”আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।।
হারায় সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।। …. ” [গগন হরকরা]
এই বাংলার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে রয়েছে কত প্রতিভা। তাদের ক’জনের খোঁজই বা আমরা পাই? তেমনই এক ছাইচাপা প্রতিভা ছিলেন গগন হরকরা। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। বাংলার এই লোকশিল্পীর আসল নাম গগন চন্দ্র দাম, কিন্তু গগন হরকরা নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তার জন্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, ১৮৪০ সালে কুষ্টিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এই বাউল সাধকের জন্ম।
শিলাইদহ ডাকঘরে তিনি চিঠি বিলির কাজ করতেন। কিন্তু হৃদয়ে ছিল সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা। তারে গানের গলাও ছিল বেশ ভাল। বিভিন্ন গানের আসরে ‘সখী সংবাদ’ এর গানে করুণ রসের আবেশ লাগিয়ে এমন গান করতেন যে শ্রোতারা মুগ্ধ আবেশে ডুবতেন। লালনের এই ভাবশিষ্য প্রকৃতির রূপ, রস আর গ্রামের মেঠো মানুষের সারল্য, আবেগ ও ভালোবাসার বাউল দর্শনকে আশ্রয় করে গান রচনা করতেন। গগন লালনের সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন। তাই কাজে একটু অবসর পেলেই ছুটে তিনি যেতেন লালনের আখড়ায়। মজে যেতেন লালনের আধ্যাত্মিক সাধনায়।
গগন কার কাছ থেকে গানের দীক্ষা নিয়েছিলেন, তা জানা সম্ভব হয়নি, তবে গগন লালনের গানের খুব ভক্ত ছিলেন। লালনও গগনের গান এবং গগনের সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন। গগনের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও, তিনি গগনের কাছে গগনের নিজের গান ও লালনের গান শুনতে চাইতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে যেভাবে পরিচয় ঘটলো এই বাউল সাধকের
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনা করতে ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এই সময় তিনি বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। লালন, গোসাঁই গোপাল, ফিকিরচাঁদ, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী এবং গোসাঁই রামলালের মতো অসংখ্য বাউলের সাথে তার পরিচয় ঘটে। বাউল-ফকিরদের গান কবিকে অন্য এক সুরের ভুবনে নিয়ে যেতো। এসব বাউল-ফকিরদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন গগন হরকরা। গগনের সাথে অদ্ভুতভাবে কবিগুরুর পরিচয় ঘটে।
একদিন কবি বজরার ছাদে বসে পদ্মার শোভা উপভোগ করছিলেন। এমন সময় পোস্ট অফিসের এক পিয়ন চিঠির থলে পিঠে নিয়ে আপন মনে গান করতে করতে সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে গান শুনে কবি কবি মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি সেই ডাক হরকরাকে ডেকে পাঠালেন। গাঁয়ের লোক তাকে চেনে ডাকে গগন হরকরা নামে, কিন্তু তিনি কবির কাছে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, তার নাম গগনচন্দ্র দাম। গ্রামের সাধারণ এক মানুষ, নিজের রচিত গানে নিজেই সুর দেন। গগনের গানে মানুষ ও সমাজই ছিল মুখ্য।
রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে যেতেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ডাক পড়তো গগনের। সন্ধ্যার পর নির্জনে বোটের ছাদে বসে কিংবা শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আয়োজিত কোনো গানের জলসায় গগনের গান ছিল বাঁধা। কবি তার বন্ধুবান্ধব ও গুণীজনের মাঝে গগনের গান শোনানোর জন্য উৎসুক থাকতেন।
একদিন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে এক জমজমাট আড্ডার আসর বসে। বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সাহিত্যিক ও গীতিকার হিসেবে তখন চারদিকে তার বেশ সুনাম। হাসির ছড়া, নাটক আর গানে তার দক্ষতা সকলকে মুগ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধু। তার তদারকিতে ব্যস্ত বাড়ির সব মানুষ। খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হলো গানবাজনা। দিজেন্দ্রলাল রায়কে গান গাইতে দু’বার অনুরোধ করতে হয় না। আসরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করেন। সকলেই সে গান শুনে বেশ তারিফ করলো।
এবার কবিগুরুর পালা। কিন্তু সেদিন সকাল থেকেই তার গলায় অল্প ব্যথা। তিনি বন্ধুবরকে বললেন, আমার গান তো অনেক শুনেছেন। আজ এক নতুন শিল্পীর গান শুনুন। আসরের এক কোণায় ফরাসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে বসে থাকা রোগা-হ্যাংলা এক ব্যক্তির দিকে কবিগুরু নির্দেশ করতেই মানুষটি আরও কাঁচুমাচু হয়ে গেলেন, “রাজাবাবু, সত্যিই কী আমাকে ডাকছেন?”
এতসব বড় বড় মানুষদের মাঝে তাকে গান করতে হবে! এলাকায় সবাই তাকে এক নামে চেনে। রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধুকে এর পরিচয় করিয়ে দিলেন। “লালনের গান তো শুনেছেন। এবার এর গান শুনুন।” গগন শ্রোতাদের সকলকে নমস্কার জানিয়ে শুরু করলেন তার গান:
“লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হতো খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে। …..”
গগনের এই উদাত্ত কণ্ঠের গান শেষ হলে অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোলো না।
শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে লালন শাহ এবং পরে গগনের বাউল প্রেমে বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। কবির মনে ধর্ম নিয়ে যে নতুন চিন্তাভাবনার উদ্ভব হয়েছিল, তারই স্বীকৃতি খুঁজে পেলেন তিনি বাউল সঙ্গীতে। বারবার তার গানে প্রকাশ পেতো লাগলো বাউলের নানা সুর।
“দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলে ধরা দেয় না।
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ঘুরিতেছি পাগল হয়ে,
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভে না,
এখন বলে বলুক লোকে মন্দ, বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না। ”
সময়টা ১৯০৫ সাল। ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করতে উদ্যত হলেন। ‘বঙ্গভঙ্গ’ অধ্যাদেশ জারি করলেন। চারদিকে বাংলাকে বিভক্ত করার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। এই আদেশ আলোড়ন তুললো সারা বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতার সুধীজনের মাঝে তার ব্যাপক প্রভাব পড়লো। প্রতিবাদের ঢেউ উঠলো সারা বাংলায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও এ প্রতিবাদে অংশ নেন। প্রতিবাদের জন্য চাই নতুন স্বদেশী গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন,
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥ …..”
স্বদেশ পর্যায়ের এ গানটিতে সুর দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুরে আশ্রয় নিলেন। গগনের এই গানটির সুরকে কবিগুরু তার গানে প্রায় অবিকল তুলে আনেন। গানটি যে কবিকে বেশ প্রভাবিত করেছিল, তা বলাই বাহুল্য। বাংলার এক লোকশিল্পীর গানের সাথে কবির স্বদেশ ভাবনার গানে এমন স্বার্থক রূপ আর কে-ইবা দিতে পারতেন। কবিগুরু যে জেনেশুনে গগনের গানের সুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিতে বসিয়েছিলেন, তা তার মন্ত্রশিষ্য ও ছায়া সঙ্গী শান্তিদেব ঘোষের এক লেখা থেকে জানা যায়।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগনের আরও একটি গান ‘ও মন অসার মায়ায় ভুলে রবে, কতকাল এমনিভাবে’ এই গানটির সুরের আদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন,
“যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা!
আমি তোমার চরণ-
মা গো, আমি তোমার চরণ করবো শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা।।
কে বলে তোর দরিদ্র ঘর, হৃদয় তোর রতন রাশি –
আমি জানি গো তার মূল্য জানি, পরের আদর কাড়ব না মা।। …..”
গগন হরকরা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধারণা
রবীন্দ্ররাথ ঠাকুর গগন হরকরার গান সম্পর্কে বেশ উচ্চধারণা পোষণ করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল, তা কবির ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথের এক লেখায় পাওয়া যায়। শিলাইদহে দু’জনের যখন দেখা হতো, তখন তারা প্রায় সময় সঙ্গীতচর্চা এবং গানের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ আগ্রহের সঙ্গে গগনের কাছে বাউল গান সম্পর্কে জানতে চাইতেন। তাই গগনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা কাকতালীয় হলেও তিনি যে গগনের গানে বেশ মজেছিলেন, তা রবি ঠাকুরের নানা লেখা ও বক্তৃতায় প্রকাশিত হয়েছে।
গগন তার সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে কবিগুরুকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করেছেন। তাই ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩২২ বাংলার বৈশাখ সংখ্যায় ‘হারমণি’ বিভাগ চালু হলে ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’-ভাবতত্ত্বের এ গান দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিভাগের সূচনা করেন। এই গানের মধ্যে দিয়ে কবিগুরু বাংলার এক প্রান্তিক শিল্পীকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নানা প্রবন্ধ এবং দেশে-বিদেশে দেয়া তার বিভিন্ন বক্তৃতায় বাউলের উদার ধর্মমতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লালন-গগনের গানের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তার ‘মানবধর্ম’ (১৯৩০) প্রবন্ধে বাউলের মানবতাবাদী দর্শনের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ‘An Indian Folk Religion’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগনের ‘কোথায় পাবো তারে’ গানটির কথা উল্লেখ করে বলেন,
“এই প্রথম বাউলগান, যা আমি মন দিয়ে শুনেছি এবং যার জন্য আমার মন আন্দোলিত হয়েছে।”
পরবর্তী সময়ে মনসুরউদ্দীনের সম্পাদিত হারামণি (১৯৩৬) গ্রন্থের ভূমিকায় গানটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেন। কবিগুরু তার আরও একটি লেখায় গগনের ‘কোথায় পাব তারে আমার মনে মানুষ যে রে’ গানটি বিষয়ে লিখেছেন, “কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের মূর্চ্ছনায় এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।”
গগনের জীবন থেকে প্রভাবিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ডাকঘর’ নাটকটি লিখেছিলেন বলে তার বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়।
গগন হরকরার অন্যান্য গান
গগন হরকরা আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রচুর গান রচনা করেছিলেন। তার সহজ-সরল শব্দময় এসব গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। তার কয়েকটি গান সম্পর্কে জানা গেলেও তার অধিকাংশ রচনা সম্পর্কে তেমন একটা জানা যায় না। সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি তার রচিত অনেক গানের কথা ও সুর। ১৩০২ বাংলা, মাঘ সংখ্যা ‘ভারতী’ পত্রিকায় সরলা দেবী গগনের কয়েকটি গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করে তাকে সাহিত্যাঙ্গনে উপস্থাপন করেন।
সরলা দেবী ওই প্রবন্ধের শেষ অংশে আবেদন করেছিলেন যে, “প্রেমিক গগনের ভক্ত জীবনীর বিবরণ সংগ্রহ করিয়া কেহ ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশার্থে পাঠাইয়া দিলে আমাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হইবেন।”
রবীন্দ্রনাথ অল্প বয়স থেকেই বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গানের প্রতি বেশ অনুরাগী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার অনেক গানেই বাউল সুর গ্রহণ করেছেন। তার অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিণীর সাথে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত-সারে বাউল সুরের মিলন ঘটিয়েছেন। তাই গগন হরকরার মতো বাউলদের গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সমৃদ্ধ করেছিল, তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।