বলা হয়, যারা শিল্প ভালোবাসে, তাদের একটি নয়, দুটি মাতৃভূমি থাকে। প্রথমটি হচ্ছে তার জন্মস্থান, অন্যটি হচ্ছে প্যারিস। এই প্রবাদ থেকে শিল্প-সংস্কৃতিতে ফ্রান্সের উৎকর্ষ সহজেই অনুমান করা যায়।
আসলে শিল্পের ইতিহাসে ফ্রান্সের স্থান নিয়ে প্রশ্ন করাই একরকম বোকামী। ইউরোপ ও আমেরিকার যেকোনো দেশের শিল্পমনস্ক মানুষ তাদের মনের তৃষ্ণা মেটাতে ফ্রান্সে ছুটে আসেন। ঘুরে বেড়ান দেশটির বিভিন্ন মিউজিয়াম ও শিল্পের জন্য বিখ্যাত অন্য সব স্থানে। এমনকি ফ্রান্সকে প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু মনে করা দেশও শিল্পে ফ্রান্সের স্থান নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। শুধু ইউরোপ বা আমেরিকা নয়, ফ্রান্স সারা বিশ্বের শিল্পী ও ভাবুকদের জন্য এক অনন্য তীর্থস্থান।
ফ্রান্সে ক্রঁজ ও বুঁজ নদীর মোহনার উবুসোঁ অঞ্চল অবস্থিত। বাহারী শৈল্পিক বুনন কৌশলে প্রকৃতি, মানুষ, প্রাণী ও অন্যান্য অপরূপ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার অনবদ্য ‘ট্যাপেস্ট্রি’ ঐতিহ্যের জন্য এ অঞ্চল বিশেষ প্রসিদ্ধ। দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাধারণ জিনিসও মানুষের স্বাভাবিক অন্তর্দৃষ্টি ও সৌন্দর্যের বোধের কারণে কতটা অসাধারণ ও নান্দনিক হয়ে উঠতে পারে, ‘উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রি’ তার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
সৌন্দর্যের উদাহরণ হিসেবে ‘উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রি’ যেমন অতুলনীয়, তেমনি এর শুরু ও বিস্তার সম্পর্কে জনমনে ইতিহাসের চেয়ে পৌরাণিক ধারণাও কম নয়। তবে এর ইতিহাস অস্বচ্ছ নয়। আনুমানিক ১৪৫৭ সালে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। নিকটবর্তী শহর ফেলেতিন বুনন শিল্পের জন্য আগে থেকেই সমৃদ্ধ ছিলো। ষোড়শ শতকে বন্য দৃশ্য ও কাল্পনিক প্রাণীর ছবি সম্বলিত ট্যাপেস্ট্রি প্রথম শুরু হয়। সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় সাহিত্যে আবেগধর্মী উপন্যাস সাফল্যের সাথে নিজের জায়গা করে নেয়। ‘উবুসোঁ’ অঞ্চলের চিত্রশিল্পীরা সাহিত্যের এই সাফল্য ট্যাপেস্ট্রি শিল্পে সার্থকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। সাহিত্যের বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্র এ সময় এই শিল্পে মূর্ত হয়ে উঠেছিলো।
‘উবুসোঁ’র এই শৈল্পিক প্রয়াস রাজপরিবারের বিশেষ সুনজরে আসে। ১৬৬৫ সালে এ অঞ্চলের ট্যাপেস্ট্রি তৈরির কারিগরিকে ‘রয়েল ম্যানুফ্যাকচার অব ট্যাপেস্ট্রিস’ খেতাব দেওয়া হয়। অন্যান্য অনেক অঞ্চলে এই কারিগরি প্রসারিত হয়েছিলো। অষ্টাদশ শতকে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর এই ট্যাপেস্ট্রি শিল্প কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছিলো। রাজকীয় শিল্পী জ্যাঁ জোসেফ দুঁমো এই লোকশিল্পের সাথে নিজস্ব শিল্পবোধ ও অন্তর্দৃষ্টি মিলিয়ে প্যারিসের অভিজাত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ঐতিহ্য ও উদ্ভাবনের এই সুন্দর মিলন ‘উবুসোঁ’ ট্যাপেস্ট্রিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা প্রদান করে। রাজকীয় অনুগ্রহে স্থানীয় গ্রাম্য কারিগর ও শিল্পীদের এই বুননশৈলী বিভিন্ন প্রদর্শনে উৎসুক মানুষের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পের বিভিন্ন আঙ্গিক ও কৌশল সার্থকভাবে এতে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছিলো।
১৮৮৪ সালে ‘উবুসোঁ’ অঞ্চলে ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ডেকোরেটিভ আর্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপের বাণিজ্যে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছিলো। ১৯১৭ সালে এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আন্তোনিও মারিয়াস মার্তিনি ট্যাপেস্ট্রি শিল্পকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করার উদ্যোগ নেন। তৎকালীন ইউরোপের আধুনিক শিল্প আন্দোলন পোস্ট-ইম্প্রেশনিজমের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে এই শিল্পকে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্তর থেকে আধুনিক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে আসেন। ইউরোপে সুররিয়ালিজম আন্দোলনের অন্যতম শিল্পী জ্যাঁ লুরকাত এতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের সংবেদন নিয়ে আসেন।
তারপর থেকে চিত্রশিল্পের বিভিন্ন ধারা ও আন্দোলনের অনেক দিক নিয়ে এই শিল্পে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। রেনেসাঁ ও রিফর্মেশনের সময়কার চিত্রশিল্পের সংবেদন পার হয়ে ‘উবুসোঁ’ ট্যাপেস্ট্রিতে অনেকরকম নিরীক্ষাধর্মী কাজ করা হয়েছে। ক্লদ মোনে, ভ্যান গগ, এদ্গার দেগা, এডভার্ড মুংক, ম্যাক্সট আর্নস্ট, সালভাদর দালি প্রমুখ কালজয়ী শিল্পীর আঁকা ছবি নিয়ে এই শিল্পের অসাধারণ সব আধুনিক নিদর্শন তৈরি করা হয়েছে। এমনকি ভারত, চীন ও জাপানের ঐতিহ্যবাহী চিত্রশিল্পের নিদর্শনও ‘উবুসোঁ’ ট্যাপেস্ট্রির শিল্পের খোরাক হওয়া থেকে বাদ থাকেনি। আজ অবধি এ ট্যাপেস্ট্রি শিল্প বিশ্বের মনন ও ঐতিহ্যপ্রিয় মানুষের কাছে রীতিমতো এক বিস্ময়।
ট্যাপেস্ট্রি মূলত বুনন শিল্প হওয়াতে এর প্রাণশক্তি হচ্ছে উল। বাছাই করা উলের কাপড় থেকে শ্রেষ্ঠ কাপড়গুলো এর জন্য নির্বাচন করা হয়। তারপর বিভিন্ন উপায়ে কাপড়গুলোকে ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। তারপর ডিজাইনের চাহিদানুযায়ী এগুলোকে ছোট অথবা বড় বিভিন্ন আকার দেওয়া হয়। এরপর আসে কাপড় ডাই করার পালা। উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রি শিল্পীরা আধুনিক শিল্পকারখানা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে কাপড় ডাই করে থাকেন। এতে কোনো রকম মেশিন ব্যবহার করা হয় না। এর বদলে তারা নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে প্রয়োজনীয় রং কাপড়ে মিশিয়ে থাকেন। এই শিল্পীরা সাধারণত বংশপরম্পরায় এই পেশা নিয়ে থাকেন, সুতরাং রং মেশানোর প্রক্রিয়ায় হাতের ব্যবহার সাধারণত একেবারে নির্ভুলভাবেই হয়ে থাকে।
রং করার পর আসে অন্য শিল্পীদের পালা। কাপড়ে ছবি ফুটিয়ে তোলার শিল্পীরা স্থানীয় ভাষায় ‘কার্টুনিস্ট’ হিসেবে পরিচিত। তাদের এই শিল্পের প্রাণ বললে অত্যুক্তি হবে না। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে আর্টের বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে একজন দক্ষ বুনন শিল্পীর উপযোগী করে তোলা। সেলাইয়ের কৌশল ও সঠিক স্থানে সঠিক রঙের সূক্ষ্ম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গ্রাফিক কোডের কাছাকাছি একরকম নকশা ব্যবহার করা হয়। রঙের ক্রম ঠিক রাখার জন্য সংখ্যার ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার একটি সুনির্দিষ্ট ও নির্ভুল স্থান নির্দেশ করে। এসব কাজ শেষ হলে ‘কার্টুনিস্ট’ সেলাই শিল্পীকে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রি শিল্পে আর্টিস্ট ও বুনন শিল্পীর সম্পর্ক বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। স্থানীয় ফরাসিদের মতে, আর্টিস্ট ও বুনন শিল্পীর মানসিক সম্পর্ক ট্যাপেস্ট্রির প্রধান উপাদান। ইতিহাসে দেখা যায়, এই ঐতিহ্য প্রাচীন কারিগরি দক্ষতা ও একজন দক্ষ শিল্পীর চিন্তাধারা- এ দুই ধারার সুন্দর সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে। আর্টিস্ট তৈরি করেন এর প্রাথমিক ও গভীর সৌকর্যের প্রাথমিক প্রক্রিয়ার দৃষ্টান্ত। আর কারিগর চির পরিচিত বুননশৈলীর দক্ষতায় তৈরি করেন শিল্পীর কল্পনা ও বোধের একেবারে বাস্তব রূপ। সুতরাং আর্টিস্ট ও কারিগরের মানসিক ও মানবিক বোঝাপড়া শুধু এ শিল্পের অঙ্গই নয়- এ শিল্পের প্রাণ বলা চলে। আধুনিক যুগের বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসো এই কালজয়ী শিল্প সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেছেন।
এই কালজয়ী শিল্পকে যুগ যুগ ধরে রাখতে ফরাসি সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ট্যাপেস্ট্রি শিল্পের জন্য বিভিন্ন ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা। এসব ওয়ার্কশপে আগ্রহী আর্টিস্ট ও বুননশিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনার ব্যবস্থা থাকে। এমনই একটি ওয়ার্কশপ হচ্ছে ‘সাইতি ইন্তারন্যাশনালেঁ দ্য লা তাপিসেঁরি’। উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রির ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসকে বর্তমানে সাফল্যের সাথে সচল রাখতে এই প্রতিষ্ঠানে বুনন ও নকশার পাশাপাশি শিল্পকলার ইতিহাস, ফ্রান্সে ট্যাপেস্ট্রির উদ্ভব ও বিকাশ, রসায়ন, বিদেশী ভাষা, অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে এ প্রতিষ্ঠানের কলাকুশলীরা ট্যাপেস্ট্রি শিল্পে নিজ নিজ দক্ষতা ও নান্দনিক বোধের প্রতিফলন ঘটিয়ে বিশ্বের মানুষের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা কুড়াতে সক্ষম হন।
১৯৮১ সালে উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। একইসাথে স্থাপিত হয় ট্যাপেস্ট্রি বিষয়ে গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ। এই ট্যাপেস্ট্রি মিউজিয়ামে ধারাবাহিক চিত্রের মতো এই শিল্পের উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার চোখে পড়ে। আর আলোচিত গ্রন্থাগারটি এই শিল্পের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত খুটিনাটি বিষয়ের যাবতীয় বিবর্তন মুদ্রিত আকারে সংরক্ষিত আছে। ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পরসিক ও পর্যটকরা এই শিল্প সম্পর্কে জানতে প্রায়ই এখানে এসে থাকেন। একে ইউরোপের সমকালীন লোকশিল্পীদের অন্যতম তীর্থস্থান বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না।
২০০৯ সালে ইউনেস্কো উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রিকে ‘ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভূষিত করে। অনেক আগে থেকেই ফ্রান্স শিল্পীদের মাতৃভূমি হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে। অনেকে বলে থাকেন, শিল্পে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সার্থক ছোঁয়াতেই অপার্থিব সৌন্দর্য তৈরি হয়ে থাকে। তার এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী উদাহরণ হচ্ছে উবুসোঁ ট্যাপেস্ট্রি।