্কর ১৯৭৬ সালে ভীমবেটকায় প্রাপ্ত গুহাচিত্রগুলোকে ৫টি যুগ এবং ২০টি শৈলীতে বিভক্ত করেন।
প্রথম যুগ: মধ্যপ্রস্তর যুগ (৮০০০-২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
- শৈলী ১: লাল রঙ, বাদামী, গাঢ় বাদামী রঙ দিয়ে ছবি আকতে দেখা যায়, কোনোরকম বহিঃরেখা ছাড়া, বড় করে সবকিছুকে তুলে ধরা হয়েছে (২-৮ ফুট লম্বা)। যেমন: হাতি, বাইসন ইত্যাদি। মানুষকে অনেক ক্ষুদ্র করে প্রতীকীরুপে আঁকা হয়েছে।
- শৈলী ২: লাল বহিঃরেখায় মহিষ, বাইসন আঁকা দেখা যায়, যেখানে কিছুটা ঠিকমতো আকারে আঁকা হয়েছে।
- শৈলী ৩: প্রাণীগুলোকে মোটা এবং পুরু বহিঃরেখায় আঁকা হয়েছে। আংশিক রঙ দিয়ে পূর্ণ ও শরীরে বিভিন্ন অলংকারিক মোটিফ দিয়ে সজ্জিত। শিকারীদের দেখা যায় তারা বাইসন, হাতি, এন্টিলপকে ধাওয়া করছে।
- শৈলী ৪: বহিঃরেখার মাধ্যমে আঁকা হয়েছে এবং শরীরের অংশে বিভিন্ন অলংকরিক মোটিফ দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে।
- শৈলী ৫: শরীর সাজসজ্জিত এবং জিওমেট্রিক প্যাটার্ন দেখা যায়।
- শৈলী ৬: জিওমেট্রিক এবং ফ্লোরাল প্যাটার্ন দেখা যায়, সরু রেখায়।
দ্বিতীয় যুগ: নব্যপ্রস্তর যুগ (২৫০০-৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
- শৈলী ৭: লাল এবং বাদামী রঙে মশিবর্ণ ছায়া-পরিলেখা (Silhouetted) এর মাধ্যমে বাইসন, মহিষ, হাতি, এবং বানরের চিত্র দেখা যায়।
- শৈলী ৮: একদম সাধারণ লাল বহিঃরেখার মাধ্যমে বন্য শূকর, শিয়াল, হরিণ এবং এন্টিলপ আঁকা হয়েছে।
- শৈলী ৯: মোটা বহিঃরেখা এবং কিছুটা অমার্জিত সাদা রঙের ড্রইং দেখা যায় যেগুলো হাতের আঙুল দিয়ে করা হয়েছে।
- শৈলী ১০: সাদা এবং কিছুটা হালকা সাদা রঙে বাঘ, ষাড়, মানুষের মশিবর্ণ ছায়া-পরিলেখার মাধ্যমে অংকিত।
তৃতীয় যুগ: ঐতিহাসিক সময় (৩০০ খ্রিস্টপূর্ব-৮০০ খ্রিস্টাব্দ)
- শৈলী ১১: যে চিত্রগুলো পাওয়া যায় তা মৌর্য, সুঙ্গ, অন্ধ্র, কুশান যুগের সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে।
- শৈলী ১২: এই শৈলীতে পাওয়া চিত্রগুলোর সময়রেখা কুশান যুগের সময়। এবং যে চিত্রগুলো পাওয়া যায় তা তাম্র যুগের পটারি নকশার অনুরূপ।
- শৈলী ১৩: লাল এবং সাদা বহিঃরেখায় ঘোড়া এবং হাতিচালকের ছবি চিত্রিত হয়েছে।
- শৈলী ১৪: বহুরঙা অলংকারিক প্যাটার্নের মাধ্যমে গুপ্ত যুগের এবং শঙ্খ খোদাইকৃত লিপি পাওয়া যায়।
- শৈলী ১৫: বহু বর্ণে (লাল, সাদা, হলুদ) সাজসজ্জা দেখা যায়।
- শৈলী ১৬: মশিবর্ণ ছায়া-পরিলেখা (Silhouetted) এর মাধ্যমে ন্যাচারিলিস্টিক মনুষ্য-অবয়ব দেখা যায়।
চতুর্থ যুগ: মধ্যযুগ (৮০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ)
- শৈলী ১৭: লাল এবং সাদা রঙে রাইডার্স এবং সৈন্যদের আকা হয়েছে।
- শৈলী ১৮: হাতি, ঘোড়া এবং মানুষের মশিবর্ণ ছায়া-পরিলেখার মাধ্যমে অংকিত হয়েছে গাঢ় লাল এবং সাদা রঙে।
- শৈলী ১৯-২০: দেভানগিরি (লেখার কৌশল-বাম পাশ থেকে ডান পাশ) স্ক্রিপ্ট এবং জিওমেট্রিক মনুষ্য অবয়ব দেখতে পাওয়া যায়।
সবুজ ও গাঢ় লাল রেখাচিত্র, বিষয়বস্তু বৃহদাকার পশু, যেমন- বাইসন, বাঘ, গণ্ডার ইত্যাদি। এগুলো উচ্চ প্যালিওলিথিক যুগের বলে মনে করা হয়। এই চিত্রগুলোতে দেখা যায় লাল রঙে আঁকা চিত্রের উপর আবার সবুজ রঙ দিয়ে নতুন করে চিত্রিত করা হয়েছে।
ভীমবেটকা গুহাচিত্র বিশ্লেষণ
ভীমবেটকা গুহাতে যে চিত্রগুলো পাওয়া যায় তা নিঃসন্দেহে প্রাচীন মানুষের অস্তিত্ব এবং তাদের জীবনযাত্রা ও বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাক্ষর বহন করে।
ভীমবেটকা গুহাচিত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো মানুষের উপস্থিতি। এখানে মানুষকে যে শুধু প্রতীকীভাবে আকা হয়েছে তা নয়, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রুপে আকার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি এই গুহাতে যত চিত্র রয়েছে তার মধ্যে মানুষের অবয়ব এসেছে ২৩৩০ বার এবং পশুপাখির ১৩৭৭টি, যা সত্যিই অভাবনীয়। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে যেসব গুহাচিত্রের উদাহরণ পাওয়া যায় তাতে কোথাও এত পরিমাণে মানুষের অবয়ব আসেনি।
ঐতিহাসিকরা তো এমন হাইপোথিসিস দিয়েই দিয়েছেন যে, আসলে গুহাচিত্র যাত্রা শুরু জাদুবিশ্বাস থেকে। কারণ প্রাচীন এই গুহামানবরা বিশ্বাস করত যে, কোনো কিছুকে দেওয়ালে চিত্রের মাধ্যমে আটকিয়ে ফেলতে পারলে তাকে বশীভূত করা যায় এবং তাকে শিকার সহজ হয়। একদল ইউরোপীয় গবেষক এটাও মনে করেন যে, তারা নাকি ছবি আঁকতো কারণ এর মাধ্যমে তারা তাদের নতুন শিকারীদের, শিকারের বিভিন্ন বিষয় এবং কলাকৌশল সম্পর্কে শিক্ষা দিত। এবং পন্ডিতদের এসব নিয়ে যুক্তি-তর্ক-গবেষণা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
তবে আমরা যদি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে পন্ডিতদের এত শত গবেষণা অনেকটাই ভুল মনে হচ্ছে। কারণ আমাদের এই উপমহাদেশের ভীমবেটকা গুহাতে যেসব চিত্র পাওয়া যায়, তাতে করে মনে হয়, এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং বিভিন্ন ঘটনাবলি চিত্রিত হয়েছে। এবং এখানে বিভিন্ন সময়ে যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এসে বসবাস করেছে এবং ছবি এঁকেছে তারও প্রমাণ রয়েছে এই গুহাচিত্রগুলোতে, কারণ এখানে অংকিত অনেক চিত্রেই দেখা যায় যে তার উপর আবার অন্য কোনো রঙ দিয়ে নতুন চিত্র অঙ্কিত হয়েছে যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি প্রমাণ করে।
ভীমবেটকা গুহার চিত্রগুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা যায়, এখানে পশুপাখি, মানুষ, যুদ্ধ, নৃত্য, প্রাকৃতিক দৃশ্য, পশুর পিঠে করে মানুষ এরকম অনেক কিছু দেখা যায়।
আমরা দেখেছি ভীমবেটকা গুহাতে একদম প্রথমদিকে সবুজ ও লাল রঙ দিয়ে রেখার মাধ্যমে প্রতীকীভাবে মানুষের অবয়ব আঁকা হয়েছে। তারপর আস্তে আস্তে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন বিষয়ে আঁকা হয়েছে। এটাই প্রমাণ করে যে, মানুষ যখন প্রথম আসলো তখন তাদের চাহিদা খুবই সীমিত ছিল। আস্তে আস্তে তারা বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে বন্য দশা কাটিয়ে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হয়। ভীমবেটকা গুহার চিত্রগুলো যেন এটাই প্রমাণ করে। সভ্যতা বিকাশের যেন একটি পূর্ণাঙ্গ গল্পকেই তুলে ধরছে ভীমবেটকা গুহার চিত্রগুলো, যা সত্যিই অসাধারণ।