ভারতীয় উপমহাদেশীয়রা জন্মগতভাবেই সংস্কৃতিপ্রেমী। তবে এ উপমহাদেশীয়রা বেশিরভাগই ক্ল্যাসিক্যাল নাচ বা উপমহাদেশীর ধাঁচের নাচের সাথে পরিচিত। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেয়া বা চর্চা চালু থাকা সত্ত্বেও মহাসাগরের ওপার থেকে আসা পশ্চিমা হিপহপ সংস্কৃতি বেশ দ্রুতই আমাদের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিচ্ছে। বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মকে পশ্চিমা হিপহপ কালচারের নিত্যনতুন সব ধারণা গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। আজকাল বিভিন্ন নাচের প্রতিযোগিতা বা প্রদর্শনীতে হিপহপ নাচের জনপ্রিয়তা দেখলেই তা সহজে অনুমান করে নেয়া যায়।
হিপহপ কালচারের আইডিয়াটি মূলত স্ট্রিট ড্যান্স থেকে উদ্ভূত। বিটের সাথে সাথে ফাংকি ধরনের স্ট্রিট ড্যান্সকেই মূলত হিপহপ ড্যান্সের মূল উৎস হিসেবে ধরা হয়। তবে পশ্চিমা বিশ্বে যখন হিপহপ নাচের উত্থান, তখন এই ড্যান্স স্টাইলের কোনো নির্দিষ্ট ব্যাকরণিক নিয়ম ছিলো না বিধায় বিভিন্ন স্ট্রিট ড্যান্সাররা তাদের নিজেদের মতো করে হিপহপ ড্যান্স চর্চা করতেন। ফলে ধীরে ধীরে হিপহপ ড্যান্সে অনেক ধরনের স্টাইলের উদ্ভব হয়েছে। তবে আজ আমরা আজ হিপহপ ড্যান্সের অন্যতম জনপ্রিয় একটি স্টাইল পপিং নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
হিপহপ কালচার বেশ অনেক বছর ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে চললেও পপ ড্যান্স কালচারটি খুব বেশি পুরনো কোনো ধারণা না। পপ ড্যান্স মূলত ষাটের দশকের পর উৎপত্তি হয়। তখনকার সময় থেকেই বিভিন্ন স্ট্রিট ড্যান্সাররা রোবটিক্স ড্যান্স ও পপ ফ্লেভারের নাচের চর্চা করতেন। মূলত কয়েক ধরনের নাচের স্টাইল একসাথে নিয়ে একটি মিশ্র ধরনের নাচ চর্চা করা হতো সে সময়টায়। তখন পর্যন্ত পপিং সম্পূর্ণ নতুন ড্যান্স স্টাইল হিসেবে চর্চা শুরু হয়নি। তবে, ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম স্যাম সলোমন নামক একজন ড্যান্সার পপ ড্যান্স কালচারটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন। স্যাম মূলত বুগালো ড্যান্স ও পপিং এই দুটি স্টাইলকে একসাথে করে ‘ইলেক্ট্রিক বুগালো’ নামে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। সেই কারণে হিপহপ ড্যান্সের জগতে তিনি বুগালো স্যাম নামেই পরিচিত। আর এই স্যামকেই ধরে নেয়া হয় পপ ড্যান্সের প্রবর্তক হিসেবে।
পপ ড্যান্স প্রথাগত নাচের মতো না। পপিংয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে শরীরের পেশী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নাচা। মিউজিকের বিটের তালে তালে হঠাৎ পেশীগুলোকে ‘স্টিফ’ করে ফেলা, আবার পরমুহূর্তে স্বাভাবিক করে ফেলার মাধ্যমে শরীরে যে ঝাঁকুনি হয়, সেটার একধরনের অভিনব উপস্থাপনাই পপিংয়ের মূল পদ্ধতি। যত কম সময়ের মাঝে পেশীতে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার তা স্বাভাবিক করে ফেলা যাবে, পপ নাচের মুভগুলো দর্শকদের কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মূলত ‘জার্কিং’য়ের মাধ্যমে শরীরের নির্দিষ্ট কোনো অংশকে আলাদাভাবে নাড়িয়ে তুলে শরীরের বিভিন্ন অংশে একটি ঢেউয়ের মতো তৈরি করাই পপ ড্যান্সের মূল কৌশল।
পপ ড্যান্সে বিশেষ কিছু ধরনের অঙ্গভঙ্গি একসাথে ব্যবহার করে নাচকে সম্পূর্ণ করা হয়। এ বিশেষ ভঙ্গিমাগুলো নিয়ে সাধারণ কিছু নিয়ম জেনে নেয়া যাক।
টিকিং
টিকিং মূলত পপিংয়ের প্রাথমিক দিককার মুভমেন্টের মধ্যে ধরা হয়ে থাকে। টিকিং করার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন- বুক, বাইসেপস, ট্রাইসেপস, পা ইত্যাদি পেশী আচমকা শক্ত করে ঝাঁকুনি তৈরি করে পরমুহূর্তে আবার শিথিল করে দেয়া হয়। টিকিংয়ের সময় শরীরের পেশীগুলোর প্রতিটি অংশে আলাদাভাবে মনোযোগ দিতে হয়। একজন পপার যখন নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গের টিকিং করে, তখন সেই অঙ্গটি বাদে শরীরের বাকি অংশগুলো মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক থাকে। সুতরাং, এতে মনযোগ দেয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
স্ট্রাটিং
সান ফ্রান্সিস্কো স্টাইল পপিংয়ের অন্যতম একটি স্টাইল হচ্ছে স্ট্রাটিং। এর মূল বিশেষত্ব হচ্ছে এটি মূলত পার্টি ড্যান্স আর রেগুলার পপিংয়ের একটি মিশ্র ড্যান্স, যা অনেকটা নতুন ধরনের একটি ড্যান্স ফ্লেভার তৈরি করে। পপিং অনেকক্ষেত্রেই একা করা হয়ে থাকলেও স্ট্রাটিং মূলত গ্রুপ ড্যান্সে বেশি ব্যবহার করা হয়। সকল ক্রু মেম্বাররা একসাথে যখন কিছু স্টাইলে সংগঠিতভাবে পারফর্ম করে, তখন সেটা দর্শকদের কাছে দেখতে আরো ভালো দেখায়।
ওয়েভিং
শরীরের অংশগুলো ধারাবাহিকভাবে একে একে নাড়িয়ে ঢেউয়ের মতো তৈরি করাকে ওয়েভিং বলে। পপ ড্যান্সে যেহেতু খুব সূক্ষ্ম মুভমেন্ট বেশি ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে বডি ওয়েভিং বেশ চোখে পড়ার মতো একটি স্টেপ। মূলত হ্যান্ড ফ্লো, আর্ম ওয়েভ, চেস্ট ওয়েভসহ বেশ কিছু ওয়েভিং দেখা যায় পপ ড্যান্সে।
গ্লাইডিং
গ্লাইডিং মূলত একধরনের ফুটওয়ার্ক। পায়ের তালুর উপর স্লাইড করে জায়গা পরিবর্তন করাকে গ্লাইডিং বলে। অন্য সব হিপহপ নাচের মতো পপিং এতটা বিস্তৃত জায়গাজুড়ে সাধারণত করতে হয় না, তুলনামূলক কম জায়গায় দাঁড়িয়েও করা যায়। সেই কারণে মাঝে মাঝে যদি ড্যান্সার জায়গা পরিবর্তন করতে চায়, তাহলে বিভিন্ন ফুটওয়ার্ক বা গ্লাইডের মাধ্যমে জায়গা পরিবর্তন করে থাকে।
এনিমেশন
এনিমেশন বলতে বিশেষ কোনো কিছুর নকল করাকে বোঝায়। রোবটিক ড্যান্সে যেমন বডি স্ট্রেইট রেখে বিভিন্ন মুভ করা হয়, আবার বিভিন্ন প্রাণীর আচার-আচরণ নকল করেও ড্যান্সাররা বিভিন্নভাবে নেচে থাকেন। এনিমেশন মূলত নাচে ভিন্ন একটি ফ্লেভার যোগ করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
স্কেয়ার ক্রো
ইংরেজি এই শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কাকতাড়ুয়া’। অনেকটা কাকতাড়ুয়ার মতো দুই পাশে দুটি হাত ঝুলিয়ে সেভাবেই পারফর্ম করার পদ্ধতিকে স্কেয়ার ক্রো পপিং বলে। মূলত কাকতাড়ুয়ারা একই ভঙ্গিমায় স্থির থাকলেও পপাররা এক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাকতাড়ুয়ার দাঁড়ানোর স্টাইল নকল করে নিজেরা ক্রমাগত স্টেপ পরিবর্তন করে থাকেন।
পপ বা ব্রেকিং হিপহপ নাচের একটি চমৎকার ট্রেন্ড হচ্ছে এ ধরনের নাচের প্রতিযোগিতাগুলো অনেকটা ‘চ্যালেঞ্জিং দ্য অপোনেন্ট’ ধরনের হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার সময় দুটি ক্রুর মেম্বাররা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। তারপর প্রতি ক্রু থেকে এক বা একাধিক পপার সামনে এসে নিজেদের স্টাইলে পপিং করে। তারপর তারা পিছিয়ে যাওয়ার পর অন্য ক্রুর ড্যান্সাররা একইভাবে এগিয়ে এসে পপিং করে। যেহেতু পপিংয়ে শুরু থেকেই এই ধরনের হেড টু হেড ব্যাটলের প্রচলন চলে আসছে, তাই এই কয়েক দশক ধরেই ড্যান্সাররা তাদের নাচকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য মৌলিক কিছু মুভমেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছে, যাতে খুব সহজেই প্রতিপক্ষের ক্রু মেম্বারদের থেকে অধিকতর মৌলিক ও বৈচিত্র্যময়তার সাথে ড্যান্স করা যায়। ফলে পপ ড্যান্সে নিয়মিতই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সব স্টাইল।
বাংলাদেশে বর্তমানে ড্যান্স ক্যাটাগরি হিসেবে পপিং বেশ জনপ্রিয় হলেও প্রফেশনাল লেভেলে পপিংয়ের চর্চা বা প্রতিযোগিতা খুব কম হয়। হিপহপ ড্যান্স করে এমন কিছু বাংলাদেশী ড্যান্স ক্রু (অ্যানোনিমাস ক্রু, ব্লু পপার্স) ব্রেক ড্যান্সের পাশাপাশি পপিংয়ের চর্চাও করে থাকে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে সর্বপ্রথম অ্যানোনিমাস ক্রুর সদস্যরা ‘দ্য সাইফার’ নামে একটি হিপহপ ড্যান্স প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলো। চর্চা কম থাকলেও ড্যান্সপ্রেমীদের আগ্রহ ও পছন্দের বিচারে পপিং এখনো বেশ ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে।