ঐতিহ্যবাহী থাইল্যান্ডে যেমন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের অভাব নেই, তেমনই ঘাটতি নেই চমৎকার এবং অসাধারণ পর্যটন স্থানের। সকলের পছন্দের এই অপরূপ সৌন্দর্যের দেশের পাঁচটি অনন্য পর্যটন স্থান নিয়ে আজকের এই লেখাটি।
১) ওয়াট পা মাহা চেদি কাইয়ু (Wat Pa Maha Chedi Kaew)
ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ভাব-ধারণায় স্বয়ংসম্পূর্ণ থাইল্যান্ডে ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীন মন্দির দেখতে পাওয়া খুব সাধারণ একটি বিষয়। প্রতিটি মন্দিরই জাঁকজমকভাবে সজ্জিত। কোনো মন্দির সোনা, আবার কোনো মন্দির বিভিন্ন মণিমুক্তা ও হীরা দিয়ে মণ্ডিত থাকে। তবে এই মন্দিরের ব্যাপারটা কিন্তু একদম আলাদা। কারণ এই মন্দির মূল্যবান কোনো সোনা-রূপা বা জহরত দিয়ে নয় বরং শুধুমাত্র বিয়ারের বোতল দিয়ে বানানো হয়েছে।
১৯৮৪ সালে থাইল্যান্ডের সিসাকেট (Sisaket) অঞ্চলের এক ধর্মযাজক বাকি সহকারী ধর্মযাজকের সহায়তায় প্রায় ১.৫ মিলিয়ন বা ১৫ লাখ বিয়ারের বোতল দিয়ে মন্দিরটি বানানো হয়। সিসাকেট অঞ্চলের সাধারণ জনগণ প্রায়ই মদ্যপান করে বোতল এখানে সেখানে ফেলত, যা পরিষ্কার করতে করতে যাজকেরা ক্লান্ত এবং বিরক্ত হয়ে যান। সবার মধ্যে রিসাইক্লিং ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতনতা আনার জন্য তারা সেখানকার লোকজনকে বিয়ারের বোতলগুলো তাদেরকে দান করার জন্য উৎসাহিত করে এবং তাদেরকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, এই বোতলগুলো ভালো কাজে ব্যবহৃত হবে, সে পুণ্যের ভাগ তারাও পাবে।
এই মন্দিরে ‘হেইনকেন’ (Heinken) এবং ‘ব্রাউন চ্যাং’ (Brown Chang) বিয়ারের বোতলই বেশি ব্যবহৃত হয়। কেননা, আঞ্চলিকভাবে এগুলোই সবার বেশি পছন্দ। প্রথমে শুধু মূল মন্দিরটি তৈরি করা হয় এবং পরবর্তীতে একটি শ্মশান, কয়েকটি পানির টাওয়ার, শোয়ার ঘর ও টয়লেট তৈরি করা হয়। আর বোতলগুলোর খাপ মোজাইক এবং মন্দিরের নকশার কাজে লাগানো হয়।
২) শাম ফান বোক (Sham Phan Bok)
উবন রাচাথানি (Ubon Ratchathani) প্রদেশের ফো সাই (Pho Sai) জেলার লাও গাম (Lao Ngam) উপজেলার ‘বান পোং পাও’ (Ban Pong Pao)-এ অবস্থিত এই শাম ফান বোক। এটি খোং নদীতে অবস্থিত সবচেয়ে বড় পাথর দ্বীপ। বর্ষার দিনে এই দ্বীপ পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এসময় ঘূর্ণিবায়ুর কারণে দ্বীপটিতে প্রায় ৩০০০ এর বেশি ক্ষুদ্র খাদ (Small basins) বা ‘Bok’-এর সৃষ্টি হয়। এজন্য এই স্থানের নাম ‘শাম ফান বোক’। এত খাদ থাকার কারণে একে ‘গ্র্যান্ড ক্যানিওন অফ থাইল্যান্ড‘ বলে।
শুষ্ক মৌসুমে এই দ্বীপ পানির উপরে উঠে আসে। এই সময়ে খোং নদীর মাঝে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শনের সৃষ্টি হয়। পর্যটকেরা এ মৌসুমে এই পাথুরে দ্বীপের রূপ-বৈচিত্র্য উপভোগ করতে পারে। এটা অনেকটা বৃত্ত, তারা, ডিম এবং আরও বিভিন্ন আকারের সমন্বয়ে তৈরী শিল্পীসুলভ চিত্রের মতো; অবশ্য আকারগুলো আসলে কেমন, তা নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের কল্পনার উপর। ‘Sam Phan Bok’ ঘোরার উপযুক্ত সময় হল জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস।
এর প্রবেশদ্বারে রয়েছে কুকুরের মাথার আকারের একটি পাথর রয়েছে। কথিত আছে যে, খোং নদীর নিকট বসবাসকারী এক নাগা শিশু সেখানে একটি চ্যানেল খনন করতে চায় এবং এ সময়ে সে একটি কুকুরকে পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব দেয়। কুকুরটি মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন করে যায় এবং মারা যাওয়ার পর এটি পাথর হয়ে যায়।
৩) কোহ হিংঘাম (Koh Hingham)
থাইল্যান্ড অবস্থিত স্থায়ী বসতিহীন ক্ষুদ্র একটি দ্বীপ হল- কোহ হিংঘাম। এই দ্বীপে সাধারণত খুব কম পর্যটকই যান। বলা হয় যে, এই দ্বীপে অনেক দেবতা থাকেন; তাই দ্বীপের শান্তি নষ্ট হতে পারে, এই আশঙ্কায় জনসাধারণের সমাগম এখানে দেখা যায় না। পুরাণ অনুসারে, এই দ্বীপ মূলত থাইল্যান্ডের সর্বোত্তম দেবতা তারুতাও (Tarutao) সৃষ্টি করেছেন এবং তার কোনো অভিশাপের কারণেই এখানকার সব পাথর কালো হয়ে গেছে। পাথরগুলো সূর্যের আলোতে এত উজ্জ্বল থাকে যে, অনেকেই প্রথমে মনে করতে পারে এটি হীরা, রুবির মত মূল্যবান কোনো পাথর।
অনেকের বিশ্বাস মতে কোহ হিংঘাম-এর পাথর দ্বীপটির বাইরে নিয়ে কেউ নিয়ে গেলে তাকে দেবতা তারুতাওয়ের অভিশাপের শিকার হতে হবে। তবে এগুলো দিয়ে দ্বীপে থাকা অবস্থায় নিজের মতো করে ব্যবহার করা যাবে। যেমন- থাই অধিবাসীরা এগুলো দিয়ে ছোট্ট বুদ্ধস্তূপ (Small Stupa) তৈরি করে এগুলোর সামনে বসে নিজেদের সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করে। কোহ হিংঘামে যাওয়ার জন্য পর্যটকেরা পার্শ্ববর্তী দ্বীপ ‘কোহ লিপ’ (Koh Lipe)– এর কোনো অভিজ্ঞ বৃদ্ধের সহায়তা নেন, যিনি তাদেরকে এই অভিশপ্ত দ্বীপটিতে নিয়ে যেতে রাজি হন। বড় একটি নৌকায় ১০ জন করে কোহ লিপ থেকে কোহ হিংঘামে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০ মিনিট সময় লাগে।
৪) ওয়াট ফ্রা কাইয়ু (Wat Phra Kaew)
এই মন্দিরটিতে এমারেল্ড বা পান্না রত্নপাথরের তৈরী বুদ্ধদেবের মূর্তি রয়েছে। ‘ওয়াট ফ্রা কাইয়ু’ তার বিচিত্র ইতিহাস ও ভালো লোকেশনের জন্য বেশ পরিচিত। এটি ব্যাংককের ‘গ্র্যান্ড প্যালেস কমপ্লেক্স’ -এ অবস্থিত। থাই মন্দিরগুলোর মধ্যে একে সবচেয়ে পবিত্র মন্দির হিসেবে ধরা হয়। ধারণা করা হয়, মন্দিরটির ভেতরের বুদ্ধমূর্তিটি ১৫ শতকে চিয়াং রাই (Chiang Rai) -এ খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৮ শতকে একে ব্যাংককে স্থানান্তর করা হয়। কথিত আছে, মন্দিরে বুদ্ধদেবের যে মূর্তিটি রাখা, তা মূলত বুদ্ধদেব যখন ভারতে মোক্ষ অর্জন করেন সেই সময়ের তার ধ্যানমগ্ন অবস্থা এখানে চিত্রিত হয়েছে। এমারেল্ড বুদ্ধমূর্তিটি মন্দিরের মূল ভবনে রয়েছে, যেখানে গিয়ে থাই সম্রাট ব্যতীত অন্য কারও এই মূর্তি স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। মন্দিরটিকে ‘ওয়াট পা ইয়া’ (Wat Pa Yia) বা ‘দ্য ব্যাম্বু ফরেস্ট মনেস্ট্রি’ও বলা হয়। মন্দিরটি রাত্তানাকোসিন রীতিতে তৈরী এবং এর স্থাপত্যশিল্প অযোধ্যার প্রাচীন রাজধানীর মন্দিরের চিত্রানুসারে করা হয়েছে। এর প্রবেশদ্বারে দুটি ‘ইয়াকশিস’ (Yakshis) থাকে। ইয়াকশিস হলো ৫ মিটার লম্বা কাল্পনিক দৈত্যের মূর্তি।
মন্দিরটিতে প্রবেশ করতে অবশ্যই আপনাকে উপযুক্ত পোশাক পরতে হবে। পুরুষদেরকে লম্বা প্যান্ট ও লম্বা হাতার শার্ট এবং নারীদেরকে লম্বা জামা পরিধান করতে হবে। আপনি চাইলে মন্দিরের বাইরে থেকে পোশাক ভাড়ায় নিতে পারবেন। তবে কোনোভাবেই আপনাকে অনুপযুক্তভাবে পোশাক পরা অবস্থায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
৫) ফ্যানম রুং (Phanom Rung)
ফ্যানম রুং হিস্টোরিকাল পার্ক বা ‘Prasat Hin Phanan Rung‘ থাইল্যান্ডের বুরিরামে অবস্থিত। এটি একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপর অবস্থিত, যা সমুদ্র থেকে ৩৫০ মিটার উপর। এটি চিত্তাকর্ষক এবং গুরুত্বপূর্ণ খামের মন্দিরগুলোর অন্যতম। দশ থেকে তের শতকে আংকর রীতিতে এই হিন্দু মন্দির তৈরি করা হয়, এটি দেব শিবের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়।
মন্দিরটি বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইট দিয়ে তৈরী। ফ্যানম রুং দেব শিবের আবাস, কৈলাস পর্বতকে চিত্রিত করে। এটা পূর্বদিকে মুখ করে আছে এবং বছরে চারবার সূর্যের আলো একসাথে ১৫টি আশ্রয়স্থলের দ্বার দিয়ে যায়। এপ্রিল মাসে সেখানকার লোকজন ফ্যানম রুং উৎসব পালন করে, এখানে ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি এবং আধুনিক রীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়।
অসাধারণ সৌন্দর্যপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী এই স্থানগুলো উপভোগ করতে চাইলে আগামী ছুটিতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন থাইল্যান্ড।
ফিচার ইমেজ: elyonholidays.com