সাগরের পাড়ে বসে সমুদ্রের গর্জন শুনছেন আর ভেঙে আসা ঢেউ দেখতে দেখতে জীবনের নানা অসমাপ্ত অংক মেলানোর চেষ্টা করছেন। সাগরের বিশালতার সামনে ক্ষুদ্র আপনি, গভীর চিন্তায় মগ্ন। মৃদু বাতাস বইছে আর পাশে আছে আপনার প্রিয় গিটারটি, এমন সময়ে হঠাৎ আপনার চোখ খুলে যায় এবং নিজেকে আবিষ্কার করেন জ্যামে আটকে পড়া একটি লোকাল বাসের কোনো এক নোংরা-ভাঙা সিটে, যেখানে এইমাত্র পাশে এসে বসা লোকটার গুঁতোই আপনার কল্পনার সমাপ্তি ঘটার কারণ। ‘অবাক ভালবাসা’ গানটি শুনতে শুনতে এমন কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। গানটির মোহসৃষ্টিকারী সুর ও লিরিকস্ আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘অবাক ভালবাসা’-এর টাইটেল ট্র্যাক এটি। গানটি গীতিকার ও সুরকার ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের সেসময়ের বেইজিস্ট মেহমুদ জাগলুর করিম, যিনি বাবনা করিম নামে বেশি পরিচিত। গানটি তারই গাওয়া।
টিউন
বাবনা অধিকাংশ সময়ই প্রথমে টিউন তৈরি করেন পরে এর উপর লিরিকস্ বা গানের কথা লেখেন। টিউনের ভাবাবেগ অনুসারে গানের কথা লেখা হয় তার। অবাক ভালবাসা গানটিও একইভাবে তৈরি হয়েছে। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে গানটি কম্পোজ করার সময় বাবনা বুয়েটের ছাত্র ছিলেন। গানটির টিউন তৈরি হয় কিছু কর্ড নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে। লেখাপড়া নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলেন এবং গিটার বাজানোর জন্য খুব কমই অবসর পেতেন তিনি। এমনকি, তিনি যে গিটারটি বাজাতেন সেটিও ছিল তার বন্ধুর। খুব স্বল্প এক অবসরে তৈরি হয় টিউনটি।
গানটির প্রাথমিক টিউন তৈরির পর তার বন্ধু শুভ এবং তার ভাই সুজনকে শোনান তিনি। তখন এটি ছিল শুধুই একটি টিউন ও সম্ভাব্য গানের কথার ধারণা। তাদের এ টিউনটি ভাল লেগেছিল এবং এটি যেভাবে তৈরি হচ্ছিল তা নিয়ে উৎসাহিত ছিলেন বাবনা।
লিরিকস্ যেভাবে লেখা হলো
১৭ জন বন্ধু মিলে বুয়েট থেকে কক্সবাজার যাচ্ছিলেন, বাবনা যাবেন নাকি যাবেন না এ নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। এমন সময়ে বন্ধু শুভর কথায় যেতে রাজি হয়ে গেলেন। তার গিটার নেয়ার ব্যাপারে বেশ আপত্তি ছিলো, তাই বন্ধু শুভ একটি গিটার জোগাড় করে সাথে নিয়ে নেন। সেদিন শুভ সাথে গিটার নিয়েছিলেন বলে বাবনা এখনও বিষয়টি মনে করে আনন্দ বোধ করেন। এ গিটারটি না নিলে হয়ত ‘অবাক ভালবাসা’ সৃষ্টি হতো না।
বিকেলে তারা কক্সবাজার পৌঁছে টিএন্ডটি রেস্টহাউসে উঠেন, যা ছিল পাহাড়ের উপরে এবং ঠিক সমুদ্রের সামনে। বিকেল হয়ে গিয়েছিল যখন তারা সেখানে পৌঁছান। সামান্য বিশ্রাম ও খাওয়ার পর শেষ বিকেলে অন্যরা সমুদ্র সৈকতে যান, বাবনার ইচ্ছা থাকলেও তিনি যাননি। তখন সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছিল এবং তার মনে হয়েছিল তখন তিনি ঐ টিউনটির উপর লিরিকস্ না লিখলে চরম ভুল হবে। তাই তিনি শুভর গিটারটি নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেন। সেখান থেকে সৈকতে তার বন্ধুদের দেখছিলেন আর দেখছিলেন সূর্যাস্ত।
ঢেউয়ের মাঝে সূর্যের রক্তিম প্রতিফলন ও মনোরম শ্বেত বালিরাশি তার মধ্যে এক প্রবল আবেগ সৃষ্টি করেছিল। সেই স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, “আমি এখনও সমদ্রের গর্জন শুনতে পাই ও ঐ সময়ের স্তব্ধতা অনুভব করতে পারি। বিশাল কোনো কিছুর সামনে গেলে যে মানুষের অনুভূতি হয় তখন তেমনই অনুভূতি হয়েছিল। মনে হয়েছিল যেন সকল সৃজনশীল সত্ত্বা উন্মোচিত হচ্ছে।” তিনি গিটার বাজাতে বাজাতে ও গুনগুন করতে শুরু করায় শব্দগুলো যেন আপনাআপনি চলে আসে। সূর্যাস্ত নাগাদ তার লিরিকস্ লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় তিনি বন্ধু শুভকে নিয়ে ছাদে যান। সমুদ্রপাড়ের বাতাস আর রাতের সৌর্ন্দয মিলিয়ে পরিবেশটা ছিল অন্যরকম আবেগঘন।
প্রেক্ষাপট
বাবনার ভাই তান্নার মৃত্যু তার পরিবারের সকলের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। এ ঘটনার ফলে জগৎ এবং জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সান্ত্বনার জন্য তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং ওয়ারফেইজ থেকে সাময়িক বিরতি নেন। তার মনে অনেক প্রশ্ন এসেছিল কিন্তু খুব অল্প কিছুরই উত্তর ছিল তার কাছে। সে সময় তার অনুভূতিগুলো টিউনে এবং চিন্তাগুলোকে লিরিকস্-এ প্রকাশ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, “এগুলো নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এগুলো ছিল স্বতঃস্ফুর্ত অনুভূতির প্রকাশ। ওয়ারফেইজের সাথে এসব কম্পোজিশন নিয়ে আলোচনা ছিল আকস্মিক। এটি ঘটে যখন ওয়ারফেইজ তাদের প্রথম অ্যালবামের কথা ভাবছিল।”
গানটি যা বলে
গানটির প্রথম অংশ এমন এক সময়ের কথা বলে যখন আপনি বিশাল কোনো কিছুর সম্মুখীন হন, যা আপনাকে, আপনার অনুভূতিকে পরিপূর্ণ করে এবং তখন আপনি চাইবেন না কোনো কিছুই আপনাকে বিক্ষিপ্ত করুক।
“সব আলো নিভে যাক আঁধারে
শুধু জেগে থাক ঐ দূরের তারারা
সব শব্দ থেমে যাক নিস্তব্ধতায়
শুধু জেগে থাক এই সাগর
আমার পাশে”
এমন তীব্র অনুভূতির মুহূর্তে, বেঁচে থাকা আসলে কী তা উপলব্ধি করা যায়। বেঁচে থাকা এমন একটি অসাধারণ উপহার যার বিনিময়ে আমাদের কিছুই দিতে হয় না। কৃতজ্ঞতার এ অনুভূতি আত্মার সব অভিযোগ ও কষ্টকে ছাপিয়ে যায়। অনুভূতিগুলো কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই অসীম সময় ও স্থান দখল করে অবস্থান করে আত্মার গভীরে। আপনি এসব চিন্তা করে বিস্ময়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন যখন মুহূর্তের মধ্যে সময়ের অনন্ত প্রবাহ থেমে যায়। হঠাৎ আপনার দম ফুরিয়ে আসে এবং শ্বাস নেয়ার কথা মনে পড়ে আর ঠিক তখনই পুরো ক্লাইমেক্স/দৃশ্যপটটি বদলে যায়। সেই মুহূর্তে, চারপাশে ঈশ্বর আমাদের জন্য যা তৈরি করেছেন তার কথা ভেবে চোখে জল আসাটা স্বাভাবিক।
“শুভ্র বালুর সৈকতে
এলোমেলো বাতাসে গিটার হাতে
নিস্তব্ধতা চৌচির
উন্মাদ ঝংকারে কাঁদি অবাক সুখের কান্না
যেন চুনি হিরা পান্না
সাগরের বুকে
আলপনা এঁকে দিয়ে যায়
অবাক ভালবাসায়
অবাক ভালবাসায় “
এটি জীবনকে ভালবাসার গান। আমাদের অস্তিত্ব যে একটি উপহার, সেই অস্তিত্বকে ভালবাসার গান এটি। গানটির সুর ও কথার গভীরতা এমনই যে তা শ্রোতাকে সেই পরিবেশে নিয়ে যাবে যে পরিবেশে এটি লেখা হয়েছিল। সনিক ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাবনা করিম এ কথাগুলো বলেন। তিনি শ্রোতাদের আহ্বান জানান কোনো এক রাতে সেই টিএন্ডটি গেস্ট হাউজের ছাদে গিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে গানটি শুনতে।
রেকর্ডিং
রাসেল আলী যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসেন ওয়ারফেইজের দ্বিতীয় অ্যালবামের কাজ করতে। তখন বাবনা ব্যস্ত ছিলেন লেখাপড়া নিয়ে। ফলে বেশি সময় দিতে পারেননি। টিপু ও রাসেল মিলেই অধিকাংশ কাজ করেন। বাবনা, রাসেলকে তার চিন্তা ও গানের কর্ড প্রগ্রেশন বুঝিয়ে দেয়ার অল্প সময়ের মধ্যে রাসেল পিয়ানো পিচটি তৈরি করেন। গানটির রেকর্ডিং হয় সারগাম স্টুডিওতে। রাসেল এতে গিটার সলো বাজিয়েছিলেন। কয়েকবার টেক দেয়ার পর গানটির আবেগ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। স্থান পরিবর্তন করে সারগাম মগবাজারে এলে তারা গানটির বাকি কাজ করতে এসে দেখেন গিটার সলোটি ভুলক্রমে ইরেজ (মুছে) হয়ে গেছে। এতে তারা বেশ কষ্ট পান। পুনরায় রাসেলকে সলো বাজাতে হয়েছিলো। কয়েকবার টেক দেয়ার পর এটি আগের সলোটির কাছাকাছি হলেও আর হুবহু আগেরটির মতো হয়নি।
অবাক ভালবাসা গানটি ১৯৯৪ সালে প্রথম শ্রোতারা শুনলেও এ প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছে গানটি তুলে ধরা হয় ‘পথ চলা’ অ্যালবামের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এ অ্যালবামটি ছিল মূলত ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের জনপ্রিয় গানগুলোর সংকলন। মূল সুর অপরিবর্তিত রেখে নতুনভাবে রেকর্ড করা হয় গানগুলো, যেটি অবাক ভালবাসা’র ক্ষেত্রেও হয়। কিন্তু ৮:৩৭ সেকেন্ডের অবাক ভালবাসা-এর নতুন ভার্সন (সংস্করণ) করা হয় ৭:২১ সেকেন্ডের।
পুরোনো ভার্সনটির ইন্ট্রোতে ছিল ১:৫০ সেকেন্ডের গিটার সলো যা শেষ হতো সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার শব্দ আর চিলের চিৎকারে। নতুন ভার্সনটিতে কোনো গিটার সলো রাখা হয়নি। যারা এর পুরোনো ভার্সনটির সাথে বেশি পরিচিত তাদের হয়ত নতুনটি একটু বেমানান লাগবে, কেননা গিটার সলোটি ছিল এ গানের অন্যতম আকর্ষণ যা শ্রোতাদের এক মোহে আচ্ছন্ন করতো। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, নতুন ভার্সনটির রেকর্ডিং এর মান পুরনোটির চেয়ে বেশি উন্নত।
ফিচার ইমেজ- Compiled