খ্যাতির চূড়ায় থাকা মানুষগুলো আমাদের সকলের কাছে নাগালের বাইরে দেখা স্বপ্নের মতো। তাদের অস্তিত্ব আমাদের নিকট কেবলই ধূম্রজাল। আমরা তাই দূর থেকে ধরে নিই, তাদের ক্ষেত্রে খ্যাতি আর সুখ বোধহয় একে অন্যের সম্পূরক। কিন্তু ইতিহাস আমাদের শোনায় ভিন্ন গীত, শোনায় কিছু অন্যরকম কাহিনী। খ্যাতিমান তারকারা তাদের পদধূলি মর্ত্যে দিয়ে জানান দেন, তারাও জীবনের একপর্যায়ে গিয়ে আমাদের মতোই হতাশায় ভোগেন, মুখোমুখি হন অতৃপ্তির। আর তখনই হয়ত আমরা তাদের দেখতে পারি আমাদেরই মতো রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে। সে মুহূর্তের আগপর্যন্ত তারা কেবলই আমাদের কাছে স্বপ্নপুরীর বাসিন্দা। আর কিছু কিছু কীর্তিমান-খ্যাতিমান ব্যক্তিরা হয়তোবা শুধুমাত্র আমাদের ভুল-ভাঙানোর জন্যেই জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন যে যশ-খ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তিই সব নয়।
নয়তো কেনই বা জিমি হেন্ড্রিক্স, জিম মরিসন, কার্ট কোবেইন, এমি ওয়াইনহাউজের মতো তারকারা খ্যাতির শীর্ষে থাকা অবস্থায়, লাখো-কোটি ভক্তের ভালবাসা উপেক্ষা করে মৃত্যুকে বেছে নেবেন! শুধু খ্যাতি এই ক’জন তারকার ক্ষেত্রে মৌলিক তা নয়, তারা একই সূত্রে গাঁথা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। শুনতে কিছুটা উদ্ভট শোনালেও এটিই প্রকৃত সত্য। শুধু জিমি হেন্ড্রিক্স, জিম মরিসন, কার্ট কোবেইন, এমি ওয়াইনহাউজই নন, এই সারিতে যুক্ত আছেন ক্রিস বেইল, ব্রায়ান জোন্স, জ্যানিস জোপলিনের মতো আরও কিছু বড় বড় নাম। এ সকল তারকাদের সবারই বয়স থেমে আছে কাকতালীয়ভাবে ২৭ বছরে।
কেউ দুর্ঘটনায়, কেউবা আবার স্বেচ্ছায় এই বয়সটাতেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। এমন নয় যে এর আশপাশের বয়সগুলোতে তারকাদের মৃত্যু স্বাভাবিক নয় কিংবা এই বয়সটাতেই মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কেন যেন এই বয়সটাকেই সঙ্গীতজগতে নিয়তির নির্মম পরিহাস হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু কেন, তা এখনও কেবলই ধূম্রজালে ঢাকা রহস্য হয়েই ইতিহাসে অবস্থান করছে। হয়তোবা আর কোনো বয়সে খ্যাতিকে তাচ্ছিল্য করার মতো সাহস সঙ্গীত জগতের বড় বড় তারকারা আর দেখায়নি। যাদের জীবন ঘড়ির কাঁটাটি স্থবির হয়ে আছে সাতাশেই, সেই সকল তারকাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘দ্য টুয়েন্টি-সেভেন ক্লাব’। এই ক্লাবটা এখন পর্যন্ত পপ কালচারের সবচেয়ে বড় উপকথাগুলোর একটা বলে বিবেচিত হয়। কিছুটা বিদ্রূপেরই উদ্রেক করে ব্যাপারটা যে, কাউকে এই ক্লাবের সদস্য হতে হলে তাকে অবশ্যই মৃত হতে হবে।
শুরুটা অবশ্য সাতাশ বছর বয়সে যারা অন্তিম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের নিয়ে নয়। এই ধারণার শুরুটা হয় ছ’জন সংগীতজ্ঞদের নিয়ে, যারা ছিলেন অগ্রগতির চূড়ায়। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে খুব অল্প সময়ের মাঝে অর্জিত সাফল্যে তাক লাগিয়ে দিতে সক্ষম হন গোটা বিশ্বকে। জনমানুষের অন্তরে স্থান করে নিতেও তাদের বিশেষ একটা বেগ পেতে হয়নি। পৃথিবী তখন তাদের হাতের মুঠোয় বন্দি, আর তাঁরা, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত। কিন্তু এসব ছেড়ে অজানার দেশে পাড়ি জমানোর ব্যাপারটা অবাক করে পুরো পৃথিবীকে কষ্ট দেয়।
এমন সম্ভাবনাময় তরুণদের অকাল প্রয়াণ শোকের চাদরে ঢেকে দেয় গোটা বিশ্বকে। মানুষ তাদেরকে মনে রাখার চেষ্টা করে কর্ম দিয়ে। জিমি হেন্ড্রিক্স, জ্যানিস জোপলিন, ব্রায়ান জোন্স, জিম মরিসন, কার্ট কোবেইন, এমি ওয়াইনহাউজ- এ ছয় সম্ভাবনাময় তরুণের মৃত্যুই বলতে গেলে জন্ম দেয় টুয়েন্টি সেভেন ক্লাবের। অবশ্য প্রথমে তাদের ডাকা হতো ‘দ্য ট্র্যাজিক সিক্স’ নামে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, কাকতালীয়ভাবে তাদের মৃত্যু হয় সাতাশে। তবে এখন আর সংখ্যাটা আর ছয়ে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সংখ্যাটা, অভিযোগ-অনুযোগের পাল্লাটা ভারি করে।
উনিশ’শো সত্তরের দিকে চার বছরের মধ্যে (১৯৬৯-১৯৭১) আমেরিকান সংগীত জগত চারটি জ্বলজ্বল নক্ষত্রকে হারায়। শুরুটা হয় ব্রায়ান জোন্সের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। জোন্স ছিলেন দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড ‘দ্য রোলিং স্টোনস’ এর প্রাথমিক সদস্যদের একজন। তার ড্রাগ আসক্তির কারণে ব্যান্ডে তার অবস্থা দিনকে দিন দুর্বল হতে থাকে। ধারণা করা হয়, যখন ব্যান্ডের ইউএস ট্যুরের প্রাক্কালে তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়, তিনি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এর কিছুদিন পরেই মৃত অবস্থায় তার লাশ সুইমিং পুলে পাওয়া যায়। এর পরের বছর মৃত্যু ঘটে ষাটের দশকের সাইকেডেলিক আন্দোলনের প্রণেতাদের একজন, জিমি হেন্ড্রিক্সের। তিনিও অপরিমিত এবং মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ সেবনের কারণে এসিফিক্জেশনে মৃত্যুবরণ করেন। অসাধারণ গিটারবাদক হিসেবে তিনি বেশ অল্প সময়েই প্রখ্যাত হয়েছিলেন। তাকে নিয়ে দ্য রোলিং স্টোন্স ম্যাগাজিনের এর মত ছিল,
“সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গিটারবাদক [….] ষাটের দশক সবথেকে বড় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের একজন, এক সাইকেডেলিক ‘ভুডু চাইল্ড’, যে কিনা ছড়িয়ে বেড়িয়েছে শব্দের মায়াজাল এবং গাঁজার ধোঁয়া।”
হেন্ড্রিক্সের মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পরেই মারা যান আরেক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, রক এন্ড রোলের রানী খ্যাত, জ্যানিস জোপলিন। তার মৃত্যুর ক্ষেত্রে অবশ্য একাকীত্বের ভারকেই দায়ী করা হয়, যতটা না দায়ী করা হয় মাদক সেবনকে। তবে এই ক্লাবটির ধারণা সূত্রবদ্ধ হয় পাকাপোক্তভাবে সঙ্গীতজগতের এক বিশাল নক্ষত্রের পতনের মধ্য দিয়ে। জোপলিনের এক বছরের মাথায় মারা যান আরেক তরুণ সম্ভাবনাময় শিল্পী যিনি দিয়ে গিয়েছেন অনেক কিছু, দেবার ছিল আরও হয়ত বহু কিছু! কালজয়ী ব্যান্ড ‘দ্য ডোরস’ এর গীতিকার ও সুদর্শন গায়ক, জিম মরিসনের অকাল মৃত্যু এখনো রক সংগীত অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি বলে বিবেচিত হয়। এখনও নতুন ব্যান্ডগুলো গান রচনা করে তাকে স্মরণ করে। এমন অসময়ে চলে যাওয়া, যাদের হয়তো দেয়ার ছিল বহু কিছু, সেই ভঙ্গুর আশাগুলো থেকেই হয়ত ভক্তকূলের মাঝে ‘টুয়েন্টি সেভেন ক্লাব’ এর ধারণার বীজ বপন হয়।
প্রায় বিশ বছর পরে, ১৯৯৪ সালে পতন ঘটে আরেক তারার। ধারণা করা হয়, তিনি বেঁচে থাকলে পৃথিবী বদলাতেন গান দিয়ে। তরুণদের আশা-নিরাশার দৃপ্ত কণ্ঠ হয়ে, কিংবা তাদের পথপ্রদর্শক। ৯০ এর দশকের সবচেয়ে বড় নামগুলোর একটা ছিল কার্ট ডোনাল্ড কোবেইন এবং তার ব্যান্ড নিরভানা। তার গাওয়া কিংবা রচিত গানগুলো এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আশির দশকের শেষ প্রান্তে এসে হঠাৎ তার পদধূলিতে গোটা বিশ্ব ছিল বিস্মিত, বিমোহিত। সবাই ধরেই নিয়েছিল যে তিনি এসেছেন গানের জগতে রাজ্য গড়তে, ঢেলে সাজাতে রক সাম্রাজ্যের নকশা। কিন্তু তার নিজের হয়ত ছিল ভিন্ন পরিকল্পনা। এম টিভিতে এক একক অ্যাকুইস্টিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নিজের মত করে বিদায় জানান বিশ্বকে। এমনকি মঞ্চটাকেও তিনি সাজাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো করে! তার কিছুদিনের মাথায় আত্মহত্যা করেন অঢেল গুণের অধিকারী মানুষটা।
তার মৃত্যুর জন্য তার তৎকালীন প্রেমিকাকে দায়ী করা হয়, যার বিরহেই হয়ত এমন হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোবেইন। তবে কারণ যা-ই হোক, তিনি নিজ থেকেই বেছে নিয়েছিলেন ২৭ বছর বয়সটা, নতুন করে পালে হাওয়া দিতে ২৭ বছরের সাথে জড়িত উপকথাটাকে। তার মৃত্যুর পরপরই জনপ্রিয় হয় ‘Forever 27’ শব্দ যুগলটি, এই চক্রান্ত তত্ত্ব (Conspiracy Theory) নিয়ে নির্মিত হয় ছবি, রচনা করা হয় গান। বলতে গেলে কোবেইনের মৃত্যু আক্ষরিক অর্থেই ‘টুয়েন্টি-সেভেন ক্লাব ‘ এর পপ-কালচারে দৃঢ় করে দেয়। ২০১১ সালে ২৭ বছর বয়সেই ব্রিটিশ পপ-তারকা এমি ওয়াইনহাউজের মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগসেবনে মৃত্যু এই ঘটনাগুলোকে আবার বিশ্বের নজরে আনে নতুন করে।
কেবল একজন-দুজন নন, প্রায় ৫০ এরও অধিক সংখ্যক তারকাদের নিয়ে ‘টুয়েন্টি সেভেন ক্লাব‘ এর সদস্য তালিকা বানানো হয়েছে, যারা মৃত্যুবরণ করেছেন ২৭ বছর বয়সে। সেই তালিকায় যেমন নাম আছে প্রসিদ্ধ কিছু সঙ্গীত শিল্পীর তেমনই নাম আছে নামিদামি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। আর যেহেতু এটিকে সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে বড় ভ্রান্ত ধারণাগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়, এ নিয়ে চর্চার কোন কমতি নেই। সাদা লাইটার এর অভিশাপ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ গবেষকদের অনুসন্ধান সব কিছুরই সাক্ষী হয়ে আছে সময়। লেখা হয়েছে কত শত প্রতিবেদন, ছাপানো হয়েছে বই, নির্মাণ করা হয়েছে ছবি।
তাদের প্রতি নিখাদ ভালবাসা থেকেই হয়ত এত বছর পরও আমরা স্মরণ করে যাই তাদের কীর্তি। তাদের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই ২০১৮ এর মার্চের ১১ তারিখ সুইজারল্যান্ডে আয়োজন করা হয়েছে এই ক্লাবের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘The 27 Club-Legends Never Die’ কনসার্টের। হয়তো পরিসংখ্যান-বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায়নি এই ক্লাবের অস্তিত্ব, কিন্তু মানুষের বিশ্বাসের অনেক শক্ত গাঁথুনি এই ধারণা গেঁথে ফেলেছে। তাদের প্রতি ভালবাসা অগ্রাহ্য করে, বিজ্ঞান শত প্রমাণ দিয়ে যে তাতে ঘুণ ধরাবে সেই সম্ভাবনা তাই আজও বেশ ক্ষীণ বলেই মেনে নিতে হয়।
ফিচার ইমেজ: Insight Magazine.