চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার। স্বভাবতই অস্কারকে ঘিরেও বিতর্ক আছে। প্রায়ই শোনা যায়, অমুক পরিচালক যে অস্কার পাবেন না, এ তো জানা কথাই! কারণ ‘অ্যাকাডেমি’ তাকে পছন্দ করে না। অথবা দেখা যায় অস্কার পাওয়ার পর পুরস্কার হাতে নিয়ে সবাই প্রথমেই ‘অ্যাকেডেমি’কে ধন্যবাদ দেয়। কিন্তু এই অ্যাকাডেমি জিনিসটি ঠিক কী? কারা আছে এই অ্যাকাডেমিতে বা অস্কার কমিটিতে? ঠিক কাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং কোন প্রক্রিয়ায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রী বা কাহিনীকার-পরিচালককে পুরস্কার দেওয়া হয়? কতটুকু নির্ভরযোগ্য সেই প্রক্রিয়া?
কারা এই অ্যাকাডেমির সদস্য?
অস্কার তথা অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স হচ্ছে প্রায় ৭,০০০ সদস্যের একটি সংগঠন। এর সদস্যরা সবাই চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যুক্ত। কেউ প্রযোজক, কেউ পরিচালক, কেউ অভিনেতা-অভিনেত্রী, সম্পাদক অথবা অন্যান্য কলাকুশলী। কারা অ্যাকাডেমির সদস্য হতে পারবে, তার কিছু নিয়ম আছে। উদাহরণস্বরূপ, সদস্য হতে আগ্রহী পরিচালককে বা প্রযোজককে কমপক্ষে দুটি চলচ্চিত্র পরিচালনা বা প্রযোজনা করতে হবে, অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে কমপক্ষে তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে হবে।
নির্ধারিত শর্ত পূরণ করার পর কেউ সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এরপর অ্যাকাডেমির সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাইয়ের পর তিনি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতেও পারেন, আবার বাদও পড়ে যেতে পারেন। শর্ত পূরণ ছাড়াও অবশ্য বর্তমান সদস্যরা বিশেষ অবদানের জন্য নতুন কাউকে সদস্য হিসবে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করতে পারেন। এছাড়া কেউ যদি কোনো বিভাগে মনোনীত হন, তাহলে অন্যান্য শর্ত পূরণ ছাড়াই তাকে অ্যাকাডেমির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়।
মনোনয়নের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া
অস্কারের জন্য মনোনীত হতে হলে প্রথমেই কোনো চলচ্চিত্রের প্রযোজক বা পরিবেশককে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে অফিশিয়াল স্ক্রিন ক্রেডিটস (OSC) নামের একটি ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হয়। এই ফর্মে অস্কারের বিভিন্ন বিভাগের জন্য চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন কলাকুশলীর নাম লিপিবদ্ধ করতে হয়। সকল চলচ্চিত্রই যে মনোনয়ন লাভের যোগ্য, এমন না। এক্ষেত্রেও বিভিন্ন শর্ত আছে। যেমন এর দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৪০ মিনিট হতে হবে, যেকোনো থিয়েটারে প্রথমে মুক্তি পেতে হবে, নির্দিষ্ট কিছুদিন পর্যন্ত হলে চলতে হবে ইত্যাদি।
ওএসসি ফর্মগুলো সংগ্রহ করার পর অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে PricewaterhouseCoopers নামের একটি হিসাবরক্ষক প্রতিষ্ঠান সেগুলোকে ‘Reminder List of Eligible Releases’ তালিকায় লিপিবদ্ধ করে এবং জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অ্যাকাডেমির সকল সদস্যের কাছে একটি করে অনুলিপি প্রেরণ করে। এরপর অ্যাকেডেমির সদস্যদের দেওয়া ভোটের জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়ে ফর্ম জমা দেওয়া শত শত চলচ্চিত্র থেকে বিভিন্ন বিভাগে প্রথমে নির্দিষ্ট সংখ্যক চলচ্চিত্র মনোনয়ন লাভ করে, এরপর দ্বিতীয় দফা ভোটের মাধ্যমে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়।
অ্যাকাডেমির সদস্যগণ কর্তৃক ভোট দেওয়ার নিয়ম
অস্কারে মোট ১৭টি শাখার অধীনে ২৪টি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। কোনো সদস্য শুধুমাত্র তার নিজের শাখার বিভাগগুলোতেই ভোট দিতে পারেন। যেমন স্টিভেন স্পিলবার্গ শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগের মনোনয়নের জন্যই ভোট দিতে পারবেন। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রী বিভাগেই ভোট দিতে পারবেন। কোনো সদস্য যদি একাধিক শাখায় কাজ করেন, তারপরেও তিনি শুধুমাত্র একটি বিভাগের জন্য ভোট দেওয়ার অধিকার পাবেন। যেমন বেন অ্যাফ্লেক অভিনয় এবং পরিচালনা দুটোই করেন, কিন্তু তিনি শুধুমাত্র অভিনেতা হিসেবেই ভোট দিতে পারেন।
অবশ্য এর কয়েকটি ব্যতিক্রমও আছে। যেমন বেস্ট পিকচার বা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য সকল সদস্য ভোট দিতে পারেন। এ বিভাগের জন্য প্রতিটি সদস্যকে তালিকায় থাকা চলচ্চিত্রগুলো থেকে কমপক্ষে ৫টি এবং সর্বোচ্চ ১০টি চলচ্চিত্রকে মনোনীত করতে হয়। আবার শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র এবং ডকুমেন্টারি বিভাগগুলোর জন্য সকল সদস্যের মধ্য থেকে একটি কমিটি গঠন করে তাদের জন্য একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়।
অধিকাংশ বিভাগের জন্য অ্যাকাডেমির সদস্যদেরকে যার যার নির্ধারিত বিভাগের সর্বোচ্চ পাঁচটি করে চলচ্চিত্রকে এক, দুই ক্রমানুসারে র্যাঙ্ক করে পাঠাতে হয়। অধিকাংশ বিভাগই পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত। সদস্যরা শুধুমাত্র ঐ বিভাগে তার দৃষ্টিতে সেরা পাঁচটি চলচ্চিত্রের নাম ক্রম অনুসারে লিখে দেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও সহ-অভিনেতার ক্ষেত্রে প্রতিটি সদস্য নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেন কোন চরিত্রকে প্রধান চরিত্র এবং কোন চরিত্রকে পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করবেন। কোনো অভিনেতা যে বিভাগের জন্য বেশি ভোট পান, তাকে সেই বিভাগের জন্যই মনোনীত করা হয়।
ভোট গণনার পদ্ধতি
জানুয়ারির শুরুর দিকে সকল সদস্যের ভোট অ্যাকাডেমিতে এসে পৌঁছে। PricewaterhouseCoopers প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ভোটের কার্ডগুলোকে প্রতিটি বিভাগের মনোনীত চলচ্চিত্রগুলোর নাম অনুযায়ী সাজান। বোঝার সুবিধার জন্য আমরা এ বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগের কথা বিবেচনা করি। এক্ষেত্রে যেসব সদস্য ‘থ্রি বিলবোর্ড আউটসাইড এবিং, মিসৌরি’ এর জন্য ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ডকে ১ নম্বরে স্থান দিয়ে ভোট দিয়েছেন, তাদের কার্ডগুলো একত্রে স্তুপীকৃত করা হবে। যারা ‘শেপ অফ ওয়াটার’ এর জন্য স্যালি হকিন্সকে ১ নম্বরে স্থান দিয়েছেন, তাদের কাগজগুলো ভিন্ন একটি স্তুপে স্থান দেওয়া হবে। এভাবে সবগুলো কার্ড অনেকগুলো স্তুপ অনুযায়ী সাজিয়ে রাখা হবে।
এরপর শুরু হয় জটিল হিসাব-নিকাশের ধাপ। যে চলচ্চিত্রগুলো সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্যদের কাছ থেকে ১ নম্বর পায়, তারাই মনোনীত হবে – ব্যাপারটি এত সরল নয়। এক্ষেত্রে ‘ম্যাজিক’ নম্বর নামে একটি সংখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধরা যাক, প্রায় ৭,০০০ সদস্যের মধ্যে ৬০০ সদস্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগের জন্য ভোট দিল। আর এ বিভাগে মনোনয়ন দেওয়া হবে পাঁচজন অভিনেত্রীকে। সেক্ষেত্রে ম্যাজিক নম্বরটি হবে ৬০০ ÷ (৫+১) = ১০০। এখন যেকোনো চলচ্চিত্র যদি শুরুতেই ১০০টির চেয়ে বেশি ১ নম্বর ভোট পেয়ে যায়, তাহলে সে চলচ্চিত্র সরাসরি মনোনীত হয়ে যাবে।
যদি প্রথম ধাপে কোনো চলচ্চিত্র মনোনীত না হয়, অর্থাৎ ম্যাজিক নম্বরকে অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে চলচ্চিত্রটি সবচেয়ে কম সদস্যের কাছ থেকে ১ নম্বর ভোট পাবে, তাকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। ধরা যাক, ৬০০ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১০ জন সদস্য একটি চলচ্চিত্রকে ১ নম্বর হিসেবে ভোট দিয়েছিলেন। এখন এই স্তুপের প্রতিটি কার্ডের ১ নম্বর চলচ্চিত্রটির নাম কেটে দিয়ে ২ নম্বরে স্থান পাওয়া চলচ্চিত্রের ভিত্তিতে কার্ডগুলোকে পুনর্বন্টন করা হবে।
যদি প্রথম ধাপেই একটি চলচ্চিত্র মনোনীত হয়ে থাকে, তাহলেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে, তবে সেক্ষেত্রে মনোনীত হওয়া চলচ্চিত্রটিকে ১ নম্বরে স্থান দেওয়া কার্ডগুলোকে প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে ম্যাজিক নম্বর নতুন করে হিসেব করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে আবারও নতুন করে ম্যাজিক নম্বরের চেয়ে বেশি ভোট পাওয়া চলচ্চিত্র অনুসন্ধান করা হবে। এভাবে একই পদ্ধতি বারবার প্রয়োগ করার মাধ্যমে একে একে শ্রেষ্ঠ পাঁচ অভিনেত্রীর মনোনয়ন নিশ্চিত করা হবে।
প্রতিটি বিভাগে বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্ণয়ের প্রক্রিয়া
সবগুলো বিভাগের মনোনয়ন নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে তালিকা তৈরি করা হয় এবং সকল সদস্যকে সেই তালিকা পাঠানো হয় পুনরায় ভোট দিয়ে প্রতিটি বিভাগের বিজীয় নির্ণয় করার জন্য। বিজয়ীর জন্য ভোট দেওয়া অবশ্য বেশ সহজ।মনোনয়নের ক্ষেত্রে যেরকম সদস্যরা শুধুমাত্র তার নিজস্ব বিভাগেই ভোট দিতে পারেন, বিজয়ী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে সীমাবদ্ধতা থাকে না। এক্ষেত্রে সকল সদস্য সবগুলো বিভাগে ভোট দিতে পারেন। মনোনয়নের মতো পাঁচটি চলচ্চিত্রকে র্যাঙ্ক করার পরিবর্তে সদস্যরা এবার সরাসরি বিভিন্ন বিভাগে তাদের দৃষ্টিতে সেরা চলচ্চিত্রগুলোকে ভোট দেন।
একমাত্র ব্যতিক্রম বেস্ট পিকচার তথা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগটি। এক্ষেত্রে আবারও পূর্বের মতো জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। আর এক্ষেত্রে ম্যাজিক নম্বরটি হয় মোট ভোট দেওয়া সদস্যের অর্ধেক। অর্থাৎ যদি শুরুতেই অর্ধেকের বেশি সদস্য নির্দিষ্টি একটি চলচ্চিত্রকে ১ নম্বরে স্থান দিয়ে থাকে, তাহলে সেটি সরাসরি বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত হবে।
কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে সবচেয়ে কম ১ নম্বর ভোট পাওয়া চলচ্চিত্রকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, ২ নম্বরে স্থান পাওয়া চলচ্চিত্রের ভিত্তিতে সেই কার্ডগুলোকে পুনর্বন্টন করে পুনরায় ভোট গণনা করা হয়। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি চলচ্চিত্র ৫০% এর বেশি ভোট না পায়, ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। যে মুহূর্তে একটি চলচ্চিত্র এ ম্যাজিক নম্বর অতিক্রম করে, সে মুহূর্তেই নির্ধারিত হয়ে যায় বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরস্কারের দাবিদার চলচ্চিত্রটি।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, এত জটিল প্রক্রিয়া কেন অনুসরণ করা হয়? এর কারণটি হচ্ছে, নয়টি চলচ্চিত্রকে যেখানে বেস্ট পিকচারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়, সেখানে যদি সরাসরি সর্বাধিক ভোট পাওয়া চলচ্চিত্রকে নির্বাচিত করা হয়, তাহলে তাত্ত্বিকভাবে মাত্র ১২ শতাংশ সদস্যের কাছ থেকে ১ নম্বরে ভোট পেয়েও একটি চলচ্চিত্র সেরা হিসেবে নির্বাচিত হয়ে যেতে পারে। অথচ এমনও হতে পারে, বাকি ৮৮ শতাংশ সদস্যই সেটিকে ৮ অথবা ৯ নম্বরে স্থান দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে হয়তো যে চলচ্চিত্রটি শেষ পর্যন্ত সেরা হিসেবে নির্বাচিত হবে, সেটি হয়তো অধিকাংশ সদস্যের প্রথম পছন্দ না-ও হতে পারে, কিন্তু খুব বেশি সম্ভাবনা যে, সেটি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্যের বেশ উপরের দিকের পছন্দ।
ফিচার ইমেজ- CHRIS PIZZELLO/ AP