বড়দিন উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে হাট বাজারের পসরা। সেগুলোর কোনোটি রঙিন, আবার কোনোটি এখনও আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। চলুন জানা যাক জনপ্রিয় সেসব ক্রিসমাস মার্কেট সম্পর্কে।
১) স্ট্রাসবার্গ খ্রিসকিন্ডেলস্মারিক, ফ্রান্স
স্ট্রাসবার্গের এই উদযাপন চলে আসছে ১৫৭০ সাল থেকে এবং এই শহরটিকে ‘ক্যাপিটাল অব ক্রিসমাস’ বা ‘বড়দিনের শহর’ হিসেবে দাবি করা হয়। প্রাচীন এই হাট-বাজারগুলোর অনাড়ম্বর বিন্যাস রয়েছে ইউনেস্কোর গ্র্যান্ড আইল (মধ্যযুগীয় পুরাতন শহরগুলোর উৎকৃষ্ট উদাহরণ) এলাকায়। ইউরোপের সবচাইতে পুরাতন ক্রিসমাস বাজারগুলোর মধ্যে এটি একটি।
এই বাজারটির আয়োজন করা হয় প্রতি বছর ২৯-৩১ ডিসেম্বরে। এই জায়গাটি মূলত বিখ্যাত এখানকার শীতকালীন আবহাওয়ায় রাস্তাগুলো থেকে ভেসে আসা উষ্ণ ওয়াইনের সুবাসের জন্য। ১৫৭০ সালে স্ট্রাসবার্গের আপত্তিকারীরা (রোমের পোপের কর্তৃক অস্বীকারকারী খ্রিস্টান) ক্যাথলিক ঐতিহ্য পালনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, যেগুলোর বেশিরভাগই ঋষিদের নামের সাথে জড়িত ছিলো। যেমন- খ্রিসকিন্ডেলস্মারিক (শিশু যিশুখ্রিস্টের হাটবাজার) ঋষির বাজারকে প্রতিস্থাপন করে। ২০০০ সালে আল-কায়দা সেখানে বোমা হামলা চালায়।
২) বলগনা ক্রিসমাস মার্কেট, ইতালি
ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ মধ্যযুগীয় শহর বলগনা ক্রিসমাস পূর্ববর্তী ইচ্ছা পূরণের জন্য একদম উপযুক্ত জায়গা। সেখানে ঘুরে দেখার মতো দুটি বাজার রয়েছে। এদের মধ্যে একটি রয়েছে প্রাচীন স্যান পিয়েত্রো ক্যাথেড্রালের যে বারান্দাটি আছে তার সামনে। অন্যটি প্রাচীন সান্তা মারিয়া দেই সের্ভি এর নির্জন স্থান বা মঠে লুকায়িত অবস্থায় আছে। সেখানে রয়েছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের নানা ঐতিহ্য। তাই সেখানকার আশেপাশের দোকানগুলোতে চোখে পড়ে শিশুদের ঘুমানোর জন্য সুশোভিত শয্যা ও ক্ষুদ্র প্রস্তরমূর্তি। সেখানে আরও যে জিনিসগুলো খুব চোখে পড়বে তা হলো তরনি ও ক্রোকান্তে আল মান্দরল্ (সেখানকার স্থানীয় ভাষায়), যা আমাদের ভাষায় কাজু বাদাম ও চিনি।
৩) মাউন্ট পিলাটাস ক্রিসমাস মার্কেট, সুইজারল্যান্ড
মাউন্ট পিলাটাস, ইউরোপের সবচাইতে উঁচুতে অবস্থিত এই ক্রিসমাস মার্কেটটিতে কেনাকাটার পাশাপাশি রয়েছে স্নোবোর্ড ও স্কি করার সুযোগ। ২,০০০ মিটার উঁচু থেকে লুসার্ন হ্রদ দেখা এবং তার সাথে পাহাড়ে উঠতে উঠতে উপভোগ করতে পারেন নান্দনিক আল্পাইনের দৃশ্য । পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোটাই যেন এক অভিনব অভিজ্ঞতা। কারণ খাড়া এক পাহাড়ের উপরে ট্রেন দিয়ে যাওয়াটা বেশ রোমাঞ্চকর বটে! পাহাড়ের উপরে থাকা সেসব দোকান থেকে আপনি কিনতে পারেন নানা রকম উপহার সামগ্রী। যেমন- মোমবাতি, জিঞ্জারব্রেড ইত্যাদি।
৪) পাস্তো ক্রিসমাস ফেস্টিভ্যাল, কর্নওয়াল
প্রতি বছর ৭-১০ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের উত্তর উপকূলীয় শহর পাস্তোতে আয়োজন করা বড়দিনের এই উৎসবটি যেকোনো ভোজন রসিকের প্রিয় তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে! জনপ্রিয় সব রন্ধনশিল্পী সরাসরি সেখানে বিভিন্ন রেসিপি রান্না করে দেখান। তাই দারুণ সব রেসিপি শেখার জন্য এর চাইতে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে! পশ্চিমা দেশগুলোতে তৈরি করা বিভিন্ন জিনিস আপনি উপহার হিসেবে কিনতে পারেন সেখান থেকে। চারপাশে থাকা খাবার গাড়িগুলোতে পাওয়া যায় ভিন্ন ধরনের কিছু খাবার, যেমন- ল্যাভেন্ডার (একজাতীয় সুগন্ধি গাছ) ও মধু দিয়ে বানানো বিশেষ মিষ্টি। আর কোনো কোনো সময় চমক হিসেবে পুরষ্কার হিসেবে দেয়া হয় পাই বা কেক।
৫) বুদাপেস্ট ক্রিসমাস ফেয়ার এন্ড উইন্টার ফেস্টিভ্যাল, হাঙ্গেরি
শুকরের পায়া ও মোরগ ভাপিয়ে বানানো বিশিষ্ট ধরনের একটি রেসিপি পেতে পারেন এই আয়োজনে, প্রতিবছর নভেম্বরের ১০-৩১ তারিখে ভোরোসমার্টি স্কয়ার বাজারে। রবিবারে এই বাজারের পুরোটাই সেজে ওঠে ঐতিহ্যবাহী সব মোমবাতি দিয়ে। চারিদিকে তাকালে মনে হয় যেন আলোর মেলা বসেছে সেখানে। আর সেই সাথে চলে মনমাতানো গানের আসর। সেখানে বিভিন্ন রকম ক্রাফট ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়, যেখানে বাচ্চারা মোমবাতি বানানো ও নিশানাবাজি শিখতে পারে। বাচ্চারা সেখানে বসে নিজ হাতে তৈরি করতে পারে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর নানা জিনিস। এছাড়াও থাকে পুতুল নাচ, আইস স্কেটিং ও বিভিন্ন রকম সঙ্গীতানুষ্ঠান।
৬) ক্রাকো ক্রিসমাস মার্কেট, পোল্যান্ড
শুভ্রতায় ভরা ক্রিসমাস আয়োজন! পোল্যান্ডের প্রাণবন্ত শহর ক্রাকোর ক্রিসমাস মার্কেটে গিয়ে আপনার অনুভূতি অনেকটা এরকমই হবে বলা চলে। চারদিকে সাদার রাজ্য আর সেই জাদুকরী আবহ ও বরফের মাঝে বসা বিভিন্ন দোকানপাট ঘুরে ঘুরে কেনাকাটার সুযোগ থাকে। এই শহরটি ইতিহাসের বর্বর সাক্ষী ও অদ্ভুত স্থাপত্যশিল্প দ্বারা পরিপূর্ণ। আর সেখানে ঐতিহাসিক এলাকায় বাজারটির দেখা মিলবে রিনাক নামের প্রকাণ্ড এক চত্বরে। সেই বাজার থেকে আপনি বেছে নিতে পারেন পছন্দের সব অলংকার, ভাস্কর্য ও সুন্দর সব ডিজাইনের টেবিলক্লথ।
৭) ক্রিসমাস মার্কেট ভেলভেট কেভ, নেদারল্যান্ড
গুহার ভেতর বাজার, সেখানেই চলে দিব্যি কেনাবেচা। শুনেই এই বাজার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কোবার্গ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ভেলভেট কেভ নামে পরিচিত এই গুহাটি আপন গুণে অনন্য। ৫০টি দোকানের চাইতেও বড় এই বাজারটির আয়োজন করা হয় প্রতিবছর ১৭ই নভেম্বর থেকে ২৩শে ডিসেম্বরে। গুহার ভেতরটা দেয়ালচিত্র দিয়ে পরিপূর্ণ। আরও আছে ভাস্কর্য, আঠারো শতকের একক ও অনন্য খ্রিস্টধর্মীয় ভজনালয়, ক্রিসমাসের উপহার সামগ্রীর দোকানপাট, আগেকার দিনের ব্যবসা ও খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা।
৮) লা গ্র্যান্ড মার্শ ডি নয়েল, মন্ট্রিল
ডিসেম্বর মাসে মন্ট্রিয়লের ব্যস্ততম চত্বরটি উৎসবের রঙিন সাজে সেজে ওঠে। ক্রিসমাসের প্রাক্কাল পর্যন্ত চলতে থাকা এই আয়োজনটি জমে উঠে নটরডেম ই এবং ডি লা কমিউন ই এর মাঝামাঝি অবস্থিত একটি পুরাতন শহরে। সেই বাজার ঘুরে চোখে পড়বে জমকালো নকশা করা পোশাক, টেকসই বাঁশ দিয়ে বানানো নানা কারুকাজ করা রোদ চশমা এবং ক্যুবেকের প্রাকৃতিক ককটেল সিরাপ।
৯) কোপেনহেগেন ক্রিসমাস মার্কেট, ডেনমার্ক
সারা বছরই তিভোলি গার্ডেনের ঐতিহাসিক বিনোদন পার্ক মোহনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর থাকে। কিন্তু বড়দিনের আয়োজনে এই জায়গাটি একদম বিস্ময়কর সৌন্দর্য ধারণ করে। চারপাশে থাকে আলোর ছটা, সান্তা ক্লজের বল্গাহরিণ, বরফে ঢাকা গাছপালা আর চলে আকর্ষণীয় লাইট শো। এই আয়োজন চলে ১৮ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
১০) লিসবন ক্রিসমাস মার্কেট, পর্তুগাল
পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে বেশ কয়েকটি ক্রিসমাস মার্কেটের আয়োজন করা হয়। তবে জমকালো আয়োজনটি হয় ২৯শে নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বরে ক্যাম্পো পেকুইনো স্কয়ারে। ক্রিসমাসের সাজসজ্জার বাহারি সব সরঞ্জাম পাওয়া যায় সেখানে, যেগুলোর বেশিরভাগই হয় বিশেষ এবং একেবারেই আলাদা। এছাড়াও থাকে কারুশিল্পের বিভিন্ন রকম দোকান, যেখান থেকে সবাই উপহার সামগ্রী সংগ্রহ করে। তবে লিসবনের বিশেষ চেরি লিকার (সুগন্ধি মিষ্ট স্বাদের ঝাঁজালো মদ) এর সাথে ডিম দিয়ে বানানো মজাদার এগ কাস্টার্ড না খেয়ে আসলেই নয়!
ফিচার ইমেজ: Inhabitat