নামখানা লিটল হলেও ব্যাপারখানা কিন্তু ছোটখাট নয়। সাহিত্যের ইতিহাসের ক্রমবর্ধমান ধারায় ‘লিটল ম্যাগাজিনে’র ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসা কথাটা মনে পড়ে যায়, “বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে”। ‘লিটল ম্যাগাজিনে’র ক্ষেত্রে কথাটা বেশ মিলে যায়। অনেক ছোট্ট পরিসরে থেকেও পুরো জাতি বা বাইরের বিশ্বকে খুঁটিয়ে দেখার অভিপ্রায় এই লিটল ম্যাগাজিনের। তাই ফেব্রুয়ারির বইমেলায় পদার্পণের সাথে সাথে লিটল ম্যাগাজিনের চত্বরে ঢুঁ মারার লোভ কয়জনই বা সামলাতে পারে?
লিটল ম্যাগাজিনকে সাধারণত সাহিত্যের এমন একটি মাধ্যম হিসেবে ধরা হয় যেখানে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও অকুতোভয় মতামতের ছোঁয়া পাওয়া যায়। এ ম্যাগাজিনকে অনেকেই অনিয়মিত ও অবাণিজ্যিক বলে অভিহিত করে থাকেন। কণ্ঠস্বরে’র সম্পাদক ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দৈনিক ইত্তেফাককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন “লিটল ম্যাগাজিন আর ব্যবসা এক সাথে হয় না”। আসলেই এই আত্তীকরণ ও আর্থিকায়নের সাহিত্যাঙ্গনে লিটল ম্যাগাজিন এক হার না মানা বারুদ যা সমাজের অসংলগ্নতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সদা সচেষ্ট।
লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা আসলেই বাংলাভাষার অন্যতম খ্যাতিমান লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু’র নামটিও অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলে আসে। লিটল ম্যাগাজিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী হবে এ ব্যাপারে তার ব্যাখ্যাকেই সর্বজনগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার ১৯৫৩ সালের মে মাসের সংখ্যায় ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন-
“এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই- যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি- জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যেসব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়- কৃতিত্ব যেটুকুই হোক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।”
লিটল ম্যাগাজিনের গোড়াপত্তন হয় রালফ ওয়াল্ডো ও মার্গারেট ফুলার সম্পাদিত ‘দি ডায়াল’-এর মাধ্যমে। লিটল ম্যাগাজিনের আরেক প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘সেভয়’। ভিক্টোরিয়ার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিল এই পত্রিকা। সাহিত্যক্ষেত্রে বিশ শতকের গোড়ার দিকে সবচেয়ে নামী লিটল ম্যাগাজিন ছিল ‘পোয়েট্রি’ যাকে বলা হতো ‘এ ম্যাগাজিন অফ ভার্স’ বা কবিতার পত্রিকা। এটি শুরু হয় ১৯১২ সালে যার সম্পাদক ছিলেন হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড। এই ম্যাগাজিন এতোই জনপ্রিয় ছিল যে এখানে কোনো নতুন কবির লেখা ছাপা হলে তাকে আর কখনও পেছনে ফিরে তাকাতে হতো না।
ধীরে ধীরে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সাহিত্যের সেতুবন্ধন লিটল ম্যাগাজিনের আবির্ভাবে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। তাই বঙ্গসাহিত্যের উত্তরণের কাঠামোয় লিটল ম্যাগাজিনের আবেদন ছড়িয়ে পড়ে এই প্রাচ্যেও। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন (১৮৭২) বাংলা ভাষায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিন ধরা হলেও পাশ্চাত্যের আদলে প্রথাবিরোধী, মননশীল গদ্য নিয়ে বঙ্গদেশে যথার্থ লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র (১৯১৪) দিয়ে।
সবুজপত্রে সার্থক সম্পাদনের পরে পরবর্তীকালে কল্লোল (১৯২৩), সওগাত (১৯২৬), শিখা (১৯২৭), কালি ও কলম (১৯২৭), প্রগতি (১৯২৭), পরিচয় (১৯৩১), পূর্বাশা (১৯৩২), কবিতা (১৯৩৫), চতুরঙ্গ (১৯৩৮), শনিবারের চিঠি (১৯২৪) ইত্যাদি পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন প্রবাহকে বেগবান করে।
১৯৪৭-এর পূর্ববর্তীকালে সাহিত্য ও সংস্কৃতির আবাসভূমি কলকাতা হওয়ায় আধুনিকতার জাগরণের সূত্রপাতও হয় সংস্কৃতিমনা শহরটিতেই। তাই ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব বসু ও অজিত কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘প্রগতি’ (১৯২৭) এবং কুমিল্লা থেকে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘পূর্বাশা’ (১৯৩২) ছাড়া বাকি কাগজগুলো কলকাতা থেকেই বের হয়।
বঙ্গভঙ্গের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকে লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষীণ প্রভাব দেখা যায় সাহিত্যাঙ্গনে। ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ও সুচরিতা চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সীমান্ত’ (১৯৪৭-৫২)। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে পত্রিকাটি স্মরণীয় হয়ে আছে। আরেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানীর সম্পাদনায় ১৯৪৯ সালে বের হয় ‘অগত্যা’। এই ম্যাগাজিনে মধ্যবিত্ত ও নব্যনাগরিক জীবন এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে যা সেই সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত এনামুল হকের সম্পাদনায় ‘উত্তরণ’ পত্রিকাটি বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অপরদিকে ফজল শাহাবুদ্দিন সম্পাদিত ‘কবিকণ্ঠ’, সাঈদুর রহমানের ‘খাপছাড়া’, মহিউদ্দিন আহমদের ‘স্পন্দন’, সিরাজুর রহমান সম্পাদিত ‘সংকেত’ প্রভৃতি কাগজ পঞ্চাশের দশকের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে গতিশীল করে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এ সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনের প্রকৃত আন্দোলন শুরু হয়। এই দশকের লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সপ্তক (১৯৬২), বক্তব্য (১৯৬৩), স্বাক্ষর (১৯৬৩), স্যাড জেনারেশন (১৯৬৩), যুগপৎ (১৯৬৩), সাম্প্রতিক (১৯৬৪), কালবেলা (১৯৬৫), কণ্ঠস্বর (১৯৬৫), ছোটগল্প (১৯৬৬), না (১৯৬৭), বহুবচন (১৯৭০), স্বদেশ (১৯৬৯), শব্দের বিকৃতি (১৯৬৯), শিল্পকলা (১৯৭০) প্রভৃতি।
ওবায়দুল ইসলাম ও মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ সম্পাদিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন ‘মুখপত্র’ (১৯৭২)। মফিদুল হক সম্পাদিত ‘গণসাহিত্য’ (১৯৭২) পত্রিকাটি প্রগতিশীল লেখকগণকে নিয়ে সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্রধারা গড়ে তুলেছিল। তিতাশ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় অলক্ত। এ দশকের কথাসাহিত্যধারাকে বেগবান করার ক্ষেত্রে এ পত্রিকাগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। মধ্যসত্তরে আবিদ আজাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কবি’ (১৯৭৫)। পত্রিকাটিতে সমকালীন কবিদের বিশ্লেষণধর্মী কবিতা ছাপা হতো।
সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে আশির দশকের শুরুতে লেখকগণের চিন্তার গভীরতা কমতে থাকে। আর রাজনৈতিক পালা বদলের ফলে মধ্য আশিতে লেখার সংকট দেখা দেয়। তাছাড়া এ সময় মুদ্রণ ব্যয় বেড়ে যায় এবং বিজ্ঞাপনের বিকেন্দ্রীকরণের প্রভাবে লিটল ম্যাগাজিনের জন্য পর্যাপ্ত শ্রম ও সততার তীব্র অভাব লক্ষ করা যায়। এ সংকটময় পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিন আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্পাদিত ‘লোকায়ত’ (১৯৮২) পত্রিকাটি প্রায় তিন দশক ধরে তরুণ সমাজের চিন্তার জগতকে প্রভাবিত করেছিল। তপন বড়ুয়া সম্পাদিত গান্ডীব, সমকালীন প্রগতিশীল নতুন লেখকদের সাহিত্যচর্চার চারণভূমি ছিল। খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ গদ্যমাধ্যমের কবিতা ও কবিতাবিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন। মীজানুর রহমান সম্পাদিত মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা (১৯৮৩), বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত সংস্কৃতি, আবু ইউসুফ সম্পাদিত আত্মপ্রতিকৃতি, মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত ঊষালোকে ম্যাগাজিনগুলোই বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত করেছে।
তবে কালের অববাহিকায় অর্থনীতি আর প্রযুক্তির মেরুকরণে হারিয়ে গিয়েছে অনেক লিটল ম্যাগাজিন। নামের জ্ঞানগর্ভের সত্যতা যাচাইয়ে যেন অধিক সংখ্যক লিটল ম্যাগাজিনগুলো পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। যেভাবেই হোক না কেন, দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রেই জন্মমাত্রই এরা স্বল্পায়ু এমন নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে আছে। যুগের এই পালাবদলে লিটল ম্যাগাজিনের এমন দৈন্যদশার উপযুক্ত সৎকারটুকুও তাই বুদ্ধদেব বসুই করে গিয়েছেন যথাযথভাবে–
“মনে হতে পারে আর্থিক কারণেই এসব পত্রিকা দীর্ঘজীবী হতে পারে না, কিন্তু সেটা শুধু আংশিক সত্য। স্বল্পায়ু হওয়াই এদের ধর্ম। বিশেষ কোনো সময়ে, বিশেষ কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর উদ্যমে, বিশেষ কোনো একটি কাজ নিয়ে এরা আসে, সেটুকু সম্পন্ন করে বিদায় নেয়। সেটাই শোভন, সেটাই যথোচিত।”
featured image: sachalayatan.com