বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ এবং অসম্ভব জনপ্রিয় কবিতা ‘বনলতা সেন’। জীবনানন্দ দাশের এই অমর সৃষ্টির অনুপ্রেরণা নিয়ে তর্ক বিতর্কের অভাব নেই, কাকে ঘিরে এই চরিত্রের অবতারণা। তবে ব্যাপারটি শুধু বনলতা সেনকে নিয়েই নয়। সাহিত্য কিংবা চিত্রকলার বিখ্যাত এমন অনেক চরিত্রই আছে যাদের নিয়ে মানুষের মনে দুরন্ত কৌতূহল বাসা বেঁধেছে, কল্পনার ডালপালা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দিকে। সুদূর ইউরোপে ভিঞ্চির মোনালিসা, শেক্সপিয়রের ডার্ক লেডি’কে মানুষ যেভাবে খুঁজে বেরিয়েছে ঠিক সেভাবেই আমাদের বাংলা সাহিত্যের বনলতা সেনকেও খুঁজেছে মানুষ।
বনলতা সেন নামে কেউ ছিলেন কিনা, না থাকলে কবি কাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই কবিতা লিখেছেন তা নিয়ে আছে বিস্তর আলোচনা। কবিতার পরতে পরতে রেখে যাওয়া ‘চাবিকাঠি’ বিশ্লেষণ করে বনলতা সেনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন অনেকেই।
সেই বিখ্যাত কবিতা
বনলতা সেন কবিতাটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে কবি জীবনানন্দ দাশের আট নম্বর খাতায়, বিচার বিশ্লেষণে ধরা হয়েছে কবিতাটি ১৯৩৪ সালে রচিত। ১৯৪২ সালে জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা ভবন’ থেকে।
জীবনানন্দের জীবনজুড়ে সজনীকান্ত দাস নামে তার এক বিখ্যাত সমালোচক ছিলেন। বনলতা সেন ছাপা হওয়ার পরে সজনীকান্ত ‘শনিবারের চিঠি’তে জীবনান্দের বিরুদ্ধে আবার কলম ধরলেন এভাবে, “এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণ এক একজন ভদ্রমহিলার নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক আর উৎসাহিত করিয়া তোলা।”
সেই বিখ্যাত কবিতাটির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক তাহলে।
হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
কবিতার ব্যাখ্যা
জীবনানন্দের কবিতার ব্যাখ্যা নিয়ে তার জীবিত থাকাকালেই ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে অনেক। একদল তার কবিতা নিয়ে করেছেন হাসি তামাশা আরেকদল করেছেন অতি প্রশংসা। অতি প্রশংসাকারীরা জীবনানন্দের কবিতাকে ছাঁচের মধ্যে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে কয়েকটি অতি সাধারণ ধারণা দাঁড়িয়েছে। এর একটি হলো, জীবনানন্দের কবিতার কৃতিত্ব তার বাণীর মহিমায় নয় বরং এর রচনা শৈলী আর চিত্ররূপময়তায়। তার কবিতা নিয়ে অভিযোগ আছে এতে কোনো দর্শন নেই কেবল রূপক আর উপমার ছটা। তাই জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে কেউ মন্তব্য করেছেন, “পৌষের চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রির মতো তার কাব্য কুহেলি কুহকে আচ্ছন্ন।”
কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে জীবনানন্দ নিয়ে গবেষণা হয়েছে, তার কবিতা নিয়ে ধারণা বদলে যাচ্ছে। কবিতার প্রতিটি শব্দ আর বাক্যের ভেতরে যে নিগুঢ় ইঙ্গিত আছে তা খুঁজে বের করছেন গবেষকরা। জীবনানন্দ যেমন নিখুঁত ভাস্করের মতো পাথর কেটে অপরূপ সুন্দর মূর্তি নির্মাণ করেছেন ঠিক সেভাবে গবেষকেরা তার মূর্তিকে কাঁটাছেড়া করে এর পেছনের সত্য উদঘাটনে নেমেছিলেন।
বনলতা সেন কবিতায় এক নায়ক কিংবা পথিকের হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হাঁটার কথা বলা হচ্ছে, সেই হাঁটার অতি সাধারণ ব্যাখ্যা ছিল হাজার বছর ধরে প্রেমিকরূপী এক পথিক তার প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কবিতায় একটু পরেই আবার বলা হচ্ছে ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’। প্রেমের পথে হেঁটে ক্লান্ত কেন প্রেমিক?
তাই ব্যাখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রেমিক নয় বরং এক জন্ম জন্মান্তরের পথে ঘুরে বেড়ানো এক ক্লান্ত মানুষ। সেই ক্লান্ত মানুষের যাত্রা নিশীথের অন্ধকারে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে। কিন্তু ভূগোল বাধিয়েছে বিপত্তি, সিংহল সমুদ্র কিংবা মালয় সাগর নামে কোনো সাগর কিংবা উপসাগরের অত্বিত্ব মানচিত্রে নেই। তবে সিংহল নামে একটি দ্বীপ আর মালয় উপদ্বীপের অস্তিত্ব আছে। তাই ধারণা করে নেওয়া হয়েছে কবি ঐ এলাকার আশেপাশের সামুদ্রিক এলাকাকেই বুঝিয়েছেন।
পথ হাঁটার কথা যেহেতু বলেছেন সেহেতু এর তটরেখা ধরেই হাঁটতে হবে, আর সেই তটরেখা ভীষণরকমের সর্পিল আর বিপদসংকুল। ঠিক আমাদের জীবনের পদে পদে আমরা যেমন বিপদসংকুল পথ পাড়ি দেই, তার রূপায়ন করেছেন কবি তার কবিতায়। আর জীবনের পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে আমরা খোঁজ করি শান্তির, নির্বাণের।
বনলতাকে খুঁজে পাওয়া আসলেই অনেক কঠিন করে দিয়েছেন কবি। কবিতার প্রতিটি অনুচ্ছেদে ‘অন্ধকার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বনলতার সাথেও কবির দেখা হয় অন্ধকারেই। কোনো কোনো গবেষক বলেছেন, এই অন্ধকার নিজেকেই চিনতে না পারার অন্ধকার। নির্বাণ বা মুক্তি লাভের আগপর্যন্ত এই অন্ধকার থেকে মুক্তি নেই। অনেকেই এই কবিতায় বৌদ্ধ দর্শনের বেশ প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। তাই এই অন্ধকারকে নিজে চিনতে না পারার কিংবা পাপের অন্ধকার হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বনলতা সেন কবিতায় দুই প্রাচীন প্রভাবশালী রাজার নাম পাওয়া যায়। এদের একজন মগধের অধিপতি বিম্বিসার আরেকজন মৌর্য সম্রাট অশোক। দুইজনই জীবদ্দশায় বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। একজন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে হয়েছিলেন পাপের শিকার, অন্যজন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে।
বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুর ছিল বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ। তাই সিংহাসন দখল করে বাবা বিম্বিসারকে কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দেন। সেখানে অনাহারে মারা যায় বিম্বিসার। অন্যদিকে নিজের লোভ আর লালসায় কাবু হয়ে অশোক যুদ্ধ বাঁধিয়েছিলেন। কিন্তু ‘কলিঙ্গ’ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে পাষণ্ড অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তাই একদিকে পাপের শিকার বিম্বিসার অন্যদিকে অনুতপ্ত পাপী অশোককে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তার কবিতায়। বনলতা সেন কবিতার ব্যাখ্যায় দীর্ঘদিন এই দুই রাজার নামকে প্রাচীনযুগের নিদর্শন হিসেবে নেওয়া হতো। এর গভীরে যে পাপবোধ আর গ্লানির ইতিহাস চাপা পড়ে আছে সেটি অবহেলিতই ছিল।
কবিতার আরো গভীরে এসেছে দু’দণ্ড শান্তির কথা, দু’দণ্ডের শান্তি দিয়ে কবি হয়তো এক ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কের কথা নির্দেশ করেছেন। এরপর বনলতার চুলের সৌন্দর্যের উপমা দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’। বিদিশার নিশা কি শুধুই বনলতার চুলের সৌন্দর্যের উপমায় ব্যবহার করা হয়েছে? নাকি এরও গুঢ় অর্থ রয়েছে?
কালিদাসের মেঘদূত-এ আছে এই প্রশ্নের উত্তর। খুব ছোটবেলা থেকেই কালীদাসের রচনাবলি পড়া শুরু করেছিলেন জীবনানন্দ। আর একটু তলিয়ে দেখলেি জানা যায় মেঘদূতে প্রাচীন ভারতের এই বিদিশা নগরীকে উপস্থাপন করা হয়েছে সকল পাপাচারের কেন্দ্র হিসেবে। পেশাদার পতিতাদের আশ্রয়স্থল হিসেবেও এই নগরীকে দেখানো হয়েছে মেঘদূতে।
তবে বনলতা নামটির উৎস কোথায় তা নিয়ে কবিকে জীবদ্দশায় প্রশ্ন করেছিলেন অশোক মিত্র। জীবনানন্দ তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, ১৯৩২ সালের আশেপাশে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘বনলতা সেন’ নামে এক বন্দীর খবর ছাপা হয়েছিল, সেই খবরটি তিনি পড়েছিলেন, নামটিও সেখান থেকেই।
বনলতার নামের সাথে কবিতায় একটি শহরের নাম উতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেটি হল নাটোর। এমনকি কবি নিজে ‘বনলতা সেন’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদে ‘Banalata Sen of Natore’ লিখেছেন।
তবে উত্তরবঙ্গের এই শহরে কবি কখনো গিয়েছিলেন তার সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় না। দিনলিপিতে না থাকলেও হয়তো ঘুরেও আসতে পারেন কোনো কালে। নাটোর শহরের আশেপাশে বড় বড় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘকাল ধরে এই শহরটি ছিল পতিতাদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।
আর কবিতায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে বনলতা দেখেছেন অন্ধকারে, পাশাপাশি দিয়েছেন দুদণ্ডের শান্তি। এইসব চাবিকাঠিকে একত্রিত করে কোনো কোনো বিশ্লেষক বনলতা সেনকে ভাগ্যের সাথে লড়াইয়ে পরাজিত এক দেহপসারিনী হিসেবেই দেখিয়েছেন। বনলতা সেন কবিতায় জীবনানন্দের ব্যবহৃত বেশিরভাগ উপমাই পাপাচারের দিকে নির্দেশ করছে, নিশ্চয় কবি কাকতালীয়ভাবে এগুলোকে একত্র করেননি। এমনকি কবির দিনলিপি ঘেঁটে তার পতিতালয়ে যাবার বর্ণনাও পাওয়া যায় যদিও সেটি দিল্লীতে, নাটোরে নয়।
কবিতার একটি লাইনে আছে ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’। এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলছেন কবিতার নায়ককে বনলতা আগে থেকেই চিনতেন, দীর্ঘ বিরতিতে দেখা হয়েছে তাই প্রশ্ন করছে এতদিন কোথায় ছিলেন। তবে অন্য অনেকেই ব্যাখ্যা করেছেন, এই প্রশ্নের মাধ্যমে বনলতা নায়কের প্রেম প্রত্যাখ্যান করছেন। কারণ নায়ক বনলতা সেনের জীবনের আসার আগেই এমন অপ্রীতিকর কিছু ঘটে গেছে, যার ফলে তার প্রেম গ্রহণ করা আর সম্ভব নয়, শুধুমাত্রই দু’দণ্ড শান্তিই ভরসা। তাই দুঃখ আর প্রত্যাখানের সুর মিশে আছে এই প্রশ্নে। হয়তো সেই ভালবাসার নায়কের সাথে আরো আগে দেখা হলে এই পথে আসার দরকার হত না বনলতার। তবে কবি বনলতার চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’। এই উপমায় চোখের সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি তুলে ধরা হয়েছে বনলতার চোখে দেখা ভালোবাসা আর আশ্রয়ের আশ্বাসের কথা।
কবিতার শেষ কয়েক লাইনে দেখা যায় পাখিদের নীড়ে ফেরার কথা, জীবনের সব লেনদেন ফুরিয়ে আসার কথা। বনলতা সেন কবিতার নায়কেরও হয়তো ঘর আছে, সব লেনদেন মিটিয়ে তাড়া আছে ঘরে ফিরে যাবার। কিন্তু ঘরে ফিরে গেলে কি বনলতা সেন থেকে তার মুক্তি মিলবে, নাকি এই সল্পসময়ের এক অভূতপূর্ব ভালোবাসা চিরজীবন তাড়া করে বেড়াবে নায়ককে।
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন
অন্ধকারে দুদণ্ড শান্তি দেওয়া বনলতা সেন চিরকাল নায়কের হৃদয় অধিকার করে রেখেছে, জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধনে জুড়ে আছে সেই প্রেম। তাই বনলতা সেনকে কেউ পতিতা বলে আখ্যা দিয়েছেন, কেউ বলেছেন এর বাস্তব ভিত্তি নেই, এটি শুধুই একটি আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব, যার চোখে প্রেম ছিল কিন্তু দুইজন দুইজনকে কাছে চেয়েছিল কিন্তু পাওয়া হয়ে উঠেনি।
কেউ কেউ এই কবিতাকে কবির জীবনের প্রেমিকা শোভনার সাথে তুলনা দিয়েছেন। জীবনানন্দের অল্পবয়সী খুড়তুতো বোন শোভনা এবং জীবনানন্দ দুজনেই দুজনকে ভালোবাসতেন। তবে সামাজিক বাঁধার কথা মাথায় রেখে এই সম্পর্ক কোনো পরিণতি পায়নি। তবে বাকিটা জীবন কবিও শোভনাকে ভুলতে পারেননি, পারিবারিক জীবনেও খুব একটা সুখী হতে পারেননি তিনি। তাই সব লেনদেন শেষ করে ক্লান্ত হয়ে কবিতার নায়কের মতোই নীড়ে ফিরে গেলেও প্রতিটি অন্ধকারই হয়তো বনলতা সেনের কথা মনে করিয়ে দেয় কবিকে বারবার। সেই বনলতা সেন কারো চোখে পতিতা, কারো চোখে না পাওয়া প্রেমিকা।