১৭৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক মঙ্গলবার। মারওয়ার রাজ্যের মন্ত্রী গিরিধার ভাণ্ডারী খেজরলি গ্রামে এসে ঘোষণা দিলেন, রাজপ্রাসাদের নির্মাণকাজের জন্য কাটা হবে গ্রামের কিছু গাছ। গ্রামটি ছিলো বিশনয়ী সম্প্রদায় অধ্যুষিত, যাদের কাছে প্রাণ-প্রকৃতি ঈশ্বরের মতোই পবিত্র। মন্ত্রীর ঘোষণার বিরুদ্ধে সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন সে গ্রামেরই অমৃতা দেবী বিশনয়ী। প্রথমে ঘুষ দিয়ে তাকে মানানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। অমৃতা আপোস করেননি তাতেও। উপায় না পেয়ে সৈন্য-সামন্ত দিয়ে বলপূর্বক গাছ কাটারই সিদ্ধান্ত নিলেন মন্ত্রী। সেদিন গাছকে বুকে জড়িয়ে অমৃতা দেবী দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন,
“সার সন্ঠে রুখ জায়ে, তো ভি সাস্তো জান।”
যার ভাবার্থ, একটি মাথার বিনিময়ে হলেও যদি একটি গাছ বাঁচানো যায়, তবে তা-ই সই। ফলস্বরূপ সৈন্যের কুড়োলকে গাছের স্পর্শ পাবার আগে পার করতে হলো অমৃতার গর্দান! মায়ের দেখাদেখি একইভাবে প্রাণ দেয় তিন কন্যা অসু, ভগু আর রত্নি। খবর শুনে আশপাশের ৮৩টি গ্রাম থেকে ছুটে আসে অর্ধ-সহস্র বিশনয়ী। তারা ঠিক করলো, প্রতিটি গাছের জন্য তারা একজন করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে। অমৃতা দেবীর দেখানো পথে বিশনয়ী সম্প্রদায়ের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা তখন একটি করে গাছ জড়িয়ে ধরেন, আর একটি একটি করে ছিন্ন শির লুটিয়ে পড়তে থাকে থর মরুর বুকে। একদিনে সেদিন প্রাণ গিয়েছিলো ৩৬৩ জন বিশনয়ীর।
রাজা অভয় সিং এ ঘটনা জানতে পেরে অত্যন্ত মর্মাহত হন। গিরিধার ভাণ্ডারী তখন রাজাকে বোঝান, “এসব বিশনয়ীদের আদিখ্যেতা। বেছে বেছে তারা কেবল বুড়োদের মরতে পাঠিয়েছে, যারা ওদের আর কোনো কাজে আসত না!” বিশনয়ী সম্প্রদায়ের তরুণ পুরুষ, নারী ও শিশুরা এসব দেখে উল্টো সিদ্ধান্ত নিলো, বড়দের এই আত্মত্যাগের আদর্শকে তারাও নিজেদের পাথেয় করবে। ওদিকে মারওয়াররাজ অভয় সিংও ঠিক করলেন, যত যা-ই হোক, অন্তত বিশনয়ীদের গ্রাম থেকে কোনোদিন কোনো গাছ কাটা হবে না।
ইতিহাসের মহাফেজখানায় ‘বিশনয়ী’ লেখা নথিটিতে খেজরলি গ্রামের অধ্যায়টির পাতায় বিস্মৃতির ধুলো জমলেও একটি দৃষ্টান্ত কিন্তু এখনও টাটকা। ১৯৯৮ সালে ‘হাম তুম সাথ সাথ হ্যায়’ সিনেমার শ্যুটিং করতে রাজস্থান রাজ্যের যোধপুরের কনকানি গ্রামে গিয়েছিলেন সালমান খান, সাইফ আলী খান, টাবু, সোনালি বেন্দ্রের মতো বলিউড তারকারা। বনভোজনের আয়েশের ফাঁকে বন্দুকের নিশানা একটু পরখ না করলেই হচ্ছিলো না তাদের! শিকারি সালমানের গুলিতে সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলো একাধিক বিরল কৃষ্ণসার ও চিঙ্কারা হরিণ। সেই ঘটনার জেরে আজও যে আইনীভাবে নাজেহাল হচ্ছেন পরাক্রমশালী তারকা সালমান, এর কারণ কী? উত্তর- বিশনয়ী। সালমানরা সেদিন বোঝেননি, সিংহীর গুহায় ঢুকে তার বাচ্চাকে মেরে দিলে সিংহী কখনোই ছেড়ে কথা বলবে না! হ্যাঁ, বলিউড তারকাদের এই বন্দুকবিলাসের বিরুদ্ধে সেদিন মামলা ঠুকেছিলো কনকানি গ্রামের বিশনয়ী সম্প্রদায়ের লোকেরাই।
এতক্ষণের ইতিহাস চর্চায় একটি প্রশ্নই ঘুরেফিরে সামনে আসে- কারা এই বিশনয়ী? পশ্চিম রাজস্থানের বিস্তীর্ণ থরের বুকে বহু বছর ধরে বাস করছেন এ সম্প্রদায়ের মানুষ। ধর্মীয় দিক থেকে বিশনয়ীরা সনাতন ধর্মের বৈষ্ণব ধারাভূক্ত হলেও এদের আছে আলাদা দর্শন। তারা বিশ্বাস করে, প্রতিটি জীবন্ত জিনিসের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। প্রাণ আর প্রকৃতিকে রক্ষা করাই তাদের কাছে পরম ধর্ম। পরিবেশ আর প্রতিবেশের সাথে সুস্থ সহাবস্থান জিইয়ে রেখে কীভাবে চরম প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে হয়, সেই দীক্ষাই দেয় বিশনয়ীদের দর্শন। আর বিশনয়ীরা ‘বিশেষ’, কেননা দর্শনকে তারা কেবল লাল-নীল-সবুজ কাপড়ে মুড়িয়ে রেখে দেয়নি, সেটিকে তারা আক্ষরিকভাবে হৃদয় দিয়েই পালন করে।
গুরু জম্ভেশ্বরকে বলা হয় এ সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক গুরু। আজ থেকে সাড়ে পাঁচশ বছর আগে তার জন্ম হয়েছিলো ক্ষত্রিয় রাজপুত পরিবারে। ৮ থেকে ৩৪ বছর বয়স অবধি তিনি রাখালের কাজ করতেন। বর্ণগত দিক থেকে কোথায় তার যুদ্ধ করবার কথা, প্রাণের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখাবার কথা, তার বদলে কি না জম্ভেশ্বরের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো প্রকৃতি ও প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা! ১৪৮৫ সালে সমর্থল ধোরা গ্রামে জম্ভেশ্বর এক নতুন দর্শনের প্রচার আরম্ভ করেন। গ্রামটি বর্তমান রাজস্থানের বার্মার জেলায় অবস্থিত।
গুরু জম্ভেশ্বরের সে দর্শন লিপিবদ্ধ হয়েছিলো ১২০ শব্দে, ‘শবদবাণী’ নামে। নাগরী লিপিতে লেখা সে অনুশাসনে ধারা ছিলো ২৯টি। ধারাগুলোর মাত্র পাঁচটি ছিলো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন সম্পর্কিত। বাকিগুলোয় কখনো নীতিশাস্ত্রের ঢঙে বলা হয়েছে- মিথ্যা বলো না, চুরি করো না, লোভী-কামুক বা ছিদ্রান্বেষী হয়ো না, ক্ষমাশীল ও দয়ালু হও ইত্যাদি। আবার কখনো স্বাস্থ্যপ্রচারণার ন্যায় বলা হয়েছে- ফুটিয়ে দুধ-পানি পান করো, সূর্য ওঠার আগে রোজ একবার স্নান করো, প্রসবের পর একমাস মা ও শিশুকে গৃহস্থালীর কাজ থেকে দূরে রাখো, মদ-গাঁজা-তামাক খেয়ো না ইত্যাদি। আর বাকি ধারাগুলো যেন কথা বলছে অনেকটা কট্টর-পরিবেশবাদীদের সুরে।
টেকসই উন্নয়ন আর পরিবেশবাদী আন্দোলনের সমর্থকেরা গাছের গুরুত্ব অনুধাবন করলেও গাছ কাটাকে পুরো উপেক্ষাও করতে পারেন না, তারা বরং ভাবেন কীভাবে গাছ কাটার সেই ফলাফল সর্বোচ্চ প্রশমিত করা যায়। অন্যদিকে পরিবেশ ও গাছের অকৃত্রিম বন্ধু বিশনয়ীরা এত জটিলতায় যায় না। তারা গৃহস্থালীর কাজে লাগায় কেবল কুড়িয়ে পাওয়া শুকনো পাতা, মরা ডাল-কাণ্ড এবং আগুন জ্বালাতে ব্যবহার করে নারকেলের ছোবড়া আর গোবর। শবদবাণীর ১৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সবুজ কোনো গাছ কাটা তাদের জন্য অধর্ম! গাছ না কাটতে বা জ্বালানীর অপচয় রুখতে তাই হিন্দু হয়েও বিশনয়ীরা শবদেহ পোড়ায় না, বরং কবর দেয়।
মরু এলাকার মাটি ধুলোময় ও অনেকটাই আলগা। ল্যু হাওয়া থেকে সেগুলোকে বাঁচাতে কিছুটা স্থিতি দেওয়া প্রয়োজন। বিশনয়ীরা তাই যেখানে-সেখানে তৈরি করে গুল্মের ঝাড়। এতে শুধু মাটিই সুরক্ষা পায় না, বরং দুর্ভিক্ষকালে বিশনয়ীদের গবাদিপশুরাও পায় শুকনো-খাবার। কৃষ্ণসার ও চিঙ্কারা হরিণদের তেষ্টা মেটাতে তারা নিজেদের ক্ষেতের মাঝেই কুয়ো বানিয়ে রাখে। বিলুপ্তপ্রায় কৃষ্ণসার হরিণের টিকে থাকতে চাই সবুজ পাতা। প্রকৃতিবন্ধু বিশনয়ীদের জন্যই প্রবল পানিশূন্যতা সত্ত্বেও রাজস্থানের মরুবুকে সবুজ পাতার অভাবে কোনো কৃষ্ণসারমৃগকে মরতে হয় না! পাখিদের বাসস্থান তৈরিতে ক্ষেতের মাঝে নির্দিষ্ট দূরত্বে উঁচু গাছও লাগায় এরা। এমনকি মাতৃহীন পশুশাবকদের নিজের বুকের দুধ খাওয়ায় বিশনয়ীরা।
শবদবাণী অনুযায়ী, পশুহত্যা নিষিদ্ধ এবং বিশনয়ীদের হতে হবে নিপাট নিরামিষভোজী। এমনকি বেওয়ারিশ পশুদেরকে হত্যার হাত থেকে বাঁচাতে আশ্রয় দেওয়া বিশনয়ীদের অবশ্য-কর্তব্য। ষাঁড় বা পাঠার অণ্ডচ্ছেদও নিষিদ্ধ এ দর্শনে। বেগুনি-নীল বর্ণের পোশাক পরিধানও বিশনয়ীদের জন্য মানা, কেননা পোশাকের জন্য এই রঞ্জক তৈরিতে কাটা পড়ে নীলগাছের সতেজ ঝাঁড়। ছনের তৈরি ‘ধানি’ নামক ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকে তারা। বাড়ির মধ্যকার উঠানটি থাকে অবিশ্বাস্য রকমের পরিচ্ছন্ন, অথচ এর পাশেই থাকে গোয়ালঘর। পরিচ্ছন্নতাই সম্ভবত তাদের সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য বৈশিষ্ট্য।
ভগবান বিষ্ণুর উপাসক হিসেবে অনেকে এ সম্প্রদায়কে ‘বিষ্ণয়ী’ও বলে থাকেন। তবে বিশনয়ীরা যতটা না বৈষ্ণব, তার চেয়ে বেশি জম্ভেশ্বর ওরফে জম্ভোজির ২৯ ধারার অনুসারী। আর ঊনত্রিশের অন্তভুক্ত বিশ ও নয়কে বাংলার মতো রাজস্থানি ভাষাতেও বলা হয় ‘বিশ-নয়’। তাই শবদবাণীর ২৯ ধারার অনুসারীদের পরিচিতিও হয়েছে বিশনয়ী। ‘জম্ভোজি’ অবশ্য কেবল রাজস্থানেই পড়ে থাকতে চাননি। বার্মার, বিকানির, যোধপুর ছাড়িয়ে তাই তিনি পুরো ভারতেই ৫১ বছর প্রচার করেছিলেন নিজের দর্শন। ফলে রাজস্থানের বাইরে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও মধ্য প্রদেশেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশনয়ী রয়েছেন। এমনকি উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডেও অল্প কিছু বিশনয়ীর দেখা মেলে। বর্তমানে এদের মোট সংখ্যা আট থেকে দশ লাখ।
মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ ভাবধারাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলো বিশনয়ীরা। আর খেজরলি ও সত্যাগ্রহের আদর্শ বুকে নিয়েই পুঞ্জীভূত হয়েছিলো ভারতের সত্তর-আশির দশকের বিখ্যাত পরিবেশবাদী ‘চিপকো আন্দোলন’। পরিবেশের বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের ধ্বজাধারীরা আশাব্যঞ্জক কিছু করে দেখাতে না পারলেও ‘পুরনো’ বিশনয়ীরা ঠিকই নীরবে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের। পরিবেশের ক্ষতি না করেও যে টিকে থাকা যায়, সভ্যভাবেই বাঁচা যায়, বিশনয়ীরাই তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। যোধপুর থেকে ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণের খেজরলি গ্রামে গিয়ে প্রকৃতির অকৃতজ্ঞ সন্তান হিসেবে একদিন নিজ থেকেই পরিচিত হয়ে আসতে পারেন প্রকৃতির কৃতজ্ঞ এই সন্তানদের জীবনধারার সাথে!