ফরাসী কবি শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলার প্রথিতযশা কবি বুদ্ধদেব বসু উচ্চারণ করেছিলেন-
“বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি?
আমি ভালবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ…উঁচুতে…ঐ উঁচুতে…
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।”
এই আশ্চর্য মেঘের দলকে ভালবেসে ফেলেছিলেন কিছু গান পাগলের সওয়ারি। তাদের গানের কথায় মেঘের আনাগোনা, কন্ঠে তাদের মেঘের সুর আর বাদ্যযন্ত্রে আছে মেঘের সিম্ফনি। গানের দলের নামটাও তাই বুদ্ধদেব বসুর কবিতার সাথে উচ্চারিত হয়ে উঠল ‘মেঘদল’।
কবির সুমনের কাব্য ও লেখনিতে ‘কলকাতা’ শহর ধরা দিয়েছে বারবার ‘তিন শতকের শহর’ হয়ে। সেখানে ট্রামে-বাসে চড়া বিবর্ণ শহরবাসীর কথা আছে, জীর্ণ অস্তিত্বে শহরের ভালো লাগা আছে। তেমনি ‘মহীনের ঘোড়াগুলো’ যখন নিজের শহরের ভালোবাসার কথা বলে-
“শহরের উষ্ণতম দিনে
পিচগলা রোদ্দুরে
বৃষ্টির বিশ্বাস
তোমায় দিলাম আজ…”
তখন কেন জানি আমাদের শহর ঢাকাকে কিছুটা অচেনা মনে হয়। কর্মব্যস্ত, যানজটে ঠাসা, কোলাহলে ঘেরা, হাজার অস্থিরতার মাঝেও কি এই শহরের ভালো লাগার কিছু নেই? এই শহরে কি শরতের হিমেল বাতাস ছুঁয়ে যায় না? শীতের বাতাসে হিম হওয়া শরীরে দুপুরের রোদ কি আমাদের শিহরিত করে না? হাজার সংঘর্ষের পরেও এই শহর কি আমাদের মায়াজালে বন্দী করে রাখেনি? কিন্তু বাংলা গানে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে নাগরিক সভ্যতার উচ্ছ্বাস যেন খুঁজে পাওয়া দায়।
মেঘদলের গল্পের শুরুটা অনেক বছর আগের। তিন বন্ধু মেজবাউর রহমান সুমন, শিব কুমার শীল ও মাসুদ হাসান উজ্জ্বল মিলে গান-বাজনার শুরু। পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগ দেন আরেক বন্ধু সৌরভ। তিনি মূলত বাঁশি বাজাতেন।
চারুকলায় পড়ার সময় নিজেদের সাথে পরিচয়। বন্ধুত্বের সাথে সাথে গানের প্রতি ভালোবাসাও বাড়তে থাকে। নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ, দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক দর্শন সবকিছুর মধ্যেই কেমন যেন আত্মীকরণ খুঁজে পেয়েছিলেন তারা। প্রথমে সুমন এবং উজ্জ্বল নিজেদের গান শুরু করেন। পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগ দেন শিব কুমার শীল বা সংক্ষেপে শিবু।
শিবু হলেন মূলত কবি। কবিতার ভাষাকে উপজীব্য করে কিছুটা নাটকীয় আমেজে সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়ে তোলার প্রয়াসে ২০০৩ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গানের দলটির নামকরণ করা হয় ‘মেঘদল’। মেঘদলের ভালো লাগা ছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলো’, ‘কবীর সুমন’, ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ ও ‘লালন’ এর প্রতি। তবে তেমন করে কখনো মঞ্চে অন্যের গান করা হয়নি দলটির। প্রথম থেকেই নিজেদের কথা ও সুরের সাথে শ্রোতাদের একাত্ম করে চলেছে মেঘদল।
শুরু থেকেই মেঘদলের গানের চিন্তায় ছিল শহরকেন্দ্রিক ‘সুরিয়ালিজম’ বা ‘পরাবাস্তবতা’। ‘ওয়াইল্ড মেট্রোপলিস’ বা ‘বন্য-মহানগর’ যেন বারবার ফিরে এসেছে মেঘদলের প্রতিটি গানে। শহরের নোনা ধরা দেয়ালের আস্তরণে, বস্তির ক্রন্দনরত শিশুর মুখের হাসি ফোটাতে, কিংবা অফিস থেকে বাসের ভিড়ে ক্লান্ত শ্রান্ত ঘামে ভেজা সেই মানুষটির চোখে এই শহরের কেমন প্রতিচ্ছবি তা-ই যেন ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে প্রতিটি গানের কথা ও সুরে।
এই শহর তো শুধু ইট পাথরের আস্তরনে গড়ে ওঠা স্মৃতি নয়। এর প্রত্যেক পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস। এই শহরে বন্দী হয়ে আছে প্রাণের আবেগ, কিছুটা দুরন্তপনা, একাকীত্বের নিস্তব্ধতা আর ব্যস্ততার মাঝে খুঁজে ফেরা নিজের শূন্যতা। ক্লান্ত-শ্রান্ত পায়ে দুপুরের খোলা আকাশের নিচে হাতের তালুতে ছোঁয়া দিয়ে যায় রোদের ফোঁটা। আর মেঘদল গেয়ে উঠে-
“শূন্যতায় ভেসে গেছে
শহরের সব পথঘাট,
ফিরবে না গতকাল জানি,
ফিরবে না আগামীকাল…
তবু চাইছি তোমাকেই
তুলে নিতে অঞ্জলিতে,
রোদের ফোঁটা…”
এই শহরের বিষাদগ্রস্থ ভাবাবেগ বারবার উঠে এসেছে মেঘদলের গানে। ‘মরবিডনেস’ বা রুগ্ন রোগীর মতো শহরটাকে তুলনা করেছেন যেখানে অনেকগুলো মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে মত্ত হয়ে উঠছে। তাই গেয়েছেন-
“কিছু বিষাদ হোক পাখি
নগরীর নোনা ধরা দেয়ালে
কাঁচপোকা সারি সারি
নির্বাণ, নির্বাণ ডেকে যায়…”
‘মেঘ’ শব্দটি মেঘদলের গানের মূল সঞ্চারণ বলা চলে। কখনো মেঘকে বন্দী করে রেখেছেন শহরের ব্যস্ততার মাঝে, কখনো চার চার চৌক জানালার ফাঁকে একফালি মেঘ দেখার উন্মাদনা অথবা মাথার উপর উন্মত্ত আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে লিখে ফেলা শিব কুমার শীলের-
“আকাশ মেঘে ঢাকা
ঢেকে যায় সব রোদ
ছায়া ছায়া অন্ধকারে
উড়ে যায় সব বোধ
আকাশ মেঘে ঢাকা …”
শহরকেন্দ্রিক গান মেঘদলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহর নিয়ে প্রথম গান ‘আমার শহর’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সুমন। পরবর্তী অ্যালবামে শহরকে নিয়ে দ্বিতীয় গানটি তৈরি করেন যার নাম ‘আবার শহর’। ২০১৭ সালের শেষের দিকে মেঘদল প্রকাশ করেন তাদের আসন্ন ‘এলুমনিয়ামের ডানায়’ অ্যালবামের একটি গান ‘এসো আমার শহরে’। গানটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে ব্যাপক সাড়া ফেলে শ্রোতাদের মনে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রেমের উপস্থিতি যে একেবারেই নেয় তেমন কিন্তু নয়। কিন্তু গানের কথায় প্রেমের অভিব্যক্তি উঠে এসেছে অন্যরকম ছন্দে। তাই তো ‘কুমারী’ গানে শিবু শীল লিখেছেন ‘আমি তোমাকে প্রেমের আগে তোমার প্রেমকে ভালোবাসি’। আবার প্রেমিকাকে মিশরীয় রহস্যময়ী সুন্দরী নেফারতিতির মতো আখ্যা দিয়ে গেয়েছেন-
“যাচ্ছো চলে নেফারতিতি
বিষণ্ন চুল উড়ছে হাওয়ায়
সবুজ আকাশ দূরে সরে যায়
পথের এখনো কিছুটা বাকি”
নিজের মনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় প্রেমিকার কাছে প্রশ্নের বান ছুড়ে দেয়া-
“জানো কি, কতটা ক্লান্ত হলে
পেছনের পথ পেছনেই পড়ে থাকে
জানো কি, কি করে স্বদেশ হারায়ে
কিভাবেই আমি কিভাবেই তুমি পরবাসী…”
অনেক বছর ধরে গান করে চললেও সংখ্যার বিচারে মেঘদলকে বেশ উদাসীন বলা চলে। এখনো পর্যন্ত মাত্র দুটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে মেঘদলের। ২০০৪ সালে মুক্তি পায় প্রথম অ্যালবাম ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা’। অ্যালবামটির ‘চেনা অচেনা’, ‘আকাশ মেঘে ঢাকা’, ‘আমার শহর’ গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
২০০৯ সালে আসে মেঘদলের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘শহরবন্দী’। অ্যালবামটির ‘রোদের ফোঁটা’, ‘ঠিক ঠাক’, ‘কুমারি’, ‘নির্বাণ’, ‘আবার শহর’ গানগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়াও কিছু মিশ্র অ্যালবামেও মেঘদলের গান চোখে পড়ে।
জনপ্রিয় কোনো ব্যান্ডদল হয়ে ওঠার সংকল্প নিয়ে কখনো গান বাঁধেনি মেঘদল। অর্থের জন্য নয়, বরং নিজেদের আত্মার প্রশান্তির জন্যই গান করার দাবি করে দলটি। নিজেদের না বলা কথা, অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে তাদের একেকটি গানের কথায়। দলের প্রত্যেক সদস্য নিজেদের ব্যক্তিগত চাকরি বা ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত। যেমন, দলটির মূল ভোকাল ও লেখক শিবু শীল ব্যক্তিগতভাবে একজন কবি, লেখক, চিত্রকর, সাংবাদিক ও প্রচ্ছদশিল্পী। সুমন রয়েছেন মিডিয়া জগতে। ক্যামেরা, নাটক, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি নিয়ে তার চালচিত্র। গিটারিস্ট এবং ভোকাল সোয়েব ব্যস্ত রয়েছেন চাকরিতে। এছাড়াও ড্রামসে রয়েছেন আমজাদ, বেস গিটারে কিবরিয়া, সৌরভ বাঁশিতে এবং রনি রয়েছেন কি-বোর্ডে।
তাই মেঘদল কখনো অর্থোপার্জনের দল হিসেবে গড়ে উঠেনি। এই দলে তাই কোনো সেনানায়কও নেই। প্রত্যেকেই এখানে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দেয়ার চেষ্টায় মত্ত। পাশাপাশি দর্শকশ্রুত হয়ে উঠলে সেই আনন্দ আরো অনেকাংশেই বেড়ে যায় তা বলাই বাহুল্য।
শ্রোতাদের কাছে খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই মেঘদলের। শুধুমাত্র শ্রোতামনে কিছুটা প্রশান্তির ছোঁয়ার পরশ বুলিয়ে দেয়াকেই নিজেদের গানের পরম সার্থকতা মনে করে দলটি। তাই দলটির মূল চাওয়া এমন কিছু গান করা যা অনেক বছর পরেও মানুষের মনে দাগ কেটে থাকবে। যে গানের কথা কখনো পুরনো হবে না।
“করতলে চিহ্ন মেঘের স্বর
লোকাল বাসে বাড়ি ফেরা প্রিয় মুখ
হৃদয়ের কাছে ব্যর্থ মুঠোফোন
দিন রাত্রি গুনগুন
হ্যালোজেন রোদ চিলতে বারান্দায়
টিকটিকি তাই বলছে ভবিষ্যত”
ফিচার ইমেজ- youtube.com