যখন থেকে মানব সভ্যতার সূচনা, তখন থেকেই রয়েছে ধর্ম। সেই ধর্ম আজকের মতো এত প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না, যা যুগে যুগে বিকশিত হয়েছে, রূপান্তরিত হয়েছে, পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত কিংবা বিলুপ্ত হয়েছে।অনেক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এসেও ধর্ম আজও পৃথিবীতে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তথাপি, বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান ৪৩০০ ধর্মের বাইরেও একটি ‘ধর্ম’ রয়েছে যার অনুসারী প্রধান ৪টি ধর্মের মতোই অনেক বেশি। সেটি হলো ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক মানুষজন, যাদের সংখ্যা ১২০ কোটিরও বেশি। এর বাইরে বিভিন্ন ধর্মের আকার নির্ধারণ করা হয় সেই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যার বিবেচনায়।
বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা হিসেব করেছে কেবল একটিই অনলাইন প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডহারেন্টস ডটকম’। তথাপি, বিশ্বজুড়ে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে কিংবা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল হওয়ায় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীর সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে। অন্যদিকে ২০১২ সালে পিউ রিসার্চের পর এরূপ তালিকা এখন পর্যন্ত আর করা হয়নি। ২০১২ সালের তালিকাটিকেই এখনো বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী সংখ্যা নির্ণয়ে প্রধান রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে তালিকার প্রথম ১০টি ধর্ম নিয়েই আজকের আয়োজন।
১. খ্রিস্টান ধর্ম
যীশুখ্রিস্টের জীবন ও শিক্ষার উপর ভিত্তি করে প্রচলিত হয় খ্রিস্টান ধর্ম। এটি একটি আব্রাহামিক ধর্ম (আব্রাহামিক ধর্ম ৩টি, খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং ইহুদী ধর্ম)। পৃথিবীর বৃহত্তম এ ধর্মের অনুসারী সংখ্যা পৃথিবীজুড়ে প্রায় ২৪০ কোটির মতো। এর মূল ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বাইবেল, যার রয়েছে দুটি খণ্ড, ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ এবং ‘নিউ টেস্টামেন্ট’। এ ধর্মের অনুসারীদের উপাসনালয়কে বলা হয় চার্চ বা গির্জা। খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব হয় খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে যীশুখ্রিস্টের পৃথিবীতে আগমনের মাধ্যমে। তার মৃত্যুর পর তার অনুসারীগণ এ ধর্মমত প্রচার করেন।
উল্লেখ্য, ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস, যীশুখ্রিস্ট, তথা হযরত ঈসা (আ:) মৃত্যুবরণ করেননি এবং তিনি শেষ জামানায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন।
খ্রিস্টধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কয়েকটি ভিন্ন মতবাদ আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় দুটি হলো ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়। রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারীর সংখ্যাই বেশি, প্রায় ১৩০ কোটির মতো। অন্যদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট মতের অনুসারী আছে ৯০ লাখের অধিক। তবে খ্রিস্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে বলেই জানা যায় বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে।
২. ইসলাম ধর্ম
“আল্লাহ ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, হযরত মুহাম্মদ (স:) তার প্রেরিত রাসূল”, এটিই হলো ইসলাম ধর্মের মূল বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এ ধর্ম, যার অনুসারী সংখ্যা ১৮০ কোটির বেশি। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, ইসলাম হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্মের নাম। এ ধর্মের অনুসারীগণ মুসলিম নামে পরিচিত। প্রায় সকল মুসলিমই দুটি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। সুন্নি মতাবলম্বী ৮৫-৯০ ভাগ এবং শিয়া মতাবলম্বী ১০-১৫ ভাগ। পৃথিবীর ৫০টি দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তথাপি বিশ্বের প্রায় সব দেশে, সব অঞ্চলেই মুসলমানদের বসবাস রয়েছে।
ইসলাম ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআন, যা আল্লাহ হযরত জিবরাইল (আ:) এর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (স:) এর উপর নাযিল করেছেন। তাছাড়া এ ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যার জন্য আছে হাদীস এবং তফসির গ্রন্থাদি। কালেমা, নামায, রোজা, হজ্ব এবং যাকাত- এই পাঁচটিকে বলা হয় ইসলামের মূল স্তম্ভ এবং মুসলিম হতে হলে অবশ্য করণীয়। ইসলাম ধর্মের উপাসনালয়ের নাম মসজিদ। এটিও একটি আব্রাহামিক ধর্ম। এ ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থান মক্কায় অবস্থিত ক্বাবা শরীফ।
৩. হিন্দুধর্ম
হিন্দুধর্ম কিংবা সনাতন ধর্ম, যা-ই বলা হোক না কেন, অনুসারীর দিক থেকে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম এ ধর্মকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। এ ধর্মের ১২০ কোটি অনুসারীর প্রায় সবারই বসবাস ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায়। পণ্ডিতদের মতে, হিন্দুধর্ম হলো আবহমান ভারতবর্ষের শত শত বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যময় ভাবধারার সংমিশ্রণ ও সমন্বয়। এ ধর্মের প্রচলন হাজার হাজার বছর পূর্বে মানুষের প্রকৃতি পূজার মাধ্যমে শুরু হলেও আনুষ্ঠানিক সমন্বয় শুরু হয় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৈদিক যুগের বিলুপ্তির সাথে সাথে, যা মধ্যযুগে এসে পূর্ণতা পায়।
পবিত্র বেদ, উপনিষদ, গীতা হলো হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। ধর্মগ্রন্থগুলো শ্রুতি এবং স্মৃতি- এই ২ শ্রেণীতে বিভক্ত। এ ধর্মের উপাসনালয়কে বলা হয় মন্দির, যেখানে পূজাপাঠ, জপ ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। এ ধর্ম জীবনের চারটি লক্ষ্যের কথা বলে। ধর্ম তথা নৈতিকতা ও কর্তব্য, অর্থ তথা কাজ, কাম তথা আকাঙ্ক্ষা, মোক্ষ তথা মুক্তিলাভ। হিন্দুধর্মে সৃষ্টিকর্তার সংখ্যা নিয়ে একাধিক বিশ্বাস রয়েছে, রয়েছে একেশ্বরবাদ ও বহু-ঈশ্বরবাদ উভয়ই। তবে ত্রিমূর্তি নামে পরিচিত তিনজন প্রধান ঈশ্বরেই অধিকাংশ হিন্দু বিশ্বাস করেন। তারা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব। এ ধর্মে রয়েছে মানুষের চারটি বর্ণ- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
৪. বৌদ্ধধর্ম
অনুসারী সংখ্যায় পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ধর্মের নাম বৌদ্ধধর্ম। পৃথিবীজুড়ে এ ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৫১ কোটি বা ততধিক। মহামানব সিদ্ধার্থ তথা গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত বিশ্বাস ও জীবনদর্শনই বৌদ্ধ ধর্ম। এ ধর্মের উপাসনালয় মঠ নামে পরিচিত। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ সেখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম ত্রিপিটক। বৌদ্ধধর্মের প্রধান দুটি মতবাদ হলো হীনযান এবং মহাযান। নৈতিক জীবন ধারণ করে, কর্মের মাধ্যমে পরম জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধি অর্জন করে দুঃখ-দুর্দশা এবং পুনর্জীবনের চক্র থেকে মুক্তিলাভই বৌদ্ধদের জীবনের লক্ষ্য।
এ লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারলে বলা হয় তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন। অর্থাৎ, পুনর্জন্মের চক্র থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন, এ জন্মে মৃত্যুর পর তার আর জন্ম নেই। বৌদ্ধধর্মের মূলনীতিগুলো হলো চতুরার্য সত্য বা জীবনের চারটি প্রধান জ্ঞান, অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা দুঃখ দূর করবার আটটি উপায় এবং ত্রিশরণ মন্ত্র। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বৌদ্ধধর্মালম্বী মানুষের বসবাস চীনে। তাছাড়া থাইল্যান্ড, জাপান, মায়ানমার, শ্রীলংকা, নেপাল ও ভুটানে বৌদ্ধধর্মালম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশের আদিবাসীদের বড় অংশই বৌদ্ধ।
৫. চীনা লোক ধর্ম
চীনারা ধর্ম পালনে খুব একটা আগ্রহী নয়, এটা সকলেরই জানা। তথাপি, চীনের সুবিশাল জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ ধার্মিকও বটে। এর মধ্যে চীনের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সম্প্রদায় হলো হানজু বা হ্যান সম্প্রদায়। তারা যে ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী তাকেই চীনা লোক ধর্ম বা হ্যান ধর্ম বলা হয়।
পৌত্তলিক এ জাতিগোষ্ঠী একাধিক দেবতায় বিশ্বাস করে যারা প্রত্যেকে মানবজীবনের ভিন্ন ভিন্ন দিকগুলো নির্ধারণ করে। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে পূজা করা এ ধর্মের প্রধান উপাসনা। এ ধর্মকে অনেক পণ্ডিতই হ্যান জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের পরিবর্তিত সংস্করণ বলে অভিহিত করেন। কেননা, হ্যান রাজবংশের শাসনামলে, আনুমানিক খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়। তবে হ্যানদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সংমিশ্রণ ঘটে তার পরিবর্তনও ঘটে। এ পরিবর্তন অধিক পরিমাণে ঘটে মধ্যযুগে। বর্তমানে এ ধর্মের অনুসারী ৪০ কোটির কাছাকাছি।
৬. শিখ ধর্ম
পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ধর্ম, শিখ ধর্মের অনুসারী প্রথম ৫টি ধর্মের তুলনায় অনেক কম। বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৩ কোটি শিখ ধর্মের অনুসারী রয়েছেন, যাদের সিংহভাগের বসবাস উত্তর ভারতের পাঞ্জাবে। ১৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে পাঞ্জাবেই এ ধর্মের আবির্ভাব ঘটে শিখদের প্রথম ধর্মপ্রচারক গুরু নানকের হাত ধরে। গুরু নানকই হলেন শিখ ধর্মের প্রথম ধর্মগুরু। তারপর একে একে ৯ জন গুরুর দায়িত্ব পালন করেছেন। একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করা এ ধর্মানুসারীদের জীবনধারণের দিকনির্দেশনা ঠিক করে দেন গুরুগণ। শিখ শব্দটির অর্থই শিষ্য। অর্থাৎ, এ ধর্মের অনুসারীগণ সকলেই গুরুর শিষ্য।
তবে, শিখদের দশম তথা বর্তমান গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং এই গুরু পরম্পরার ইতি টেনেছেন। শিখ ধর্মের পবিত্র গ্রন্থকেই তিনি নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছেন। অর্থাৎ, এ ধর্মগ্রন্থই অনাগত দিনে শিখদের পথচলার নিদর্শন হবে। তিনি এর নামকরণ করেছেন ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’। এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে মানবজাতির সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাওয়াই এ ধর্মের মূল শিক্ষা। শিখরা আরো বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে প্রচলিত কোনো ধর্মই পরম সত্য নয় কিংবা কোনো ধর্মই সর্বৈব মিথ্যা নয়।
৭. ইহুদী ধর্ম
একেশ্বরে বিশ্বাসী, আব্রাহামিক ধর্ম ‘জুডাইজম’ তথা ইহুদী ধর্ম অনুসারীর দিক থেকে বিশ্বের ৭ম বৃহৎ ধর্ম। পৃথিবীজুড়ে এ ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ১.৪-১.৭ কোটির মতো, যার ৪৩ ভাগই ইসরায়েলে বসবাস করে। আমেরিকা এবং কানাডায় বসবাস করে আরো ৪৩ শতাংশ ইহুদী ধর্মাবলম্বী। অবশিষ্টরা লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা আর এশিয়ায় বসবাস করে। ইহুদী ধর্মের ইতিহাস ৩ হাজার বছরেরও অধিক পুরনো। ব্রোঞ্জ যুগে মধ্যপ্রাচ্যে এ ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
মূল ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেল, যা তানাখ নামে পরিচিত। অনেক ইতিহাসবিদের দাবি, পরবর্তীকালের আব্রাহামিক ধর্মগুলো, যেমন- খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম, ইহুদী ধর্মের অনেক রীতিনীতি ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। তাছাড়া, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও আইনব্যবস্থাও ইহুদী ধর্মের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। ইহুদী ধর্মের প্রধান তিনটি সম্প্রদায় হলো অর্থোডক্স, কনজারভেটিভ এবং রিফর্মিস্ট।
৮. বাহাই ধর্ম
বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত ও অনুসারী সংখ্যায় বৃহৎ ধর্মগুলোর তালিকায় বাহাই ধর্ম সবচেয়ে নতুন। উনবিংশ শতাব্দীতে মির্জা হুসাইন আলী তথা বাহাউল্লাহ তৎকালীন পারস্যে (বর্তমান ইরান) এ ধর্মের সূচনা করেন। অনেকেই একে ধর্ম না বলে একটি বিশেষ বিশ্বাস হিসেবেও উল্লেখ করতে চান। ‘কিতাবুল আকদাস’ এ ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ। আর মানবজাতির ঐক্য ও মেলবন্ধনই এ ধর্মের মূল লক্ষ্য। বাহাই বিশ্বাস হচ্ছে স্বর্গীয় প্রতিনিধির সিলসিলায় বিশ্বাস, যে সিলসিলা বাহাউল্লাহর মাধ্যমে শেষ হয়েছে।
হযরত ইব্রাহীম (আ:), গৌতম বুদ্ধ, যীশুখ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত মুহাম্মদ (স:)- প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন স্বর্গীয় প্রতিনিধি, যারা নিজেদের যুগের প্রয়োজনানুসারে একেকটি ধর্ম প্রবর্তন করেছেন। তাদের পৃথিবীতে আগমনের সেই ধারাবাহিকতা বাহাউল্লাহর মাধ্যমে শেষ হয়েছে বলে বিশ্বাস করে এই ধর্মের অনুসারীরা। তিনি মানবজাতির সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করে দিয়ে গেছেন, আর তা হলো ঐক্য। বিশ্বের ২০০’র অধিক দেশে ৭০ লক্ষাধিক মানুষ বাহাই ধর্মের অনুসারী। তবে, প্রতিটি দেশেই বাহাই ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা নানাবিধ অত্যাচার ও বঞ্চনার শিকার হন। বিশেষ করে এ ধর্মের উৎপত্তিস্থল ইরানেই সবচেয়ে বেশি হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটে।
৯. জৈন ধর্ম
সংস্কৃত শব্দ ‘জৈন’ এর অর্থ বিজয়ী। এই বিজয়ী দ্বারা যুদ্ধজয়ীকে বোঝায় না, বরং মানুষের যাবতীয় অনৈতিক গুণাবলী থেকে নিজেকে মুক্ত করাকে বোঝায়। জৈন ধর্মের মূল বিশ্বাস হলো পৃথিবীতে ২৪ জন ‘তীর্থঙ্কর’ তথা বিজয়ী মহাপুরুষের আগমন, যারা নিজ নিজ সময়ে মানবজাতির ত্রাণকর্তা এবং শিক্ষক ছিলেন। এই ২৪ জনের মাঝে সর্বপ্রথম পৃথিবীতে এসেছিলেন ঋষভ, যার আগমন ঘটেছিল লক্ষ লক্ষ বছর আগে। আর সর্বশেষ ২৪ তম তীর্থঙ্কর মহাবীরের আগমন ঘটে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে। নির্দিষ্ট কোনো ঈশ্বর নয়, বরং কালে কালে তীর্থঙ্কররাই পৃথিবীতে মানবজাতির দিকনির্দেশনার জন্য আসেন। মোটামুটি জৈন ধর্মের মূল বিশ্বাস এটিই।
এ ধর্মের দুটি প্রধান মতবাদ হলো ‘দিগম্বর’ এবং ‘শ্বেতাম্বর’। একে পুরোপুরি ভারতীয় ধর্মই বলাচলে। কেননা এর উৎপত্তি ভারতে হওয়ার পাশাপাশি আচার, রীতিনীতিও ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মূলত, অহিংসা ও আত্মসংযমের মাধ্যমে জন্ম-মৃত্যু-জন্মের চক্র থেকে মোক্ষ তথা মুক্তি লাভই হচ্ছে এ ধর্মের মূলকথা। বিশ্বে ৪০ লক্ষাধিক জৈন ধর্মানুসারী মানুষ আছেন, যাদের এক-তৃতীয়াংশের বসবাস ভারতে। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা এবং কিছু ইউরোপীয় দেশেও জৈনদের বসবাস দেখা যায়।
১০. শিন্তো ধর্ম
জাপানের স্থানীয় এবং অনানুষ্ঠানিক একটি রাষ্ট্রীয় ধর্ম শিন্তো এমন একটি ধর্ম, যার কোনো ঈশ্বর নেই, প্রচারক নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই, পরকাল নেই, নেই কোনো বিধিবদ্ধ রীতিনীতি। ৮ম শতকে বিকশিত হওয়া এ ধর্মকে বরং অনেকে জাপানের এক শ্রেণীর মানুষের বিশেষ জীবন ধারণের পন্থা হিসেবে অভিহিত করেন। শিন্তো ধর্মের মূল কথা হলো, সৃষ্টিকর্তা বলতে কেউ নেই, তবে কিছু স্বাধীন আত্মা বা স্বর্গীয় স্বত্ত্বা আছেন, যাদের নাম ‘কামি’। এই কামিরা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণকামী। তাই মানুষের উচিৎ তাদের পূজা করা, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খুশি রাখা।
শিন্তো ধর্ম পুরোটাই স্থানীয় এবং ব্যক্তিপর্যায়ের। এ ধর্মের মন্দিরগুলোয় কোনো বৃহৎ লোক সমাগম হয় না। বরং অধিকাংশ মানুষের বাড়িতেই ছোট্ট একটি মন্দির রয়েছে। তবে শিন্তো ধর্মের উৎসবগুলোতে জাপানের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই অংশগ্রহণ করে। যেহেতু শিন্তো ধর্মের কোনো বাঁধাধরা নিয়মকানুন নেই, এ ধর্মের অনুসারী হবার জন্যও নেই কোনো বিশেষ পন্থা, তাই যেকোনো ধর্মের মানুষই শিন্তো মন্দিরে যাতায়াত করেন, কামির প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করেন। পুরো জাপানজুড়ে ৮১ হাজার শিন্তো মন্দির রয়েছে, যেগুলোতে শিন্ত ধর্মাবলম্বীর চেয়ে সাধারণ মানুষের আনাগোনাই বেশি। পৃথিবীতে এ ধর্মের অনুসারী রয়েছে ৪০ লাখের মতো, যার পুরোভাগেরই বাস জাপানে।