তুরস্কের উরফা শহরের লোকালয় থেকে ৬ মাইল দূরে অতি প্রাচীন এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস শ্মিট। ১৯৯৪ সালে যখন তিনি গোবেকলি তেপে নামক নিদর্শনটি আবিষ্কার করেন, তখন তিনি জানতেন না যে তিনি ২০ শতকের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতত্ত্বটি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সময় যত গড়িয়েছে, প্রত্নতত্ত্বটি নিয়ে তত গবেষণা হয়েছে এবং সেটির গুরুত্ব ও প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে বিস্ময়কর সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন স্টোনহেঞ্জের চেয়েও ৬ হাজার বছর পুরনো এই গোবেকলি তেপে! তেপের একেকটি বড় বাঁকানো পাথরগুলোর বয়স ১১ হাজার বছরেরও বেশি! প্রাগৈতিহাসিককালে নির্মিত এই পাথুরে স্থাপনা সম্বন্ধে আজ জানাবো।
গোবেকলি তেপে, পৃথিবীর প্রাচীনতম মন্দির বলা হয় যাকে, নির্মিত হয়েছিল আনুমানিক ৯৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অর্থাৎ, আমরা যে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটির কথা বলছি, সেটি নির্মিত হয়েছিল প্রস্তরযুগেই, সুমেরে লিখিত বর্ণমালা আবিষ্কৃত হতে তখনো ৬ হাজার বছর বাকি, তখনো কৃষিকাজ শুরু করেছে পৃথিবীর অল্প সংখ্যক স্থানের খুব অল্প কিছু মানুষ! আমরা এমন একটি স্থাপনা নিয়ে কথা বলছি, যেটি নির্মাণ করেছিল গুহাবাসী মানুষেরা, যারা পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো, ব্যবহার করতো পাথরের অস্ত্র। এতটাই প্রাচীন এই গোবেকলি তেপে।
১৯৬০ সালে প্রাথমিকভাবে আবিষ্কৃত হয় গোবেকলি তেপে। সেবছর তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী একটি গবেষণা কাজের জন্য উরফার লোকালয়ের বাইরে অবস্থিত ছোট ছোট পাহাড়গুলোয় জরিপ কাজে ভ্রমণ করে। তারা সেখানে একটি ভাঙা চুনাপাথরের ফলক দেখতে পায়। প্রথমে কৌতূহল জাগলেও শেষে তারা এই সিদ্ধান্তে আসে যে সেখানে নিশ্চয়ই কোনো মধ্যযুগীয় সমাধি আছে, এর বেশি কিছু নয়। শিক্ষার্থীরা এই ফলকটির কথা কেবল তাদের গবেষণায় সংক্ষেপে উল্লেখ করে। এটিকে তারা কোনোপ্রকার গুরুত্বই দেয়নি। আর তাতে গোবেকলি তেপের পুনর্জন্ম আরো কিছুকাল পিছিয়ে যায়।
১৯৯৪ সালে গোবেকলি তেপের প্রতি নতুন করে আকৃষ্ট হন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস শ্মিট। তিনি ১৯৬০ সালে করা সেই গবেষণাটি পড়তে গিয়ে গোবেকলি তেপের সম্বন্ধে জানতে পেরে উরফা ভ্রমণ করেন। ফলকের কাছে পৌঁছুতেই তিনি যেন দৈবক্রমে জেনে যান, তার পায়ের নিচে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু লুকিয়ে আছে। ব্যস, গোবেকলি তেপের পুনর্জন্মের কাজ সেদিনই শুরু হয়ে যায়। শ্মিট সেই স্থানটিতে পূর্ণোদ্যমে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেন। যেখানে তার তুরস্ক যাবারই কথা ছিল না, সেখানে ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি এখনো পর্যন্ত গোবেকলি তেপে নিয়ে কাজ করে চলেছেন তুরস্কের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে। তার এই উদ্যম বিন্দুমাত্র বৃথা যায়নি। কেননা রেডিওকার্বন পরীক্ষায় জানা গেছে, গোবেকলি তেপে নির্মিত হয়েছিল ১১,৫০০ বছর আগে।
গোবেকলি তেপের চেয়েও প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু, গোবেকলি তেপের চেয়ে প্রাচীন উপাসনালয় আর একটিও নেই। খনন পুরোপুরি সম্পন্ন হবার পর প্রত্নতত্ত্বিকগণ অন্তত এটিই মনে করছেন যে এটি একটি মন্দির হিসেবেই বানানো হয়েছিল। রান্নার ব্যবস্থা, শয়নস্থান, আবর্জনা ফেলবার ব্যবস্থা কিংবা নালা, কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই এই গোবেকলি তেপেতে, যা ইঙ্গিত করে যে মূল স্থাপনায় কোনো মানুষের বসতি ছিল না। বরং, প্রবেশপথের ধরন দেখেও অনুমান করা যায়, মানুষ এখানে প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করতো। তবে, এই অনুমানের পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। স্থাপনাটি যখন নির্মিত হয়েছে, তখনো পৃথিবীতে শিকারী সমাজ অস্তিত্ববান ছিল এবং মানুষ যাযাবর জীবন যাপন করতো। সেক্ষেত্রে একই স্থানে দীর্ঘদিন বসবাস করার মতো কিছু তৈরিই করা হতো না।
গোবেকলি তেপে থেকে পাওয়া অসংখ্য পশুর কঙ্কাল বরং এর মন্দির হবার যুক্তিকে শক্ত করে। এটি উপাসনালয় ছিল বলেই এখানে পশু এনে বলি দেয়া হতো, এরকমটা ভাবা খুব বেশি অবাস্তব হবে না। এখানে নানাধরনের উৎসবও হতো, যার প্রমাণ মেলে তেপের বিশালাকারের সব কলস থেকে। পাথরের নির্মিত কলসগুলো এত বড় যে সেগুলোর মধ্যে অনায়াসে ১৫০ লিটার পানীয় রাখা যাবে! তবে নিশ্চিত না হলেও, প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা এই কলসগুলো মদ রাখার জন্যই ব্যবহৃত হতো, একেবারে প্রাথমিককালের মদ।
দূরদূরান্ত থেকে মানুষ গোবেকলি তেপেতে আসতো। শ্মিটের মতে, ইসরায়েল, এমনকি মিশর থেকেও মানুষ আসতো এই উপাসনালয় ভ্রমণে। শ্মিটের ধারণা সত্য হয়ে থাকলে গোবেকলি তেপের উপাসনালয় হবার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাচ্ছে। কেননা, প্রাচীন সে সময়ে মানুষ আনন্দ ভ্রমণের জন্য ১৫০০ কিলোমিটার দূরে যাবার কথা ভুলেও ভাবেনি। আর ভাববেই বা কেন, তখন তো আনন্দ ভ্রমণ বলতে কিছু ছিলই না! তাছাড়া, প্রাচীনকালে এরূপ দীর্ঘ ভ্রমণের একমাত্র কারণ ঈশ্বর ও ধর্ম সংক্রান্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তথাপি, এতকাল পূর্বের একটি স্থাপনা সম্বন্ধে কোনোকিছুই একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলা চলে না।
এদিকে গোবেকলি তেপের আবিষ্কার মানব সভ্যতার সূচনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে। আমরা এতকাল জেনে এসেছি, মানব সভ্যতার সূচনা হয়েছিল কৃষিকাজ শুরুর মাধ্যমে। কৃষিকাজের জন্য জমি চাষ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং শস্য সংরক্ষণের জন্য একইসাথে লোকবল এবং স্থায়িত্ব প্রয়োজন ছিল। এ কারণেই মানুষ তার কৃষিজমির নিকট সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করে। আর তা থেকেই সূচনা হয় সভ্যতার। কিন্তু গোবেকলি তেপের আবিষ্কার এ প্রসঙ্গে ভিন্ন কিছুই যেন বলছে। কৃষির সূচনার ৫০০ বছর আগেই (অন্তত তুরস্কের ঐ অঞ্চলে) গোবেকলি তেপে নির্মিত হয়েছে। এর বড় বড় পাথরের আকার এবং খোদাই দেখে ধারণা করা হয়, এটি নির্মাণে অন্তত ১০ বছর তো লেগেছেই। আর, শতাধিক মানুষের শ্রম ছাড়া এরকম একটি পাথুরে স্থাপনার নির্মাণকাজের কথা কল্পনাই করা যায় না। এর মানে দাঁড়ায়, কৃষিকাজ শুরুর পূর্বেই মানুষ একত্রে বসবাস করতে শুরু করে। ১০ বছর ধরে নিশ্চয়ই যাযাবররা এরকম একটি স্থাপনা নির্মাণ করবে না।
একনজরে গোবেকলি তেপে-
- আনুমানিক ৯,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গোবেকলি তেপে নির্মিত হয়। এর নির্মাণ শেষ হবার পর তুরস্কের উরফা অঞ্চলে (যা তখন এদেসা নামে পরিচিত ছিল) দ্রুত জনবসতি বাড়তে থাকে। এর আশেপাশে গড়ে ওঠে জনপদ। এই জনপদ দু’ হাজার বছরের মতো টিকে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দের কোনো এক সময় গোবেকলি তেপে পরিত্যক্ত হয়, বিলীন হয় একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদটিও।
- সাধারণত প্রাচীন স্থাপনাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আমরা তাদের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাই। কিন্তু গোবেকলি তেপে এর আদিরূপ প্রায় পুরোটাই ধরে রেখেছে! অবিশ্বাস মনে হলেও সত্য, হাজার হাজার বছরে গোবেকলি তেপের তেমন কোনো ক্ষয়ই হয়নি। আর এর কারণ হলো এর সংরক্ষণে নিয়োজিত মানুষগুলোর বুদ্ধিমত্তা। গোবেকলি তেপে চূড়ান্তভাবে পরিত্যাগ করে যাবার আগে সে সময়ের মানুষেরা একে পাথর আর মাটি দিয়ে ভরাট করে দিয়ে যায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে অক্ষত অবস্থায় মাটিচাপা পড়ে ছিল স্থাপনাটি।
- মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি স্টোনহেঞ্জ। গোবেকলি তেপে এই স্টোনহেঞ্জেরও ৬ হাজার পূর্বে নির্মিত।
- গোবেকলি তেপে নিজের সময়ের চেয়ে অগ্রসর এক স্থাপনা। বিশাল বিশাল পাথরের সমাহার আর ছোট পাথরের সুনিপুন সজ্জায় যেভাবে গোবেকলি তেপে নির্মাণ করা হয়েছে, এরকম স্থাপনা অন্তত আরো ৩/৪ হাজার বছর পর পৃথিবীতে সহজলভ্য হয় বলে ধারণা করা হয়। সেক্ষেত্রে কৃষিযুগ পূর্ববর্তী মানব সভ্যতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া সম্ভব গোবেকলি তেপে থেকে।
- গোবেকলি তেপে ১৯৬০ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হলেও পূর্ণ আবিষ্কার ঘটে ১৯৯৪ সালে।
- সুপ্রাচীন এই স্থাপনা নিয়ে যদিও কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, তথাপি বিভিন্ন নিদর্শন থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ একে একটি ধর্মীয় স্থাপনা বলেই রায় দিয়েছেন। সে হিসেবে, গোবেকলি তেপে হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম উপাসনালয়। তবে অনেকে একে একটি সমাধিক্ষেত্রও মনে করেন।
- গোবেকলি তেপের কেন্দ্রে বেশকিছু বড় লম্বা পাথর স্থাপন করা হয়েছে, খুব সম্ভবত যেগুলোকে পূজা করা হতো। এই পাথরগুলোর একেকটির ওজন ২০ থেকে ৬০ টন পর্যন্ত এবং গোবেকলি তেপের নিকটবর্তী কোনো স্থান থেকে এগুলো আনা হয়নি। কোথা থেকে আনা হয়েছে তা জানা না গেলেও, ৬০ টন ওজনের পাথর নিশ্চয়ই মানুষ কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে আসেনি। অতঃপর, এই দৈত্যাকার পাথরগুলোর উপর ১০ টন ওজনের সব পাথুরে ব্লক বসানো হয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে, নিশ্চয়ই এই বিশাল ওজনগুলো ওঠানোর কোনো বিশেষ প্রযুক্তি ছিল তখনকার মানুষের কাছে।
- বড় বড় পাথরগুলোর মধ্যে অনেক অদ্ভুত চিত্র খোদাই করা আছে যেগুলোর রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়নি। তবে, পাথরের আকার এবং মাথায় বসানো ব্লকের আকৃতি দেখে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ এদেরকে মানুষের প্রতিকৃতি বলে অভিহিত করেছেন।
- গোবেকলি তেপে কেবল একটি মন্দির নয়। এটি পৃথক পৃথক ২০টি মন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত একটি উপাসনালয়। প্রতিটি মন্দিরই প্রায় একই আদলে সামান্য ভিন্ন আঙ্গিকে নির্মিত হয়েছে।
গোবেকলি তেপে আবিষ্কারের পর খুব দ্রুতই বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর একটি হয়ে ওঠে। পর্যটকদের আকর্ষণও বেড়ে যায় রাতারাতি। তাই এর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়। এর সংরক্ষণে ২০১০ সালে প্রথম এগিয়ে আসে ‘গ্লোবাল হেরিটেজ ফান্ড’। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে ‘জার্মান আর্কিওলজিকাল ফাউন্ডেশন’, ‘জার্মান রিসার্চ ইনস্টিটিউট’, ‘উরফা মিউনিসিপাল গভার্নমেন্ট’, ‘তুর্কিশ মিনিস্ট্রি অব ট্যুরিজম অ্যান্ড কালচার’। বর্তমানে পুরো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটির সংস্কার কাজ চলছে। এই স্থাপনাটি নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যে যুগের মানুষদেরকে আমরা অসভ্য আর বর্বর বলে জানতাম, তাদের সময়েই সভ্যতার সূচনার ইঙ্গিত দেয় এই গোবেকলি তেপে। তাই একে প্রত্নতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন বললেও অত্যুক্তি হবে না।