মৃত্যুর কারণে প্রিয়জন হারানোর বেদনা কখনোই ভোলার না। সময়ের সাথে সাথে সেই অনুভূতি ঝাপসা হয় মাত্র, কিন্তু কখনোই মুছে যায় না। মৃত ব্যক্তি যত কাছেরই হোক না কেন, মৃত্যুর পরপরই তার দেহের সৎকারের ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়ে ওঠে সবাই। আমাদের সমাজে আমরা মূলত মৃতদেহকে কবর দিতে কিংবা শ্মশানে চিতায় পোড়াতে দেখি। তবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মৃতদেহ সৎকারের এমন সব অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত আছে বা ছিলো, যেগুলো সম্পর্কে জানলে গা ঘিনঘিন করা থেকে শুরু করে পুরো সমাজ ব্যবস্থার উপর রাগও উঠে যেতে পারে আপনার। বিচিত্র সেসব সংস্কৃতির কাহিনী দিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
আকাশ-সমাহীতকরণ
নামটা দেখে যে কেউই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবতে পারেন, “আকাশে তো মাটিও নাই, আগুনও নাই। তাইলে সেইখানে আবার মৃতদেহের সৎকার হয় কেমনে?” আসলে নামের মতো মৃতদেহ সৎকারের এ পদ্ধতিটি বেশ অদ্ভুত এবং একইসাথে বেশ গা ঘিনঘিনেও বটে।
এ প্রথাটির চর্চা করা হয় তিব্বতে। তিব্বতী ভাষায় এ প্রথাটির নাম ‘ঝাটর’, যার অর্থ পাখিদের খাদ্য দেয়া। সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে মৃতদেহটিকে প্রথমে পাহাড়ের উপরে দেহ সৎকারের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে থাকা সন্নাসীরা এরপর কাপড় সরিয়ে কুড়াল দিয়ে দেহটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেন! তারপর সেখানে উড়ে আসে শকুনের মতো মাংশাসী পাখিরা। তারা এসে মৃতদেহটিকে সাবাড় করে দিয়ে যায়। শকুনেরা তো শুধু মাংস খেয়েই উড়ে যায়, থেকে যায় মৃতদেহের হাড়গুলো। সেগুলোকে এরপর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুড়ো গুড়ো করে ফেলা হয়। হাড়ের চূর্ণকে এরপর ময়দার সাথে মিশিয়ে অন্যান্য ছোট পাখিদের খাওয়ানো হয়। আকাশ থেকে উড়ে আসা প্রাণীদের সাহায্যে এ সৎকারের কাজ করা হয় বলেই এর এরুপ নামকরণ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে, মৃতদেহ সৎকারের বিচিত্র এ পদ্ধতির শুরু হয়েছিলো দ্বাদশ শতকের কাছাকাছি সময়ে।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রথা
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা মৃতদেহ সৎকারের বেলায় অবশ্য আমাদের জানাশোনা সবই করে থাকে। কবর দেয়া, আগুনে পোড়ানো, মমিতে পরিণত করা, এমনকি মৃতদেহ খেয়ে ফেলার প্রথাও আছে তাদের মাঝে।
দেশটির উত্তরাঞ্চলে আরেকদল আদিবাসী আছে যারা এত ঝামেলায় যেতে চায় না। প্রথমে মৃতদেহটিকে এক উঁচু, খোলা জায়গায় রেখে আসে তারা। গাছের শাখা-প্রশাখা দিয়ে ঢেকে দেয়া দেহটির মাংস পচে যেতে সময় লাগে মাসখানেক। কয়েক মাস পর তারা সেখানে গিয়ে হাড়গুলো নিয়ে আসে এবং সেগুলোকে লাল রঙ দিয়ে সাজায়। তারপর সেই লালরঙা হাড়গুলো কোনো গুহায় কিংবা গাছের ফাঁপা গুঁড়িতে রেখে আসা হয়। কখনো আবার মৃতের আত্মীয়রা সেই হাড়গুলো প্রায় এক বছর সময় ধরে নিজেদের সাথেই নিয়ে ঘুরে বেড়ান!
বসে থাকা মৃতদেহ
কেউ মারা গেলে, সে যত আপনজনই হোক না কেন, তার মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করতে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঘন্টাখানেক পর তাই আমরা নিজেদের আবিষ্কার করি খুব একা হিসেবে। কারণ পছন্দের মানুষটি হয় তখন শুয়ে আছে মাটির নিচে কিংবা পরিণত হয়ে গেছে ভস্মে।
তবে ফিলিপাইনের ইফুগাও অঞ্চলের মানুষেরা ভুলেও এসবের ধার ধারে না। বরং কেউ মারা গেলে তারা মৃতদেহটিকে তার বাড়ির সামনে চেয়ারে বসিয়ে রাখে! হাত-পা-মাথা বেঁধে রাখা হয় যাতে সদ্য মৃত সেই ব্যক্তি পড়ে না যান। ঠিক যেন বাড়ির উঠোনে লোকেরা কাজ করছে, আর চেয়ারে বসে থেকে কেউ সেই কাজগুলোর তদারক করছে। এভাবে দেহটি রেখে দেয়া হয় আট দিন পর্যন্ত। এই আট দিনে তার আত্মীয়-স্বজনেরা মৃতদেহকে ঘিরে নানা আচার-অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। শোক প্রকাশ, হাসি-ঠাট্টা, পার্টি, অ্যালকোহল পানে মেতে ওঠা- এ সবই চলে আসরের মাঝখানে সেই দেহটিকে রেখেই।
মৃতব্যক্তির স্যুপ
এ পদ্ধতির নাম পড়ে যে কারোরই চোখ কুঁচকে যেতে বাধ্য। অবশ্য আপনি যা ভাবছেন, অর্থাৎ মৃতদেহকে সিদ্ধ করে তারপরে তার স্যুপ খাওয়া, তেমন কিছু না ঘটলেও এর কাছাকাছি ঘটনাই ঘটিয়ে থাকে ভেনেজুয়েলার ঘন বনাঞ্চলে বাস করা ইয়ানোমামি গোত্রের লোকেরা।
কেউ মারা গেলে তার দেহটিকে গ্রাম থেকে বেশ দূরের এক জায়গায় নিয়ে যায় তারা। সেখানে নিয়ে দেহটিকে প্রথমে চিতায় পোড়ানো হয়। এরপর অবশেষ হিসেবে থেকে যাওয়া হাড়-ছাইগুলো একত্রিত করে বিশেষ কন্টেইনারে করে সেগুলো গ্রামে নিয়ে আসে তারা। এরপরই যেন শুরু হয় মৃতদেহ সৎকারের মূল আনুষ্ঠানিকতা।
মৃতের হাড়গুলো চূর্ণ করা হয় প্রথমে। এরপর একটি পাত্রে কলা নিয়ে তা সিদ্ধ করা হয়। কলা সিদ্ধর মাঝেই এরপর মিশিয়ে দেয়া হয় সেই হাড়চূর্ণ ও ছাই। মৃতের আত্মীয়েরা এরপর সেগুলো মজা করেই সাবাড় করে দেয়! একে মৃতের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশের উপায় হিসেবেই মনে করে তারা।
সতীদাহ
সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে কম-বেশি জানা আছে আমাদের সবারই। এ প্রথার ফলে সদ্য বিধবা হওয়া স্ত্রীকেও তার স্বামীর সাথে চিতার আগুনে যেতে হতো। পার্থক্য হলো- স্বামী যেতেন মৃত্যুর পর, আর স্ত্রীকে যেতে হতো জীবিতাবস্থায়।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গায়ে আগুন লাগার পর সদ্য বিধবা সেই নারী স্বাভাবিক মানব প্রবৃত্তি অনুযায়ী নিজেকে বাঁচাতে সেখান থেকে পালাতে চাইতেন। আর এটা যাতে তিনি না করতে পারেন সেজন্য সেখানে বাঁশ নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতেন কেউ কেউ। বিধবা সেই নারী উঠতে চাইলেই আঘাত দিয়ে তাকে আবার আগুনে ফেলে দেয়া হতো। কখনো কখনো আবার সরাসরি হাত-পা বেঁধেই আগুনে নিক্ষেপ করা হতো সেই দুর্ভাগাকে। আঠারো শতকের এক বিধবার কথা জানা যায় যিনি এসব বাধা পেরিয়ে কোনোক্রমে পাশের নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরের আগুন নিভিয়েছিলেন। এতে করে ক্ষিপ্ত জনতা তাকে ধরে এনে প্রথমেই পা দুটো ও পরে হাত দুটো ভেঙে দিয়েছিলো যাতে করে তিনি আর পালাবার দুঃসাহস করতে না পারেন। এরপর তাকে আবারো আগুনে নিক্ষেপ করা হয়।
১৮২৯ সালের ডিসেম্বর ৪-এ বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতিদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এসময় বেঙ্গলের গভর্ণর ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক। অবশ্য এ আইনী কার্যক্রম গৃহীত হয় মূলতঃ রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই। বিভিন্ন গোড়া সমাজে এরপরেও এটা চলতে থাকে। তাই ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় এবং ১৯৮১ সালে তৃতীয়বারের মতো অমানবিক এ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারতীয় সরকার।
ভাইকিংদের নৃশংস প্রথা
আজ মৃতদের সৎকারের যতগুলো প্রথা আলোচনা করা হলো, তার মাঝে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জঘন্য ছিলো ভাইকিংদের প্রথাটি। ‘ছিলো’ বললাম, কারণ এখন এটি কেবলই ইতিহাস, দুঃখের এক ইতিহাস।
ভাইকিংদের কোনো গোষ্ঠীপতি মারা গেলে প্রথম পর্বে তার মৃতদেহটি দশদিনের জন্য এক অস্থায়ী কবরে রাখা হতো। এ সময়ের মাঝে তার জন্য নতুন কাপড় বানানো হতো। একইসাথে তার কোনো ক্রীতদাসীকে তার সাথে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত করা হতে থাকতো। এ সময় তাকে রাত-দিন পাহারার মাঝে রাখা হতো এবং প্রচুর পরিমাণে উত্তেজক পানীয় পান করানো হতো।
এরপর যখন সৎকারের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো, তখন দুর্ভাগা সেই মেয়েটি একের পর এক গ্রামের সব তাবুতেই যেতে বাধ্য হতো। সেসব তাবুর পুরুষেরা তার সাথে মিলিত হতো আর বলতো, “তোমার মনিবকে বলো যে, এটা তার প্রতি আমার ভালোবাসা থেকেই করলাম”! সবগুলো তাবু ঘোরা শেষে মেয়েটি যেত আরেকটি তাবুতে যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করতো ছয়জন ভাইকিং পুরুষ। তারাও তার সাথে মিলিত হতো। এরপরই দড়ি দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে দুর্ভাগা সেই মেয়েটিকে মেরে ফেলা হতো। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেই গোত্রেরই মহিলা প্রধান তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতেন।
এরপর? এরপর সেই মেয়ে আর তার মনিবের মৃতদেহ একই কাঠের নৌকায় তুলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হতো সেখানে। এটি করা হতো যাতে পরকালে গিয়ে মেয়েটি তার মনিবের ঠিকঠাক সেবা-যত্ন করে সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতেই।