১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ইথিয়োপিয়ায় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। দুই বছর ধরে চলা সে দূর্ভিক্ষে ১২ লক্ষ মানুষ মারা যায়। গৃহহীন হয়ে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় প্রায় চার লক্ষ মানুষ। প্রায় দুই লক্ষ শিশু বাবা-মা হারিয়ে অনাথ হয়ে যায়। ইথিয়োপিয়ার এই দূর্দশা দেখে ব্রিটিশ শিল্পী বব গেল্ডফ ও মিজ ইউর সিদ্ধান্ত নেন তাদের জন্য একটি চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজন করার। বিভিন্ন জনপ্রিয় শিল্পী কনসার্টে গাইবেন এবং তা থেকে অর্জিত অর্থ পুরাটা দান করা হবে ইথিয়োপিয়ায়। ১৯৮৫ সালের ১৩ জুলাই ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে এবং আমেরিকার জন এফ কেনেডি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় লাইভ এইড কনসার্ট। কনসার্ট থেকে প্রায় ১২৭ মিলিয়ন ডলার উত্তোলন করা হয় এবং তা দান করা হয় ইথিয়োপিয়ায়।
যেভাবে শুরু
১৯৮৪ সালে টেলিভিশনে ইথিয়োপিয়ার দুর্ভিক্ষ দেখে বব গেল্ডফ সে দেশে যান স্বচক্ষে অবস্থা দেখতে। গিয়ে চারপাশে মৃত্যু আর একটু খাদ্যের জন্য লাখো মানুষের হাহাকার দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন তাদের জন্য কিছু করার। লন্ডন ফিরে এসে ‘ডু দে নো ইটস ক্রিসমাস’ নামে একটি গান লিখেন তিনি আর মিজ ইউর।
গানটি গাওয়ার জন্য ব্রিটিশ ও আইরিশ বিভিন্ন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীকে আমন্ত্রণ জানান বব। ইথিয়োপিয়ায় ত্রাণ পাঠানোর উদ্দেশ্যে তৈরি করা এই গান ব্রিটিশ টপচার্টে এক নাম্বার স্থান দখল করে নেয়। আমেরিকায় ও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে গানটি। এই গান থেকে প্রায় আট মিলিয়ন পাউন্ড উত্তোলন করা হয় এবং এর পুরোটাই দান করা হয় ইথিয়োপিয়ার ত্রাণ ফান্ডে। এই গানের সফলতা দেখে আমেরিকা থেকেও মাইকেল জ্যাকসন আর লিওনেল রিচির লেখা ‘উই আর দ্যা ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি গান প্রকাশিত হয়। বব ডিলান, লিওনেল রিচি, মাইকেল জ্যাকসনসহ বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীর গাওয়া এই গানের মাধ্যমে ইথিয়োপিয়ার জন্য প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলার উত্তোলন করা হয়।
এই দু’টি গানের সফলতা এবং ইথিয়োপিয়ার প্রতি ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের মায়া দেখে বব গেল্ডফ সিদ্ধান্ত নেন এমন একটি কনসার্ট করার যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল বিখ্যাত শিল্পী অংশগ্রহণ করবেন এবং বিনামূল্যে সংগীত পরিবেশনা করবেন। দর্শকরা টিকিট কেটে কনসার্ট দেখবেন আর সেই টাকা পুরোটাই দান করা হবে ইথিয়োপিয়ার মানুষের জন্য।
১৩ জুলাই, ১৯৮৫
মাত্র দশ সপ্তাহের মধ্যে কনসার্টটির সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন বব। ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামকে নির্ধারণ করা হয় কনসার্টের ভেন্যু হিসেবে। আর আমেরিকায় ববের বন্ধু টনি ভারনা ফিলাডেফলিয়া শহরের জন এফ কেনেডি স্টেডিয়াম নির্ধারণ করেন আমেরিকার ভেন্যু হিসেবে। চ্যারিটি কনসার্টের ধারণা নিয়ে বব গেল্ডফ যত বিখ্যাত শিল্পীর দ্বারস্থ হয়েছেন, সবাই একবাক্যে রাজি হয়েছেন বিনামূল্যে সংগীত পরিবেশনার জন্য। এমন মহৎ কর্মযজ্ঞের অংশীদার হওয়ার সুযোগ কেউই হারাতে চাননি।
একই দিনে দুই দেশে হওয়া এই কনসার্টে উভয় দেশের অন্তত ৭৫ জন বিখ্যাত শিল্পী এবং ব্যান্ড অংশগ্রহণ করে। এখন পর্যন্ত হওয়া অন্যতম বৃহৎ চ্যারিটি কনসার্ট এই লাইভ এইড। ৭৫ জন শিল্পীর মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলো- ইংল্যান্ডের ডেভিড বোয়ি, ডায়ার স্ট্রেইটস, এলটন জন, পোল ম্যাকার্টনি, কুইন, স্টিং, ইউ টু, দ্যা হু ইত্যাদি। আর আমেরিকায় ব্রায়ান অ্যাডামস, জোয়ান বায়েজ, ব্ল্যাক স্যাবাথ, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, মিক জ্যাগার, জুডাস প্রিস্ট, ম্যাডোনা, অজি অসবোর্ন, জিমি পেজ, স্যানটানা এবং নিল ইয়ং সহ আরো অনেকে।
শিল্পীদের মধ্যে ব্যতিক্রমী এক নাম হলো ফিল কলিন্স। তিনি একাধারে একজন গায়ক ও ড্রামার। তিনি ইতিহাসের একমাত্র ব্যাক্তি যে একই দিনে দুই মহাদেশের কনসার্টে অংশ নিয়েছেন। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে পারফরম্যান্স শেষে সাথে সাথে ফিল আমেরিকার ফিলাডেফলিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। জন এফ কেনেডি স্টেডিয়ামে তিনি এরিক ক্ল্যাপটনের জন্য ড্রামস বাজান। এছাড়াও লেড জেপেলিনের রিইউনিয়ন হওয়া সদস্যদের জন্যও ড্রামস বাজান ফিল কলিন্স।
১৩ জুলাই দুপুর ১২টায় ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়না উদ্বোধন করেন লাইভ এইড। এরপর স্ট্যাটাস কুও ব্যান্ডের পারফরম্যান্স দিয়ে শুরু হয় কনসার্ট। আর আমেরিকায় সকাল সাতটায় শুরু হয় কনসার্ট। জোয়ান বায়েজ তার সম্মোহনী কন্ঠের গান দিয়ে মাতিয়ে তুলেন জন এফ কেনেডি স্টেডিয়ামের ৯০ হাজার দর্শককে। দুই মহাদেশের দুই দেশে একই দিনে চলমান কনসার্টের সুরের মূর্ছনায় ভাসতে থাকে লক্ষ লক্ষ দর্শক। আর মূল উদ্দেশ্য, ত্রাণ উত্তোলনও হতে থাকে একনাগাড়ে।
লাইভ এইড হলো সর্ববৃহৎ টিভি ব্রডকাস্ট হওয়া কনসার্ট। লন্ডনের সময় থেকে ফিলাডেফলিয়ার সময় প্রায় পাঁচ ঘন্টা এগিয়ে থাকার কারণে ব্রডকাস্টিংয়ের দায়িত্ত্বে থাকা বিবিসিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল দুটো কনসার্ট একসাথে ব্রডকাস্ট করার জন্য। লাইভ এইডের সাথে মিল রেখে একই দিনে বিশ্বের অন্যান্য কিছু শহরেও চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজন হয়। জাপান,অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, কানাডা ও জার্মানি থেকে কয়েকটি পারফরম্যান্স লাইভ ব্রডকাস্ট করা হয়। এই লাইভ এইড কভার করার জন্য মহাকাশে ১৩টি স্যাটেলাইট কাজ করেছে। সারা পৃথিবীর ১১০টি দেশের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ লাইভ এইড সরাসরি উপভোগ করেছে। লাইভ এইড কনসার্টের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে যে সংগীতের কোনো ভাষা নেই। সংগীত সর্বজনীন।
ওয়েম্বলিতে ৭২ হাজার আর কেনেডি স্টেডিয়ামে ৯০ হাজার দর্শকের পুরো টিকেটের টাকা মিলে অনেক অর্থ উত্তোলিত হয়। ওয়েম্বলিতে টিকেটের দাম ছিল ২৫ পাউন্ড আর কেনেডি স্টেডিয়ামে ৩৫ ডলার। এছাড়াও টেলিথন (লাইভ অনুষ্ঠান চলাকালীন টিভি দর্শকরা নির্দিষ্ট নাম্বারে টেলিফোন করে ক্রেডিট কার্ড কিংবা চেকের মাধ্যমে অর্থ দান করার পদ্ধতি)-এর মাধ্যমে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার উত্তোলন হয়। ৪০টি দেশ থেকে টেলিথনের মাধ্যমে এ অর্থ সংগ্রহ হয়। প্রায় ৩০০ জন টেলিফোন অপারেটর সর্বক্ষণ কর্মরত ছিলেন পুরো কনসার্ট চলাকালীন সময়ে। নিচে ওয়েম্বলিতে কুইনের প্রথম গান এর ভিডিও-
লাইভ এইড কনসার্টের কয়েকজন শিল্পীর পারফরম্যান্স ইতিহাস রচনা করে। ওয়েম্বলিতে কুইন এবং ইউ টু ব্যান্ডের গান চলাকালীন সময়ে টেলিথনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ হয়। কুইনের পারফরম্যান্সকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ লাইভ কনসার্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয় ২০০৫ সালের এক জরিপে। কেনেডি স্টেডিয়াম এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ মাতিয়ে তুলেন। ঐতিহাসিক ব্যান্ড লেড জেপেলিনের পুনর্মিলন হয় লাইভ এইডে। কেনেডি স্টেডিয়ামে এরিক ক্ল্যাপটনের ‘লায়লা’ গানের ভিডিও-
বর্তমান বিশ্ব নানা সমস্যায় জর্জরিত। জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র, যুদ্ধ, বর্ণবাদ, ক্ষুধা, মহামারী এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ তো আছেই। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে একজন মানুষ বব গেল্ডফ প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে সংগীত দিয়ে মানুষের মাঝে ভালোবাসা ছড়িয়ে বড় ধরনের সমস্যার সমাধান আনা যায়। মানুষ একটু চাইলেই সম্মিলিতভাবে অনেক বড় কিছু করতে পারে। এমন মহৎ কাজের জন্য বব গেল্ডফ ও মিজ ইউর আজো সম্মানিত। ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ সম্মানিত পদক নাইট উপাধি লাভ করেন বব গেল্ডফ। এছাড়াও নোবেল কমিটি থেকে বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য ববকে ‘ম্যান অভ পিস’ এওয়ার্ড দেওয়া হয়।