১৯৩৫ সালের ১ ডিসেম্বর একটি ইহুদি পরিবারে জন্ম নেন উডি অ্যালেন। চারবার একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক, অভিনেতা, জাজ মিউজিশিয়ান, কমেডিয়ান ও নাট্যকার তিনি। আধুনিক সময়ের বর্ণাঢ্য এ লেখক-পরিচালকের সিনেমাগুলো বিশেষভাবে পরিচিত স্যাটায়ার, উইট ও হিউমারের বিশেষ প্রকাশভঙ্গির কারণে। তার ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে সাহিত্য, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ইহুদিবাদ, ইওরোপিয়ান সিনেমা ও নিউ ইয়র্ক শহর। নিউ ইয়র্ক শহরেই তিনি জন্মেছেন এবং জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন।
ক্যারিয়ায় প্রায় অর্ধশতক বছরের। বয়স তার প্রায় ৮২। তিনি একাধারে মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, কমেডিয়ান, নাট্যকার এবং জ্যাজ সঙ্গীতজ্ঞ। চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে অ্যালেন বিশেষ সম্মানিত। তার সিনেমার পেছনে মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে সাহিত্য, যৌনতা, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, ইহুদি পরিচয়, ইউরোপীয় চলচ্চিত্র। প্রথমে কমেডি রাইটার হিসেবে ৫০ দশকে যাত্রা শুরু করেন অ্যালেন। সে সময় টেলিভিশনের জন্য হাসির অনুষ্ঠান ও কৌতুকের বই লিখতেন তিনি। এরপর ৬০ দশকে স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেই সময়ই সিনেমার দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। কমেডি ছবি লেখা এবং পরিচালনার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রচুর চিত্রনাট্য রচনা করেছেন, ছবি বানিয়েছেন, অভিনয়ও করেছেন বিভিন্ন চরিত্রে। ২৪ বার অস্কারের জন্য মনোনীত হয়ে চারবার পেয়েছেন এই সম্মান।
কিন্তু ছবি তৈরি হোক, কিংবা নিজের ছবি নিয়ে কথা বলাই হোক, উডি অ্যালেন নিজের মতো বাঁচতে ভালবাসেন। জীবনে বিতর্ক ও সমালোচনা তাই পিছু ছাড়েনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। অ্যালেন কয়েকবার বিয়ে করেছেন এবং এ বিয়ে নিয়েই বেশি বিতর্কিত হয়েছেন। প্রথম বিয়ে হয়েছিল হারলেন রোজেনের সঙ্গে ১৯ বছর বয়সে। দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৬ সালে লুইজি লেজারের সঙ্গে। ‘টেক দ্য মানি অ্যান্ড রান’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের পর অ্যালেনের ‘ব্যানানাস’, ‘এভরিথিং ইউ ওয়ান্টেড টু নো অ্যাবাউট সেক্স’ ও ‘স্টারডাস্ট মেমোরিজ’ নামের তিনটি সিনেমায় কাজ করেছিলেন লুইজি লেজার। বলা হয়ে থাকে তার ‘হাসবেন্ডস অ্যান্ড ওয়াইফস’ মুভিটি লেজারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে তৈরি হয়েছিল।
তার পরবর্তী স্ত্রী ডায়ান কিটন। ‘অ্যানি হল’সহ উডি অ্যালেনের বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন এই অভিনেত্রী। বলা হয় তার ‘ম্যানহাটন’ ছবিটি স্টেসি নেলকিনের সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্ক নিয়ে তৈরি। কিন্তু অ্যালেন কখনোই স্টেসির সঙ্গে সম্পর্কে কথা জনসমক্ষে স্বীকার করেননি। এরপর তার সম্পর্ক হয় মিয়া ফারোর সঙ্গে। এ সম্পর্ক ও পরবর্তী ঘটনাক্রমে অ্যালেনের জীবনে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। মিয়া ফারো তার আত্মজীবনীতে লেখেন, তার দত্তক মেয়ে সুন ই প্রেভিনের সঙ্গে অ্যালেনের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। মিয়া ফারোর সঙ্গে অ্যালেনের বিবাহ বিচ্ছেদের পর অ্যালেন প্রকাশ্যে প্রেভিনের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। এ নিয়ে তাকে প্রচুর সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়তে হয়।
উডি অ্যালেনর নামের পাশে অসংখ্য ছবি রয়েছে। ‘ম্যাচ পয়েন্ট’ থেকে ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’- এই দীর্ঘ তালিকায় নানা ধরনের ছবি। কোনোটি বক্স অফিসে সফল, কোনোটি আবার একেবারেই নয়। বেশ কিছু সিনেমা সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে, আবার অনেক সময় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে উডি অ্যালেনের সিনেমা। ক্যারিয়ারের প্রায় ‘শেষ’ পর্যায়ে আছেন তিনি। কিন্তু তবুও তার বক্তব্য, ছবি করার সময় প্রযোজকরা চান, ছবিটার প্রচার হোক। আর সেই কারণেই দ্বারস্থ হতে হয় সংবাদ মাধ্যমের। কিন্তু তিনি সংবাদ মাধ্যমকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করতে চান না। এদিকে অধিকাংশ সময়ই তাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়। অনেকে বলতে পারেন, মিডিয়া নিয়ে যদি তার এতই যদি আপত্তি থাকে তাহলে তিনি এত সাক্ষাৎকার দেন কেন? জবাবটা নিজেই দিয়েছেন উডি। বলেছেন, ঘুরিয়ে নিজের ছবি প্রোমোট করার একটা ব্যাপার থাকেই। আর নিজের ছবির প্রচার করাটাকে তিনি ইচ্ছে করেই করতে চান। আর একারণেই আর তাই তিনি সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন।
‘দ্য টকস’ পত্রিকায় একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি পরিচালক। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করে দেয়া হল।
আপনার শুরুর দিকের কাজগুলোয় ঘুরে-ফিরে নশ্বরতার বিষয়টা এসেছে। এখন তো আপনার আশি চলছে। মৃত্যু কি এখনো আপনাকে ভাবায়?
উডি অ্যালেন: পাঁচ বছর বয়স থেকেই মৃত্যুচিন্তা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল আর এই ভয় সারা জীবন ধরেই আমাকে তাড়া করছে। হ্যাঁ, অবশ্যই এসব ভাবনা এখনো আমাকে হয়রান করে তোলে। আমার মতে এর একমাত্র সমাধান হলো, এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা আর নিজের কাজে মন দেয়া। মৃত্যুচিন্তায় সর্বদা বুঁদ হয়ে থাকলে, জীবনের পাশা খেলায় হেরে বসবেন যে।
আপনি তো সারাটা জীবন নিউ ইয়র্কেই বসবাস করেছেন। এখনো কি লস অ্যাঞ্জেলসকে ঘৃণা করেন?
উডি অ্যালেন: না, না। এটা একটা সর্বজনবিদিত ভুল ধারণা। আমি মোটেও লস অ্যাঞ্জেলস ঘৃণা করি না। ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার অনেক বন্ধু আছে। আর সেখানে ঘুরতে যেতেও আমার ভালো লাগে। আমি শুধু সেখানে থাকতে চাই না। কারণ আমার রোদেলা আবহাওয়া আর গাড়ির উপর নির্ভর করতে ভালো লাগে না। আমি গাড়ি চালাতে জানি, কিন্তু আমার ড্রাইভ করতে ভালো লাগে না। আমার নিউ ইয়র্কের মতো শহর ভালো লাগে; যেখানে ঘর থেকে বেরোলেই শহুরে প্রাণ-চাঞ্চল্যের দেখা মিলবে, মেঘাচ্ছন্ন দিন আর তুষার পাবো।
পত্রিকা পড়া হয় কি? অথবা নিজেকে নিয়ে কোনো নিউজ?
উডি অ্যালেন: ছোটবেলা থেকেই নিউ ইয়র্ক টাইমসটা পড়ছি, এখনো অভ্যাসবশত সেটাই পড়া হয়। এছাড়া আমার ড্রাইভার গাড়িতে কিছু ট্যাবলয়েড রাখে। সেগুলোতেও মাঝে মাঝে চোখ বুলাই। কিন্তু আমি কখনোই নিজের সম্পর্কে কিছু পড়িনি। না আমার কোনো ইন্টারভিউ, আর না আমাকে নিয়ে রটানো কোনো কেচ্ছা-কাহিনী। আমি কখনোই, ভুলেও আমার কোনো ছবির রিভিউ পড়ি না। যদিও শুরুর দিকে ব্যাপারটা এমন ছিলো না। কিন্তু এখন আমি শুধু নিজের কাজেই মন দেই। আমার ভাবনার দখল নিতে পারে, এমন যে কোন কিছু খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাই। আমি কতটা অসাধারণ অথবা কত বড় বোকার হদ্দ, সেটার হদিস রাখি না। কাজ থেকে আপনার আনন্দ পেতে হবে। সকালে উঠে স্ক্রীপ্ট হাতে নিয়ে, সেটে গিয়ে প্রতিভাবান সব মানুষের সাথে কাজ করার মজাই আলাদা। যখন এটা শেষ হয়েছে আর আপনি নিজের সেরাটা দিয়ে ফেলেছেন, এগিয়ে যান। আমি না আমার কোনো ছবির দিকে ফিরে তাকাই, আর না সেগুলো নিয়ে কিছু পড়ি।
মি. অ্যালেন, আপনি কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন যে জীবনে সুখে থাকা আসলে অসম্ভব?
উডি অ্যালেন: এটা আমার দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমি সব সময় আমার জীবনে সেটাই দেখে এসেছি। আমি খুব কঠিন এবং হতাশার জীবন কাটিয়েছি। আমি জীবনের অসুখী দিকটা ভালোমতো দেখেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি প্রতিকূলতা দেখে বড় হয়েছি। বয়সের সাথে সাথে তা শুধু বেড়েছে। তাই আমি মনে করি জীবনটা সবসময়ই কঠিন দুঃস্বপ্নের মতো। জীবিত থাকার মতো সে রকম কোনো কারণ নেই যদি না আপনি নিজের সাথে প্রতারণা করে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে জীবনটাকে এভাবেই মেনে নেন।
আমার মনে হয় বেশির ভাগ মানুষই আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করবে।
উডি অ্যালেন: কিন্তু আমিই তো প্রথম না যে এ ধরনের কথা বলছি। আমিই প্রথম না যে এতটা স্পষ্টভাবে কথাগুলো বলছি। এর আগে নিৎস বলেছেন, ফ্রয়েড বলেছেন, ইউজিন ও’নীল বলেছেন একই কথা। জীবন নিয়ে মানুষের বিভ্রম থাকতেই পারে। আপনি যদি সৎভাবে এবং পরিষ্কারভাবে জীবনের দিকে তাকান, দেখবেন এই জীবন বয়ে চলাটা খুব কষ্টের। এটা এতটাই কঠিন যে মরে যাওয়াটাই আপনার কাছে শ্রেয় মনে হবে।
সবার জীবনে খারাপ সময় গেছে, উডি অ্যালেনও কি জীবনে এ রকম খারাপ সময় পার করে এসেছেন?
উডি অ্যালেন: আমি খুবই ভাগ্যবান এবং আমি আমার মেধা খাটিয়ে জীবনটাকে একটা কার্যক্ষমতার দিকে প্রবাহিত করতে পেরেছি। কিন্তু এর বাইরে আমি আর কোনো কিছুই করতে পারিনি। আমি খুব ভালোভাবে জীবনটা যাপন করতে পারিনি, এমনকি জীবনের সামান্যতম ব্যাপারগুলোও আমি ঠিকমতো পাইনি। অনেক মানুষের কাছে এই সামান্য ব্যাপারগুলো হয়তো ছেলের হাতের মোয়া মনে হতে পারে কিন্তু আমার কাছে সেগুলো মারাত্মক আঘাত।
কী রকম?
উডি অ্যালেন: যেমন কোনো অচেনা এয়ারপোর্টে নামা বা হোটেলে ওঠা, মানুষের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলা, হাঁটতে বের হওয়া, দোকান থেকে জিনিস কেনা। আমি এখনো সেই অলিম্পাস টাইপরাইটারেই কাজ করছি যেটা আমি ১৬ বছর বয়স থেকে ব্যবহার করে আসছি এবং সেটা এখনো নতুনের মতোই আছে। আমার সব ছবি লেখা হয়েছে ওই টাইপরাইটারে। কিন্তু আমি সেই টাইপরাইটারের কালার রিবনটাও পাল্টাতে জানি না। এমনও সময় গেছে ওই কাজটা করে দেওয়ার জন্য আমি মানুষকে বাড়িতে দাওয়াত করে খাইয়েছি। আমার কাছে এগুলো সবই ট্র্যাজেডি।
আপনি কি জীবনের ভালো বিষয়গুলোকে অবিশ্বাস করেন?
উডি অ্যালেন: জীবন অনেক ভালো মুহূর্ত দিয়ে ভরা। একটা টিকেট কিনে লটারি জিতে ফেলা, একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখে থমকে যাওয়া, চেটেপুটে খাওয়া একটা রাতের খাবার। কিন্তু সব মিলিয়ে জীবনটা আসলে বিষাদময়। জীবন আপনার আশ্রয়স্থল, সেটা বেশ মনোরম। যেকোনো একটা সিনেমা, ধরুন বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’, ছবিটা কিন্তু পুরোটাই ট্র্যাজেডি। কিন্তু তার মধ্যেও একটা দৃশ্য রয়েছে যখন লোকটা বাচ্চাদের সাথে বসে রয়েছে এবং দুধ খাচ্ছে, গাছ থেকে পেড়ে বুনো স্ট্রবেরি খাচ্ছে। কিন্তু তারপর এই সুন্দর মুহূর্তগুলো চলে যায় এবং আপনি বাস্তবতার মুখোমুখি হন।
আপনি কি ভালোবাসার ব্যাপারেও একই রকম হতাশ?
উডি অ্যালেন: আপনি যতটা ভাবছেন, তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে আপনি ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ বলে যে সম্পর্ক ভালো রাখতে হলে সময় দিতে হয়। কিন্তু আপনি কখনো শুনবেন না যে আপনি যে কাজগুলো পছন্দ করেন, সেসব কাজেও আপনার সময় দেওয়া উচিত। যেমন মাছ ধরতে যাওয়া বা ফুটবল খেলা। আপনি কখনো বলেন না যে এগুলোতেও আমার সময় দেওয়া উচিত, যে ব্যাপারগুলো আপনি ভালোবাসেন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে সময় দেওয়ার কিছু নেই, আপনি কখনো কোনো সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে আপনাকে ভাগ্যবান হতে হবে এবং জীবনে যা ঘটছে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আর আপনি যদি ভাগ্যবান না হন তাহলে আপনার উচিত দুঃখ পাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা। এ কারণেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বেশ মুশকিল এবং এজন্য আপনি কষ্টও পাবেন। মানুষ একসাথে থাকে কারণ তারা জড় পদার্থের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তারা হয় একা থাকতে ভয় পায় নাহলে বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে আলাদা হয় না।
একজন পুরুষ কি একইসাথে দুজন নারীকে ভালোবাসতে পারে?
উডি অ্যালেন: দুজনেরও বেশি। আমার মনে হয় আপনিও পারবেন। এ কারণেই রোমান্স জিনিসটা খুবই কঠিন এবং কষ্টকর। একইসাথে খুবই কঠিন এবং খুবই জটিল বিষয়। আপনি বিবাহিত জীবনে নিজের বউকে নিয়ে হয়তো অনেক সুখে আছেন। তারপর দেখা গেল আরেক নারীর সাথে আপনার পরিচয় হলো এবং আপনি তাকে ভালোবেসে ফেললেন। কিন্তু আপনি আপনার বউকেও ভালোবাসেন। আবার আপনি যে নারীকে ভালোবেসে ফেলেছেন তার সাথে হয়তো অন্য কোনো পুরুষের দেখা হলো। তিনি সেই পুরুষের প্রেমে পড়ে গেলেন, একই সাথে সেই মহিলা আপনাকেও ভালোবাসেন। ব্যাপারটা যে এখানেই শেষ তা না। আপনি আরেক মহিলার প্রেমে পড়ে যেতেই পারেন। তখন একসাথে তিনজনকেই আপনি ভালোবাসতে পারেন। শুধু একজন কেন হবে?
কেউ যদি আপনার পরামর্শ অনুযায়ী চলতে চায় তাকে কি বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হবে?
উডি অ্যালেন: নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। না হলে জীবনে জটিলতা শুধু বেড়েই চলে। কেউ কেউ বলে থাকেন যে সমাজের দৃষ্টি আরো উদার হওয়া উচিত। কিন্তু সেটাও কাজ করবে না। আমার মনে হয় এটা ‘লুজ-লুজ সিচ্যুয়েশন’। আপনি যদি অন্য আরেক নারীর কাছে যান তাহলে আপনার বউ আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু অন্য নারীর কাছে যাওয়ার পরও যদি আপনার সংসার টিকে থাকে সেটাও কিন্তু সুবিধাজনক কিছু না। শেষ পর্যন্ত আসলে আপনার কাছে কিছুই থাকবে না, ভাগ্যবান না হলে আপনি সুখী হতে পারবেন না।
আপনি কি কখনো কেঁদেছেন?
উডি অ্যালেন: আমি সিনেমা হলে সব সময়ই কাঁদি। এটাই মনে হয় একমাত্র জায়গা যেখান থেকে আমি সবসময় চোখ ভিজিয়ে বের হই। কারণ আমার কান্নার রোগ আছে। ‘হান্নাহ অ্যান্ড হার সিস্টার্স’ ছবিতে আমার একটা দৃশ্য ছিল যেখানে কাঁদতে হবে। আমাকে কাঁদানোর জন্য চোখে সবকিছুই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার মোটেও কান্না পায়নি তখন। কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে ছবির সে জায়গাগুলো দেখে আমি ফুপিয়ে কেঁদেছি। ব্যাপারটা অনেকটা জাদুর মতো। তবে ‘বাইসাইকেল থিফ’ এবং ‘সিটি লাইটস’ ছবির শেষ দৃশ্য দেখে আমি কাঁদিনি। সিনেমা হলেও কাঁদিনি, বাইরে এসেও কখনো কাঁদিনি।
আপনার পরিচালিত সব ছবিতেই আপনি অভিনয় করেছেন। কিন্তু ইদানীং ছবিতে আপনার উপস্থিতি কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোটায় চলে এসেছে। কারণটা কী?
উডি অ্যালেন: কারণ অভিনয় করার মতো ভালো কোনো চরিত্র নেই। বহু বছর ধরে আমি রোমান্টিক সিনেমার নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছি, কিন্তু যখন বয়স হয়ে গেল তখন তা ছেড়ে দিয়েছি। বুড়ো বয়সে সুন্দরী সব মেয়েরা আমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ছে এমন চরিত্রে আমাকে মানাতো না। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ব্যাপারটা কি রকম হতাশার? ছবির অভিনেতারা স্কারলেট জোহানসন এবং নওমি ওয়াটসের মতো সুন্দরীদের বগলদাবা করছেন, অথচ ছবির পরিচালক হিসেবে আমি শুধু সেটা চেয়ে চেয়ে দেখছি। আমি সেই বুড়ো মানুষ যার কাজ শুধু পরিচালনা করা। ব্যাপারটা আমার পছন্দ না। আমি সেই লোকটা হতে চাই যে এই নায়িকাদের সাথে রেস্টুরেন্টে সামনাসামনি বসে চোখে চোখ রেখে মিথ্যা কথা বলবে। আমি যদি সেটা বাস্তবে করতে না পারি তাহলে পর্দায় করাটা কেমন হাস্যকর হবে, ভাবুন!
বৃদ্ধ হয়ে যাওয়াটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
উডি অ্যালেন: জিনিসটাকে আমার খুব বিশ্রী মনে হয়। বৃদ্ধ হওয়ার কোনো সুবিধা নেই। আপনার বুদ্ধি বাড়ছে না, আপনি আগের চেয়ে বেশি স্মার্ট হচ্ছেন না, আপনি পাকামো করছেন না, দয়ালু হচ্ছেন না। এর মধ্যে ভালো কিছুই নেই। আপনার পিঠে আর কোমড়ে ব্যথা বাড়বে, বদহজমের সমস্যা বাড়বে, চোখে ভালো দেখবেন না, কানে শোনার জন্য হিয়ারিং এইড লাগবে। বয়স বাড়াটা খুবই বিরক্তিকর, আমার পরামর্শ থাকবে, সুযোগ থাকলে বুড়ো না হওয়াই ভালো। বৃদ্ধ হওয়ার মধ্যে কোনো রোমান্টিকতা নেই।
আপনি কি কখনো ছবি বানানো বন্ধ করে দেবেন?
উডি অ্যালেন: আমি আনন্দ নিয়ে কাজ করি। আমি আর কোথায় ভালো কাজ করতে পারি? একজন শিল্পী হিসেবে আপনি সবসময়ই কিছু অর্জন করতে চাইবেন, কিন্তু সেটা আপনি পারবেন না। একটা অতৃপ্তি থেকে যাবে। আপনি একটা ছবির জন্য শুট করলেন, কিন্তু পরে দেখে মনে হলো, যা করেছেন তার চেয়ে ভালো করা যেত। আপনি আবার আরেকটা ছবি ভালোভাবে করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু হলো না। আমি এই বারবার চেষ্টা করার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাই। এতে লক্ষ্য থেকে আপনি কখনো বিচ্যুত হবেন না, বরং একটু একটু করে নিজের লক্ষ্যের দিকেই এগিয়ে যেতে থাকবেন। টাকা-পয়সা করার জন্য বা বক্স অফিসের রেকর্ড ভাঙার জন্য আমি ছবি বানাই না। আমি ছবি করতে করতে ছবি বানানোর চেষ্টা করি। আমি যদি সবকিছু করে ফেলি, সব লক্ষ্য অর্জন করে ফেলি, তাহলে এরপর আমি কী করব!