কিছুদিন আগেই আমার বান্ধবী বলছিল বিয়ের জন্য তার বাসা থেকে অনেক চাপ আসছে, সবাই বলছে, “বয়স হয়ে গেছে, বিয়ে কেন করছো না?” যদি আপনি মেয়ে হয়ে থাকেন তাহলে কারো না কারো কাছে আপনি এমন মন্তব্য নিশ্চয়ই শুনেছেন বা শুনবেন। আর যদি আপনি ছেলে হয়ে থাকেন, আপনাকেও নিশ্চয়ই বলা হয়েছে/হবে ‘বংশের বাতি’ জ্বালাতে! আমরা জানি, আমাদের দেশে বিয়ের উপযুক্ত বয়সের পরে ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের জন্য সামাজিক চাপ আসতে থাকে।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, এশিয়ার কয়েকটি দেশ (চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর), আফ্রিকা, এমনকি ফ্রান্সেও বিয়ের জন্য এমন ধরনের চাপ দেয়া হয়, যার সামনে আমাদের দেশের চাপ কিছুই না। একটি উদাহরণ হতে পারে চৈনিক বৈবাহিক প্রথা মিয়াং খুন বা ভূত-বিয়ে।
মিয়াং খুন- মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত বিয়ে
মিয়াং খুনের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশ চীন। মিয়াং খুন একটি প্রাচীন চৈনিক প্রথার নাম যেখানে মৃত ব্যক্তিকে অন্য মৃত বা জীবিত ব্যক্তির সাথে বিয়ে দেয়া হয়। আমাদের দেশে বা পাশ্চাত্যে বিয়ের জন্য লোকে আপনাকে জীবিত থাকতেই জ্বালাতন করবে। কিন্তু চীনা সমাজে বিয়ের চাপ মৃত্যুর পরও আপনার পিছু ছাড়বে না।
ধারণা করা হয়, চীনের সাং সাম্রাজ্য (১৬০০-১০৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সর্বপ্রথম এই প্রথার শুরু করে, যখন সাম্রাজ্যের যুদ্ধরাজ চাও চাওয়ের ১২ বছরের ছেলে মারা যায়। সম্রাট তার ছেলের বংশগতি ধরে রাখার জন্য একটি জীবিত মেয়েকে তার ছেলের সাথে কবর দিয়েছিলেন।
চীনের ধর্মীয় বিশ্বাসমতে, মৃত্যুর পরেও একজন মানুষ পরকালে তার জীবনযাপন চালিয়ে যায়। যেমন- চীনের প্রথম সম্রাট ইয়াং ঝাংয়ের মৃত্যুর পর তার সাথে কবরে ‘টেরাকোটা আর্মি’দের পাঠানো হয়েছিল যাতে তিনি পরকালেও যুদ্ধজয় করতে পারেন।
মৃতদের সম্পর্কে চীনাদের ধারণা
চীন ছাড়া অনেক দেশে এই প্রথা চালু থাকলেও চীনের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারানুষ্ঠান এই প্রথার জন্য অনেকটাই দায়ী। চৈনিক বিশ্বাস মতে, একজন মৃতেরও জীবিতদের মতো চাহিদা আছে। তারাও ভালো খেতে চায়, তারাও পরকালে ‘একা’ থাকে, সঙ্গীহীনতায় ভোগে। যারা জীবিত অবস্থায় বিবাহিত ছিলেন তাদের সঙ্গীরা তাকে পরকালেও সঙ্গ দেন। কিন্তু তাদের কী হবে যারা বিয়ে না করেই মৃত্যুবরণ করেছেন?
বাংলাদেশের মতোই চীনে বিয়ে নিয়ে সামাজিক একটি চাপ থাকে। বিয়ের উপযুক্ত ছেলেমেয়ে অবিবাহিত থাকলে তার বাবা-মাকে সমাজে ছোট করা হয়। অন্যদিকে, চীনা সমাজে বড় ভাই-বোনদের আগে ছোট ভাই-বোনদের বিয়ে দেয়াও খুবই অপমানজনক বলে ধরে নেয়া হয়।
কী হবে যখন অবিবাহিত বড় ভাই বা বোন মারা যান?
বাংলাদেশে এমন হলে ছোট ভাই বা বোনের বিয়ের ব্যাপারে কোনো বাধা নেই। কিন্তু যদি আপনি চীনের গ্রামাঞ্চলে বড় হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে পোহাতে হবে কিছু ঝামেলা।
যেহেতু চীনারা ধরে নেন মৃত্যুর পরও তাদের স্বজনদের চাহিদা আছে, তারা এটাও বিশ্বাস করেন যে পরকালে পর্যাপ্ত সুখী না হলে মৃতের আত্মা তাদের তাড়া করে বেড়াবে। ধারণা করা হয়, পরকালে একাকী সে আত্মা তার মায়ের স্বপ্নে এসে তার জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করে! যতই কাছের মানুষ হোক, মৃতের আত্মাকে কেউই তাদের বাসায় চান না। এজন্য মৃতের আত্মাকে খুশি করার জন্যও তাকে একজন সঙ্গী দেয়া হয়।
যদি এমন হয় যে বড় ভাই বা বোন অবিবাহিত অবস্থায়ই মারা গেছেন, তাহলে তাদের জন্য মিয়াং খুন বা ভূত বিয়ের আয়োজন করা হয়।
কীভাবে হয় ভূত-বিয়ে?
চীনে সাধারণত বর-কনে দুজনই মৃত থাকে, তবে আফ্রিকার নুয়ার ও আতুত নামক জনগোষ্ঠীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবিত মেয়ের সাথে মৃত ছেলের বিয়ে দেয়া হয়। এরপর আজীবন সে মেয়ে তার স্বামীর বাড়িতে বিধবাবেশে বসবাস করে। সেসব অঞ্চলে ভূত বিয়ে করানোর মূল উদ্দেশ্য যত না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি বৈষয়িক।
আফ্রিকায় যদি ধনী কোনো অবিবাহিত যুবক মারা যান, তাহলে মৃত্যুর পর তার বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকার কেউ থাকে না। এজন্য ছেলের পরিবার জীবিত মেয়ের পরিবারকে পর্যাপ্ত যৌতুক দেয় যাতে মেয়েটি তাদের মৃত ছেলেকে বিয়ে করে। অতঃপর একটি ছেলে সন্তান দত্তক নিয়ে সে ছেলেকে ঐ মৃত ব্যক্তির সন্তান বানানো হয়। এভাবে বংশের ধারা ও সম্পত্তির মালিকানা ঠিক রাখা হয়।
কিন্তু চীনা সমাজে ব্যাপারটি শুধু সম্পত্তিকেন্দ্রিক না। তাদের হাজার বছরের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আনুষ্ঠানিকতা তাদের এই প্রথা থেকে বের হতে দেয় না।
ইয়াং অয়াং নামের চায়নার সাংশি হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“যখনই হাসপাতালে বিবাহ উপযুক্ত কোনো মেয়ে মারা যান, তৎক্ষণাৎ ভূত বিয়ের জন্য তার দেহ নিলামে উঠে যায়। মৃত ছেলেদের পরিবারগুলো নিলাম যুদ্ধে লেগে পড়ে!”
বেশিরভাগ সময়েই জীবিত আছে কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে- এমন মেয়েদের শরীর বিক্রি করা হয় ভূত বিয়ের জন্য। অনেকে আবার এই মৃত মেয়েদের সন্ধান দেয়ার জন্য ঘটকালীও করে থাকেন। এমনই একজন অভিজ্ঞ ভূত-বিয়ের ঘটক জানান,
“যেখানে ১৯৯০ সালে একটি মৃতদেহের দাম ছিল ১,০৩৫ ডলার করে সেখানে ২০১৬-তে সে দাম পৌঁছেছে প্রায় ৩২ হাজার ডলারে!”।
মৃতের বয়স, মৃত্যুর সময় ও বংশ মর্যাদা অনুযায়ী মৃতদেহের মূল্যে তারতম্য হয়।
কনে যোগাড় হওয়ার পর, অন্য সব চীনা বিয়ের মতো স্বাভাবিকভাবেই অনুষ্ঠিত হয় ভূত বিয়ে। পার্থক্য শুধু এই যে বর-কনে দুজন মৃত থাকে আর তাদের আত্মীয়রা একই সাথে সুখী আবার দুঃখী থাকেন। মৃতের শ্রাদ্ধ এবং বিয়ে একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়।
বর-কনেও উপস্থিত থাকেন। কাগজ ও বাঁশ দিয়ে বর-কনের পুতুল তৈরি করা হয়, সেই সাথে আসবাবপত্র, খাবার ইত্যাদি যা যা তাদের ‘পরকালে কাজে লাগবে’ তা তৈরি করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে কাগজের পুতুলসহ সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা হয় এই বিশ্বাসে যে সেগুলো মৃতের কাছে পৌঁছাবে। একই কবরে বর-কনের মৃতদেহ রাখা হয়।
কী হবে যদি ভূত বিয়ে না হয়?
এতক্ষণ নিশ্চয়ই আপনারা ভুরু কুঁচকেছেন অনেকবার। কিন্তু চীনের গ্রাম্য সমাজে ভূত-বিয়ে সাধারণ বিয়ের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। তারা বরং ভূত-বিয়ে হয় না শুনলে চমকাবেন বেশি! এই নির্লিপ্ততা এসেছে তাদের কুসংস্কার থেকে। চীনা সমাজে ভূত বা আত্মাদের অনেক বেশি ভয় করা হয়। আত্মাদের খুশি রাখার জন্য হেন কাজ নেই তারা করবেন না।
বিয়ে না করা তাদের কাছে অনেক বড় একটি অপূর্ণতা। চীনে অবিবাহিত কাউকে মৃত্যুর পর তার পারিবারিক কবরে দাফন করা হয় না। তারা মনে করেন, এতে পরিবারে অমঙ্গল হবে এবং পরিবারের বুজুর্গরা অসন্তুষ্ট হবেন। মেয়েদের জন্য এই নিয়ম আরও ভয়াবহ।
অবিবাহিত ছেলেকে অন্যত্র দাফন করা গেলেও অবিবাহিত মেয়েদেরকে ভূত-বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত দাফনই করা হয় না! কারণ মেয়েরা তার বাবার পরিবারের অংশ নয়; যদি বিয়ে না দেয়া হয় তাহলে তারা কোনো পরিবারেরই অংশ হবে না। তবে চীনে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদেরই ভূত বিয়ে বেশি হয়।
ভূত বিয়ের প্রভাব চীনে কেমন?
৩ হাজার বছরের পুরনো প্রথা হলেও এই ২০১৮-তেও চীনের কিছু পশ্চাদপদ গ্রামে এখনো দেখা মিলবে ভূত বিয়ের। কিন্তু এই প্রথার সামাজিক কিছু অন্ধকার দিক আছে।
১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া চীনের এক সন্তান নীতি এবং কন্যা শিশুর ভ্রূণহত্যার কারণে সেদেশে মেয়েদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কম। চীনে এখন মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সংখ্যা ৩৩.৫ মিলিয়ন বেশি।
এর মধ্যে বিষফোঁড়া হয়ে আছে ভূত বিয়ে প্রথা। চীনের গ্রামাঞ্চলে কয়লা খনির শ্রমিক হিসেবে কাজ করে হাজার হাজার তরুণ। তারা প্রায়ই খনি দুর্ঘটনায় কম বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান। এত মৃতদেহের জন্য মেয়ে খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক পিয়াং ইয়াও বলেন, “নারীদেহের স্বল্পতার জন্য চীনে হত্যা ও অপহরণের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে”। ২০১৬ সালে মা চংখুয়া নামের এক ব্যাক্তি দুজন মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ ৮,৩০০ ডলারে বিক্রি করে ভূত বিয়ের জন্য। এছাড়াও সাংশি প্রদেশে ২০১৫ সালে ১৪টি মেয়ের কবর খুড়ে তাদের লাশ চুরি করার ঘটনাও ঘটেছে। মেয়ের সংখ্যা কম হওয়ায় অনেক সময় পরিবারের সম্মতিতেই একটি মেয়ের মৃতদেহ অনেকজন মৃত ছেলের সাথে মিয়াং খুন করা হয়।
চীনা সংস্কৃতিকে আমরা ছোট করে দেখছি না। তাদের সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে পরিবার, পারিবারিক সম্পর্ক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা শুধু মানুষে-মানুষে সম্পর্কে বিশ্বাস করে না। তারা মানুষ আর আত্মার সম্পর্কেও অনেক গুরুত্ব দেয়। সমস্যা তখন হয় যখন একটি প্রাচীন প্রথা বাঁচানোর জন্য সমাজে পাপাচার বেড়ে যেতে থাকে।
চীনে নারী-পুরুষের সংখ্যার যে ব্যবধান, তাতে ভূত-বিয়ে প্রথা আর কতদিন টিকে থাকবে বলা মুশকিল। জাপানে মৃতের সাথে এখন আর মৃতদেহ নয়, বরং ভূত-বিয়ের জন্য বানানো পুতুল ব্যবহার করা হয়। চীনেও যদি এমন করা যায় তাহলে অনেক নির্দোষ মানুষকে কুসংস্কারের বলি হতে হবে না।
ফিচার ইমেজ: scmp.com