নজরুল সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম: সঙ্গীতের জগতের এক অক্লান্ত যোদ্ধা

নয় কি দশ বছর বয়স তখন তার, গ্রামোফোন কোম্পানির প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা’- গান শুনিয়ে কবিকে মুগ্ধ করলেন শিশু ফিরোজা। অবশ্য তিনি তখন ভালো করে বোঝেনওনি কাকে গান শোনাচ্ছেন! মামার সাথেই গিয়েছিলেন কবির আসরে। এরপর ১৯৪২ সালে ১২ বছর বয়সে তার একটি রেকর্ড বেরোয় এই কোম্পানি হতেই। শৈশবেই নজরুলের সান্নিধ্য পাওয়াও হয়তো একটি কারণ ছিল তার নজরুলগীতি প্রেমের। সুস্থ অবস্থায় ফিরোজা বেগম নজরুলের সঙ্গ পান প্রায় তিন বছর। কবির কাছে গানের তালিম নেবার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি।

তার ‘ভীরু এ মনের কলি’ যেন ফুটেছিলো কবির সান্নিধ্যের ছোঁয়ায়। কবি অসুস্থ হবার পর থেকে তার গানের সংগ্রামের ভার অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গানের অনুষ্ঠানকে তিনিই বাধ্যতামূলক করেন। সুরের সকল শুদ্ধতা বজায় রেখে নজরুলসঙ্গীতকে তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন শ্রোতৃসমাজের কাছে। সে সঙ্গীতের কোনো প্রকার বিকৃতি তিনি মেনে নিতে পারতেন না কখনোই, তাই সবসময় শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের দিকে মন দিয়েছেন। নজরুলের পর তিনিই নজরুলসঙ্গীতের প্রথম স্বরলিপিকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

ফিরোজা বেগম (১৯৩০-২০১৪); Source: oneindia.com

তিনি নজরুলসঙ্গীতের প্রতি তার প্রেমকে অনেকটাই ব্যক্তিগত আন্দোলনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন,

“১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি আমার গলায় নজরুলের গান রেকর্ড করতে রাজি হয়। তখন আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা… গেয়েছিলাম। পুজোর রেকর্ডের ক্ষেত্রেও আমি একই সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছি । এজন্য আমাকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। শেষপর্যন্ত জয় আমারই হয়েছে। কোম্পানি পুজোয় আমার গাওয়া নজরুল সংগীতের রেকর্ড বাজারে ছাড়তে রাজি হয়েছিল”।

১৯৪৯ সালে তার এই নাছোড়বান্দা স্বভাবের কারণে নজরুলসঙ্গীতের ঝুলিতে আরো অনেক প্রাপ্তি যুক্ত হয়।

ফিরোজা বিশ্বাস করতেন,

“নজরুলের গান ভালোভাবে গাওয়ার জন্য প্রয়োজন তাঁর গানের চিত্রকল্পগুলোকে রপ্ত করা; সেই সৌন্দর্যকে অন্তরে ধারণ করে প্রকাশ করতে হবে যেমন- আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই অথবা শিয়রে গিরিরাজ হিমালয় প্রহরী/আশিস মেঘবারি সদা তার পড়ে ঝরি ইত্যাদি”।

তরুণী ফিরোজা বেগম; Source: gunjan.org.bd

তার প্রিয় গানের তালিকায় শীর্ষে ছিল ‘দূর দ্বীপবাসিনী’, ‘মোমের পুতুল’, ‘খেলিছে জলদেবী’, ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’, ‘নূরজাহান’, ‘কে বিদেশি বন উদাসী’, ‘রুম ঝুমঝুম খেজুর পাতার নূপুর’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ’, ‘বুলবুলি নিরব নার্গিস বনে’, ‘বনমালার ফুল’, ‘বলেছিল তুমি আসিবে’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো’ ইত্যাদি।

তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ধরা হয় ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ ও ‘মোমের পুতুল’কে। ১৯৬০ সালে দুর্গাপূজায় গান দুটির রেকর্ড বেরিয়েছিল। একদিকে সুরের ঝঙ্কারে মমির দেশের মেয়ের গল্প শোনান তিনি, অন্যদিকে দূর দ্বীপবাসিনীকে চেনেন বলে দাবি জানান। এ দুটি গান তার এবং নজরুলগীতির জনপ্রিয়তাকে এক ধাক্কায় এত বেশি উপরে উঠিয়ে দেয় যে এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাবার কোনো অবকাশই ছিল না।

নজরুল সম্রাজ্ঞী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই, ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার একটি গ্রামে। রাতইল ঘোনাপাড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম জমিদার বাড়িতে তার জন্ম হয়। তার পিতা খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল এবং মাতা বেগম কওকাবুন্নেসা। সংস্কারবোধ থেকে তিনি অনেকটাই মুক্ত ছিলেন। অভিজাত মুসলমান পরিবারের মেয়ে হয়েও তিনি গান করেছেন। শুধু গান করেনইনি, সমগ্র জীবন সঁপে দিয়েছেন গানের কাছে।

তার রিনিঝিনি কণ্ঠে প্রেমের গান বেজেছে, ভক্তি কিংবা বিরহের গানেও তিনি সিদ্ধকণ্ঠ। দ্রোহ তার মধ্যে ছিল সহজাত, নজরুলের যোগ্য শিষ্যাই ছিলেন তিনি। পাকিস্তান শাসন আমলে উর্দুর আগে বাংলা গান গেয়েছেন বেতারে, কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করেননি। খাজা শাহাবুদ্দীনকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা গানই গাইবেন আগে। নিজের বাঙালিয়ানায় কোনো অশুদ্ধতার আঁচড় লাগতে দেননি তিনি। ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’ গানটি।

কবি কাজী নজরুলের সান্নিধ্যে গান গাইছেন ফিরোজা বেগম; Source: observerbd.com

সত্তরের উত্তাল সময়ে তিনি দৃপ্ত প্রত্যয়ে একের পর এক বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়ে গেছেন। পাকিস্তানের ভূমিতে তিনি ‘জয় বাংলার জয়’ গাইবার সাহস দেখিয়েছিলেন। একদিন এজন্যই তাকে রেডিও স্টেশন থেকে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে গানের রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার আগে তাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। পাকিস্তানী শাসকদের রোষানলে পড়ার যথেষ্ট কারণও ছিল তার। স্বাধীন বাংলার সংস্কৃতির হাল ধরতে তিনি যে শক্ত একটি খুঁটি হবেন- এ ভয় তাদের ছিল।

নজরুলসঙ্গীতের প্রতি তার ছিল অগাধ আন্তরিকতা এবং পুরো জীবন ধরে সে ক্ষেত্রেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নজরুলসঙ্গীত যখন খুব কম মানুষ শুনতো, তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু নজরুলের গানই গাইবেন। সকলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন যে অন্য গান ছেড়ে দিলে তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়বে, “নজরুলের গান ক’জনই বা শোনে!” আধুনিক গান গেয়ে তার প্রচুর খ্যাতি হয়েছিল। খ্যাতির মোটামুটি শীর্ষে উঠে আবেগে মথিত হয়ে নেওয়া তার এ সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই ভুল ঠেকে। কিন্তু তার কাছে এটি ছিল অনেক বেশি কিছু। কবি নজরুলের গান গেয়েই তিনি সকলের কাছে জনপ্রিয় হবেন, জনপ্রিয়তার মুকুট পরবেন নজরুলসঙ্গীতও- এই ছিল তার লক্ষ্য।

কমল দাশগুপ্তের সাথে তিনি; Source: observerbd.com

জীবনসাথী কমল দাশগুপ্তের সাথে দেখাটাও কবি নজরুলের বদৌলতেই হয়েছিলো। প্রথমবার যে কবিকে গান শোনাবার সময়, তখন কবিই কমল দাশগুপ্তকে ডেকে আনলেন ছোট মেয়েটির অদ্ভুত সঙ্গীত প্রতিভা দেখাতে। কমল দাশগুপ্ত কবির খুব প্রিয় একজন সংগীতকার ছিলেন। কবি শুধুমাত্র তাকেই অধিকার দিয়েছিলেন নিজের লেখা গানে সুর বসাবার। কমল দাশগুপ্ত প্রতিভার পরখ করা জানতেন খুব ভালো করেই। তার হাত দিয়েই গানের জগতে যুক্ত হয়েছেন কত না শক্তিশালী পরিচিত কণ্ঠ। ফিরোজা ও কমলের প্রেম তখনকার সময়ে বিখ্যাত ছিল। একে তো দুই সঙ্গীতের মহারথী, অপরদিকে ভিন্ন ধর্মের, চর্চা করার বহু উপাদানই লোকজন খুঁজে নিতো এ থেকে। তবে এই শিল্পীযুগলের কিছুই এসে যেত না। একসাথে আধুনিক ও নজরুলসঙ্গীত গেয়ে বেড়াতেন। ১৯৫৬ সালে বিয়েও করলেন। নিজেদের ভেতরকার বন্ধনকে তারা গানেও প্রকাশ করেছেন, “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান” (১৯৭২ সালে রবীন্দ্র সদনে গাওয়া)। একই দিনে জন্ম এই হংস মিথুনের। দারিদ্র্য এবং বিরূপ প্রতিকূলতা বহুবার তাদের সংসারে ছায়া ফেলেছে, তবু তারা একসাথেই ছিলেন যতদিন না মৃত্যু এসে পথ আলাদা করে দিয়ে গেলো। কমল দাশগুপ্তের মৃত্যু হয় ১৯৭৪ সালে।

তিন পুত্রের সাথে (বাঁ থেকে শাফিন আহমেদ, তাহসিন আহমেদ, হামিন আহমেদ); Source: The Daily Star

ফিরোজা বেগমের সংগ্রাম, গানের প্রতি তার সর্বোচ্চ আন্তরিকতার ফলে তিনি বেশ কিছু স্বীকৃতিস্বরূপ পুরষ্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৯ সালে প্রাপ্ত ‘স্বাধীনতা পুরষ্কার’, একুশে পদক, নেতাজী সুভাষচন্দ্র পুরষ্কার, সত্যজিত রায় পুরষ্কার, নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, সেরা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পুরষ্কার ইত্যাদি। কিডনিজনিত জটিলতার কারণে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এই বিখ্যাত শিল্পী। তার তিন পুত্র তাহসিন, হামিন ও শাফিন। এর মধ্যে হামিন ও শাফিন দুজনেই বাংলাদেশের খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী। মাইলস ব্যান্ডের সক্রিয় সদস্য এরা। সঙ্গীত এদের পরিবার জুড়েই নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে বারবার, এখনও তার পরম্পরা বিদ্যমান।

ফিচার ইমেজ: Youtube.com

Related Articles

Exit mobile version