জমকালো মুখোশ, অভিনয়ে আকস্মিক আবেগ, কৌতুক ও হাস্যরসের সরব উপস্থিতি এবং আকর্ষণীয় নাচ ও কস্টিউম- এর সবক’টি জিনিসই উপস্থিত দর্শক ও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে দিতে পারে। মঞ্চের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা আর রঙিন পোশাকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অসামান্য উপস্থিতি অনেক কিছু মনে করিয়ে দিতে পারে। অতীতের রাজা ও রাজবংশের গল্প, গ্রামের লোককথা, পারিবারিক কাহিনী, ভূত-প্রেতের উপদ্রব এমনকি নিছক হাস্যরস; এর সবই উপস্থাপনার গুণে অভাবনীয় ও সুন্দর হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, এটা আর কিছু নয়, জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাবুকি থিয়েটার।
কাবুকি আসলে জাপানের এক ধরনের পারফর্মিং আর্ট। এর শুরু মূলত জাপানের লোকনৃত্য ও সঙ্গীতের হাত ধরে হয়েছিলো। শব্দটির আক্ষরিক অর্থই হচ্ছে ‘দক্ষতার সাথে নৃত্য পরিবেশন ও গান করা।’ কিন্তু পরবর্তীতে শুধু নাচ বা গানের মতো ছোট ক্ষেত্রে এটি বন্দী হয়ে থাকেনি। ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়তে বাড়তে মঞ্চের মতো বড় পরিসরে এর বিকাশ হয়েছিলো। ফলে এটি হয়ে উঠেছিলো জাপানের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
কাবুকি থিয়েটারের ইতিহাস এর মতোই বৈচিত্র্যময়। ধারণা করা হয়, আনুমানিক ১৬০৩ সালে কাবুকি থিয়েটারের উৎপত্তি। জাপান তখন তোকুগাওয়া শোগুন শাসকদের অধীনে ছিল। জাপানে সে যুগটি কিয়োটো থেকে সরিয়ে রাজধানী ইডো- অর্থাৎ আজকের টোকিয়োতে সরিয়ে আনার জন্য ‘ইডো পিরিয়ড’ নামে খ্যাত হয়ে আছে। কাবুকির প্রাথমিক পারফর্মেন্সে তখন শুধু নারীরা অংশ নিতো। নাচ, গান বা অভিনয়ের জন্য নারী বা পুরুষ চরিত্র যেটাই হোক- কস্টিউম ও মেকআপের বদৌলতে নারীরাই কাজ চালিয়ে দিতো।
ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কাবুকির উদ্ভব যার হাত ধরে, সেই ইজুমোনো ওকুনি রাজপ্রাসাদে প্রদর্শনীর অনুমতি পেলেন। সেসময় অনেক ছোট ছোট দল নাচ ও গানের মাধ্যমে বিনোদনের আয়োজন করতো। ওকুনির সাফল্যে তারাও উঠে পড়ে লাগলো। প্রথমদিকে কাবুকি থিয়েটারের বিষয়বস্তু আজকের মতো এত বেশি ছিলো না। এর উৎপত্তি হবার সময় শুধুমাত্র হালকা চাল এবং যৌন ও স্পর্শকাতর বিষয় প্রচুর পরিমাণে থাকার কারণে এর দর্শক বেশি হচ্ছিলো। ফলে জাপানের সরকার নিয়ন্ত্রিত পতিতালয়গুলোতে কাবুকির চল বাড়তে শুরু করলো। একে কেন্দ্র করে টি হাউজ, রেস্তোরাঁ, মদের দোকান ও অন্যান্য বিনোদনের কেন্দ্র গড়ে উঠছিলো।
১৬২৯ সালের দিকে কাবুকি জাপানি শোগুনদের রোষানলে পড়ে। ফলে নারীদের অভিনয় ও গানের কাবুকি নিষিদ্ধ হয়ে গেলো। সরকারের মনে হয়েছিলো, এ ধরনের বিনোদনের ফলে সমাজের উঁচু মহলে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেবে। ফলে নারীদের অংশগ্রহণের বদলে ছেলেদের দ্বারা নতুনভাবে চালু করার চেষ্টা হয়েছিলো। একই কারণে এটিও নিষিদ্ধ হলো। ১৬৫০ সালের দিকে কাবুকিতে বয়স্ক পুরুষদের অভিনয় করার প্রচলন হয়েছিলো। এই পর্যায়ে পুরুষ অভিনেতারাই চরিত্রের প্রয়োজনে মেকআপ নিয়ে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় ছিলো। শহরাঞ্চলে কাবুকি থিয়েটারের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়তেই থাকে। ‘নাকামুরা-জা’, ‘ইচিমুরা জা’ ও ‘কাওয়ারাজাকি জা’ এই থিয়েটারগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।
১৬৭৩ সাল থেকে কাবুকি থিয়েটারের স্টাইলে বৈচিত্র্য আসতে শুরু করে। আগেকার সময়ের নিছক নাচ ও গানের প্রদর্শন থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা নাটকীয়তার দিকে মোড় নেয়। এসময় অন্যান্য আরো কিছু বিনোদন মাধ্যমের প্রভাব কাবুকির উপর পড়তে থাকে। এর মধ্যে জাপানের ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচের অনুষ্ঠান ‘বুনরাকু’ কাবুকির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কাবুকি থিয়েটারও এই পুতুলনাচের বিকাশে সহায়ক ছিলো। এই সমন্বয়ের ফলে কাবুকি থিয়েটার থেকে বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় নাট্যকারের জন্ম হয়। তাদের মধ্যে চিকামাৎসু মঞ্জিমোন অন্যতম।
১৮৪০ সালের দিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণে কাবুকি থিয়েটারগুলো ইডোর উত্তরদিকে আসাকুসা এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এই সময়কে কাবুকির স্বর্ণযুগ বলা হয়। আসাকুসা অঞ্চলের সারুয়াকা মাচি এলাকা কাবুকি থিয়েটেরের নতুন যুগের ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায়। এসময় কাবুকি পারফর্ম সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বের শিল্পী, চিত্রকর ও সাহিত্যিকরা এসময় জাপানের এমন তুলনাহীন মঞ্চ অভিনয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন। সেসময়ের অন্যতম কাবুকি নাট্যকার ছিলেন কাওয়াতাকে মোকুয়ামি। তার অনেক নাটক এখনও কাবুকি থিয়েটারগুলোতে অভিনীত হয়।
১৮৬৮ সালে জাপানে মেইজি সংস্কার চালু হয়। এসময় পশ্চিমা বিশ্ব জাপানের শিল্পকলা সম্পর্কে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাইরের পৃথিবীর সাথে জাপানের যোগাযোগ আরো দৃঢ় হয়। ফলে কাবুকি থিয়েটারের প্রাচীন ধারার সাথে নতুন ভাব ও রুচি যুক্ত হলো। ফলে এর আন্তর্জাতিক আবেদন আরো বেড়ে গেলো। আর কাবুকি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে এটিই জাপানের অন্যতম পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বিশ শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের সূত্রে মিত্রবাহিনী কাবুকি থিয়েটার সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে। ১৯৪৭ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
কাবুকি থিয়েটারের মঞ্চের গঠন বেশ অভিনব। সাধারণ বড় চারকোণা মঞ্চের সাথে দর্শক সারির মাঝখানে পথের মতো লম্বা জায়গা যুক্ত থাকে। এ ব্যবস্থাকে ‘হানামিচি’ বলা হয়। ইউরোপ বা আমেরিকার আধুনিক থিয়েটারে এমন অকল্পনীয় ব্যাপার ভাবাই যায় না। মঞ্চের এমন অবস্থান নাটকের ভেতর হঠাৎ কোনো চরিত্রের আবির্ভাব, আকস্মিক দৃশ্যের অবতারণা ও চমক দেওয়া সংলাপের সবচেয়ে কার্যকর আমেজ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া ‘কেরেন’ নামের একধরনের চোরা দরজার ব্যবহার প্রচলন ছিল। এখনকার কাবুকি থিয়েটারে রিভলভিং স্টেজও ব্যবহৃত হয়। একে ‘মাওয়ারি বুতাই’ বলা হয়।
কাবুকি অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা চরিত্রের প্রয়োজনে কস্টিউমের সাথে দড়ি বেঁধে মঞ্চ জুড়ে বা অডিটোরিয়ামে শূন্যে ভেসে বেড়াতে পারতেন! এই ব্যবস্থাকে ‘চুনোরি’ বলা হয়। ‘কুরোকু’ নামে এক অভিনব পদ্ধতিতে মঞ্চের পর্দা খোলা থাকা অবস্থায়ই দৃশ্যের প্রয়োজনে মঞ্চের পরিবেশ পরিবর্তন করা হয়। এ পদ্ধতিতে ‘হিকি দোগু’ বা ছোট চলন্ত মঞ্চের মাধ্যমে দৃশ্যের মধ্যে দৃশ্য তৈরি হয়। পেছনে থাকা সাহায্যকারীদেরই কুরোকু বলা হয়ে থাকে। তারা সাধারণত কালো পোশাক পরে থাকেন, যাতে দৃশ্য পরিবর্তনের সময় তাদের দেখা না যায়।
এ থিয়েটারে কালো, লাল ও সবুজ রঙের স্ট্রাইপ দেওয়া পর্দা ব্যবহৃত হয়। কাবুকি থিয়েটারের নাটক সাধারণত তিন রকমের হয়। ঐতিহাসিক নাটক ‘জিদাইমোনো’ নামে, প্রতিদিনের জীবন ও হাস্যরস নিয়ে তৈরি নাটক ‘সেওয়ামোনো’ নামে এবং গানের সাথে নাচ ভিত্তিক নাটক ‘শোশাগোতো’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে জিদাইমোনো ধারা জাপানের ইতিহাসে যুদ্ধ বিগ্রহে ভরপুর ‘সোনগোকু’ পিরিয়ডের ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়। অন্যদিকে ‘সেওয়ামোনো’ ধারায় ইতিহাস বা রাজনৈতিক উত্থান পতনের কোনো বিষয় থাকে না।
এই থিয়েটারের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্রের প্রয়োজনে মুখোশ ও মুখমণ্ডলে রঙের বিচিত্র ব্যবহার। নাটকের প্রকার ও চরিত্রের ধরনের উপর মুখমণ্ডলের রং ভিন্ন ভিন্ন হয়। কালো রং মানবিক আবেগ বোঝাতে, হলুদ রং বিদ্রোহী ভাব বোঝাতে ও সাদা রং খল ও দুশ্চরিত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। অনেকে ধারণা করে থাকেন, চরিত্রের ভিন্নতা বোঝাতে রঙের এই ব্যবহার চীনের বেইজিং ও সাংহাই অপেরার প্রভাবে হয়েছে। তবে এমন মতামতের পেছনে ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না।
জাপানের বিভিন্ন স্থানে নামকরা কাবুকি থিয়েটার রয়েছে। এসবের মধ্যে রাজধানী টোকিয়োতে ‘শিনবাশি এনবুজো’, ‘মেইজি জা’ ও ‘কাবুকি জা’, কিয়োটোতে ‘মিনামি জা’, ওসাকায় ‘শিন কাবুকি জা’, কাগাওয়াতে ‘হাকাতা জা’ ও নাগোয়ায় ‘মিসোনো জা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ২০০৫ সালে জাপানের কাবুকি থিয়েটার ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ বলে ঘোষিত হয়েছে। এই থিয়েটার শুধু জাপানের নয়, এশিয়ার সাংস্কৃতিক অর্জনের এক অনন্য উদাহরণ।